×

মুক্তচিন্তা

রাজনীতি নয়, একজোট হয়েই করোনার বিরুদ্ধে লড়তে হবে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১০ এপ্রিল ২০২০, ০৮:৪৩ পিএম

করোনা ভাইরাস বা কোভিড-১৯ মানব জাতিকে চরম সংকটের মধ্যে ফেলেছে। প্রতিদিন মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। ভয়াবহ এই মৃত্যুদূতকে রুখে দেয়ার জন্য এখন দরকার একজোট হয়ে কাজ করা। পারস্পরিক দোষারোপ এখন তিক্ততা বাড়াবে কিন্তু করোনার হাত থেকে বাঁচাতে সাহায্য করবে না। করোনা নিয়ে যেমন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে রাজনীতি আছে, জাতীয় পর্যায়েও তার ব্যতিক্রম নেই। বাংলাদেশ দিয়েই শুরু করা যাক। আমাদের দেশে করোনা পরিস্থিতির মোকাবিলার যে সময় আমরা, আমাদের সরকার পেয়েছিল, তা কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে যে গাফিলতি ছিল, সেটা নিয়ে বিতর্ক করে কালক্ষেপ এখন অর্থহীন। সরকারকে দোষ দেয়া যেতেই পারে। সব দায় অবশ্যই সরকারের। যে কোনো দুর্যোগে বা সংকটে সরকারকেই নেতৃত্ব দিতে হয়, উত্তরণের পথ দেখাতে হয়। আমাদের সরকার অনেক পদক্ষেপই নিয়েছে। কিন্তু অভিযোগ হলো, সরকার করোনার আগে হাঁটতে পারেনি। পিছু পিছু হাঁটতে গিয়ে সমস্যা বাড়িয়েছে। আবার আমরা, মানে দেশের মানুষ সরকারকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা না করে করোনা ভাইরাস কীভাবে বিস্তৃত হয়, সে সম্পর্কে অবহিত হয়ে বা না হয়ে সরকারি সিদ্ধান্ত এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চলে পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে সহযোগিতা করেছি। সরকার প্রস্তুতির কথা বলেছে। কিন্তু করোনাকেও সম্ভবত একটি সাধারণ ব্যাধির মতো ভেবেছে। আর নাগরিকদের অনেকেই ঘরে থাকা, শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা, গা ঘেঁষে চলাচল না করার বিধি উপেক্ষা করে চরম দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছি, দিয়েই চলেছি। আমরা সরকারকে দায়ী করছি, নিজেদের দায় এড়িয়ে চলছি। আবার কেউ কোথাও ভালো উদ্যোগ নিলে তার প্রশংসা না করে সেটা ভণ্ডুল করার পক্ষে কাজ করছি। শুরু থেকেই আমাদের দেশে করোনা ভাইরাস পরীক্ষার জন্য কিটের অভাব ছিল। কিট সংকটে পরীক্ষা ব্যাহত হয়েছে। কিট সমস্যা সমাধানের জন্য এগিয়ে আসেন গাজীপুর সিটি করপোরশনের মেয়র জাহাঙ্গীর আলম। তিনি সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে চীন থেকে ৫০ হাজার কিট আমদানি করেন। প্রয়োজন হলে আরো কিট আনার কথাও তিনি জানিয়েছেন। দ্রæত সময়ের মধ্যে করোনা ভাইরাস শনাক্ত করার জন্য এই কিট ব্যবহার করা হয়। এই কিট ব্যবহার করেই চীন করোনা মোকাবিলায় সফল হয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে জাহাঙ্গীর আলমের আমদানি করা কিট নিয়ে উদ্দেশ্যমূলকভাবে অপপ্রচার চালানো হলো। কোনো ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করেই বলা হলো, চীনের এই কিট নিম্নমানের! জাহাঙ্গীর আলম কি ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে এই কিট আমদানি করেছেন? এতে কি সরকারি অর্থের অপচয় হয়েছে? তিনি কি এগুলো উচ্চ দামে বিক্রি করে লাভবান হয়েছেন? না। তিনি আমদানি করা কিটগুলো বিনামূল্যে বিতরণ করেছেন। বলা হচ্ছে, তার আমদানি করা কিটগুলো যথাযথ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক অনুমোদিত নয়। হতেই পারে। মানুষের জীবন বাঁচানোর তাগিদ থেকে দ্রুততম সময়ে কিট আমদানির জন্য আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এড়াতে জাহাঙ্গীর আলম অনুমোদন ছাড়াই টেস্ট কিট আমদানি করেছেন। কিটগুলো দেশে আনার পর প্রয়োজন বিবেচনায় পূর্ব অনুমোদনের বিষয়টি ছাড় দিয়ে এগুলো ব্যবহারের অনুমতি দিলে তো কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। বিষয়টি নিয়ে যারা প্রশ্ন তুলেছেন তাদের কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকা অসম্ভব নয়। জাহাঙ্গীর আলম রাজনীতি করেন। তিনি আওয়ামী লীগ করেন। গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র। তার রাজনৈতিক পক্ষ-বিপক্ষ থাকাটাই স্বাভাবিক। চীন থেকে আনা তার করোনা ভাইরাস পরীক্ষার কিট ‘রাজনীতির শিকার’ করার কোনো নেপথ্য চালক আছে কিনা খুঁজে দেখা দরকার। করোনাকালে এই বিষয়টি নিয়ে দেশে দেশে রাজনীতি যে হচ্ছে সে খবরও আমাদের কানে আসছে। হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন নামের একটি ম্যালেরিয়া প্রতিরোধী ওষুধ নিয়ে আমেরিকা ও ভারতের মধ্যে ছোট রাজনীতি আমরা দেখলাম। এই ওষুধটি করোনা চিকিৎসায় উপকারী বলে মনে করা হচ্ছে। সারা বিশ্বের মধ্যে ভারত একাই ৭০ শতাংশ হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন উৎপাদন করে। গত ২৫ মার্চ ভারত এই ওষুধ রপ্তানির ওপর নিষেজ্ঞা আরোপ করে। আমেরিকা করোনা চিকিৎসার জন্য এই ওষুধ ভারত থেকে নিতে চায়। কিন্তু রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার কারণে সেটা সম্ভব হচ্ছিল না। এই অবস্থায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারতের প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, নিষেধাজ্ঞা তুলে না নিলে আমেরিকা পাল্টা ব্যবস্থা নেবে। ট্রাম্পের এই হুঁশিয়ারি উচ্চারণের চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই ভারত রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে ২ কোটি ৯০ লাখ হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন ওষুধ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাঠাতে সম্মত হয়েছে। হুমকি-ধমকি শেষ। এখন ট্রাম্প বলছেন, মোদি মহান, তিনি খুব ভালো মানুষ। আর মোদি বলেছেন, কোভিড ১৯-এর বিরুদ্ধে সভ্যতার লড়াইয়ে সহায়তা করার জন্য যা যা করা সম্ভব, ভারত তার সব কিছুই করবে। আমরা একই সঙ্গে এই লড়াইয়ে জিতব। আহ, সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানরা যদি সত্যি সত্যি এমন সহযোগিতার নীতি নিয়েই চলতেন তাহলে একটি মানবিক বিশ্ব তৈরি হয়তো সম্ভব হতো। কিন্তু বাস্তবে তো রাজনীতির পথ জটিল এবং কুটিল। নানা স্বার্থ চিন্তা ও সমীকরণ রাজনৈতিক সম্পর্ক নির্ধারণে নিয়ামক ভ‚মিকা পালন করে। গত ডিসেম্বরে চীনের উহানে শুরু হওয়া করোনা ভাইরাসে আসলে পৃথিবীর কোনো দেশই গুরুত্বের সঙ্গে নেয়নি। এটা যে বৈশ্বিক মহামারির রূপ নেবে সেটাও অনেক সরকারপ্রধানের এন্টেনায় ধরা পড়েনি। এই চীনা ভাইরাস আমেরিকার কিছু করতে পারবে না বলেও ডোনাল্ড ট্রাম্প বড়াই করেছিলেন। ট্রাম্প সরকার শুরু থেকে সতর্কতা নেয়নি বলেই আমেরিকায় এখন করোনা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। তবে অভিযোগ যাই থাকুক, এই মুহূর্তে কোভিড-১৯ তার মারণ থাবা দিয়ে সারা পৃথিবীর প্রকৃত চিকিৎসা ব্যবস্থার নাজুক অবস্থা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। সারা বিশ্বে এই রোগে মৃত্যুর সংখ্যা লাখ ছুঁই ছুঁই করছে। আক্রান্ত ষোলো লক্ষাধিক, লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে সংক্রামিতের সংখ্যাও। উন্নত দেশগুলোতেও টেস্ট কিট, অক্সিজেন, ভেন্টিলেটারসহ নানা অত্যাবশ্যকীয় সরঞ্জামের অপ্রতুলতা পরিস্থিতিকে ভয়াবহ করে তুলেছে। পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত এবং সুসংহত দাবি করা আমেরিকার আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার; সেই সঙ্গে ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, জার্মানিতে এই ভাইরাসের সংক্রমণ এবং মৃত্যুর পরিসংখ্যান দেখে সারা বিশ্ব হতভম্ব হয়ে পড়েছে। করোনা যত প্রবল আঘাত হানছে আমারিকায় ততই বেসামাল হয়ে পড়ছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। নিজের ব্যর্থতা এবং অপরিণামদর্শিতার দায় তিনি চাপিয়ে দিতে চাইছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) ওপর। যুক্তরাষ্ট্রের দাবি, করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ে তাদের সতর্ক করেনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)। শুধু তাই নয়, এ নিয়ে ভুল বার্তাও দেয়া হয়েছে তাদের। গত ৭ এপ্রিল হুর বিরুদ্ধে এমনই অভিযোগ তুলেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ট্রাম্প বলেছেন, হু যদি সঠিক বার্তা দিত, তাহলে এত লোকের মৃত্যু হতো না তার দেশে। কিন্তু হু সেটা করেনি। তার আরো অভিযোগ, গোটা বিশ্বের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিষয় যাদের দেখার কথা, সেটা না করে চীনের হয়ে কাজ করেছে হু। যার জেরে গোটা বিশ্বে মহামারির আকার নিয়েছে করোনা। এই মুহূর্তে বিশ্ব রাজনীতির মঞ্চে একমাত্র খলনায়ক হলো করোনা ভাইরাস। যে করেই হোক একে পরাস্ত করা জরুরি। না হলে পরাস্ত হবে বিশ্ব মানবতা। মানুষের বিরুদ্ধে এক অদৃশ্য জীবাণুর জয় কাম্য নয়, এটা হতে পারে না, হতে দেয়া যায় না। একবিংশ শতকের এই সময়ে এক ভাইরাসের সংক্রমণে যদি লাখ লাখ মানুষের প্রাণ সংহার হয়, তাহলে আমরা যে বড় বড় মানবতার বুলি আওড়াই তা আদতেই অসার প্রমাণিত হবে। আমাদের খুঁজে বের করতে হবে কোন প্রযুক্তিতে কীভাবে এই জীবাণুকে পরাস্ত করা যায়। পৃথিবীর বিভিন্ন গবেষণাগারে যে গবেষণা হচ্ছে, সেগুলোকে সমন্বয় করতে হবে সরকারগুলোকেই। বিশ্ব রাজনীতির ভেদাভেদ ভুলে এক হতে হবে। কোভিড-১৯ মোকাবিলায় যারা সফল হয়েছে, তাদের সহায়তা নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে করোনার উৎপত্তিস্থল চীনের উহানকে রোল মডেল ধরা যায়। এত বড় সংক্রমণে এত লোক হারিয়েও চীন থমকে যায়নি। প্রায় আড়াই মাস লড়াই শেষে ভাইরাসটিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। চীনের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডা চালানোর আগে তাদের সক্ষমতার বিষয়টিও বিবেচনায় রাখতে হবে। সক্ষমরাই সামনে যাবে, অক্ষমরা নয়। ছোট দেশ কিউবা কিংবা ভিয়েতনাম যা পারে, বিশ্ব নিয়ন্ত্রকরা তা কেন পারে না, সে প্রশ্ন সামনে আসছে, করোনা শেষে আরো তীব্রভাবে আসবে। এখন পর্যন্ত সফলভাবে করোনার কোনো ভ্যাকসিন আবিষ্কার হয়নি। তবে করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় চীন কিউবার ওষুধ প্রযুক্তি ইন্টারফেরন আলফা টু-বি ব্যবহার করে সফলতা পেয়েছে। আবার উহানের কাছের হংকংও সফলতা পেয়েছে ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য সুরক্ষা ব্যবস্থার কারণে। সফলতা পেয়েছে সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান, হংকং, দক্ষিণ কোরিয়ার অভিজ্ঞতা। তবে আমাদের দেশে আমরা বেশি বেশি পরীক্ষা এবং সীমান্তে নজরদারিতে সাফল্য দেখাতে পারিনি। ফলে দ্রæতই এই রোগ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এখন সর্বশেষ পন্থা হিসেবে সামাজিক দূরত্ব তথা শারীরিক দূরত্ব নিশ্চিতের মাধ্যমেই শুধু এর প্রকোপ থেকে রক্ষা পেতে পারি। বিপুল জনসংখ্যার ঘনবসতিপূর্ণ এই দেশে মানুষকে ঘরে রাখার ব্যবস্থা কার্যকর করা সত্যিই দুরূহ ব্যাপার। এখানে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বড় অংশই দিন এনে দিন খাওয়া মানুষ। অর্থনীতির এই দুঃসময়ে দীর্ঘদিন এত বিপুলসংখ্যক মানুষকে খাদ্য সরবরাহ করা এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। তারপরও আছে জনগণের অসচেতনতা। আইন প্রয়োগ করেও বাহিরমুখী মানুষকে ঘরে আবদ্ধ রাখা যাচ্ছে না। খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করে, অভাবী মানুষের কাছে সরাসরি সাহায্য পৌঁছানোর উপায় বের করে প্রয়োজনে আরো কঠোর পন্থা অবলম্বন করে জনগণকে ঘরে আবদ্ধ রাখতেই হবে। করোনা থেকে রক্ষা পেতে এর চেইন ভাঙার কোনো বিকল্প নেই। করোনার প্রভাবে ইতোমধ্যে বিশ্ব অর্থনীতি যে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সব কথার শেষ কথা, যে কোনো মূল্যে বাঁচাতে হবে মানুষকে; মানুষই তো অর্থনীতির প্রাণ। তাই করোনা নিয়ে রাজনীতি নয়। করোনা সংক্রমণ রোধে কাজ করতে হবে দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে। রাজনৈতিক পরিচয় দেখে করোনা ভাইরাস আক্রমণ করছে না। করোনা ভাইরাস যেহেতু বৈষম্যহীন চরিত্রের সেহেতু একে মোকাবিলার জন্যও সব ধরনের বৈষম্য পরিহার করা উচিত। বিভুরঞ্জন সরকার : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App