মির্জা ফখরুল : জিয়ার বিরুদ্ধে মিথ্যাচার মানুষ বিশ্বাস করে না

আগের সংবাদ

বিলুপ্তির পথে সোনাগাজীর ঐতিহ্য ‘পানের বরজ’

পরের সংবাদ

শব্দগুলো জেগে আছে স্মৃতির বারান্দায়

প্রকাশিত: আগস্ট ২০, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: আগস্ট ২০, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

কবি ও শিল্পী খালিদ আহসানের একটি কবিতার পঙ্ক্তি এ রকম- কিছুদিন হয় কবিতাবিহীন, শব্দরা বুঝি ঘুমোতে গিয়েছে।
তার শব্দরা যখন ঘুমিয়ে থাকত, তখন তিনি জেগে জেগে রং-তুলির সঙ্গে খেলায় মেতে উঠতেন। শিল্পের দুই মাধ্যমেই সমান্তরালভাবে হেঁটেছেন স্বাচ্ছন্দ্যে। কাব্যচর্চার আড়ালে অন্য একটা শিল্পসত্ত্বাও তার ভেতরে গোপনে বেড়ে উঠছিল তা টের পেয়েছি পরিচয়ের বহু পর- গল্প সংকলন ‘গোপন গোলাপ’ যখন মনোরম সৌকর্য নিয়ে চট্টগ্রামে সৌরভ ছড়াচ্ছিল। সিসা কিংবা তামার ব্লকে ঢেঁকির মতো ছাপাখানার সেই যুগে একটি অপরিচিত সৌন্দর্যে প্রকাশিত সংকলনটির প্রচ্ছদ করেছিলেন তিনি। আমাদের তরুণ চোখে বিস্ময়ের শেষ নেই। এত সুন্দর হতে পারে সংকলন! পরে জানলাম ‘এ সংকলনের প্রচ্ছদ সাধারণ প্রেসে ছাপা নয়, অফসেটে ছাপা।’ ব্লকের যুগ থেকে খালিদ আহসান এইভাবে চট্টগ্রামের ছোটকাগজের জগৎকে অফসেটের যুগে নিয়ে এলেন। প্রযুক্তির সাহায্যে নিজের অসাধারণ রুচি ও নান্দনিক বোধকে কাজে লাগিয়ে চট্টগ্রামের প্রকাশনায় একটা ছোটখাটো বিপ্লব করে ফেললেন। সেই বিপ্লবের ঢেউ চট্টগ্রাম ছাড়িয়ে রাজধানীসহ দেশের অন্যান্য শহরেও ছড়িয়ে গেল। তখন চট্টগ্রামের প্রকাশনার অসাধারণত্বের প্রশংসা সবখানে। ‘গোপন গোলাপ’ প্রকাশের কদিন পর তার সম্পাদিত কবিতাপত্র ‘চোখ’ প্রকাশিত হলো। এটির প্রচ্ছদও তার। অন্ধকারের ভেতর কালো একটি চোখ। সবার একটিই মন্তব্য- অসাধারণ। সেই ‘চোখ’-এর প্রচ্ছদের জন্য মুক্তধারার সাহিত্য পুরস্কার পেল। আর এভাবে ছোটকাগজ আর বইপত্রের প্রচ্ছদে খালিদ আহসান প্রধান ভরসা হয়ে উঠলেন চট্টগ্রামের। তারপর ধীরে ধীরে সারাদেশের কবি-সাহিত্যিকদের।
বিশ্ববিদ্যালয়ে একসঙ্গে এম এ ক্লাসে পড়লেও তিনি স্কুলে আমার জ্যেষ্ঠ ছিলেন। খালিদ ভাই বলে সম্বোধন করতাম। ১৯৭৭ কি ’৭৮ সালে ‘সংকেত’ নামে একটি লিটল ম্যাগাজিন করেছিলাম। প্রচ্ছদ করেছিলেন তিনি। তাতে উঁচু একটা পাহাড়ের চূড়ায় এক নিঃসঙ্গ মানুষ। সেই প্রচ্ছদের দিকে আমি শুধু তাকিয়ে থাকতাম। তখন একুশে ফেব্রুয়ারি ঘনিয়ে এলে আমাদের ঘুম উধাও হতো। আনকোড়া সংকলন হাতে নিয়ে প্রভাতফেরিতে যোগ দিতে না পারলে জনমটাই যেন বৃথা মনে হতো। আমার নন্দনকাননের বাড়ি থেকে চট্টগ্রামের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার মাত্র তিন-চারশ গজ দূরে। খালিদ ভাই আমাদের পরামর্শ দিলেন, ‘শহীদ মিনারে হাতে হাতে বই বিক্রি করব না আর। তোমার বাসা থেকে টেবিল-চেয়ার এনে বসে যাব। টেবিলে সাজানো থাকবে আমাদের নতুন যত প্রকাশনা। মানুষ নিজেরা পছন্দ করে কিনে নিয়ে যাবে।’ যেই ভাবা সেই কাজ। আমার বাসা থেকে টেবিল-চেয়ার এনে তাতে সাজিয়ে দিলাম নতুন নতুন সব ম্যাগাজিন। তার পরের বছর টেবিলটা একটু বড় হলো, পাশে পর্দাও দিলাম। আরো কয়েকজন সতীর্থ বন্ধু নিজেদের প্রকাশনা নিয়ে টেবিল সাজালো। এইভাবে চট্টগ্রামে একুশের বইমেলার যাত্রা শুরু।
তো প্রচ্ছদ শিল্পী, কবি, গল্পকার, ছড়াকার খালিদ আহসান যৌথভাবে একটি দেহের অবয়বে হাঁটতে শুরু করলেন। এই পথচলা দুই হাজার একুশ সাল পর্যন্ত চলেছে। কখনো তাকে দেখতাম কবিতা পাঠের আসরে- নিজের কবিতা আবৃত্তি করছেন, কখনো দেখছি নাট্যকর্মী হিসেবে, কখনো প্রচ্ছদ শিল্পী হিসেবে, কখনো ফ্যাশনজগতের কোরিওগ্রাফার হিসেবে। প্রচ্ছদ শিল্পী হিসেবে ৭০, ৮০ ও ৯০ দশকে প্রচণ্ড দাপট ছিল তার। শুধু চট্টগ্রামের নয়, দেশের বিখ্যাত সব কবি-সাহিত্যিকের বইয়ের প্রচ্ছদ করতে শুরু করেছেন সে সময়। শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, শহীদ কাদরী, হুমায়ূন আহমেদ, নির্মলেন্দু গুণ, হুমায়ুন আজাদ, সিকদার আমিনুল হকসহ অনেকের নাম এই তালিকায় রয়েছে। এই তালিকা বড় দীর্ঘ। তার আঁকা প্রচ্ছদের মধ্যে কোনোটি কখনো নিন্দিত হতে শুনিনি। নিরঙ্কুশ প্রশংসা প্রাপ্তি ছাড়া অন্যথা ঘটেনি।
খালিদ আহসানের সঙ্গে আমার ভাই-বন্ধু মিলিয়ে এক অবিমিশ্র সম্পর্ক। আমার জীবনের ঘটে যাওয়া সকল গোপন-অগোপন ঘটনার কথা যেমন তার জানা, তেমনি তার জীবনের প্রায় প্রতিটি বাঁকে আমি খুব ঘনিষ্ঠভাবে ছিলাম। আমাদের নন্দনকাননের এই বাড়িটি তখন চারদিকে ইট-পাথরে বন্দি ছিল না। সামনের উঠোনে শিউলিগাছের তলায় তিনি ক্যামেরা দিয়ে আমার অনেক ছবি তুলেছেন। এমন অনেক দিনও গেছে বাইরে থেকে বাসায় এসে দেখি খালিদ ভাই আমার টেবিলে বসে আঁকাবুঁকি করছেন। তার দেওয়ান হাট, দেওয়ান বাজার এবং বর্তমান চান্দগাঁওয়ের বাসায় আমি বিনা নোটিসে কতবার যে গিয়ে হানা দিয়েছি এবং ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিয়েছি! সত্যিকার অর্থে আমরা যারা লেখালেখি শুরু করেছি একসঙ্গে, তাদের কারো যেন একার কোনো জীবন ছিল না। আমরা সবাই মিলে যেন একটা যৌথ জীবন যাপন করেছি তারুণ্যে এবং যৌবনে। যেই যৌথ জীবন থেকে খালিদ আহসান মাঝে মাঝে কেমন যেন কোথায় হারিয়ে যেতেন। তার এ রকম মানসিক অবস্থানের বিবরণ তিনি দিয়ে গেছেন নিজেরই কবিতায়।
পৃথিবীর মানুষের নাগালের অনেক বাইরে আমি।
কবে রক্তমাংসের মানুষ আমি-
……….
অন্ধকার অ্যালকোহল আর ধোঁয়াশা কুহকের স্তর সরিয়ে সরিয়ে উঁচুতে এসে দেখি ভীষণ একা এক মেঘলোকের সঙ্গী আমি।
নতুন একটি কবিতা হবে? এনেসথেসিয়া।

সত্যি, মাঝে মাঝে খালিদ ভাই মেঘলোকের কিংবা অন্যলোকের সঙ্গী হয়ে যেতেন। চারপাশের বাস্তবতাকে ছাড়িয়ে কোথাও চলে যেতেন। কেমন অচেনা একটা মানুষ তখন। কিসের ঘোরে অন্যমনে কথা বলতেন, তখন দুহাত অসম্ভব সচল হয়ে যায় তার। এক নাগাড়ে কবিতা লিখতেন আর ছবি আঁকতেন। খালিদ ভাই বিড়বিড় করে বলতেন, আমি লিখি না, আমাকে দিয়ে ওরা লিখিয়ে নেয়, আঁকিয়ে নেয়। ওরা কারা? ওরা মানে অন্যলোকের কেউ। যারা রক্তের শিরায় শিরায়, তার সমস্ত সত্তায় অবতরণ করেছে। তখন তিনি কি এক ঘোরের ভেতর লেখায়-আঁকায় সক্রিয় থাকতেন। পৃথিবীর মাটি থেকে দূরের মেঘের দেশ থেকে তিনি উচ্চারণ করে যাচ্ছেন অলৌকিক শব্দাবলি।
মনে করো অন্ধকার, বাদামী রঙ আমি তোমাকেই চেয়েছিলাম
মনে করো যমজ তিলক, আমার স্বপ্ন চুম্বন চর্চিত ছিলো এখানেই,
আহ্লাদ বা ঐশ্বর্য কিছুই চাইনি তোমার প্রহ্লাদ ছাড়া,
এখন ভেসে যাচ্ছি মেঘে, টুকরো টুকারো হাত পা আমার
জোড়া লাগাতে লাগাতে বারো মাস।
হাওয়া ঘুড়ি, অসুখে মোড়ানো প্রথম শ্রোতা, এনেসথেসিয়া।
তার একটি কবিতার বইয়ের নাম এনেসথেসিয়া। জগতের যা কিছু বিষাদ, দুঃখ, গøানি, অপরাজনীতি, দারিদ্র্য সবকিছু থেকে নিজেকে সরিয়ে এনে অথবা সবকিছু ভুলে যেতেই শৈল্পিক এনেসথেসিয়া তিনি ধারণ করেছিলেন। আজীবন শিল্পের নেশায় বুঁদ ছিলেন প্রকৃত এই শিল্পী। তার রুচিবোধ, শিল্পবোধ এগুলো নিতান্ত সহজাত, যেন বা প্রাকৃতিক। মন জুড়িয়ে দেয়া হাওয়ার মতো, চিরদিন বয়ে চলা নদীর মতো। সর্বশেষ কবিতার বই ঝিঁঝির কনসার্টে একান্ত খালিদ ভাইকে পাওয়া যায়।
ফুসফুসের অন্ধকারে কাঁপে নিকোটিনের সংক্রমণ
বিষ খাবি না বিষ খাবি না বলে মা চেঁচাতো
ছেলে কথা শোনেনি
ধনুকের ছিলার মতো টানটান শাসানি ডিঙিয়ে
সে গেছে পাহাড়ের দিকে
সেখানে বসে থাকতো এক বংশীবাদক
অস্পষ্ট দুরন্তু রেখায়।
অন্ধ ফুসফুস, ঝিঁঝির কনসার্ট
দূরের রেখায় বংশীবাদকের খোঁজে যে মানুষটি মায়ের শাসন ভাষণ না মেনে পাহাড়ের দিকে চলে গেছে সেই মানুষটি সমতলের সমকাল স্পর্শ করেনি তা নয়, বরং সময়ের ব্যাপারে বেশি স্পর্শকাতর ছিলেন বলেই অভিমান কিংবা চাপা রাগ ছিল। তবে সেটি কখনো চিৎকারের মতো, সেøাগানের মতো আসতো না খালিদ আহসানের কবিতায়। তার উচ্চারণ নম্র, পরিশীলিত, শিল্পের সুষমামণ্ডিত। কবিতার চিররহস্যময়তাকে তিনি কখনো ছিন্ন করেনি। বরং কবিতার ভেতর এক মায়াজাল বিস্তার করে রাখতেন। সবচেয়ে বড় কথা তিনি নিজেও সেই মায়ার মধ্যে ডুবে থাকতেন। আর ডুবন্ত অবস্থায় নিজের পৃথিবীটাকে অন্যরকম একটা চোখ দিয়ে দেখতেন। যা থেকে বেরিয়ে আসত অন্যরকম এক বাস্তবতা।

ঘরের মেঝেতে একটা গর্ত আছে। সেখান থেকে
বেরিয়ে সাপ ফণা তোলে, নাচ দেখায়, কবিতা লেখায়।
যেতে হবে বড় দিঘির পাশ দিয়ে
পাড়ে হালকা জঙ্গল, জারুল গাছের সারি
তার উপরে অশ্বথামা ডেকে চলেছে সারাক্ষণ।
কুমড়োর ফুলে ফড়িং বসেছে, দেখা যাচ্ছে বাড়ি
দিঘির পাড়ে লেজ গুটিয়ে শুয়ে রয়েছে
বিলুপ্ত ডাইনোসর।
সুপার মুন, ঝিঁঝির কনসার্ট

দৃশ্যের সুনিপুণ বিবরণ, আলোছায়ার ভাষার মতো ফুটে উঠেছে। যেন একটা জলছবি চোখের সামনে। অবশ্যই কাল্পনিক, তবুও বাস্তব। এখানেই খালিদ আহসানের বিশেষত্ব। তার কবিতায় ছবির প্রভাব, আর ছবিতে কবিতার প্রভাব। আসলে ছবি আর শব্দ দুটোর মিথস্ক্রিয়ার ভেতর দিয়ে নতুন একটা শিল্প বেরিয়ে আসতো তার ভেতর থেকে। দৃশ্যের সুনিপুণ বর্ণনার আরেকটি উদাহরণ তুলে ধরছি পাঠকের সামনে।
পা বাড়ালেই ছিলো পথ
পথ পেরুলেই বিজন এক বনভূমি
তারপর সারিবদ্ধ সবুজ, সারিবদ্ধ পাহাড়-
আদিবাসিনীর খুপরি বসতি ডাকলো আমাকে
ডাকল নুড়িপাথর, ঝর্ণার স্বচ্ছ জল,
ডাকল তোমাকেও
বৃষ্টি এসে স্বপ্নের মতো চুমু খায় পাহাড়ের চূড়া।
ভ্রমণ, তোমাকে পানকৌড়িকে

ছোট ছোট অনুসঙ্গ টেনে এনে কবিতার ভেতরে কী অনায়াসে নিয়ে আসতেন তিনি আর তা দিয়েই ঘোর তৈরি করতে পারতেন। সাধারণ আটপৌরে শব্দ ব্যবহার করে কীভাবে লুকিয়ে থাকা কোনো এক অজানা জীবনের গল্পের ইশারা পাওয়া যায় তার কবিতায়।
অন্ধকারের আলখেল্লা পরা
খোলামেলা নির্জন বারান্দা
আমি তোমাকে দিলাম
গোপন ক্রন্দনের জন্য এইতো যথার্থ স্থান-

গোপন ক্রন্দনের যথার্থ স্থান যখন কবি চিহ্নিত করেন তখন পাঠকের গায়ে জীবনের অদৃশ্য বেদনার ভারবাহী বাতাসের স্পর্শ লাগে। কবির দুঃখ তখন সংক্রমিত হয় অন্য হৃদয়ে। খালিদ আহসান চাপা স্বভাবের মানুষ ছিলেন। বাইরে তো কখনো নয়, নিজের সুখ, দুঃখ, কষ্ট, আনন্দ, উল্লাস কদাচিৎ
প্রকাশ করতেন বন্ধু মহলে। কিন্তু কবিতায় অকৃত্রিম আন্তরিকভাবে নিজেকে উজাড় করে দিতেন। আদিষ্ট, অনুরুদ্ধ কিংবা ফরমায়েশি লেখা খালিদ আহসান কখনো লিখতেন না। তার উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ হৃদয় নিংড়ানো, রক্তঝরানো। লেখার ঘোরের সময় তিনি মাটির স্তর থেকে শূন্যতার একটা অলৌকিক ধাপে নিজেকে নিয়ে যেতেন। আমি জানি না সেটা কোথায়, হয়তো বহু আলোকবর্ষ দূরে। সেখান থেকেই তিনি লিখতেন-
কাল চন্দ্রগ্রহণ ছিল
চাঁদ খুব ভালোবেসেছিল পৃথিবীকে।
জেগেছিল সুখী-জাগরণে নিবিড় বেদনায়,
যেন কোন মহাশূন্যের ওপাড় থেকে পৃথিবী আর তার গ্রহকে প্রত্যক্ষ করছেন তিনি। যেন তিনি অন্যকোনো অবস্থান থেকে দেখছেন। তবে মাঝে মাঝে ফিরেও আসেন মৃত্তিকার খুব কাছাকাছি।
এই নারকেল বীথির ডগা ছুঁয়ে আমি
কতোবার উড়ে এসেছি তোমার অসুখের পাশে
জানালায় কাশফুলের ডগা দুলছে-স্কেচ খাতা থেকে
তা উঠে এসেছে বুটিক শিল্পের কায়দায় নীল জঙ্গলে।
প্রত্যাবর্তন, তোমাকে পানকৌড়িকে

২০০৮ সালে প্রকাশিত কবিতার বই তোমাকে, পানকৌড়িকে উৎসর্গ করেছিলেন অভিক ওসমান, আসাদ মান্নান, সনজীব বড়ুয়া, বিশ্বজিৎ চৌধুরী এবং আমাকে। এই বইয়ের কয়েকটি কবিতা বার বার পড়ি। না, আমাদের উৎসর্গ করেছেন বলে নয়। এখানে প্রেমিক খালিদ আহসানকে খুঁজে পাওয়া যায় বেশি। সেই প্রেমিক কোনো লুনাটিক বা চাঁদে পাওয়া মানুষ নন। বরং ধুলামাখা, ঘামে ভেজা কোনো তুখোড় তরুণ।

তুমি এতো তীব্র এতো তীক্ষè
এতো দাবদাহ, এত বেশি সম্মোহন তোমার
তুমি এতো বেশি অঙ্গীকার, আবদ্ধ শৃঙ্খলিত
আমার পরাগরেণু তাই বাতাসেই ওড়ে।

আমাদের ব্যক্তিগত বন্ধুতার কত কথা, কত ছবি, কত পর্যটন, দিনের পর দিন আড্ডার কথা মনে পড়ছে আজ। কিন্তু সেইসব ব্যক্তিগত দিনলিপির বিবরণ এখানে দেব না। এখানে কবি বা শিল্পী খালিদ আহসানের কথাই বেশি বলতে চাইছি। এই সময়ের পাঠকের কাছে সেটাই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়। অবশ্য কবিতা নিয়ে বেশি আলোচনার অবকাশ আছে বলেও আমার মনে হয় না। কবিতার আলোচনায় না গিয়ে সরাসরি কবিতায় ডুব দেয়া ভালো। আমি তাই এই লেখায় খালিদ আহসানের কবিতাকে বেশি বেশি উদ্ধৃত করছি। যাতে পাঠক তার প্রবণতাকে ধরতে পারেন। কবিতা নিয়ে বেশি আলোচনা তিনিও করতেন না। তিনি বলতেন অত আলোচনার চেয়ে কবিতা পাঠ বা কবিতা শোনা অনেক ভালো। আমি তার বাসায় গিয়ে প্রায় সময় তার কাছ থেকে কবিতা শুনতাম। তিনি সদ্য লেখা কবিতাগুলো একের পর এক শুনিয়ে যেতেন। তিনি আবৃত্তি করতেন অসাধারণ। স্পষ্টভাবে প্রতিটি শব্দ নিখুঁতভাবে উচ্চারণ করতেন। চট্টগ্রামে জন্ম ও বেড়ে উঠলেও আঞ্চলিকতার প্রভাব তার উচ্চারণে কখনো ছিল না। স্বরচিত কবিতা পাঠের আসরে একটি কবিতা প্রায় পড়তেন-

আ আলজিভ স্পর্শ করে, নগ্ন কর, চুম্বন কর তাকে
শব্দের সুষমায় ভরা প্রিয় কবিতাকে
আ আলজিভ স্পর্শ করে, নগ্ন কর, চুম্বন কর তাকে
প্রেমান্ধ যাতনায় ক্লান্ত বধির বেদনাকে।
স্পর্শ কর, ঝিঁঝির কনসার্ট

খালিদ ভাই বেশ কয়েকটা গানও লিখেছেন। সেসব গানে ছিল কবিতার মেজাজ। বাংলাদেশের বিখ্যাত ব্যান্ড সোলস, রেনেসাঁ, তার লেখা গান গেছে। এগুলো বেশ জনপ্রিয়ও হয়েছে।
প্রতিভার দীপ্তি আসলে নানা ক্ষেত্রে ছড়িয়েছিল। লেখালেখির শুরু করেছিলেন শিশু সাহিত্য দিয়ে। বেশিদিন শিশুসাহিত্য চর্চায় না থাকেননি। সেসবের কোনো বইও নেই। তারপরও ৩০/৩৫ বছর আগে ছোটদের জন্য তার লেখা ছড়া এখনো আমার মনে আছে। সত্যিকার অর্থ ছোটদের জন্য এমন সুন্দর ছড়া খুব কমই চোখে পড়ে।

সোমা মনি হায়/গড়াগড়ি খায় মাটিতে
কেন কি কারণ/মায়ের বারণ হাঁটিতে।/সোমা যদি হতো/বড়দের মতো/এত কী বারণ থাকত/ইচ্ছাটি যত
হেঁটে চলে যেত/কেউ কি ধরে রাখত?

তিনি ছবি আঁকতেন স্বপ্নের ক্যানভাসে। খালিদ ভাইয়ের প্রচ্ছদ কিংবা কবিতা সেই সত্তর-আশি দশক থেকে দেখে আসছি, পড়ে আসছে পাঠক। কিন্তু তার ছবিগুলোর কোনো প্রদর্শনী হয়নি। ঘোরের মধ্যে ওগুলো তৈরি করতেন, আর নিজের স্টুডিওতে ভাঁজে ভাঁজে জমা রাখতেন। মাঝে মাঝে কারো অনুরোধে দু-একটি কাউকে দিয়ে দিতেন, অথবা ইচ্ছে হলে দু-একটাকে ফ্রেমবন্দি করে নিজের স্টুডিওর দেয়ালে টাঙিয়ে রাখতেন। খালিদ আহসানের তৈরি ছবিগুলোতে সময়ের প্রত্যক্ষ বর্ণনা হয়তো নেই কিন্তু ফ্রেমবন্দি কিছু অবয়ব এমনভাবে সাজানো থাকে যা দেখতে দেখতে আপনিও অন্য এক আবেশে চলে যাবেন। নানা আকৃতির, নানা ঢঙ ও রঙের ফিগারের সমন্বয়ে এমন কিছু প্রতীক তৈরি করেছেন যা সংকটাপন্ন সময়ের অসাড়তাকেই মূর্ত করে তোলে। ছবি আঁকতে প্রচলিত মাধ্যমগুলো বাদ দিয়ে প্রযুক্তির আশ্রয় নিয়েছেন।
কম্পিউটারে আঁকা তার ছবিগুলো অভিনবত্বে আলাদা। নিজের অসাধারণ কল্পনা যা শব্দমাধ্যমে অপ্রকাশ্য থেকে যায়, তা-ই ছবিতে প্রকাশ করেছেন কবি খালিদ আহসান। তাতে বেশিরভাগ কল্পনাই প্রতিফলিত হয়। যাই হোক না কেন, ছবিগুলোর সামনে দাঁড়ালে তার নান্দনিক বোধের পরিচয় দর্শকের সামনে উদঘাটিত হয়।
খালিদ আহসান কবিতা লিখতেন, প্রচ্ছদ করতেন, ছবি আঁকতেন, আড্ডা দিতেন, ঘুরে বেড়াতেন- আমি তার কোন কাজের ভক্ত? আসলে আমি তার প্রচ্ছদের ভক্ত, কবিতার পাঠক, তার ছবিগুলোর সামনে কিছু বুঝি বা না বুঝি নিমগ্ন দাঁড়িয়ে থাকি। তবে আমি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি ওই আশ্চর্য শিশুর মতো মানুষটিকে। যিনি আনন্দে লাফিয়ে উঠতেন, হাসতেন চিৎকার করে, সুযোগ পেলে বেড়াতে যেতেন। আর মাঝে মাঝে কোথায় কোন অজানার দেশে হারিয়ে যান। এই পৃথিবীর গøানি-ক্লেদ খালিদ ভাইকে স্পর্শ করতে পারেনি। তিনি ছিলেন অন্তরীক্ষের। যেন একটা ফানুস। মাটি থেকে উড়ে গিয়ে তারার মতো জ্বলতেন। নিজের সেই কথা তিনি লিখে গেছেন শেষ কবিতায়।

তিলে তিলে অসুখটা
আমিই নির্মাণ করেছি
নিকোটিনের বিষে আমি যখন
নীল কৃষ্ণ
রাধিকা নয়, সেবিকা রয়েছে চারপাশে
ঘুম আসে না
ঘুম আমাকে ছেড়ে পালিয়েছি যৌবনে
তারপরও গতি শ্লথ হয়নি
ভালোবাসার তাপে আমি তাপিত হয়েছি
এখন মনে হচ্ছে জ্বালানি ফুরিয়ে এসেছে ফানুসের
এবার মাটিতে নামার সময়
এখন আমি ঘুম খুঁজে পাবো
আত্মপরিচয় খুঁজে পাবো
খুব করো বিশ্রাম নেব দুপশলা।

শিল্পের কর্মমুখর জীবন শেষে এখন চিরবিশ্রাম নিচ্ছে সেই ফানুস। কিন্তু তার আলো বহু বহুদিন আলোকিত করে রাখবে আমাদের। তিনি বলেছিলেন, শব্দরা বুঝি ঘুমোতে গিয়েছে। না তার শব্দরা ঘুমায়নি। সেগুলো জেগে আছে আমাদের স্মৃতির বারান্দায়।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়