×

মুক্তচিন্তা

অবকাশের ফুরসত কই?

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০১ জুন ২০২৩, ০২:০৩ এএম

ছোটবেলায় পড়েছি সময় ও স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে না। শিক্ষকগণ নানা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে এই মহামূল্যবান বাণীর তাৎপর্য আমাদের বুঝিয়েছেন। আমরাও বুঝেছি সময় হেলার পাত্র নয়, তাকে অবহেলা করা চলবে না। তাই সেই ছোট কাল থেকেই আমরা পরতে পরতে সময়ের হিসাব নেয়া শুরু করেছি, পাছে যেন অপব্যয় না হয়ে যায়। এই হিসাব করার ব্যাপারটি বা সময়ানুবর্তিতা নিঃসন্দেহে মানবজীবনের একটি মহৎ গুণ। তবে হিসাবের খাতায় সময়ের বণ্টন সুষম না হলে তখন লাভের থেকে ক্ষতির মাত্রা যেন বেশি ঘটে। মানুষের চাহিদার কোনো শেষ নেই। মানুষ তার নানামাত্রিক চাহিদা পূরণে সব সময়ই ব্যস্ত। কর্মব্যস্ততা মানুষের জীবনকে গতিময়তা দান করে। নানা রকমের কাজে ব্যস্ত থাকলে মানুষ আজেবাজে চিন্তা-ভাবনা থেকে মুক্ত থাকতে পারে। কিন্তু এ কর্মব্যস্ততা মাঝে মাঝে অতিরিক্ত পর্যায়ে চলে যায়। কর্মময় জীবনের কৃত্রিম জালে আবদ্ধ মানুষ ভাবলেশহীন যন্ত্রে পরিণত হয়। ব্যস্ততার এ জাল ছিঁড়ে সামান্যতম অবকাশ যাপন করার মতো সময় থাকে না। নিজের ভালো লাগা মন্দ লাগাকে মানুষ বিক্রি করে ফেলে কর্মব্যস্ত জীবনের কাছে। এর প্রভাব অত্যন্ত ক্ষতিকর। অবকাশহীন একঘেয়ে কর্মজীবন মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে ফেলে মানুষকে। এর প্রভাবে নানা রকম জটিল মনোরোগ দেখা দেয়। এতে মানুষের আচরণে অনেক অস্বাভাবিকতা আসতে পারে। অনেক সময় হতাশা ও বিষণ্নতা জীবনে স্থায়ী রূপ লাভ করে। নিত্যদিনের কর্মব্যস্ততায় চাপা পড়া মন মাঝে মধ্যেই হারিয়ে যেতে চায় কল্পনার জগতে, পেতে চায় প্রজাপতির মতো অবাধ স্বাধীনতা। ইচ্ছা হয় জীবনের রঙিন স্বপ্নগুলো ছুঁয়ে দেখার। হাজারো চিন্তায় জর্জরিত মন আর্তনাদ করে উঠে সামান্য একটু স্নিগ্ধ অবকাশের আশায়। অবকাশ মানুষের জীবনকে প্রাণ-প্রাচুর্যে ভরপুর করে তোলে। অবকাশ যাপন যেন নতুন করে জীবন শুরু করার এক প্রস্তুতি পর্ব। মানুষকে যেমন বাহ্যিকভাবে সমৃদ্ধ হতে হয় তেমনি অর্জন করতে হয় আত্মিক পরিপুষ্টতা। আত্মিক পরিপুষ্টতা বা হৃদয়কে সমৃদ্ধ করতে না পারলে জাগতিক কোনো মঙ্গল তার দ্বারা সম্ভব নয়। আত্মাকে পরিপূর্ণ করতে যেমন আত্মিক সাধনার প্রয়োজন তেমনি প্রয়োজন একটু অবসর, একটু বিরতির। এই অবসর মানুষের চিন্তার জগৎকে ঝাঁঝালো করে; নিজেকে চিনতে শেখায়; নতুন ভাবোদয়ের জন্ম দেয়; অন্তর্নিহিত শক্তিকে জাগ্রত করে। জীবনের তাগিদে চাকরি, ব্যবসা, অর্থ-কড়ি, ধন-দৌলত ইত্যাদির পেছনে অনবরত ছুটতে গিয়ে কখনো আমাদের আত্মার সমৃদ্ধতা ক্ষয়ে যায়। তখন হতাশা-দুশ্চিন্তায় ঘিরে ধরে। রোগ-শোকে পেয়ে বসে। তাই প্রয়োজন আত্মিক প্রশস্ততা। আর অবকাশই আত্মাকে সুস্থ করে তোলে, প্রশস্ততা দান করে। তবে সেই অবকাশের জন্য আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে সময় বরাদ্দ আছে কি? একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে আসা যাক। মানুষ কেন বেঁচে থাকে? কিংবা জীবনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য কী? এমন প্রশ্ন যদি কোনো রাজদরবারের অধিপতির কাছে পেশ করা হয়, তিনি জবাব দেবেন- এ ক্ষণস্থায়ী জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হলো শক্তি আর ঐশ্বর্যের বলে ধরণীর বুকে নিজের নামকে যুগ-যুগের জন্য স্বর্ণাক্ষরে লিখে যাওয়া। আর ওই রাজ্যের সর্বাপেক্ষা দরিদ্র মানুষটির কাছে এই প্রশ্ন করা হলে তিনি বলবেন- জীবনের অর্থ দুবেলা দুমুঠো আহার জুগিয়ে কিছু উচ্ছিষ্ট জমিয়ে রাখা। এবার ওই দরবারের কোনো আমলাকে একই প্রশ্ন করা হলে তিনি উত্তর দেবেন- পদোন্নতি পেয়ে রাজ অধিপতির অধিকতর কাছের আসনে আসীন হওয়াই জীবনের একমাত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। তাহলে একটি বিষয় পরিষ্কার হলো, রাজা থেকে প্রজা কিংবা আমলা থেকে কামলা- সব মানুষের মধ্যে তার বর্তমান অবস্থান থেকে অধিকতর উন্নত হওয়ার একটি আকাক্সক্ষা থাকে, বড় হওয়ার ইচ্ছা জাগে। এবং এই ইচ্ছা-আকাক্সক্ষা নিয়েই তার জীবনের সব আয়োজন, যত জল্পনা-কল্পনা। তার সব শ্রম, শক্তি, মেধা ও সময় সঁপে দেন এই জল্পনার খায়েশ মেটাতে। এ পর্যন্ত ঠিক আছে। তবে অনেক সময় এই জল্পনার জলে নিমক্ত হয়ে কেবল বড় হওয়ার ইচ্ছা ছাড়াও যে জীবনের আরো কিছু মৌলিক সত্য আছে, সৌন্দর্য আছে-যা বেঁচে থাকার জন্য অপরিহার্য, তা ভুলে থাকেন অনেকে। এখানেই যত বিপত্তি! বড় হওয়ার তাগিদে আমরা অবিরাম ছুটতে শুরু করি। এই ছোটায় কোনো যতি নেই, ছেদ নেই বা বিরাম চিহ্ন নেই। আমাদের ছোটা শুরু হয় জন্ম থেকে চলতে থাকে মৃত্যুর আগ অবধি। ছোটাছুটির রোষানলে পড়ে আমরা বঞ্চিত হই জীবনের ওইসব সৌন্দর্য থেকে। আমরা নগদে বিশ্বাসী; বাকিতে নয়। অবকাশ ফল দেয় একটু দেরিতে। তাই এই সৌন্দর্যকেও ফেলে রেখেছি ওই বঞ্চিত হওয়ার কাতারেই। প্রশ্ন ছিল অবকাশের জন্য আমাদের সময় বরাদ্দ আছে কিনা। এতক্ষণে পাঠক তার উত্তর জেনে গিয়েছেন, তা হলো- নেই। আমরা জয় করতে ভালোবাসি। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, বিশ্বকে জয় করি তবে নিজের নয়, আত্মার নয়। আত্মাকে জয় করার ভাবনা আমাদের মনস্তাত্ত্বিকতায় নেই। তবে এ জয় কঠিন কিছু নয়। একটু একান্তে নিরিবিলি সময়, একটি ভালো বই বা জ্যোৎস্না স্নাত চাঁদের আলো কিংবা একটি ভালো গান বা ভালো নাটক দিয়েই পরিশীলিত করা সম্ভব আত্মাকে। কিন্তু সে সময় আমাদের নেই। আগ্রাসনী সমাজ-সামাজিকতা-পারিপর্শ্বিকতা বোঝাতে থাকে অমন মেকি আমাদের জন্য নয়; আমাদের দৌড়াতে হবে কেবল অর্থ, ধন-দৌলত, গাড়ি-বাড়ি, সাম্রাজ্য আর ক্ষমতার পেছনে- তবেই জয় করা সম্ভব হবে। এই মিছে ভাবনায় যেন আমরা বুঁদ হয়ে আছি। এই ভাবনার ইতি ঘটিয়ে জীবন সংগ্রামে একটু কমা প্রয়োজন, থামা প্রয়োজন। শাকিরুল আলম শাকিল : গ-২৬/১, শাহজাদপুর, গুলশান, ঢাকা-১২১২। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App