ডিএনসিসি মেয়র আতিক : ডেঙ্গু প্রতিরোধে সবাইকে সচেতন করতে পারছি না

আগের সংবাদ

বেহাল রেলের মেগা প্রকল্প : খুলনা-মোংলা রেল প্রকল্পের কাজ কবে শেষ হবে কেউ জানে না

পরের সংবাদ

ইনজেকশনে ভয় পেত রবীন্দ্রনাথ!

প্রকাশিত: আগস্ট ৪, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: আগস্ট ৪, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

রবীন্দ্রনাথের কবিতার ‘খোকা’ তার মাকে প্রশ্ন করেছিল, ‘এলেম আমি কোথা থেকে?’ মা শুনে হেসে কেঁদে খোকাকে বুকে বেঁধে জবাব দিয়েছিলেন, ‘ইচ্ছা হয়ে ছিলি মনের মাঝারে।’
না, প্রতিমা দেবীর সেই ইচ্ছা পূরণ হয়নি। প্রতিমা ছিলেন রবীন্দ্রনাথের পুত্রবধূ। রবীন্দ্রনাথের তখন যথেষ্ট বয়েস হয়েছে, কর্মব্যস্ততাও তুঙ্গে। সারাক্ষণই কবিকে চোখে চোখে আগলে রাখতেন প্রতিমা। রবীন্দ্রনাথও তাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। ডাকতেন ‘মামণি’। ‘বাবামশাই’ রবীন্দ্রনাথের কন্যাতুল্য স্নেহ তার জীবনে ছিল পরম প্রাপ্তি। তারপরও প্রতিমার মনে একটা লুকানো কষ্ট ছিল- ‘মা’ ডাক শুনতে না পারার কষ্ট। একই কারণে স্বামী রথীন্দ্রনাথের মধ্যেও ছিল বেদনার ক্ষত। তাদের জীবনের এই শূন্যতা, সন্তানের জন্য হাহাকার রবীন্দ্রনাথকেও কষ্ট দিত। তিনি চেয়েছিলেন তাদের জীবনে পূর্ণতা আসুক! শুধু কি তাদের জীবনে, ছোট্ট ছোট্ট টলমল পায়ে ঘুরে বেড়াবে একটি শিশু, তাকে আদর করবেন, সে সর্বক্ষণের সঙ্গী হবে, হয়তো এমন ভাবনাও রবীন্দ্র-মনে খেলে যেত! শেষে রবীন্দ্রনাথের পরামর্শেই রথীন্দ্রনাথ ও প্রতিমা ছোট্ট পুপেকে নিজেদের সন্তান হিসেবে গ্রহণ (দত্তক) করেছিলেন। স্নেহে ভালোবাসায় তিলে তিলে বড় করে তুলেছিলেন। পুপের প্রাণময় উপস্থিতিতে উত্তরায়ণ মুখরিত হয়ে উঠেছিল। সারাক্ষণই তার উপস্থিতি টের পাওয়া যেত।
‘পুপে’ নামে ডাকতেন রবীন্দ্রনাথ। এই নামটি রবীন্দ্রনাথই দিয়েছিলেন। ‘পুপে’ শব্দটি ফারসি। যার অর্থ ‘পুতুল’। ছোট্ট মেয়েটির সত্যিই ছিল ‘পুতুল-পুতুল গড়ন’। টুকটুকে গায়ের রং। দেখতেও ফুটফুটে সুন্দর। হ্যাঁ, তাকে ‘পুতুল’ বলেই ভুল হতো! আসল নাম ছিল তার ‘নন্দিনী’। নন্দিনীর পিতা-মাতা ছিলেন গুজরাটের মানুষ। দুজনেই ছিলেন রবীন্দ্রনাথের ভক্ত, মাঝেমধ্যেই তারা আসতেন শান্তিনিকেতনে। অন্য কোনো উদ্দেশ্যে নয়, আসতেন প্রাণের টানে। কবির সঙ্গে দুটো কথা বলে তাদের হৃদয় জুড়াত।
স্ত্রী খুব অসুস্থ, দিশেহারা অবস্থা, তাই জন্মানোর পরপরই পুপের পিতা চতুর্ভুজ দামোদর কবির হাতে তুলে দিয়েছিলেন নবজাতককে। শান্তিনিকেতনের উত্তরায়ণে সমাদরেই ঠাঁই পায় ফুটফুটে? সেই শিশু-সন্তানটি। বড় হতে থাকে আদরে-ভালোবাসায়, অফুরান স্নেহে। বালিকা-বয়সেই হয়ে ওঠে কবির ‘অভিভাবিকা’। রবীন্দ্রনাথ তাকে নিয়ে লিখেছিলেন বেশ ক’টি কবিতা। তারই একটি ‘তৃতীয়া’। সে কবিতায় আছে, ‘কাছের থেকে দেয় না ধরা, দূরের থেকে ডাকে/তিন বছরের প্রিয়া আমার, দুঃখ জানাই কা’কে?/কণ্ঠেতে ওর দিয়ে গেছে দখিন হাওয়ার দান/বসন্ত তার দোয়েল শ্যামার তিন বছরের গান;/তবু কেন আমারে ওর এতই কৃপণতা,/বারেক ডেকে পালিয়ে সে যায়, কইতে না চায় কথা।’
কবির শেষ বয়সের রচনাকর্মে, বিশেষত ছোটদের লেখাজুড়ে রয়েছে পুপের উপস্থিতি। বলা যায়, রবীন্দ্রনাথের শেষ জীবনটি ভরিয়ে তুলেছিলেন আদরের নাতনি। কবির তখন হাজারো ব্যস্ততা। লেখার চাপ, শান্তিনিকেতনের দায়দায়িত্ব। লেখালেখিতে ডুবে থাকার মুহূর্তেও পুপের উপস্থিতি কবিকে আনন্দ দিত। বড় হয়ে ‘পিতা-পুত্রী’ নামে একটি বই লিখেছিলেন নন্দিনী। সে বইতে আছে, ‘…বাবা যখন বাইরে, মা ঘরের কাজে ব্যস্ত, আমি তখন মা’র চোখ এড়িয়ে দাদামশাইয়ের পড়ার ঘরে গুটি গুটি হাজির। …তিনি লেখা থেকে মুখ তুলে আমাকে সাদরে কাছে টেনে নিয়ে, তারপর মুখে মুখে কবিতা বানিয়ে আদর করতেন। কখনো বানিয়ে গল্প বলতেন। তার লেখা পড়ে থাকত, তিনি আমাকে বসিয়ে গল্প শোনাতেন।’ গল্প বলতে বলতে কখনো থামতেন কবি। পুপেকে বলতেন, ‘এবার লেখো’।
এক মুহূর্ত দেরি না করে পুপে তখুনি লিখতে শুরু করে দিতেন। এমনভাবে দাদামশাই তার মধ্যে গল্প লেখার নেশা ধরিয়ে দিয়েছিলেন। গল্প লিখে পুপে দেখাতেন রবীন্দ্রনাথকে। দাদামশাই খুঁটিয়ে পড়ে প্রয়োজনে সংশোধনও করে দিতেন। এভাবেই পুপে একটি গল্প লিখে ফেলেছিলেন। সে গল্পের নাম ‘ইঁদুরের ভোজ’। ভারি সুন্দর, মজাদার এক গল্প।
দাদামশাই রবীন্দ্রনাথের কাছে দৈনন্দিন পড়াশোনা করতেন পুপে। রবীন্দ্রনাথই ডাক দিতেন, ‘পড়ার বইটা নিয়ে এসো তো! দেখি, কী পড়েছ!’ মজা হচ্ছে, পড়তে বসার খানিক পরেই পুপের খিদে পেয়ে যেত। মুখে সে কথা বলতেন না। বলতেন ঘুরিয়ে। ‘তোমার খেতে দেরি হয়ে যাচ্ছে’, দাদামশাইকে এ কথা বলার পর আর বুঝতে বাকি থাকত না যে, বেচারি পুপের খিদে পেয়েছে! দাদামশাই রবীন্দ্রনাথ হেসে বলতেন, ‘হ্যাঁ দিদি, তোমার আর ভালো লাগছে না! ছুটি চাই তো?’ দাদামশাইয়ের মুখে সে কথা শোনার পর পুপের কী আনন্দ-আহ্লাদ! তখুনি বই-খাতা তুলে রাখতেন। সেদিনের মতো অন্তত সাঙ্গ হতো পড়াশোনা।
পুপের শখ জেগেছিল পাখি পোষার। মুক্ত আকাশ যার বিচরণভূমি, ছোট্ট এক খাঁচায় তাকে বন্দি করে রাখার পক্ষপাতী ছিলেন না রবীন্দ্রনাথ। পাখি পোষার ইচ্ছের কথা শুনে বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ, পুষবে বৈকি দিদি।’ না, খাঁচায় নয়, ছেড়ে রেখেই পুষতে হবে, বলেছিলেন দাদামশাই। দাদামশাইয়ের পরামর্শ মতোই পুপে একটি পাখি পুষেছিলেন। সেটি ছিল ময়না। ময়নাটি খাঁচায় নয়, ছাড়াই থাকত। শান্তিনিকেতনে উত্তরায়ণের বাগানে উড়ে, ঘুরে বেড়াত। ডাকলেই এসে বসত পুপের হাতে। আদর করে খাইয়ে আবার ছেড়ে দিতেন। কখনো ময়নাটি পুপের ঘরে গিয়েও বসে থাকত। পুপে কয়েকটি হাঁসও পুষেছিলেন। পুপের পোষা হাঁস রবীন্দ্রনাথ উত্তরায়ণের যে ঘরে বসে লেখাপড়া করতেন, সে ঘরের বাইরে, জানলার কাছে দাঁড়িয়ে কবির লেখাপড়ার ব্যাঘাত ঘটাত। পুপে সহজভাবে মেনে নিতে পারতেন না। ছড়ি হাতে বকাঝকা করতেন, ভব্যতা শেখাতেন।
দাদামশাই শান্তিনিকেতনে না থাকলে পুপের কাছে বড় ফাঁকা ফাঁকা লাগত। নিজেকে খুব নিঃসঙ্গ মনে হতো। দাদামশাইয়ের উদ্দেশে নিয়ম করে চিঠি লিখতেন। রবীন্দ্রনাথ ভারি সুন্দর করে সেসব চিঠির উত্তর দিতেন। কবি তখন সুদূর আর্জেন্টিনায়। পুপে খুব যতœ করে একটি চিঠি লিখেছিলেন। বেশি যতœ করে সে চিঠি লিখতে গিয়ে অনেক কাটাকুটি করে ফেলেছিলেন। চিঠিটি হাতে পেয়ে এত কাটাকুটি দেখে আরও কিছু কাটাকুটি করতে ইচ্ছে জাগে কবির। কাটাকুটিতে কাটাকুটিতে চিত্রিত সে-চিঠি পুপের কাছে ফেরত পাঠানোর জন্য কবি দিয়েছিলেন ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোকে। ওকাম্পো চিঠির কারুকাজে মুগ্ধ হয়ে ভেবেছিলেন, এমন সুন্দর ছবিময় চিঠি এভাবে না পাঠিয়ে মাউন্ট করে পাঠালে সুন্দর দেখাবে। যেমন ভাবা তেমন কাজ। নিজের হাতে মাউন্ট করে খামে পুরে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন শান্তিনিকেতনে।
কাটাকুটিতে ভরা একটি চিঠি পাঠিয়ে কী অসাধ্য সাধনই না করেছিলেন ছোট্ট পুপে! সেদিন এত শত বোঝেননি, বুঝেছিলেন পরে। বই লিখতে বসে তাই মনে হয়েছে, ‘আমার মনে হয় সেই চিঠিতে আঁকিবুঁকি করে যে ছবি তিনি এঁকেছিলেন, সেই ছবি থেকেই তার ছবি আঁকার সূত্রপাত। আমার এই ধারণার সমর্থন মিলেছিল আমার মায়ের কথায়। মাকে লেখা দাদামশাইয়ের চিঠির মধ্যে তার ইঙ্গিত আছে।’
পুপের লেখা থেকেই জানা যায়, ডাক্তারদের কতখানি ভয় পেতেন রবীন্দ্রনাথ। ওষুধপত্রে অনীহা ছিল না, যদি ইনজেকশন দিয়ে দেন- এই ভেবে খুব ভয় পেতেন কবি।
শান্তিনিকেতনে তখন ম্যালেরিয়ার প্রকোপ। রবীন্দ্রনাথেরও শরীর ভালো নেই, মাঝে-মধ্যে জ্বর হচ্ছে। সেদিন নিজের লেখা সম্পাদকের দপ্তরে পোস্ট করতে বেরুচ্ছিলেন কবি। এমন সময় উত্তরায়ণে আশ্রমের ডাক্তারবাবু ঢুকলেন। পুপের মুখে ডাক্তার আসার কথা শুনে ইনজেকশন দেবেন ভেবে রবীন্দ্রনাথ লুকিয়ে পড়েছিলেন বাথরুমে।
রবীন্দ্রনাথ তো বাথরুমে লুকোলেন, ডাক্তারবাবু এসে বসে রইলেন কবির ঘরে, ওঠার নামটি নেই তার। পুপে নানাভাবে এটা-সেটা বলেও ডাক্তারবাবুকে কিছুতেই বাড়ি পাঠাতে পারলেন না। রবীন্দ্রনাথ বাথরুমের ভেতর থেকে সব শুনছিলেন। শেষে নিরুপায় হয়েই বাইরে এলেন।
না, সেদিন কোনো ইনজেকশন দেননি, ওষুধ লিখে দিয়েছিলেন প্রেসক্রিপশনে। চলে যাওয়ার পর কবি কৌতুক করে পুপেকে বলেছিলেন, ‘ভাগ্যে তুমি ছিলে পুপেদিদি, তা নাহলে ডাক্তারবাবু নিশ্চয়ই আমাকে ইনজেকশন দিয়ে দিতেন।’

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়