নিম্ন আয়ের মানুষের সঙ্গে ইফতার মেয়র আতিকের

আগের সংবাদ

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের পথেই বাংলাদেশ

পরের সংবাদ

নিঃসঙ্গ পড়ে রইল তানপুরা…

প্রকাশিত: মার্চ ১৬, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ১৬, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বিনয়ী, স্বল্পভাষী এই গুণী সংগীতশিল্পী যেমন গাইতেন ভালো, তেমনি গানের শিক্ষক হিসেবেও যথেষ্ট সুনাম ছিল সাদী মহম্মদের। দেশের অনেক তরুণ, প্রতিষ্ঠিত শিল্পীর গুরু ছিলেন তিনি। বছরের পর বছর গানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেছেন। তার রয়েছে অসংখ্য অনুরাগী।
সব ফেলে বুধবার রাতে চলে গেলেন অনন্তের পথে। নিঃসঙ্গ পড়ে রইল তার রেওয়াজের তানপুরা। বাবা শহীদ সলিমউল্লাহ ও মা জেবুন্নেসা সলিমউল্লাহর কবরেই শায়িত হয়েছেন সংগীতশিল্পী সাদী মহম্মদ

মা ছিলেন তার অন্তহীন আকাশ
শহীদ সলিমউল্লাহর ছেলে রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী সাদী মহম্মদ। সলিমউল্লাহ ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা। বঙ্গবন্ধু পরিবারের সঙ্গে তার ছিল সখ্য। একাত্তরের ২৩ মার্চ মোহাম্মদপুরের বাসার ছাদে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছিলেন তিনি। ২৬ মার্চ মুক্তিযুদ্ধ শুরুর দিনই অবাঙালিরা ওই বাড়িতে চড়াও হয়ে আগুন দেয়। হত্যা করা হয় সলিমউল্লাহসহ তার পরিবারের কয়েকজনকে। পরে স্বাধীন বাংলাদেশে তার নামেই ঢাকার মোহাম্মদপুরের সলিমউল্লাহ রোডের নামকরণ করা হয়। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বাবাকে নিজের চোখের সামনে নির্মমভাবে খুন হতে দেখেন সাদী। এরপর সাদী মহম্মদের মা জেবুন্নেছা সলিমউল্লাহ গত বছরের ৮ জুলাই বার্ধক্যজনিত রোগে মারা যান। মাকে হারানোর ব্যথা বুকে চেপেই একই বাড়িতেই সাদী মহম্মদ বেছে নেন স্বেচ্ছামৃত্যুর পথ। মায়ের মৃত্যুর পর এক সাক্ষাৎকারে সাদী মহম্মদ বলেছিলেন, ‘যখন পাকিস্তানি সেনারা আমার বাবাকে নির্মমভাবে হত্যা করে, তখন আমার এই মায়ের কোলে ছিল ১০টি সন্তান। এই মা আমাদের ১০ ভাই-বোনকে একা মানুষ করেছেন। সেলাই মেশিন চালিয়ে আমাদের ভাত খাইয়েছেন, পড়াশোনা করিয়েছেন। এই মা ছিল আমার কাছে অন্তহীন আকাশ। যে আকাশে আমি পাখা মেলে দিতাম পাখির মতো। সেই আকাশটা আজ থেকে আর নেই। সাদী মহম্মদ সেদিন আরো জানান, তার মা ৭১ সালের ২৬ মার্চের সেই ভয়াল রাতে হানাদার বাহিনীর হাত থেকে বাঁচার জন্য মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোডের বাড়ির ছাদ থেকে লাফ দিয়ে নিচে পড়েন। সেদিন থেকে দুটো পা ভেঙে অকেজো হয়। এরপর লম্বা সময় ক্র্যাচে ভর দিয়ে শেষ ১৫ বছর হুইলচেয়ারে জীবন কাটিয়েছেন।’

ইঞ্জিনিয়ারিং ছেড়ে বিশ্বভারতী
বাবা-মায়ের ইচ্ছা অনুযায়ী ১৯৭৩ সালে বুয়েটে ভর্তি হয়েছিলেন সাদী মহম্মদ। তবে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে মন বসাতে পারেননি। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াকালীন ১৯৭৫ সালে স্কলারশিপ নিয়ে শান্তিনিকেতনে সংগীত নিয়ে পড়তে যান। বিশ্বভারতী থেকে রবীন্দ্রসংগীতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন। সেই থেকে শুরু পথচলা। বর্ষা ও বসন্তের গান পছন্দ করতেন সাদী মহম্মদ। ভারতের শান্তিনিকেতনে গানের ওপরে পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফিরে সরকারি সংগীত কলেজের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। সেখান থেকে অবসর নেয়ার পরও গানের তালিম দিয়ে গেছেন। নিজের বাসাতেই গান শেখান শিক্ষার্থীদের। রবিরাগ নামে তার একটা গানের সংগঠনও আছে। নানা কাজের মধ্যে প্রতিদিন দুপুরে ১০ মিনিট হলেও বিশ্রাম নেন। সময় পেলেই রেওয়াজে বসেন। মাঝে মাঝে বাড়িতে যোগব্যায়াম করেন।

পছন্দের লেখক বিভূতিভূষণ
সত্যজিৎ রায়ের সিনেমা দেখার কথাও বলেছেন তিনি। উত্তম কুমার ও সুচিত্রা সেনের সিনেমা ছাড়াও হলিউডের ‘দ্য বাইসাইকেল থিফ’, ‘রোমান হলিডে’ ছিল তার বেশ পছন্দের। এছাড়া বই পড়তেন। প্রিয় লেখকদের একজন ছিলেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। এছাড়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্প, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, সমরেশ বসু, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস পছন্দ করতেন। আর গীতবিতান পড়তে পড়তেই হারিয়ে যান রবীন্দ্রভাবনার জগতে। ‘রবীন্দ্রনাথের মধ্যে আমার জীবনের সবকিছু খুঁজে পাই। আমার হাসি-আনন্দ, সুখ-দুঃখ, জীবনযাপনের সবটা জুড়েই থাকেন রবীন্দ্রনাথ। ২৫ বৈশাখ তার জন্মদিন, কিন্তু আমার কাছে তার অস্তিত্ব সারাক্ষণ।’ সাক্ষাৎকারে এমনটাই বলেছিলেন সাদী।

শার্টে থাকত দুটি বুকপকেট
রবীন্দ্রনাথের ভক্ত মানেই যে পাঞ্জাবি পরে ঘুরতে হবে, এমনটা মনে করেন না সাদী। যেমন নিজেই সব সময় পরেন শার্ট। এর বাইরে অন্য কোনো পোশাক পরেন না এই রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী। বাসায় সাদা লুঙ্গি আর শার্ট পরেন। তবে শার্টের থাকতে হবে দুটি বুকপকেট। সেই পকেট দুটো আবার ঢাকনা দেওয়া। তবে শার্ট ফুলহাতা নয়, সেটা হতে হবে খাটো হাতা। সঙ্গে তৈরি করা প্যান্ট পরেন। পায়ে বেছে নেন স্যান্ডেল। শীতকালে অবশ্য শার্টের ওপরে একটা শাল জড়িয়ে নেন। কোনো দাওয়াতে গেলে অথবা শুটিং থাকলে পরেন নিজের ডিজাইন করা শার্ট। তসর বা সিল্কের শার্ট বানিয়ে নিয়ে নিজ হাতেই নকশা করেন। নানা ধরনের উজ্জ্বল রঙের শার্ট পরেন। তবে যখন তিনি শিক্ষক, তখন বেছে নেন চেক শার্ট। ভালোবাসেন সুগন্ধি লাগাতে। নানা ব্র্যান্ডের সুগন্ধি সংগ্রহে আছে। চন্দনের ধুপও ভালোবাসেন। নানা ধরনের গাছ লাগাতে ভালোবাসেন। এসব গাছের যতœ নিতেন নিজেই।

বর্ণাঢ্য সংগীতজীবন
মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোডেই সাদী মহম্মদের জন্ম ও বেড়ে ওঠা। রবীন্দ্রসংগীতের ওপর বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেছিলেন তিনি। রবিঠাকুরের গানে তার মূল পরিচিতি হলেও আধুনিক গানেও ছিলেন অনন্য। তার কণ্ঠে বহু রবীন্দ্রসংগীতের অ্যালবাম প্রকাশিত হয়েছে। তাকে দেখে, শুনে এই সুরের জগতে এসেছেন অসংখ্য শিল্পী। যারা নিজ নিজ পরিচয়ে উজ্জ্বল, সফল। জীবদ্দশায় চ্যানেল আই থেকে আজীবন সম্মাননা ও বাংলা একাডেমি থেকে রবীন্দ্র পুরস্কার পেয়েছিলেন এই শিল্পী। কিন্তু কোনো রাষ্ট্রীয় পুরস্কার জোটেনি তার দীর্ঘ, বর্ণাঢ্য সংগীতজীবনে।

তানপুরার বিষণ্ন সুরেই ডুব অনন্তযাত্রায়
সাদী মহম্মদের বাড়িটির সামনে একটি চালতা গাছ। সময়ের আঘাতে মলিন হয়ে গেছে রং। ক্ষয়ে গেছে অনেক কিছু। সেই জীর্ণ বাড়িটিকে যেন দ্বাররক্ষীর মতো পাহারা দিচ্ছে চালতা গাছটি। এই গাছের ছায়ায় হয়তো তিনি দাঁড়াতেন, পাতার ফাঁকে খুঁজতেন পাখির সুর। কারণ একটা জীবন সুরের খেয়া বাইতে বাইতেই যে কাটিয়ে দিলেন। বাড়ি লাগোয়া সড়ক। বড়জোর বিশ-পঁচিশ হাতের ব্যবধান। সড়কের ওপারেই কবরস্থান। যেখানে আম-কাঁঠালের ছায়ায় শুয়ে আছে শিল্পীর মাসহ কত কত মানুষ। জীবন থেকে মৃত্যুর দূরত্ব যেন এই একটি সড়ক। আর সাদী মহম্মদ সেই সড়ক পাড়ি দিলেন তানপুরা বাজাতে বাজাতে বুধবারের সন্ধ্যায়, সবার অলক্ষ্যে। ইফতার সেরে বসেছিলেন রেয়াজে। কে জানত, জীবনে শেষবারের মতো তানপুরায় সুর তুলছিলেন তিনি! তানপুরার বিষণ্ন সুরেই ডুব দিয়েছিলেন অনন্তযাত্রায়, স্বেচ্ছামৃত্যুর হাত ধরে। বাবা শহীদ সলিমউল্লাহ ও মা জেবুন্নেসা সলিমউল্লাহর কবরে শায়িত হলেন সংগীতশিল্পী সাদী মহম্মদ।

: মেলা প্রতিবেদক

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়