মির্জা ফখরুল : জিয়ার বিরুদ্ধে মিথ্যাচার মানুষ বিশ্বাস করে না

আগের সংবাদ

বিলুপ্তির পথে সোনাগাজীর ঐতিহ্য ‘পানের বরজ’

পরের সংবাদ

মৃত্যু অনিবার্য এক শিল্প

প্রকাশিত: আগস্ট ২০, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: আগস্ট ২০, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

আগুন চোখে বসে থাকা ছেলেটির দিকে তাকানো যাচ্ছিল না। তার দুই আঙুলের ফাঁকে সময় ঝলসানো সিগারেটের ধোঁয়া। এত উচ্ছল, চনমনে তরুণ আগে কখনো দেখিনি। দেখার কথাও নয়। এর মধ্যে শিল্প-সাহিত্যের কানাগলিতে উঁকিঝুঁকি দিয়ে অনেকে থিতু হয়েছে। বাইরে দাঁড়িয়ে যারা তখনো উঁকি দিচ্ছে তাদের মধ্যে আমি সবার পেছনে। এর অন্তর্গত একটি কারণও বিদ্যমান ছিল, তাদের মা-বাবারা শহুরে মানুষ, তারা আগে থেকেই একটি সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের আলো পেয়েছে। আমি থাকি মফস্বলে। মাঝেমধ্যে আলো ঝলমলে শহরে আসতাম চোখে রং মাখতে।
শুরুতে যে তরুণের কথা বলেছি সে সবসময়ই তার অবয়বে সৃষ্টির বা মহাজাগতিক নানা জটিলতা ও রহস্য ঝুলিয়ে রাখে। তার চিন্তাশীল চোখে কিছু একটা খুঁজে পাওয়ার আকুতি বা নতুন সৃজনের উন্মাদনা একপশলা বৃষ্টি ছোঁয়ায় পুকুরের মাছ যেন উজানে যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে আছে। তার সঙ্গে একই সময়ে কলার থোড়ের মতো যারা বেড়ে উঠেছে তাদের মধ্যে অজয় দাশগুপ্ত, আসাদ মান্নান, মিনার মনসুর, সঞ্জিব বড়ুয়া, বিশ্বজিৎ চৌধুরী, জ্যোতির্ময় নন্দী, সম্পদ বড়ুয়া, শ্যামল দত্ত, দিলওয়ার চৌধুরী, শাহিদ আনোয়ার, আবু মুসা চৌধুরী, সাফায়াৎ খান, উত্তম সেন, সেলিনা শেলী এবং এ তালিকায় আমিসহ আরো অনেকের নাম আসতে পারে।
সে সময় চট্টগ্রামে আরো বেশকিছু সাহিত্য আড্ডা হতো, সেগুলো থেকেও বেরিয়ে এসেছেন অনেক গুণী কবি-সাহিত্যিক ও নাট্যকর্মী। এ বিষয়ে পরে কোনো দিন কলম ধরব।
তারা নন্দনকানন বোসব্রাদার্স, ফুলকী, আলীর চায়ের দোকান, ডিসি হিলের খোলা প্রান্তর… সব জায়গা মুখর করে রাখত ছড়া-কবিতা ও সাহিত্য আড্ডায়। যার কথা দিয়ে শুরু করেছি সে হচ্ছে খালিদ আহসান। তার অবস্থান এখন আমাদের সবার স্পর্শের বাইরে।
মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে তরুণদের মধ্যে লিটলম্যাগ প্রকাশের হিড়িক পড়ে যায়। সে সময় তরুণদের স্বপ্নের সহযাত্রী হয় খালিদ আহসান। লিটল ম্যাগাজিন ও বই-পুস্তক প্রকাশের ক্ষেত্রে সেগুলোর প্রচ্ছদ ও অঙ্গসৌষ্ঠব নির্মাণে সে নতুন এক ধারণা নিয়ে আসে এবং ওই পথে হাঁটতে থাকে। তখন চট্টগ্রামে আজকের মতো শত শত কম্পিউটার ও এতগুলো অপসেট প্রেস ছিল না। কাজ করতে হতো লেটার প্রেসে, হ্যান্ড কম্পোজে।
যাহোক কিছুকাল পরে আমরাও তোলপাড় নামে একটি লিটলম্যাগ প্রকাশে উদ্যোগী হই। এ ম্যাগাজিনের শুরুর কয়েকটি সংখ্যা ব্যতীত অন্য সবগুলোর প্রচ্ছদ করেছে খালিদ আহসান স্বপ্রণোদিত হয়ে। এভাবে যেচে বিনাপারিশ্রমিকে ডিজাইন করে দেয়ার মানুষ বর্তমানে বিরল। শুধু আমাদের এ ম্যাগাজিনের নয়, চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত যে কোনো ম্যাগাজিন ও বইয়ের প্রচ্ছদ, বিনিময়ের হাতছানির দিকে পা না বাড়িয়ে সে করে দিয়েছে। তাছাড়া সে সময় নাটকের সেট ডিজাইনেও প্রয়োগ করেছে আধুনিক ধ্যান-ধারণা।
বাংলা সাহিত্যের এ কৃতী ছাত্র ম্যাগাজিন ও বিভিন্ন গ্রন্থের প্রচ্ছদ আঁকতে আঁকতে পরিপক্ব শিল্পী হয়ে ওঠে। তার আঁকাআঁকির মধ্যে লুকিয়ে উঁকি দেয় মহাজাগতিক রহস্য ও সৌরজগতের কাল্পনিক প্রাণীদের অদ্ভুত সব অবয়ব; আমাদের কাছে যা ছিল বিস্ময়কর। স্বাধীন বাংলাদেশে বইয়ের প্রচ্ছদকে শিল্পের পর্যায়ে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে তার প্রচেষ্টা ছিল অগ্রণী। সে সময় বাংলাদেশের বহু খ্যাতিমান লেখক তাকে দিয়ে বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকানোর জন্য মুখিয়ে থাকতেন।
খালিদ আহসানের চলন-বলন ছিল অন্যদের চেয়ে আলাদা। এ পার্থক্যটুকু তার কাব্যচর্চায়ও সুস্পষ্ট লক্ষ করা যায়। তার কবিতা থেকে কিছু উদ্ধৃতি নিলে বুঝতে সুবিধা হবে।
সত্তর দশকের শেষ দিক থেকে ছড়া-কবিতা লিখলেও খালিদের প্রথম কব্যগ্রন্থ ‘শীতের কফিন’ থেকে উৎসারিত মানি প্ল্যান্ট প্রকাশিত হয় ২০০১ সালে। এ গ্রন্থের মূল প্রবেশদ্বারে কালো পৃষ্ঠায় সাদা অক্ষরে অলঙ্করণসহ মুদ্রিত আরম্ভ কথায় সে লিখেছে- ‘আজ পাতা ঝরে যেতে দেখলাম।/হাজার বছর পর আমি দেখলাম/উদ্ভিদের ডালে হিমালয় ঘুরে আসা/বসন্তকালীন পাখি।/হাজার বছর বা তারও অধিক সময়,/আমি এ সবের আড়ালে মুখ রেখেছিলাম।/আমার চোখ হয়ে উঠেছিল অন্ধ।/পা-দুটো স্থবির। কেবল হাত দুটো কাটতো কাগজের পাখি।/আমার সূর্যোদয় দেখার জানালাটি/খুলে যাচ্ছে।/ঘুমিয়ে পড়ার আকাশ/আবার আমি দেখতে পাচ্ছি।/আমার মৃত ইচ্ছেগুলো নক্ষত্রের/মতো দৃষ্টিগোচর হয়ে উঠছে/পৃথিবী অন্ধকার হলেই।/মেঘ ডাকলে তোমাকে আমি ডাকবো/দুশে মাইল দূর থেকে, ভিন্ন কোন গ্রহে।’
এ কবিতা পাঠ শেষে স্তব্ধ হয়ে যাই, সে কি বুঝে গিয়েছিল মানসপ্রিয়াকে অনন্ত অন্ধকার থেকে ডাক দিতে হবে অকালে! একই ধরনের আবেশ মনকে দোলায় বির্ণিত গ্রন্থের ‘এই কাল চন্দ্রগ্রহণের’ শিরোনামের কবিতায়, সে যখন বলে- ‘কাল চন্দ্রগ্রহণ ছিলো/চাঁদ খুব ভালোবেসেছিল পৃথিবীকে,/ভালোবাসা মানে তীক্ষè সম্মোহন, ছিন্ন-ভিন্ন মায়া/ভালোবাসা মানে দূর থেকে কাছে, ভালোবেসে দূরে যাওয়া।’
একইভাবে তার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘মন্দলোক ও কাঠের ঘোড়া’র কবিতাগুলোও বেশ আগ্রহ-উদ্দীপক। এখানে কবি অন্তর্বাস্তবের ঘন-গভীর ও ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র শেওলাগুলোকে আপনার করে নিতে চায়। প্রয়াসী হয় প্রতিটি ভ্রমণের চৈতন্যকে নিজের করে আঁকতে। এ গ্রন্থেও ‘ফুটপাত’ কবিতায় সে ‘নিদ্রা, স্বপ্ন, সম্মোহন ও মৃত্যু’কে ‘চার ভাই’ বলে সমান্তরালে চিহ্নিত করতে উদ্গ্রীব। পা তুলে পা ফেলে যখন ‘তোমাকে পানকৌড়িকে’ কাব্যগ্রন্থের দরজা খুলে এগোই আমরা দেখতে পাই প্রেম-প্রকৃতি ও নিরুদ্দেশ্য সময়ের গূঢ় ও গভীর বয়ান। এখানে ‘টিস্যু পেপার’ কবিতার দিকে একবার তাকানো যাক- ‘টিস্যু আছে? টিস্যু/আমার পাশে অন্ধকারে বসে আছে এক শিশু/প্রাপ্তবয়স্ক দাড়িগোঁফ/এখনো ভনিতা বোঝে না/জীবনের মানে খোঁজে সারাক্ষণ/শুধু নিজেকেই খোঁজে না/আকাশ ওড়ালে মেঘ/ছিঁড়ে নিতে চায় ভাবাবেগ/উড়ে যাচ্ছে ছাদের ওপার/টুকরো টুকরো টিস্যু পেপার।’ সময় দ্রুত উড়িয়ে নিচ্ছে আয়ু; তাই কবি পৃথিবীর শিরা-উপশিরা কাব্যগ্রন্থে ‘ফিরে এল গল্প হবে’ বলে তার অন্তর্গত অনুভবকে আশ্বস্ত করে। এভাবে ‘আমি পুষ্পের আদলে আবার/পৃথিবীর মানচিত্রে/আবার পৃথিবীর কোন সহজ সমীকরণের/সূত্রে ফিরে আসবো প্রত্যাবর্তনের গল্প শোনাবো বলে।’ এ গল্প শোনানোর ঘোর কাটতে না কাটতেই হাতে আসে ‘বর্ণ চক্ষু অন্তঃকরণ’ ও ‘কলম লিখেছে কবিতা আমি তার প্রথম শ্রোতা’। এ দুটো কাব্যগ্রন্থে সে মায়াভারাক্রান্ত জাগতিক টুকিটাকি, প্রেম-অপ্রেম ও প্রকৃতি নানা ভঙ্গিতে মেলে ধরেছে পাঠকের চোখের পাতায়। সেখানেও বিশ্রামের আকুতি ও আহ্বান ছিল প্রবল। সর্বশেষ বিশ্রামের জন্য কবি কি বড়শিতে আটকানো মাছের মতো তড়পাচ্ছিল! অন্য একটি কাব্যগ্রন্থ ‘ঝিঁঝিঁর কনসার্ট’-এও জীবন-মৃত্যুর ছায়া যে স্পষ্ট তা ‘নীলপদ্ম’ কবিতায় প্রস্ফুটিত হয়েছে, সে যখন লেখে ‘মৃত্যু এক অনিবার্য বিমূর্ত শিল্প/তার আগে নিজেকে আবিষ্কার ও/ক্রমাগত পুরুদ্ধারের পালা’।
এভাবে মৃত্যু নিয়ে কল্পনার জালবুনে ‘করোনাকালের কবিতা’ শিরোনামে সে লিখেছে ‘তিলে তিলে অসুখটা/আমিই নির্মাণ করেছি/নিকোটিনের বিষে আমি যখন/নীল কৃষ্ণ/রাধিকা নয়, সেবিকা রয়েছে চারপাশে/ঘুম আসে না/ঘুম আমাকে ছেড়ে পালিয়েছে যৌবনে/তারপরও গতি শ্লথ হয়নি/ভালোবাসার তাপে আমি তাপিত হয়েছি/এখন মনে হচ্ছে জ্বালানি ফুরিয়ে এসেছে ফানুসের/এবার মাটিতে নামার সময়/এখন আমি ঘুম খুঁজে পাবো/খুব করে বিশ্রাম নেবো দু’পশলা।’ এমনি করে ভাবনার জালে আটকা পড়ে এক সময় ফুরিয়ে যাওয়া গ্যাস-বেলুনের মতো সে নাই হয়ে গেল।
উদ্ধৃত কবিতাটি ছাপা হয়েছে সম্প্রতি প্রকাশিত কবি মনজু রহমান সম্পাদিত কবিতা বিষয়ক ছোট কাগজ অ্যালবামের ৪৫ বর্ষ, ৪৪-৪৫ সংখ্যায়। এখানেও তার নেই হয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত। এই হচ্ছে খালিদ আহসান। তার কবিতা পাঠে মনে হয় সে পাঠকের সাথে কথা বলছে বা পাশে বসেই পড়ে যাচ্ছে এক একটি কালজয়ী কবিতা। ফলে তার আঁকা ও লেখায় সবসময় তাকে পাই, নিবিড়ভাবে পাই। তাই বলতে হয় বিশুদ্ধতার মৃত্যু নেই। মৃত্যুকে সে অনিবার্য শিল্প করে তুলতে পেরেছে অনায়াসে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়