ডিএসইর ডিজিটাল সাবমিশন প্ল্যাটফর্ম চালু

আগের সংবাদ

লোভের আগুনে কত স্বপ্ন পুড়বে?

পরের সংবাদ

বিষাদের মহানায়ক : রূপকথার গল্পের চেয়েও বর্ণিল

প্রকাশিত: জুলাই ১০, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুলাই ১০, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ভারতীয় চলচ্চিত্রের সংজ্ঞা আর দিলীপ কুমার (১১ ডিসেম্বর ১৯২২-৭ জুলাই ২০২১) একই সুতোয় গাঁথা। তারকা ও অভিনেতার নিখুঁত মিশেলে উপমহাদেশের জনমানসের কাছে চলচ্চিত্রের যে আবেদন তার সর্বোচ্চ চূড়া অতিক্রম করে গিয়েছিলেন তিনি। প্রায় শতবর্ষী এই কিংবদন্তির দীর্ঘজীবন রূপকথার গল্পের চেয়েও বেশি বর্ণিল, চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যের থেকেও বেশি আকর্ষণীয়। প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ও দিলীপ কুমারের জীবনীকার লর্ড মেঘনাদ দেশাই তো মনেই করেন, ভারতীয় চলচ্চিত্র যে ক’জন শ্রেষ্ঠ অভিনেতার জন্ম দিয়েছে তাদের মধ্যে দিলীপ কুমারই সেরা। তার চেয়ে বড় তারকা কেউ কেউ থাকতে পারেন, কিন্তু বড় অভিনেতা কেউ নন। কেতাবি ভাষায় দিলীপ কুমারকে বলা হয় ‘মেথোড এক্টর’। চরিত্রের সঙ্গে নিজেকে আবেগীয়ভাবে পুরোপুরি নিমগ্ন করে ফেলতেন তিনি। কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই রপ্ত করেছিলেন স্তানিস্লাভস্কিয় অভিনয়ের এই কৌশল। কেউ কেউ বলে থাকেন পারস্য নাটক থেকেই দিলীপ কুমার পেয়েছিলেন এ গুণ। কিন্তু তার ক্ষেত্রে সেটা ছিল একেবারেই প্রকৃতিপ্রদত্ত। অভিনয়ের গভীরতা আর নিমগ্নতায় বিশ্ব চলচ্চিত্র ইতিহাসে হলিউড গ্রেট মার্লন ব্রান্ডো, জাপানি তারকা তোশিরো মিফুন কিংবা ইতালীয় কিংবদন্তি মার্সেলো মাস্ত্রোয়েনির সঙ্গে তুলনা চলে তার। হিন্দি চলচ্চিত্রের যুগনায়ক দিলীপ কুমার রাজত্ব করেছেন ছয় দশক ধরে। এ সময়ে ৬৩টি সিনেমায় তিনি অভিনয় করেছেন। প্রযোজনাও করেছেন কয়েকটি সিনেমায়। অসামান্য অভিনয়ের মাধ্যমে দেশকাল সীমানা পেরিয়ে উপমহাদেশের কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে ‘ট্র্যাজেডি কিং’হয়ে রয়েছেন। তবে কমেডি চরিত্রেও তিনি সমান সফল। চলচ্চিত্রে আসা তার হঠাৎ করেই। দিলীপ কুমারের আসল নাম মোহাম্মদ ইউসুফ খান। অবিভক্ত ব্রিটিশ ভারতে, বর্তমানে পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনওয়া প্রদেশের পেশোয়ারে ১৯২২ সালের ১১ ডিসেম্বর তার জন্ম। বাবা লালা গোলাম সারওয়ার ছিলেন ধনাঢ্য ফল ব্যবসায়ী, মা আয়েশা বেগম গৃহিণী। ১৯৩০ সালে গোলাম সারওয়ার পরিবার নিয়ে বোম্বে (বর্তমানে মুম্বাই) চলে আসেন। ব্যবসায়ী বাবার সন্তান ইউসুফ খানের স্বপ্ন ছিল ব্যবসায়ী হবার। বাবার সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় বাড়ি ছেড়েছিলেন। পুনেতে গিয়ে দিয়েছিলেন স্যান্ডউইচের দোকান। মুম্বাই ফিরে তার সঙ্গে আলাপ হয় মাসানির সঙ্গে। এ পরিচয়ই তার জীবনকে পাল্টে দেয়। মাসানি তাকে নিয়ে যান বম্বে টকিজে। ভালো উর্দু জানতেন। চিত্রনাট্য লেখার কাজে সহযোগিতা করতেন। নিজ প্রভিভাতেই পরিচিতমুখ হয়ে ওঠেন। ১৯৪৪ সালে অভিনেত্রী দেবিকারানী বলিউডের প্রথম খান ইউসুফ খানকে চলচ্চিত্র অভিনয়ে নিয়ে আসেন। অমিয় চক্রবর্তীর ‘জোয়ার ভাটা’ দিয়ে শুরু হয় তার অভিষেক। দেবিকারানী তাকে নাম পাল্টানোর পরামর্শ দেন। দিলীপ কুমার, জাহাঙ্গীর ও বাসুদেব এই তিনটি নামের মধ্য থেকে তিনি বেছে নেন দিলীপ কুমার নামটি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নৌকাডুবি অবলম্বনে তৃতীয় সিনেমা ‘মিলন’ তার জীবনের বাঁক চিরদিনের মতো বদলে দিল। এই সিনেমার নির্মাতা নীতিন বোসের সংস্পর্শ তার অভিনয় স্টাইলেও বাঁকবদল হলো। এরপর ১৯৯৮ সালে ‘কিলা’ সিনেমায় শেষবারের মতো আবির্ভাবের আগ পর্যন্ত অর্ধশতাব্দীজুড়ে নির্মাণ করে গেছেন অভিনয় জগতে কিংবদন্তিতুল্য ইতিহাস। দিলীপ কুমারের সিনেমা ১৯৪৭ পরবর্তী ভারতের সামাজিক ইতিহাসের প্রতিবিম্ব। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরুর যে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক মডেল সেটার রূপায়ন ঘটেছে তার অভিনীত চরিত্রগুলোতে। ফুটপাত, নয়া দৌড়, গঙ্গা যমুনা ও লিডার- এই চারটি চলচ্চিত্রে নেহেরুর হাত দিয়ে উপনেবেশিক ও সামন্ততান্ত্রিক ভারতের সমাজ বদলে যাওয়ার যে সূচনা হয়েছিল তারই প্রতিফলন ঘটেছে। সদ্য স্বাধীন একটা দেশ নির্মাণের স্বপ্ন বাস্তবায়ন এবং প্রতিবন্ধকতা ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দিলীপ কুমারের একেকটা চরিত্রের সামাজিক প্রভাব ছিল অসামান্য। মেঘনাদ দেশাইয়ের কাছে দিলীপ কুমার তাই ‘নেহেরুর হিরো’। দিলীপ কুমার অভিনীত অনবদ্য সিনেমার মধ্যে শবনম, আন্দাজ, বাবুল, দেবদাস, মধুমতি, মুঘল-ই-আজম, গঙ্গা যমুনা, রাম অর শ্যাম, ক্রান্তি, শক্তি, মশাল উল্লেখযোগ্য। উদয় তারা নায়ারের অনুলিখনে তার আত্মজীবনী ‘দ্য সাবটেন্স এন্ড দ্য স্যাডো’অসামান্য এক জীবন আখ্যান। চল্লিশ থেকে সত্তরের দশক পর্যন্ত হিন্দি সিনেমার স্বর্ণযুগের সবচেয়ে উজ্জ্বলতম প্রতিনিধি দিলীপ কুমার। রাজ কাপুর, দেব আনন্দের মতো তারকাদের সময়ে অভিনয় করে নিজেই একজন যুগনায়ক হয়ে ওঠা চাট্টিখানি কথা নয়। আর তিনি শুধু যুগনায়কই হননি, পেরিয়ে গেছেন নিজের কালকেও। পরবর্তীকালে অমিতাভ বচ্চন থেকে শুরু করে শাহরুখ খান সবার কাছেই আইকনিক এক হিরো দিলীপ কুমার। যুগের পর যুগ কোটি কোটি মানুষের হৃদয় জয় করার পাশাপাশি অসংখ্য পুরস্কার, সম্মাননা ভরেছে দিলীপ কুমারের জীবনের ঝুলি। ভারতীয় অভিনেতাদের মধ্যে পুরস্কার প্রাপ্তির সংখ্যায় গিনেজ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে ঠাঁই করে নিয়েছেন তিনি। আটবার জিতেছেন ‘ফিল্ম ফেয়ার শ্রেষ্ঠ অভিনেতা’ পুরস্কার। ১৯৯৪ সালে পেয়েছেন ‘দাদা সাহেব ফালকে পুরস্কার’। ভারত সরকারের পদ্মভূষণ, পদ্মবিভূষণ সম্মাননাও পেয়েছেন তিনি। ১৯৯৮ সালে পাকিস্তানের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় খেতাব ‘নিশান ই ইমতিয়াজ’ পান তিনি। খেতাব ফিরিয়ে দেয়ার দাবি তোলে ভারতের মৌলবাদী গোষ্ঠী। উপমহাদেশের মানুষের হৃদয়ের নায়ক দিলীপ কুমার নতি স্বীকার করেননি রাজনৈতিক বিদ্বেষের এই বিষবাষ্পে। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী পুরস্কার প্রাপ্তির অধিকারের পক্ষে কথা বলেন। চলচ্চিত্রের পর্দার হিরো দিলীপ কুমার বাস্তবে রাজনীতিও করেছেন। কংগ্রেসের হয়ে সংসদ সদস্যও হয়েছিলেন তিনি। দিলীপ কুমারের প্রেম ও ব্যক্তিগত জীবন ছিল বর্ণিল। সিনেমায় ‘ট্র্যাজেডি কিং’ হলেও বাস্তব জীবন কেটেছে ভালোবাসায় রঙিন। তার কালের সেরা অভিনেত্রী কামিনী কৌশল, মধুবালা, বৈজয়ন্তীমালার সঙ্গে প্রেমের গুঞ্জন ছড়িয়েছে নানা সময়ে। ৪৪ বছর বয়সে বিয়ে করেন তার চেয়ে ২২ বছরের ছোট তৎকালীন জনপ্রিয় অভিনেত্রী সায়রা বানুকে। নানা উত্থান পতনে তাদের ৫৫ বছরের দাম্পত্য জীবন কেটেছে অটুট। মাঝে অবশ্য আসমা সাহিবার সঙ্গে দ্বিতীয় বিয়ে করেন তিনি। কিন্তু সে বিয়ে বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। দিলীপ কুমার সায়রা বানুর কাছেই আবার ফিরে আসেন। প্রকৃতির নিয়মেই জীবনাবসান হয় একদিন। কিন্তু নিজের কালকে অতিক্রম করে কেউ কেউ বেঁচে থাকেন অন্য কালেও। দিলীপ কুমার উপমহাদেশের মানুষের মনিকোঠায় আরো বহুকাল মৃত্যুঞ্জয়ী হয়ে থাকবেন।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়