×

মুক্তচিন্তা

ফয়সালের ফুটবলে সবুজ পৃথিবী

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১০ এপ্রিল ২০২০, ০৮:৪১ পিএম

মাঠের শেষ প্রান্ত এবং যেখানটায় বিলের শুরু; ঠিক সেখানটায় একা দাঁড়িয়ে আছে বড় বটগাছটা। খেলার সাথীদের নিয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে সেই গাছের নিচে এসে বসে ফয়সাল। প্রায় দেড় ঘণ্টা ফুটবল খেলেছে বালকগুলো। ওদের প্রত্যেকেরই বয়স ১০ থেকে ১৪ বছরের মধ্যে। বিশ্বব্যাপী করোনার আতঙ্ক ছুঁতে পারেনি বালকগুলোকে। মহাআনন্দে নিত্যদিনের মতো খেলা শেষ করেছে মাত্রই। কেউ গাছে হেলান দিয়ে, কেউ ঘাসের ওপর পা ছড়িয়ে আবার কেউ খেলার সাথীর পিঠে হেলান দিয়ে বসে গেছে অলস ভঙ্গিতে। কিছুক্ষণ জিরিয়ে যে যার বাড়ি ফিরবে সন্ধ্যার আগে। বটগাছের পরে বিলের শুরুর দিক থেকেই থৈ থৈ পানি। মধ্যে মধ্যে কয়েকটি উঁচু জমি চরের মতো জেগে উঁকি দিয়ে দেখছে পুরো বিলটাকে। সবুজ মোটা সুতোর রেখার মতো দেখা যাচ্ছে বিল শেষের দূরের গ্রামগুলোকে। বৃষ্টি হয়েছিল আগের দিন রাতে। মাঠের কাদায় একাকার বালকগুলোর গেঞ্জি-হাফপ্যান্ট। গায়ে পায়ে কাদাপানির মাখামাখি। কাদা শুকিয়ে লেগে আছে কারো কারো চুলে। ফুটবলটা ছিল বালকগুলোর মাঝখানেই। কাদাপানি মেখে ফুটবলটা যেন আর ফুটবল নেই। তার ওপর গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে পশ্চিমাকাশের অদ্ভুত এক আলো এসে পড়েছে বলটির ওপর। ক্লান্ত বালকগুলো হঠাৎই আবিষ্কার করল, ফুটবলটাকে বল নয়, ঠিক পৃথিবীর মতোই লাগছে! কাদাপানি লেগে জায়গায় জায়গায় ভিন্ন ভিন্ন দাগ। কোথাও গোল কোথাও চ্যাপটা আবার কোথাও ঢেউ ঢেউ আকৃতি পেয়ে বলের শরীরটাকে ম্যাপের মতোই লাগছে। বলের গায়ে ফুটে উঠেছে সবগুলো দেশ-মহাদেশের সীমারেখা। একটি গ্লোব। আমাদের পৃথিবী। চোখজুড়ে কেবলই পৃথিবী। নিস্তব্ধ বিকালের মতো, নিঝুম শান্ত সবুজ এক পৃথিবী। বালকগুলো সেখানে কোনো মানুষ দেখতে পেল না। বালকগুলোর চোখে পৃথিবী দেখার এই হচ্ছে শুরু। করোনাকালে এর চেয়ে ভালো কোনো দৃশ্য চোখে পড়ছে না আমার। চীন থেকে শুরু হয়ে ইউরোপ-আমেরিকাসহ সারাবিশ্বের মানুষগুলোকে তাড়িয়ে ঘরে তুলে দিয়েছে করোনা নামের ভাইরাস। পৃথিবীর কোথাও যেন কেউ নেই। মানুষগুলো সব একজোট হয়ে অন্য কোথাও বেড়াতে গেছে হয়তো। আট-দশটা বালকের চোখে ভেসে ওঠে পৃথিবীর সুনসান নীরবতা। দেশ-মহাদেশের ব্যারিকেড নেই। যেখানে কিশোরগঞ্জের প্রত্যন্ত হাওরের নির্মল হাওয়া অনায়াসে চলে যাচ্ছে সুইজারল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস কিংবা ব্রাজিলের আকাশে। একটু কান পাতলেই শোনা যায় আমাজনের নাম না-জানা বুনো কোনো পাখির ডাক। প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে একাকার বালকগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে পুরো পৃথিবীটাকে। মানুষের কোলাহল বন্ধ হলে পর হেসে ওঠে প্রকৃতি। দেরিতে হলেও এটি বুঝে গেছে প্রকৃতি। এরই মধ্যে সমুদ্রের পাড়টা দখলে নিয়ে নিয়েছে লাল কাঁকড়ার দল। সাগরলতাগুলো সৈকতে জেগে উঠছে তরতর করে। কচ্ছপগুলো সমবেত হয়েছে উপক‚লের সৈকতে, হয়ত ওদের কোনো কনসার্ট বা সমাবেশ হবে; যেখানে করোনা ভাইরাসের কোনো ভয় নেই। ডলফিনগুলো ফিরে পেয়েছে নিজেদের জায়গা। মানুষের দখল না থাকায় ছোট-বড় ঢেউগুলো বাতাসের সঙ্গে তাল মিলিয়ে খেলা করছে উথাল-পাতাল আনন্দে। রমনা-সোহরাওয়ার্দীর কাঠবিড়ালিগুলো নির্ভয়ে নেমে এসেছে রাজধানীর রাস্তায়। মুখে কোনো মাস্ক ছাড়াই মনের সুখে গান গাইছে পাখিগুলো। অনর্থক ক্লাব, বার, রেস্তোরাঁ আর শপিংমলগুলো স্থবির। থমকে আছে সব। লকডাউনে প্রকৃতি যেন ফিরে পেয়েছে নিজস্ব ছন্দ। সতেজ রূপে আবিভর্‚ত হয়েছে আবার। কমে গেছে বায়ুদূষণ। কমেছে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য দায়ী কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ। নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইডের উপস্থিতি কমে গেছে ব্যাপক হারে। বালকগুলো আরেকটু ঝুঁকে আসে বলটির দিকে। স্বচ্ছ হয়ে উঠেছে ভেনিসের খালগুলোর পানি। বিশুদ্ধ বাতাস বইছে চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি কিংবা দক্ষিণ কোরিয়ায়। পৃথিবীর প্রায় সব ইঞ্জিন বন্ধ। বন্ধ বাস-ট্রাক কলকারখানা। কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ কম। কমে গেছে কার্বন মনোঅক্সাইডের পরিমাণ। পরিষ্কার বাতাস, শান্ত সমুদ্র। বদলে গেছে পৃথিবীর গতিবিধি। ভ‚পৃষ্ঠের ওপর চাপ কমে গেছে ছয় বিলিয়ন ট্রিলিয়ন টন ওজনের এই পৃথিবীর। লকডাউনের আগের তুলনায় ১-২০ হার্টস ফ্রিকোয়েন্সিতে ভ‚পৃষ্ঠের দুলুনি এখন অনেক কম। সবকিছু মিলিয়ে পৃথিবীর ওপর যে চাপ কমেছে তার নজির বিরল! পাশের দেশ ভারতের ওপর তাকিয়ে বালকগুলোর চোখ উচ্ছ¡সিত, বিস্মিত হয়। জলন্ধর এলাকার বাড়ির ছাদের ওপর থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে হিমাচল পর্বত। দূষণমুক্ত আকাশে দেখা মেলে অচেনা একঝাঁক তারকার। পৃথিবীময় পরিষ্কার আকাশে স্পষ্ট হয়ে ওঠে প্রকৃতি। যেখানে মানুষের কোনো রাজত্ব নেই, রাজত্বটা প্রকৃতির। ওদিকে আপনজন হারানোর পরও শেষবারের মতো স্বজনকে ছুঁয়ে দেখতে না পারার কষ্ট নিয়ে ঘরবন্দি অসহায় মানুষ। সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে দেখে প্রায় জোর করেই ফয়সালদের মাঠে এসে হাজির হন তামাম দুনিয়ার বিজ্ঞানী, গবেষক আর ক্ষমতাসীন বিশ্বনেতারা। কিছু একটা করা প্রয়োজন। বিশ্ব সভা হবে রূপগঞ্জের এই মাঠেই। নেপাল, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্যসহ তামাম দেশের বাঘা বাঘা সমাজবিদ, পরিবেশবিদরা ধীরে ধীরে জড়ো হচ্ছে রূপগঞ্জে। সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে এবার। ভোগের অভ্যাসগত পরিবর্তন ব্যক্তিসীমা পার করে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রেও ছড়িয়ে দেয়া দরকার। প্রকৃতি রক্ষার শপথে আলোচনায় মেতে ওঠেন সমাবেশকারীরা। কেউ বলেন, মানুষই এই পৃথিবীর ব্যাধি। যখনই পিছিয়েছে মানুষ, তখনই প্রস্ফুটিত হয়েছে প্রকৃতি। বিরোধিতা করে ওঠেন বিশেষজ্ঞরা। এটা ঠিক নয়। কারণ মানুষ এই প্রকৃতিরই অংশ। মাথাটা ভনভন করে ওঠে আমার। সমাধান মিলছে না কিছুতেই। হঠাৎ বালকগুলোর পাশ কাটিয়ে হে হে হে করে হেসে ওঠে ওই গ্রামেরই শ্যাম পাগল। আপনমনে প্রচুর কথা বলে শ্যাম। কথা বলার সময় দুই পা কিছুটা ভাঁজ করে ধাক্কা মেরে মেরে কথা বলে পাগলা। ‘দুনিয়ায় মানুষই যদি না থাকে; তাইলে প্রকৃতির সোন্দর্য দিয়া কী হইব? হে হে হে।’ স্বগতোক্তি করতে করতে গ্রামের ভেতর দিকে চলে যায় শ্যাম পাগল। বালকগুলোর পেছন দিয়ে হেঁটে বিশাল বিলের মুখোমুখি হই আমি। দুই হাঁটু গেড়ে বসি বিলের দিকে চেয়ে। বুক ভরে দম নিই। ফুসফুসের তলা পর্যন্ত পরিপূর্ণ হয়ে যায় শীতল নির্মল অক্সিজেন। গলার সমস্ত শক্তি দিয়ে চিৎকার করে উঠি আমি, ‘আরো একবার ক্ষমা করো আমাদের। ক্ষমা করো। ক্ষমা করো।’ কম্পিত হয়ে কথাগুলো ছড়িয়ে পড়ে বিলের বাতাসে। সন্ধ্যার আগেই লেখাটা শেষ করা দরকার। আজ বুধবার। রাতের আকাশে উঠবে সুপারমুন। গোলাপি হয়ে দেখা দেবে চাঁদ। সাধারণ পূর্ণিমা থেকে আজকের চাঁদটি ১৪ শতাংশ বড় আর ৩০ শতাংশ বেশি উজ্জ্বল হবে। প্রকৃতির কী খেলা! তামাম পৃথিবীর মানুষগুলো যখন একে অপরের কাছে আসতে পারছে না; তখন পৃথিবী আর চাঁদের দূরত্ব আজ কমে যাবে ২৭ হাজার ৪৯৩ কিলোমিটার। বিধিনিষেধ থাকবে না কোনো। আরো কাছাকাছি আসবে তারা। ভালোবাসা জানাবে পরস্পরকে। নান্দনিক চাঁদের এই দৃশ্যটি কোনোভাবেই মিস করতে চাইছি না আমি। নতুন তথ্যের আশায় টেলিভিশনের রিমোর্টটা হাতে নিই। অন করতেই বাংলাদেশি একটি চ্যানেলে সবুজ শাড়িপরা তরুণীর ঘোষণা : সুপ্রিয় দর্শক, এখন আপনারা দেখবেন পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা ছায়াছবি ‘আবার তোরা মানুষ হ’। সমস্বরে চিৎকার করে ওঠে বালকগুলো। মোহিন বলে ওঠে, ‘এ অবস্থায় বাড়ি গেলে আম্মু বকা দেবে। আমি গোসল না করে বাড়িতে যাব না।’ মোহিনের কথায় সায় দেয় অন্য বালকগুলো। মাঠের ভেতর দিকে কিছুটা এগিয়ে ঘুরে আবার বিলের দিকে মুখ করে দলবেঁধে দাঁড়ায় ওরা। একে একে দৌড়ে বিলের পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে বালকগুলো। গায়ে মাথায় লেগে থাকা কাদা ছাড়ানোর আনন্দে মেতে ওঠে ওরা। বালকগুলোর সেই আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে বিলজুড়ে। মোস্তাক আহমেদ : সাংবাদিক ও লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App