হাইকোর্টের রুল : সরকারি কর্মচারী গ্রেপ্তারে পূর্বানুমতি কেন অবৈধ নয়

আগের সংবাদ

উৎসবের গণটিকায় ভোগান্তিও

পরের সংবাদ

দূরদৃষ্টি, দৃঢ়তা ও সততার মিশেলে অনন্য নেত্রী

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৮, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: সেপ্টেম্বর ২৮, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বিভ্রান্ত দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে বিভাজিত ভারতবর্ষের পাকিস্তান অংশের প্রথম রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হচ্ছে ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ পর্যন্ত চলা পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন। দ্বিতীয় তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনাটি হচ্ছে ছয় দফা আন্দোলন। ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক ছয় দফা ঘোষণা করেন। ছয় দফাকে বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। ৬ দফাকে কেন্দ্র করেই ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০-এর নির্বাচন, ১৯৭১-এর ৭ মার্চের ভাষণ, ২৬ মার্চের স্বাধীনতা ঘোষণা এবং মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১৬ ডিসেম্বর রেসকোর্সের মাঠে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে বিজয় অর্জন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালি জাতি ইতিহাসে এই প্রথম ‘বাংলাদেশ’ নামক একটি স্বাধীন সার্বভৌম আধুনিক রাষ্ট্রের মালিকানা লাভ করল। কিন্তু মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাঙালি তার রাষ্ট্রের মালিকানা হারিয়ে ফেলে। ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালে জাতির জনককে সপরিবারে হত্যার পরে যা অবশিষ্ট থাকল সেটাকে কোনোভাবেই আর বাংলাদেশ বলা যাবে না। দেশটাকে পূর্ব পাকিস্তানে রূপান্তর করা হয়েছিল। একটা ঘটনা উল্লেখ করলেই পুরো বিষয়টি পরিষ্কার হবে- স্থান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, তারিখ ৭ মার্চ; শুধু সালটা ১৯৭৬। যেই রেসকোর্সের ময়দানে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ যেখানে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছিল, ঠিক সেখানটাতেই সিরাত সম্মেলনে মাওলানা দেলোয়ার হোসেন সাঈদী ছয় দফা ঘোষণা করলেন। দফার সংখ্যা, স্থান এবং তারিখ লক্ষ্য করলে দেখা যাবে দফার বিরুদ্ধে দফাকে দাঁড় করানো হয়েছিল। অত্যন্ত হিসাব-নিকাশ করেই এমনটি করা হয়েছিল। স্বাধীনতাবিরোধীরা মনে করত মুসলমান এবং পাকিস্তান সমার্থক।
মুসলমানের পরাজয় হতে পারে না। মুসলমানের পরাজয়ের স্মৃতিচিহ্ন মুছে ফেলতেই জিয়াউর রহমান পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের জায়গাটিতেই উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে শিশু পার্ক তৈরি করেছিলেন। কবি নির্মলেন্দু গুণের ভাষায় : ‘… এই শিশু পার্ক সেদিন ছিল না,/… জানি, সেদিনের সব স্মৃতি মুছে দিতে/ হয়েছে উদ্যত কালো হাত। / তাই দেখি কবিহীন বিমুখ প্রান্তরে আজ/ কবির বিরুদ্ধে কবি,/ মাঠের বিরুদ্ধে মাঠ,/ বিকেলের বিরুদ্ধে বিকেল, / উদ্যানের বিরুদ্ধে উদ্যান,/ মার্চের বিরুদ্ধে মার্চ…’।
সিরাত সম্মেলনে ঘোষিত ছয় দফার প্রথম দফাই ছিল ‘বাংলাদেশকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা করতে হবে।’ অন্যান্য দফার মধ্যে ছিল পতাকা বদলাতে হবে, শহীদ মিনার ভাঙতে হবে ইত্যাদি (অবশ্য এই রেসকোর্স ময়দানেই ১৯৪৮ সালে ২১ মার্চ পাকিস্তানের জাতির পিতা কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বলেছিলেন, ‘উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’)। ওই সিরাত সম্মেলনে উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল এম জি তোয়াব জিয়াউর রহমান সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। সিরাতে উপস্থিত তথাকথিত ইসলামের সমর্থকগোষ্ঠী সেøাগান তুলেছিল ‘তোয়াব ভাই তোয়াব ভাই, চাঁদ-তারা পতাকা চাই’। এমন একটি বিভীষিকাময় পরিস্থিতি তৈরি করেছিল বঙ্গবন্ধুর নামটিও কেউ মুখে নিতে পারত না। ৪ আগস্ট ১৯৭৬, তথাকথিত বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তক জিয়াউর রহমান পিপিআর ঘোষণা করেন। তাতে বলা হয়, ‘কোনো ব্যক্তিবিশেষের প্রতি ভক্তি বা বিশ্বাস গড়ে তুলতে পারে এমন কোনো নাম দল গঠনের প্রস্তাবিত গঠনতন্ত্রে উল্লেখ থাকতে পারবে না।’ ৪ নভেম্বর ১৯৭৬, জিয়াউর রহমান সরকার বঙ্গবন্ধুর নাম কেটে দিয়ে আওয়ামী লীগকে দল করার অনুমতি নিতে বাধ্য করে। ৩১ আগস্ট ১৯৭৬, খাঁন আতা ও আমজাদ হোসেনের নেতৃত্বে চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা জেনারেল জিয়ার সঙ্গে দেখা করতে গেলে সিনেমা থেকে শেখ মুজিবের নাম মুছে ফেলার প্রস্তাব আসে। তৎকালীন তথ্যসচিব এবিএম গোলাম মোস্তফা তা দ্রুত কার্যকরের জন্য তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নেন। বঙ্গবন্ধুর ছবি ও নামের ওপর কালি লেপনের নির্দেশনা জারি করেন।
এমন পরিস্থিতিতে ১৯৮১ সালের ১৭ মে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বিদেশে অবস্থান করায় ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আসেন। শুরু হয় রূপান্তরিত পূর্ব পাকিস্তানকে আবার বাংলাদেশের ধারায় ফিরিয়ে আনার সংগ্রাম। বাঙালির বুকে আশার সঞ্চার হয় বাংলাদেশকে আবার ফিরে পাওয়ার। এর মধ্যেই সহস্রাধিক সেনা সদস্যকে সামরিক বিচারিক প্রহসনের মাধ্যমে হত্যাকারী জিয়াউর রহমান একদল সেনা সদস্য কর্তৃক চট্টগ্রামে নিহত হন। কয়েক দিন ধানাই-পানাই করে বিচারপতি ছাত্তারকে তাড়িয়ে ক্ষমতা দখল করেন অপর স্বৈরশাসক হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ। শুধু পীর বদল হয়- ‘ছারছীনা থেকে আটরশি’, বাকি সবই আগের মতো। ‘সাফারি-সানগøাস-খাল কাটার’ জায়গায় চলে এলো ‘মেরি (লেডি)-হেলিকপ্টার- গতরাতে স্বপ্ন দেখা মসজিদে জুমার নামাজ আদায়।’ এরশাদ এক ধাপ এগিয়ে রাষ্ট্রের ভিত্তি ধর্মনিরপেক্ষতাকে চিরতরে বিতাড়িত করার জন্য রাষ্ট্রধর্ম ইসলামকে সামনে নিয়ে আসলেন। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানে এরশাদের পতন এবং ১৯৯১ সালের নির্বাচন। কিন্তু ১৯৯১-এর নির্বাচনে গণতন্ত্র মুক্তি পেল না। সামরিক শাসক জিয়া-এরশাদের মতোই গণতন্ত্র অবরুদ্ধ থাকল ক্যান্টনমেন্টে। শহীদ নূর হোসেনের বুকে লেখা গণতন্ত্র পুরোপুরি মুক্তি পেল না। গণতন্ত্র থেকে গেল সেনানিবাসেই। সেনানিবাসে থেকে গেলেন আমাদের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী। রয়ে গেল পাকিস্তানি ভাবধারা। একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরো স্পষ্ট হবে। ৮ জানুয়ারি ১৯৯৩, পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল আসিফ নেওয়াজ জানজুয়ার আকস্মিক মৃত্যুতে নজিরবিহীন শোক বাণী পাঠান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। জানজুয়া ১৯৭১ সালে হানাদার হিসেবে বাংলাদেশে গণহত্যা পরিচালনা করে। স্বৈরশাসক এরশাদের পতন হলেও গণতন্ত্র মুক্তি পেল না। বিচারপতি শাহাবুদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে এদেশের মানুষ দীর্ঘ দেড় দশক পর গণতন্ত্রের অন্যতম একটি অনুষঙ্গ স্বাধীনভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারলেও কুশীলবদের সূ² কারচুপির কারণে গণতন্ত্র ক্যান্টনমেন্টেই থেকে গেল। সেনানিবাস থেকেই গণতান্ত্রিক দেশের গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী দেশ শাসন করতে লাগলেন। সামরিক গোয়েন্দাদের খবরদারি থেকে গেল সরকার ব্যবস্থায়। পরে আরো দুটি নির্বাচনে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ও পরে ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এলেও বিরোধী দলের নেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী সেনানিবাসে থেকে গেলেন। পাকিস্তানি কায়দায় সামরিক গোয়েন্দারা সবকিছুতেই খবরদারি করছিল। এ সময়ে ঘটে ইতিহাসের আরেকটি নৃশংস হত্যার ঘটনা, ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্তে, সব গোয়েন্দা সংস্থার যোগসাজশে তৎকালীন সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনাকে সদলবলে হত্যায়ই ছিল এই গ্রেনেড হামলার উদ্দেশ্য। নারীনেত্রী বেগম আইভি রহমানসহ অসংখ্য নেতাকর্মী নিহত আহত হন এই গ্রেনেড হামলায়। আল্লাহর অসীম কৃপায় বেঁচে গেলেন জননেত্রী শেখ হাসিনা। ক্যান্টনমেন্টে বসে গোয়েন্দা সংস্থার লোকেরাই দেশ চালাতেন তার প্রমাণ মেলে ১/১১-এর ষড়যন্ত্রের সময়ও। প্রকাশ পেতে থাকে ব্রিগেডিয়ার আমিন-বারীদের হাতেই বন্দি ছিল গণতন্ত্র। সেনানিবাসের মইনুদ্দিনরাই জোগাড় করেছিল ফখরুদ্দিনদের। এদেশের গণতন্ত্র বিনাশী ষড়যন্ত্রের সঙ্গে সেনানিবাসে জন্মগ্রহণ ও নেতৃত্বের সেনানিবাসে অবস্থানকারী রাজনৈতিক দলটির সম্পৃক্ততা সন্দেহাতীত। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ইতিহাসে সবচেয়ে বড় একটি টার্নিং পয়েন্ট হচ্ছে ২০০৯ সালের পরবর্তী সময়ে দেশের সেনানিবাসে জন্মানো রাজনৈতিক দলটির নেতৃত্বকে আইনসম্মতভাবে সেনানিবাসের বাইরে নিয়ে আসা। এখানে আমি বাংলাদেশের রাজনীতির একটি স্থায়ী ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছি। এখন ‘সংসদে-রাজপথে-মিডিয়ায়’ যেভাবে গণতন্ত্র চর্চা হচ্ছে তা নিয়ে অনেক সমালোচনা হতে পারে; কিন্তু আজ থেকে ১০ বছর আগেও কিছু হলেই যেমনটি শোনা যেত ‘উত্তর পাড়ার (সেনানিবাসের) খবর কি’, এখন আর তেমনটি শোনা যায় না। একসময় একজন পান বিক্রেতা, রিকশাওয়ালাও সেনাবাহিনী প্রধান, পরবর্তী এবং তার পরবর্তী প্রধানের নাম পর্যন্ত জানত। এমনকি সাভার সেনানিবাসের জিওসি কে, ট্যাংক রেজিমেন্টের দায়িত্বে কে ইত্যাদি খবর সাধারণ মানুষের মুখে মুখে থাকত। এখন সেই দিন আর নেই। (সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিদেশে পলাতক কিছু সাংবাদিক এবং সাজাপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তার ইউটিউব সংলাপকে দেশের মানুষ পাগলের প্রলাপ হিসেবেই গণ্য করে)। আর সেটা সম্ভব হয়েছে সেনানিবাসে অবস্থানকারী দলটির নেত্রীকে সেনানিবাস থেকে বের করে আনার মধ্য দিয়ে। এর আগ পর্যন্ত পাকিস্তানি ভাবধারায় যে দেশ চলছিল তার আরেকটি উদাহরণ দেয়া যায়। ২০০৫ সালের ৩ মে মৃত্যুবরণ করেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা। সে সময় বেগম খালেদা জিয়া ক্যান্টনমেন্টে অবস্থান করেই প্রধানমন্ত্রিত্ব চালাচ্ছিলেন। যার নেতৃত্বে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছিল তার মৃত্যুতে প্রধানমন্ত্রী কোনো শোক বার্তা দেননি, এর বিপরীতটাই করেছিলেন জানজুয়ার ক্ষেত্রে।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের ক্ষমতা গ্রহণের মধ্য দিয়েই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গণতান্ত্রিকতা, ধর্মনিরপেক্ষতা, বাঙালিত্ব, অসাম্প্রদায়িকতা, সাম্যভিত্তিক মানবিক বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়। আর সেটার নেতৃত্ব অবশ্যই দিচ্ছেন আজকের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা। যে দেশটি অস্তিত্ব সংকটের মধ্যে পড়েছিল, জঙ্গিবাদী ব্যর্থ রাষ্ট্রের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছিল, সেটাই আজকে বিশ্বে উন্নয়নের বিস্ময়। ১৯৭২-৭৩ থেকে শুরু করে ২০০৬-০৭ সাল পর্যন্ত ৩৪ বছর সময় লেগেছিল মাথাপিছু আয় ৫৩২ ডলারে আসতে। ২০০৭-০৮ থেকে ২০১৯-২০ সালে এসে মাথাপিছু আয় দাঁড়ায় ২০৬৪ ডলারে। ১১ বছরে প্রায় চারগুণ হয়েছে। ২০২১ সালে আমাদের মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছে ২২২৭ ডলার। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ব্যাপারটি হচ্ছে নেতৃত্বের দূরদর্শিতা। নেতৃত্বের দূরদর্শিতা কীভাবে একটা জাতিকে উন্নয়নের পথ দেখায় তা বোঝার জন্য একটা উদাহরণ দিচ্ছি। ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পঞ্চগড় সফরে গেলেন। নেত্রীর অগ্রগামী দল হিসেবে আমরা যারা যুবলীগের নেতৃত্বে ছিলাম আগেই সেখানে পৌঁছে গিয়েছিলাম। বিকেলে সবাই যখন চা খাচ্ছিলাম তখন প্রধানমন্ত্রী হঠাৎ করেই বলে বসলেন, ‘ভারতের দার্জিলিংয়ে যদি চা চাষ হতে পারে, তাহলে পঞ্চগড়ে কেন হবে না’। সেখানে উপস্থিত ছিলেন পঞ্চগড়ের তৎকালীন জেলা প্রশাসক মো. রবিউল হোসেন। সম্ভাবনা যাচাই করতে তিনি মৌলভীবাজার থেকে চারা সংগ্রহ করে টবে লাগালেন। ২৫ বছর পর এখন পঞ্চগড়ে প্রায় ৩০০০ হেক্টর জমিতে চা চাষ হচ্ছে। ২০১৭ সালে উৎপাদন ছিল ৫৫ লাখ কেজি। বছরে তিন কোটি কেজি চা উৎপাদন সম্ভব।
শেখ হাসিনার মনোবল কত দৃঢ় এবং সিদ্ধান্তে কতটা অবিচল তার প্রমাণ পাওয়া যায় বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করার মধ্য দিয়ে। দেশি-বিদেশি সব চাপ উপেক্ষা করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে তিনি ছিলেন আপসহীন। এছাড়াও মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনকে মুখের ওপর গ্যাস রপ্তানির সুযোগ নাকচ করে দিয়েও তার অদম্য সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন। শেখ হাসিনার নেতৃত্বের দৃঢ়তার অন্যতম উদাহরণ হচ্ছে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ। দেশি-বিদেশি চক্রান্তে কাল্পনিক দুর্নীতির অভিযোগ এনে বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য দাতা সংস্থা যখন অর্থায়ন থেকে সরে দাঁড়াল তখন কালবিলম্ব না করে শেখ হাসিনা সিদ্ধান্ত নিলেন পদ্মা সেতু হবে নিজস্ব অর্থায়নে এবং হয়েছেও তাই। পদ্মা সেতু এখন বাস্তবতা। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘সাড়ে সাত কোটি বাঙালিরে কেউ দাবায়া রাখতে পারবে না।’ বঙ্গবন্ধুর এই উক্তির স্থাপত্য রূপ হচ্ছে পদ্মা সেতু। ১৯৯৬ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার বিরুদ্ধে একই ধরনের দুর্নীতির অভিযোগ তোলে ‘সিউল থেকে বুসান’ হাইওয়ে নির্মাণে অর্থায়ন থেকে সরে দাঁড়ায় বিশ্বব্যাংক। তখন দক্ষিণ কোরিয়া মহাসড়কটি নিজস্ব অর্থায়নে তৈরি করে দেখিয়ে দেয়, ‘আমরাও পারি’। এরপর থেকে বিশ্বব্যাংকের নির্ভরতা কমিয়ে আনে। ১৯৯৬ সালের পরে দক্ষিণ কোরিয়া আর বিশ্বব্যাংকের কোনো ঋণ গ্রহণ করেনি।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা তার সততা এবং দুর্নীতিমুক্ত থাকার কারণে বিশ্ব দরবারে অনন্য এক উচ্চতায় আসীন হয়েছেন। সম্প্রতি ইউরোপের একটি গবেষণা সংস্থা ‘পিপলস এন্ড পলিটিক্স’ বিশ্বের ৫ সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানকে চিহ্নিত করেছেন যাদের কোনো দুর্নীতি স্পর্শ করেনি। এদের বিদেশে কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নেই, উল্লেখ করার মতো সম্পদও নেই। ১৭৩টি দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানদের ১০০ নম্বরের ভিত্তিতে স্কোর করা হয়। এই তালিকায় প্রথম স্থান অধিকার করেন জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মার্কেল, তার স্কোর ৯০। দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী লি সিয়েন লুং, স্কোর ৮৮। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৮৭ স্কোর পেয়ে তালিকায় তৃতীয় স্থান অর্জন করেন। নরওয়ের প্রধানমন্ত্রী ইরনা সোলবার্গ এবং ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানী যথাক্রমে চতুর্থ ও পঞ্চম স্থান অধিকার করেন, তাদের স্কোর ছিল যথাক্রমে ৮৫ ও ৮১। এই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, দেশের ৭৮ শতাংশ মানুষ মনে করে শেখ হাসিনা দুর্নীতিমুক্ত এবং লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে। ছোটখাটো দুর্নীতিও তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। এর বিপরীতে দেশের একটি বড় রাজনৈতিক দলের চেয়ারপারসন তার প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন সময়ের দুর্নীতির দায়ে আদালত কর্তৃক সাজাপ্রাপ্ত হয়ে বর্তমানে সাময়িক বিরতিসহ জেল খাটছেন। অনেকে বলেন, সামান্য আড়াই কোটি টাকার জন্য বেগম খালেদা জিয়ার ১০ বছর জেল হওয়া খুবই অমানবিক। এটা নাকি ন্যায়বিচারের পরিপন্থি। অনেকটা এমন- বড় রাজনীতিবিদদের বড় দুর্নীতির বিচার করা যাবে, হাজার কোটি টাকা চুরি না করলে এর বিচার করা যাবে না। বড় রাজনীতিবিদদের যখন দুর্নীতির দায়ে ধরা হয় সারা পৃথিবীতেই এসব নেতা নাকি কান্নাকাটি করেন এবং অন্যরাও দুর্নীতি করেছেন অজুহাত দেখিয়ে আত্মপক্ষ সমর্থনের চেষ্টা চালান। এর অর্থ এই যে, কোনো অসৎ রাজনীতিবিদকে সাজা দেয়া যাবে না, যদি না প্রথমে অন্য সব অসৎ রাজনীতিকদের সাজা দেয়া না হয়। মনে রাখতে হবে আমাদের দেশেই বেগম জিয়ার শাসনামলে জনতা টাওয়ার মামলায় মাত্র ৫ লাখ টাকার জন্য এরশাদের পাঁচ বছর জেল হয়। করের অতিরিক্ত টাকা ফেরত পাওয়ায়। মামলা চলে ১৯৯১ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলা দায়ের করা হয় ২০০৮ সালের ৩ জুলাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। মামলা চলে ৯ বছর চার মাস। ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ তারিখে মামলার রায় হয়। কার্যদিবস ২৮০ দিন, খালেদা জিয়ার হাজিরা ৩৬ দিন।
মামলাটির পরতে পরতে আইনি ব্যাখ্যার নামে কালক্ষেপণের উদ্দেশ্যে উচ্চ আদালতে ২৫ বার পাঠানো হয়। মামলাটির শেষের দিকে দেশের প্রধান বিচারপতি ছিলেন এস কে সিনহা, প্রতিবারই মামলার যথার্থতা (মেরিট) সঠিক বলে বিবেচিত হয় এবং বিচারের জন্য নিম্ন আদালতে ফেরত পাঠানো হয়। বিচারক বদল হন চারবার। আইনের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় আসামিকে আত্মপক্ষ সমর্থনের যথেষ্ট সুযোগ দিয়ে রায় প্রদান করা হয়। তারও আগে ’৭৫ পরবর্তী সময়ে সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের শাসনামলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বোস অধ্যাপক আব্দুল মতিন চৌধুরীকে তিন মাস জেল দিয়েছিলেন ১৫০০ টাকা হিসাবে গরমিলের অজুহাতে। ’৭৫ পরবর্তী সময়ে শত শত প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যকে প্রায় বিনা বিচারে তথাকথিত সংক্ষিপ্ত সামরিক আদালতের মাধ্যমে জেলখানার ভেতরে বিচার করে ফাঁসি দেয়া হয়। তাদের পরিবারের সদস্যরা আজও জানেন না এ সব সেনা ও বিমান বাহিনীর সদস্যদের কী অপরাধ ছিল। ’৭৫ এবং পরবর্তী সামরিক অভ্যুত্থানগুলোতে জেনারেল জিয়া যার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সমর্থন পেয়েছিলেন সেই কর্নেল তাহেরকে প্রায় বিনা বিচারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেন।
এখনো স্পষ্ট নয় জিয়াউর রহমান কেন কর্নেল তাহেরকে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছিলেন। অনেকে মনে করেন তার ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করার জন্যই এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিলেন। জিয়াউর রহমান তার রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের অন্যতম শিখণ্ডী খন্দকার মোশতাককেও ছাড় দেননি। মোশতাককে ক্ষমতাচ্যুত করতে জিয়া প্রধান বিচারপতিকে এই পদে নিয়ে আসেন। পরে নিজেই সেই পদে আসীন হন। মোশতাক তড়িঘড়ি করে নির্বাচন দিয়ে রাষ্ট্রপতি হওয়ার জন্য ডেমোক্রেটিক লীগ গঠন করেন। মোশতাকের দলের বায়তুল মোকাররমে আয়োজিত জনসভায় গোয়েন্দা সংস্থার সহযোগিতায় সাপ ছেড়ে দেয়া হয়। তারপরও যখন মোশতাককে নিবৃত করা যাচ্ছিল না, জিয়া তখন মোশতাকের দাউদকান্দির গ্রামের এক প্রতিবেশীকে দিয়ে জমি জবর-দখলের মামলা করিয়ে মোশতাককে সামরিক আদালতে ছয় বছরের জেল দেন, যাতে মোশতাক প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার অযোগ্য হন।
দেশের শীর্ষ পদে অধিষ্ঠিত কেউ কী পরিমাণ দুর্নীতি করলে তাকে দুর্নীতিবাজ বলা যাবে- এ ব্যাপারে ফ্রান্সিস বেকনের একটি উদাহরণ দিয়ে আজকের আলোচনার সমাপ্তি টানব।
ফ্রান্সিস বেকন (১৫৬১-১৬২৬), ইংরেজ রাজনীতিবিদ ও দার্শনিক। রানী এলিজাবেথের মৃত্যুর পর ১৬০৩ সালে রাজা প্রথম জেমসের উপদেষ্টা নিয়োজিত হন, ১৬০৭ সালে সলিসিটর জেনারেল, ১৬১৪ সালে অ্যাটর্নি জেনারেল এবং ১৬১৮ সালে লর্ড চ্যান্সেলর (চিফ জাস্টিস সমমর্যাদার) নিযুক্ত হন। বিচারকের আসনে বসে তিনি মামলাকারীদের কাছ থেকে উপঢৌকন গ্রহণ করেন, যদিও সেকালে এটা স্বাভাবিক ছিল, তবুও এটি অবৈধ। এই অপরাধের দায়ে বেকন ক্ষমতাচ্যুত হন, টাওয়ার অব লন্ডনে তাকে বন্দি করা হয়, বড় অঙ্কের জরিমানা করা হয়, সারা জীবনের জন্য সরকারি পদে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। পরে অবশ্য রাজা ক্ষমা করে দেন। যদিও জনগণের বিশ্বাস হত্যা এবং ঘুষ গ্রহণের কারণে সাজাপ্রাপ্ত উচ্চমানের রাজনীতিবিদদের দৃষ্টান্ত সে আমলেও খুবই কম ছিল। সাজা ঘোষণার পর বেকনের মন্তব্য ছিল একটু অন্যরকম। ‘ইংল্যান্ডের ৫০ বছরের মধ্যে আমি ছিলাম ন্যায়পরায়ণতম বিচারক; কিন্তু আইনসভার ২০০ বছরের মধ্যে এটাই ছিল ন্যায্যতম তিরস্কার।’
এতিমের জন্য বিদেশ থেকে আনা টাকা আত্মসাতের চেষ্টায় বেগম খালেদা জিয়ার মাত্র ১০ বছর জেল হয়েছে। এর কম আর কি সাজা হতে পারত?

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়