মির্জা ফখরুল : জিয়ার বিরুদ্ধে মিথ্যাচার মানুষ বিশ্বাস করে না

আগের সংবাদ

বিলুপ্তির পথে সোনাগাজীর ঐতিহ্য ‘পানের বরজ’

পরের সংবাদ

প্রাণের পরে চলে গেল সে

প্রকাশিত: আগস্ট ২০, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: আগস্ট ২০, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

আমার বন্ধু খালিদ আহসান। বলা উচিত আমার মেধাবী শিল্পী বন্ধু। কখন কীভাবে পরিচয় আজ আর মনে নেই। পরিচয় কি আগের জন্মেই নির্ধারিত ছিল? হবে হয়তো। শৈশবের শেষ প্রান্তে কৈশোর শেষ হওয়ার সময়কালে তার সঙ্গে পরিচয়। মনে মনে ইচ্ছে থাকলেও আমরা অনেকেই তখন লম্বা চুল রাখতে পারিনি। একদিকে পরিবারের ভয়, অন্যদিকে পাছে লোকে কিছু বলে। খালিদ এসবের বাইরে। তার তখনই দীর্ঘ চুল। স্বপ্নময় চোখ আর খোঁচা খোঁচা দাড়ি। দেখলে মুগ্ধ হওয়ার বিকল্প ছিল না।
আমরা তখন ছড়ার রাজ্যে বিপুল সম্ভাবনার সঙ্গে একে একে নিজেদের জায়গা করার জন্য ব্যস্ত। আমার মতো যত্রতত্র এবং প্রচুর ছড়া ছাপার ব্যাপারে তার আগ্রহ না থাকলেও সে নিয়মমতো লিখত। দৈনিক বাংলা পত্রিকার সাত ভাই চম্পা নামের ছোটদের আসরে চমৎকার সব ছড়া আর কিশোর পদ্য লিখে ঈর্ষণীয় হয়ে ওঠা খালিদ সময়ের চেয়ে একটু এগিয়ে ছিল সবসময়। কেন জানি ওই সময়টায় আমার সঙ্গে বিপুল ঘনিষ্ঠতা হয় তার। আসত সন্ধ্যার একটু পর। কলেজের লেখাপড়ার সঙ্গে ঘরের নজরদারি। তারপর ও ওর ডাক এড়িয়ে চলা ছিল অসম্ভব। জানালা দিয়ে ওর মুখটা দেখা যাওয়ার দেরি। ছলে বলে কৌশলে এক ঘণ্টার জন্য উধাও হয়ে যেতাম।
নন্দনকাননের মোড়ে একখানা ছোট সাধুর মিষ্টির দোকান। সেখানে বসেই ও লিখে ফেলত মজার কাব্যিক পদ্য, ছড়া বা গানের কথা। যতদূর মনে পড়ে সোলসের বিখ্যাত গান : এই মুখরিত জীবনের পথের বাঁকে রচিত হয়েছিল এভাবেই তাও সম্ভবত কোনো সিগারেটের প্যাকেটে। একটা ছড়ার জন্ম মনে আছে :
ওখানে কে? রাজপুত্তর? নয়তো লাট?
ওখানে কে শ্রেণিশত্রæর মুণ্ডু কাট…
আচ্ছা খালিদ কি সমাজতন্ত্র বা এ জাতীয় কোনো কিছুতে বিশ্বাস করত? তেমনটা হওয়ার ব্যক্তিগত কোনো কারণ ছিল না। সাধারণত মধ্যবিত্ত বা নি¤œবিত্তের মেধাবী সন্তানরাই ঝুঁকত বাম রাজনীতিতে। টপে মানে মাথার ওপর থাকত ধনীদের কিছু দুলাল, যাদের কাছে বাম রাজনীতি এক ধরনের ফ্যাশন। খালিদ এসব দলের না। ও মধ্যবিত্ত সচ্ছল পরিবারের একমাত্র পুত্রসন্তান। তার বাবা ছিলেন করপোরেশনের ডাক্তার। তাদের বাসার সবকিছুতে রুচি ও সচ্ছলতার ছাপ দেখেছি। তা ছাড়াও কখনো কোনোভাবেই রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামাত না। তার অন্তরে বঙ্গবন্ধু থাকলেও সে ছিল নীরব এক প্রেমময় কবি। তার এই কবিতাপর্ব শুরুর ঘটনায় সে জড়িয়ে পড়েছিল সত্তর দশকে চট্টগ্রামে গড়ে ওঠা আমাদের অগ্রজদের সংগঠন স্পার্ক জেনারেশনে। এই স্পার্ক জেনারেশন কোন ঘটনায় প্রভাবিত বা কী কারণে এমন নাম তা জানা বা আলোচনা করা যাবে অন্য কোথায়ও, কিন্তু এটা বলব, সে সময়ে তারা যে আধুনিকতা আর পাশ্চাত্যমুখী মননের পরিচয় দিয়েছিলেন এখন তা ভাবাও অসম্ভব। সময়ের চেয়ে অগ্রগামী সে সময়কার চট্টগ্রাম দেখা আমাদের বন্ধু খালিদকে স্পার্ক জেনারেশন লুফে নিয়েছিল। যার মানে তখন ছিল খালিদ কবি হয়ে গেছে এবং আমাদের চেয়ে এগিয়ে।
অবশ্য সেসব বন্ধন তার জন্য না। সে তখন প্রেম করার জন্য মরিয়া। মূলত আমাদের বাসস্থান নন্দনকানন এলাকায় তার ভালোবাসার মুকুল ফুটলেও সে প্রেমে পড়ে আমাদের এক বন্ধুর বোনের। যে নিজেও শিল্পী, ডিজাইনার নান্দনিক। তরুণীর সঙ্গে তার প্রেম সে গোপন রাখেনি। মাঝে মাঝে এসে সেসব গল্প বলত। অসম ধর্মের এই ভালোবাসা পরিণতি লাভ করার বিষয়ে সন্দেহ না থাকলেও এটা জানতাম মানতে পারবে না অনেকে। তাতে খালিদ আহসানের কি আসে-যায়? সে তো জন্মেছিল ভালোবাসার জন্য। তার কাজ ছিল নিজেকে ভালোবাসার মায়াজালে আবদ্ধ রেখে সংসারের বাইরে এক স্বপ্নের জগতে বসবাস করা। সেটা সে খুব ভালো মতে করতে পেরেছি। আইভি হাসান বাড়িঘর সংসার সামলাত আর খালিদ সামলাত তার বহুমুখী প্রতিভার স্বপ্নের বাগান।
আমার এই বন্ধুটি ক্রিকেট বুঝত। মাঝে মাঝে এসে আমাদের সঙ্গে খেললে টের পেতাম কী দারুণ ফিল্ডিং দিতে পারত। সুর ভাজা ছিল তার কাছে নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়। পথ চলতে আড্ডা দিতে এমন কি সিরিয়াস কাজের সময়ও সে গুনগুন করত। বেশিরভাগ সময় দেখতাম গানের কলির চেয়েও সে গুনগুন করছে কোন সুর। তখন তার অন্য পরিচয় বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। বাংলাদেশের অন্যতম সেরা প্রচ্ছদশিল্পী খালিদ আহসান এঁকে ফেলেছে পরবর্তীকালে কিংবদন্তিতুল্য ‘যে জলে আগুনে জ্বলে’ কবিতার বইয়ের প্রচ্ছদ। হেলাল হাফিজ এই একটি কবিতার বইতেও জয় করেছেন বাঙালির মনোভুবন। এমন নানা কীর্তির সঙ্গে জড়িয়ে খালিদের নাম।
আঠারো-ঊনিশ বছর বয়সে আমরা একটি গল্প বইয়ের সংকলন করেছিলাম। দীপক বড়ুয়ার অর্থায়নে প্রকাশিত এই গল্পের সংকলনটি মূলত খালিদের ব্রেইন চাইল্ড। অসামান্য প্রচ্ছদ আর গেটআপে এটি বলে দিয়েছিল খালিদ থামতে আসেনি। আমার এই বন্ধুর স্বভাবজাত দোষ ছিল দুটি।
সে কোনো নিয়ম মানত না। যৌবনের সিংহভাগ সময় তার কেটেছিল চায়ের আড্ডায় আর সিগারেট পান করে। ধূমপানে এমন নিষ্ঠ আর অক্লান্ত বন্ধু দ্বিতীয় কেউ ছিল না। আর একটা দোষ কবিতার মতো এক মায়াবী অলীক জগতে বসবাস। এই জগৎটি সে বিশ্বাস করত। ইংরেজিতে যাকে বলে রিঃযফৎধষি ংুসঢ়ঃড়স. সেটাই বেছে নিয়েছিল সে। থাকত সবার সঙ্গে অথচ ভয় পেত বাস করত ভালোবাসত নির্জন এক মনোভূমি। শেষবার দেখা হয়েছিল চেরাগী পাহাড়ের এক চায়ের দোকানে। আমরা সবাই আড্ডা দিচ্ছিলাম। সিডনি থেকে গেছি সবার সঙ্গে দেখা-কথা আন্তরিকতা বিনিময় তো স্বাভাবিক ব্যাপার। সে ফাঁকে কখন যে সে সরে গেছিল জানতে পারিনি। যাওয়ার আগে চায়ের বিল চুকিয়ে যেতে ভুলেনি বন্ধু। করোনা তাকে নিয়ে যেতে পারে, এটা ভাবিনি। ওই যে একা থাকা নির্জনে থাকা এমন কোলাহলমুক্ত মানুষকে করোনা ছাড় দেয়নি। কিন্তু কী জানেন, মনে ভয় থাকলেও একজন সংস্কৃতিকর্মীর পাশে দাঁড়াতে করোনাকালে দেখা করে টাকা দিতে ভুল করেনি খালিদ।
ওর মানবিক মননশীল রুচিসম্মত আচরণ সবসময় নির্জন আর চুপচাপ স্বভাবের কোনো গাছের মতো। যে নীরবে ছায়া দেয়। কাউকে কিছু বলে না। শুধু তার দুঃখ অভিমানগুলো ঝরে পড়ে পাতার মতো। তার কবিতায় সে লিখেছিল :
চেতনার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গেছে গভীর ক্লান্ত কুয়াশা
জানি না কখন ঘুমিয়ে পড়েছি ঘুমিয়ে পড়েছি একা
একা একাকিত্ব আর একা যাওয়ার মহামারিকালে একা একাই ঘুমিয়ে পড়েছে খালিদ আহসান। যে তার ‘শীতের কফিন থেকে উৎসারিত মানি প্ল্যান্ট’ কবিতার বইটি দেয়ার সময় লিখেছিল-
অজয়, ছেলেবেলার বন্ধু আমার…
আমি চোখের জলে চিকচিক করা বাইরে তাকাই, আমার বন্ধুর কফিন দেখিনি আমি। খালিদ আহসান সময় অগ্রবর্তী সখার নাম।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়