আশুলিয়ার দুই গ্রামে বেড়েছে চুরি

আগের সংবাদ

উন্নয়নের মুকুটে নতুন পালক

পরের সংবাদ

আকাশ ও বীর মুক্তিযোদ্ধা বাবা

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২৮, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ডিসেম্বর ২৮, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

আকাশের খুব মন খারাপ। নীল আকাশে কালো মেঘ জমলে যেমন হয়, ঠিক তেমনি কালো মেঘে ছেয়ে আছে আকাশের মুখ। যে কোনো মুহূর্তে ঝড় বৃষ্টি হতে পারে।
ছেলের মন খারাপ দেখে মা বলল- আকাশ কী হয়েছে বাবা, স্কুলে স্যারেরা বকেছে?
আকাশ কেঁদে ফেলে- না মা, ওরা…
– ওরা কে, কী করেছে?
– ওরা বলেছে আমার বাবা নাকি খোঁড়া, এক হাত নেই।
ছেলেকে সান্ত¡না দেবার জন্য মা বলেন- ওরা যা ইচ্ছে বলুক, এতে তোমার মন খারাপ করার কিছু নেই। ওরা জানে না বুঝে না বলে এসব বলছে।
আকাশ মায়ের সান্ত¡না মানতে চায় না।
– না মা, ওরা প্রতিদিন এসব বলে, আমাকে ঠাট্টা উপহাস করে, আমাকে রাগায়, আমি আর স্কুলে যাব না।
– আচ্ছা ঠিক আছে, আমি কাল তোমার সঙ্গে ইশকুলে যাব। তোমাদের ক্লাস টিচারকে বলব।
– না মা, স্যার আমাকে বকা দেবেন।
– দেখবে কিছু বলবেন না, স্যার তোমার বাবার বন্ধু।
– আচ্ছা মা, বাবার হাত নাই কেন? আকাশের প্রশ্ন।
মা আমেনা বেগম কেঁদে ওঠেন ছেলের কথায়। আকাশ হতবাক হয়ে যায়। মায়ের কান্নায় কী করবে ভেবে পায় না। ব্যাকুল হয়ে বলে- সরি, মা সরি… আমি আর বলব না। এরপর হাত দিয়ে মায়ের চোখের পানি মুছে দেয়।
আমেনা বেগম ছেলেকে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরেন। মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হয় না, এভাবে অনেকক্ষণ। পরে ছেলেকে নিয়ে ঘরে যান। আকাশ তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। বয়স সাড়ে আট বছর।

২.
আমেনা বেগমকে স্কুলে দেখে অফিসের স্যারেরা ওঠে দাঁড়ান। আকাশ তো অবাক! তার মা কি ইশকুলের স্যারদের চেয়েও বড়।
আকাশের ক্লাস টিচার খালেদ হাসান চেয়ার টেনে দিয়ে বলেন- ভাবি বসেন। কী মনে করে স্কুলে এলেন? কোনো প্রয়োজন হলে আমরাই যেতাম।
– না, ভাই তেমন কিছু না। একটা কথা বলার ছিল।
এরপর এক পাশে গিয়ে আমেনা বেগম খালেদ স্যারকে আকাশের কথাটা খুলে বলেন।
খালেদ স্যার এবার জিজ্ঞাসা করেন- আকাশ, কে কী বলেছে?
– নিজাম, জসিম, হাসমত এরা।
– তুমি তো সেটা আমাকেও বলতে পারতে, তাহলে কষ্ট করে তোমার মাকে এখানে আসতে হতো না। ঠিক আছে ভাবি আপনি যান, আমি দেখব। আকাশ তুমি ক্লাসে যাও।
আকাশ ক্লাসে ঢুকতে ঢুকতে মাকে চলে যেতে দেখল।

৩.
খালেদ স্যার ক্লাসে ঢুকেই বললেন- তোমাদের আজ একটি সত্যি গল্প বলব।
পড়ার বদলে গল্পের কথা বলায় সবার চোখে মুখে আনন্দের রেখা ফুটে ওঠে।
– তোমরা তো জান, আমাদের দেশ বাংলাদেশ। এই বাংলাদেশ স্বাধীন হয় ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরে। সে দিন আমরা বিজয় দিবস পালন করি।
সবাই সমস্বরে বলল- হ্যাঁ।
– কিন্তু জানো কীভাবে আমরা বিজয় পেয়েছি, কীভাবে স্বাধীনতা অর্জন করেছি?
– না, স্যার।
– শোন, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণার পর পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে আমরা যুদ্ধ শুরু করি। বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে যারা নিজের জীবনকে বাজি ধরে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন তাদের আমরা বীর মুক্তিযোদ্ধা বলি। আমাদের আকাশের বাবা, একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা।
একথা শুনে সবাই আকাশের দিকে তাকায়। একে অন্যের সঙ্গে ফিশ ফিশ করে কী যেন বলে। আকাশের বুক গর্বে ভরে ওঠে। আবার অবাকও হয়। তাই স্যারকে সে প্রশ্ন করে- আমার বাবা?
-হ্যাঁ! মনি ভাই, আমার বন্ধু। আমরা একসঙ্গে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি, আমাদের এক সহযোগী যোদ্ধা কর্ণফুলীর দক্ষিণে কানুংগো পাড়া গ্রামে পাকিস্তানিদের গুলিতে ১২ নভেম্বর ১৯৭১ এ শহীদ হলে, তার প্রতিশোধ নিতে মনি ভাই মরিয়া হয়ে ওঠেন। একের পর এক অপারেশনে অংশ নেন তিনি। আমরা শত্রæদের বিভিন্ন খবরাখবর সংগ্রহ করি। মনি ভাই খুব চালাক। একদিন আমরা বারণ করা সত্ত্বেও পাকিস্তানি হানাদারের ক্যাম্পে ঢুকে পড়েন। দিনটি ছিল ১৯ নভেম্বর। কিন্তু দুর্ভাগ্য মনি ভাই ধরা পড়ে যান। কয়েকজন রাজাকারও ছিল সেনা ক্যাম্পে। তারা দঁড়ি দিয়ে গাছের সঙ্গে বেঁধে ফেলে মনি ভাইকে। পাকিস্তানি ক্যাম্প কমান্ডার তাকে চড় থাপ্পড় মেরে ছেড়ে দিতে চেয়েছিল, কিন্তু আমাদের দেশীয় দালাল, যারা পাকিস্তানিদের সহযোগিতা করত, সেই বিল্টু রাজাকার ও হামিদ রাজাকার বলে, না স্যার, ও মুক্তিযোদ্ধা হ্যায়।
এ কথা শুনে পাকিস্তানি আর্মিরা মনি ভাইয়ের মাথা লক্ষ্য করে গুলি তাক করল। এমন মুহূর্তে মনি ভাই দড়ি ছিঁড়ে দৌড় দেন। কিন্তু গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যায় মনি ভাইয়ের বাম হাত। আমরা ভেবেছি, পাকিস্তনি আর্মিরা বুঝি মেরেই ফেলেছে মনি ভাইকে। না, এই বীর মুক্তিযোদ্ধা, দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানকে মারতে পারেনি। আমরা বহু কষ্টে তাকে ডাক্তার দেখালে বাম হাতটা কেটে বাদ দেয়। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানিদের পরাজিত করে আমরা স্বাধীন হলাম।
আমরা কান্না করছি দেখে, মনি ভাই বলল- খালেদ কাঁদিস না, আমার হাত নেই তো কী হয়েছে। কিন্তু স্বাধীন দেশ তো পেয়েছি।
খালেদ স্যার কেঁদে ওঠেন। কাঁদে আকাশও। পুরো ক্লাস স্তব্ধ! মিজান, জসিম, হাসমত দাঁড়িয়ে যায়। নিজেদের ভুল বুঝতে পারে স্যারের পায়ে ধরে বলে, স্যার আমাদের ক্ষমা করবেন। আমাদের ভুল হয়ে গেছে। আমরা না জেনে আকাশকে কত কিছু বলেছি।
– ঠিক আছে, ওঠ। আকাশ।
– জ্বি স্যার।
– ওরা ওদের ভুল বুঝতে পেরেছে।
আকাশ চোখ মুছতে মুছতে বলে- ঠিক আছে স্যার।
– আমরা আমাদের দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বোচ্চ সম্মান করব। কারণ তাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে এই স্বাধীন বাংলাদেশ আমরা পেয়েছি।
– হ্যাঁ স্যার। সমস্বরে বলে উঠে সবাই।
ঘরে ফিরে আকাশ মাকে জড়িয়ে ধরে বলে-
মা, আমি বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান।
গর্বে আমেনা বেগমের বুক ভরে যায়।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়