×

সারাদেশ

শ্রমিক সংকটে দুশ্চিন্তায় কৃষকরা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১২ এপ্রিল ২০২০, ১২:২১ পিএম

শ্রমিক সংকটে দুশ্চিন্তায় কৃষকরা

সুনামগঞ্জে হাওরের ধান পাকতে শুরু করেছে। অল্প কিছু দিনের মধ্যেই তা কৃষকের গোলায় উঠবে। ছবিটি শনিবার (১১ এপ্রিল) বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার খরছার হাওর থেকে তোলা -ভোরের কাগজ

পাকতে শুরু হয়েছে হাওরাঞ্চলের জেলা সুনামগঞ্জের একমাত্র ফসল বোরো ধান। চৈত্রের মাঝামাঝি অর্থাৎ এপ্রিলের শুরুতেই হাওরাঞ্চলে ধান পাকা শুরু হয়। গ্রামে গ্রামে হয় নবান্নের আয়োজন। এবার সেই আয়োজন নেই বললেই চলে। করোনার সংক্রমণ রোধে ঘরে থাকা কৃষকরা মাঠের সোনালি ধান দেখে দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন। পাকা ধান কেটে আনার উৎকণ্ঠায় রয়েছেন তারা।

কৃষি অফিসের তথ্য মোতাবেক সুনামগঞ্জের ১১ উপজেলার হাওরে এবার বোরো চাষাবাদ হয়েছে ২ লাখ ১৯ হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১২ লাখ টন। কিন্তু এসব ধান ঘরে তোলা নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন জেলার ৩ লাখ কৃষক। সাধারণত এক হেক্টর বোরো জমির ধান কাটতে ১৫ জন শ্রমিকের প্রয়োজন। সেই হিসাবে ২ লাখ ১৯ হাজার ৩০০ হেক্টর জমির ধান কাটতে শ্রমিক লাগবে ৩২ লাখ ৯১ হাজার ৭৫০ জন। বোরো ধান কাটার সময়কাল ১৫ থেকে ২০ দিনের বেশি পাওয়া যায় না। ২০ দিনে সুনামগঞ্জের উৎপাদিত ধান কাটতে শ্রমিক লাগবে ১ লাখ ৬৪ হাজার ৫৮৭ জন। এই অবস্থায় করোনাকালে ধান কাটার শ্রমিক পাওয়া যাবে কিনা, অকাল বন্যা হয় কিনা, পানি আসার আগে ধানকাটা মাড়াই শেষ হবে কিনা, এমন দুশ্চিন্তায় রয়েছে হাওরাঞ্চলের কৃষকরা। জেলার দিরাই উপজেলার রাজাপুর গ্রামের কৃষক আব্দুস ছাত্তার জানান, বিশ^ম্ভরপুর উপজেলার চিনাকান্দি থেকে প্রতিবছর ৫০ থেকে ৬০ জন শ্রমিক তাদের গ্রামে যায়। তার জমি ছাড়াও কালিয়াকুটা হাওরে থাকা অন্তত ২০-২৫ হাল জমির ধান কাটে তারা। এবার এই শ্রমিকরা এখনো পৌঁছাতে পারেনি। আসার জন্য পরিবহনও পাচ্ছে না।

তিনি বলেন, আমরা যোগাযোগ করে জেনেছি, দ্বিগুন ভাড়া দিয়েও তারা পরিবহনের ব্যবস্থা করতে পারছে না। যারা প্রতিবছর আসে তারাও অনেকে আসতে চাচ্ছে না। আগামী শুক্রবার জুমার পরে যেভাবে হোক রওয়ানা দেবে, কোথাও পুলিশ আটকালে আমরা যাতে ছাড়ানোর ব্যবস্থা করি সেই অনুরোধও করেছে তারা। তিনি জানান, পুরো হাওরাঞ্চলেই এমন সংকট তৈরি হয়েছে। করোনার ভয়ও আছে শ্রমিকদের মধ্যে। অন্যান্য বছরপ্রতি একর জমি ছয় থেকে সাড়ে ছয়

হাজার টাকায় কাটানো যেত, এবার যে কত দাবি করবে সেই দুশ্চিন্তাও রয়েছে। তিনি মনে করেন, ধান কাটার মেশিন কম্বাইন হারভেস্টার বা রিপার মেশিন দিয়ে একটু নিচু এলাকার ধানই কাটা সম্ভব নয়।

সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার ইসলামপুর গ্রামের কৃষক আব্দুল কাইয়ুম জানান, প্রতিবছরই চৈত্র মাসে ছোট-বড় সব কৃষকই অভাবে দিন কাটায়। এবার করোনা ভাইরাসের কারণে এটা আরো তীব্র হয়েছে। সরকার যদি ধান কাটার বিষয়ে আমাদের মেশিন কিনতে প্রণোদনা দিত তাহলে অনেক উপকৃত হতাম। অন্যথায় মহাজনী ঋণ নিয়ে ধান কাটার মেশিন কিনে ধান কাটতে হবে। সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের দায়িত্বশীলরা জানান, ২০১৭ সালে হাওর ডুবা শুরু হয়েছিল ২৯ মার্চ থেকে, ২০১৮ সালে ৭ মে এবং গতবছর হাওরে পানি এসেছিল ২ মে। এসব বিবেচনায় আসন্ন বিপদ থেকে রক্ষা পেতে কৃষকদের কাছে ধান কাটার যন্ত্রপাতি দ্রুত সরবরাহের কথা বললেন সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সবিবুর রহমান। তিনি বলেন, করোনা পরিস্থিতির কারণে মাইগ্রেটেড শ্রমিক কম আসবে। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে এই বিষয়টি জেলা প্রশাসক ও কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগকে জানিয়েছি। এছাড়া এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে বৃষ্টিও বেশি হওয়ার আবাস দিয়েছে আবহাওয়া বিভাগ। সুনামগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক সফর উদ্দিন বলেন, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনাসহ বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা ধানকাটা শ্রমিকদের এই জেলায় আনা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে এবং ধান কেটে ঘরে আনতে নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। হাওর এলাকার স্কুল কলেজগুলোতে এবং আলাদা আলাদা তাবু তৈরি করে শ্রমিকদের থাকার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। জেলায় ধান কাটার ১৩১টি কম্বাইন হারভেস্টার মেশিন রয়েছে নতুন করে আরো ৩৩টি দেয়া হচ্ছে। রিপার আছে ২৮৫টি। নতুন করে আরো ১৭টি দেয়া হচ্ছে। সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলায় সবচেয়ে বেশি হাওর। যেখানে ছোট বড় ২৩টি হাওরে পাকা বোরো ধান কাটতে অন্য জেলার লোক নিয়োগ না করে নিজ নিজ এলাকার শ্রমিক নিয়োগের নির্দেশ দিয়েছেন তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিজেন ব্যানার্জি। তিনি জানান, বর্তমান করোনা ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্যই সবাইকে সতর্কতা অবলম্বন করে নিজ নিজ এলাকার ধান কাটার শ্রমিক নিয়োগ করা প্রয়োজন। কারণ অন্য জেলা থেকে ধান কাটার শ্রমিক আসলে করোনা ভাইরাস সংক্রমণের আশঙ্কা রয়েছে। তাই নিজের নিরাপত্তার জন্যই নিজ নিজ এলাকার শ্রমিক নিয়োগের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। করোনা ভাইরাসের এই মহামারির সময়ে ধানকাটা নিয়ে জেলা সিভিল সার্জন ডা. সামশ উদ্দিন জানান, সুনামগঞ্জের বোরো ধান দেশের খাদ্য চাহিদায় বিশাল এক ভূমিকা রাখে। সেহেতু সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে ধান কাটতে স্বাস্থ্যকর্মীরা মাঠে সচেতনতামূলক প্রচারণা চালাচ্ছেন। গত শুক্রবার এক বিবৃতিতে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আহাদ বলেন, ধান কাটার শ্রমিক সংকট থেকে পরিত্রাণ পেতে আমরা গতবছর কৃষকদের মাধ্যমে সমিতি করে হারভাস্টার মেশিন কিনেছিলাম। বর্তমানে ৯২টা কম্বাইন্ড হারভাস্টার ও ১৯৩টা রিপার মেশিন আছে। এ বছর সমিতি করে আরো বেশি করে এসব মেশিন কেনা হবে। তাতে অনেকটাই শ্রমিক সংকট নিরসন হবে।

সুনামগঞ্জের কৃষকরা এবার করোনা ভাইরাসের কারণে যদিও অনেকটা দুশ্চিন্তায় আছেন। তবুও তাদের ঘরে যাতে ধান তুলতে পারেন এমনটাই প্রত্যাশা এবং প্রার্থনা করছেন জেলার সুধীজন। তবে আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে যে আগাম বন্যার পূর্ভাবাস দেয়া হয়েছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App