সাড়ে ৩ মাস পর কারামুক্ত আলাল

আগের সংবাদ

নির্বাচন নিয়ে বিদেশিদের কোনো প্রশ্ন নেই : সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী

পরের সংবাদ

ভাষা আন্দোলন এবং বাঙালি নারী

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ঘুম পাড়ানি মাসি-পিসি কিংবা আয় আয় চাঁদ মামা টিপ দিয়ে যা এর মতো মিষ্টি মিষ্টি সুরে মায়ের কণ্ঠে গাওয়া ছড়া গানের ভাষা হলো বাংলা ভাষা। এটি আদি ভাষা হিসেবেই পরিচিত। তথাপি যুগে যুগে দেশে দেশে এই ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করতে, নিজেদের ভাষা বলে রাষ্ট্রের কাছে মর্যাদা আদায় করে নেয়ার জন্য রক্তপাত ঘটাতে হয়েছে। তাই ভাষা আন্দোলন একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা বাঙালি জাতির জন্য। বাংলাদেশ এবং বাংলা ভাষা পাশাপাশি এই শব্দ দুটি মনে করিয়ে দেয় এক রক্ত ঝরার ইতিহাসকে। আর এই রক্তদানের সঙ্গে মিশে আছে আমাদের মা-বোনের সংগ্রাম ইতিহাস এবং জীবনদানের গল্প। আসলে পৃথিবীর কোনো আন্দোলন কখনোই বেগবান হয় না যতক্ষণ না নারীদের সহযোগিতা থাকে। এই সহযোগিতা সংগ্রাম-লড়াইয়ের ভেতর দিয়েই এ দেশে নারীরা নিজেদের জন্য একটি মর্যাদার স্থান করে নিয়েছে বহু যুগ আগেই। তথাপি এই ভাষা আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণের বিষয়টি সংগ্রামের সাধারণ ইতিহাসে খুব বেশি গুরুত্ব পায়নি।
ভাষা আন্দোলন প্রসঙ্গের শুরুতেই আমি চলে যেতে চাই ১৯৪৮ সালে সেখানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীতে পাই ‘ফেব্রুয়ারির ৮ই হবে, ১৯৪৮ সাল। করাচিতে পাকিস্তান সংবিধান সভার বৈঠক হচ্ছিল। সেখানে রাষ্ট্রভাষা কি হবে সেই বিষয়ে আলোচনা চলছিল। মুসলিম লীগ নেতারা উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষপাতী। কুমিল্লার কংগ্রেস সদস্য বাবু ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত দাবি করলেন বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করা হোক। কিন্তু মুসলিম লীগ সদস্যরা কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না। আমরা দেখলাম, বিরাট ষড়যন্ত্র চলছে বাংলাকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্রভাষা উর্দু করার। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ও তমদ্দুন মজলিশের প্রতিবাদ করল এবং দাবি করল, বাংলা ও উর্দু দুই ভাষাকেই রাষ্ট্রভাষা করতে হবে। তমদ্দুন মজলিস একটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান যার নেতা ছিলেন অধ্যাপক আবুল কাশেম সাহেব। যা হোক, সভায় ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চকে ‘বাংলা ভাষা দাবি’ দিবস ঘোষণা করা হয়। অর্থাৎ ১৯৪৮ সালেই ভাষা আন্দোলনের বীজ বোনা হয়েছিল। এবং তখনকার প্রেক্ষাপটে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল যে, ১১ মার্চ বাংলা ভাষা দাবি দিবস। এবং সেই সময় স্কুলের ছোট ছোট মেয়েদের আন্দোলনের একটি চিত্র বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীতে আমরা দেখতে পাই। তিনি লিখেছেন, ১১ মার্চ ভোরবেলা শত শত ছাত্রকর্মী ইডেন বিল্ডিং, জেনারেল পোস্ট অফিস ও অন্যান্য জায়গায় পিকেটিং শুরু করল। জেলের যে ওয়ার্ডে আমাদের রাখা হয়েছিল, তার নাম চার নম্বর ওয়ার্ড। তিনতলা দালান। দেয়ালের বাইরে মুসলিম গার্লস স্কুল। যে পাঁচ দিন আমরা জেলে ছিলাম সকাল ১০টায় মেয়েরা স্কুলের ছাদে উঠে স্লোগান দিতে শুরু করত, আর ৪টায় শেষ করত। ছোট্ট ছোট্ট মেয়েরা একটু ক্লান্তও হতো না। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই,’ ‘বন্দি ভাইদের মুক্তি চাই, পুলিশি জুলুম চলবে না’- এ রকম নানা ধরনের স্লোগান। এই সময় শামসুল হক সাহেবকে আমি বললাম, ‘হক সাহেব ওই দেখুন, আমাদের বোনেরা বেরিয়ে এসেছে। আর বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা না করে পারবে না।’ পাক শাসকরা সত্যিই পারেনি বাংলার মাটিতে অন্য ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করতে। রাজধানী থেকে শুরু করে গ্রাম-গঞ্জেও যখন একটি আন্দোলন ছড়িয়ে যায় তখন বোঝা যায় এর দুর্বার গতি। বোঝা যায় কতটা অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে একটি আন্দোলন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনটিও সেই গতির ছিল। নারীরা পুরুষের পাশে এসে দাঁড়িয়ে ছিল এবং পাকিস্তান আর্মি ও পুলিশদের মুখোমুখি হতে একটুও ভয় করেনি। ভয় করেনি পুলিশের তাক করা বন্দুকের নল। মায়ের ভাষাকে চিরদিনের করে পাওয়ার আকাক্সক্ষায় নারীরা মিছিল-মিটিং করেছে সামনের কাতারে থেকে। নারীরা পুলিশের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কি করে পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙেছে। ১৪৪ ধারা ভেঙে প্রথম এগিয়ে গেছে নারীরাই। ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্রীরা আহতদের চিকিৎসা দিয়ে ভাষা আন্দোলনে একাত্ম হয়েছে। আহত ছাত্রদের চিকিৎসার জন্য অন্য ছাত্রীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাঁদা তুলে নিয়ে এসেছে। রাতভর ব্যানার পোস্টার লেখার কাজেও নারীরা সহযোদ্ধার ভূমিকা পালন করেছে। পুলিশের তাড়া খাওয়া ছাত্রদের নিজেদের কাছে লুকিয়ে রেখেছে। মায়েরা নিজের অলঙ্কার তুলে দিয়েছে ছেলেদের হাতে। কারণ আন্দোলন মানে শুধুই মিছিল-মিটিং নয়। আন্দেলনের আনুষঙ্গিক অনেক খরচও থাকে। থাকা খাওয়া চিকিৎসা এ রকম আরো অনেক কিছু। সন্তানের সেই খরচ জোগাতে মায়েরা বিক্রি করেছেন তার শখের গহনাপত্র। ভাষা আন্দোলনে জড়িত হয়ে অনেক নারী হারিয়েছেন স্বামী সংসার। কেউ কেউ জেল জুলুমও সহ্য করেছেন। নারীদের কেউ আবার বহিষ্কৃতও হয়েছেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে।
আমরা জানি ১৯৫২ সালের ঐতিহাসিক একুশে ফেব্রুয়ারি পুলিশের ব্যারিকেড ভাঙার মূল কাজটিই করেছেন রওশন আরা বাচ্চু এবং তার সহপাঠী কয়েকজন। কারণ দশজন করে মিছিল বের হওয়ার প্রথম দুটি দলের অনেকেই গ্রেপ্তার হন। পরে ছাত্রীরা তৃতীয় দলে বেরিয়ে ব্যারিকেড ধরে টানাটানি শুরু করেন।
সেদিন পুলিশের লাঠিচার্জ ও টিয়ারশেলে অনেক ছাত্রী আহত হন। এদের মধ্যে ছিলেন রওশন আরা বাচ্চুু, বোরখা শামসুন, সারা তৈফুর, সুরাইয়া হাকিম, সুরাইয়া ডলি। মেয়েদের মোট আহতের সংখ্যা ছিল ৮ জন। ঢাকার বাইরে নারায়ণগঞ্জে নারীদের ভাষা আন্দোলনে একাত্ম হতে মমতাজ বেগমের লাঞ্ছনার কথা আমরা এখন অনেকেই জানি। তিনি কারা নির্যাতনের একপর্যায়ে সরকারের চাপে স্বামীর কাছ থেকে তালাকপ্রাপ্ত হন। মমতাজ বেগমের ছাত্রী ইলা বকশী, বেনু ধর, শবানীর মতো কিশোরীদেরও গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
সিলেট জেলার কুলাউড়ার মেয়ে সালেহা বেগম ময়মনসিংহ মুসলিম গার্লস স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্রী থাকাকালীন ভাষা শহীদদের স্মরণে স্কুলে কালো পতাকা উত্তোলন করেন। আর এই অপরাধে তাকে জেলার ডিসি তিন বছরের জন্য স্কুল থেকে বহিষ্কার করেন। পরে তিনি আর লেখাপড়া চালিয়ে নিতে পারেননি। এভাবে চট্টগ্রাম এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের এই একই চিত্র পাওয়া যায়। ফরিদপুর জেলার সুফিয়া আহম্মদ। লালমনিরহাট জেলার ড. শাফিয়া খাতুন। ছিলেন তেজস্বী নারী হামিদা রহমান। হামিদা রহমানের নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছিল ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ, তিনি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মিছিল বের করে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ ধ্বনিতে মুখরিত করেছিলেন চারদিক। তিনি ছেলেদের পোশাক পরে পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে যশোর কলেজের বৈঠকে যোগ দেন। পুলিশের ওয়ারেন্টের যন্ত্রণায় এক সময় তিনি আত্মগোপন করতেও বাধ্য হন। এছাড়াও পিরোজপুরের মেয়ে ডা. কাজী খালেদা খাতুন বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সময় কামরুন্নেসা স্কুলের ছাত্রী ছিলেন। জানা যায় যে, স্কুল ছাত্রছাত্রীদের সমাবেশে ২১-এ ফেব্রুয়ারি আমতলার সভায় তিনি বক্তব্য রেখে ছিলেন এবং পরে মিছিলে যোগ দেন। জুলেখা হক, গুলে ফেরদৌস, দৌলতুন্নেসা, ইডেনের ছাত্রী চেমন আরা, বেগম আনোয়ারা খাতুন, হালিমা খাতুন প্রমুখের বলিষ্ঠ নেতৃত্ব এবং সক্রিয় ভূমিকা পালনের খবর পাওয়া যায়। পাশাপাশি এটাও সত্য যে, আমাদের এই অতি প্রিয় বাংলা ভাষা মর্যাদা রক্ষার জন্য বায়ান্নর আন্দোলনে বিপ্লবের সঙ্গী ছিলেন বহু জানা-অজানা নারী। তাদের মধ্যে কিছুসংখ্যক নাম আমরা ধীরে ধীরে খুঁজে পেলেও কিছু হারিয়ে গেছে বিস্মৃতির অতলে। বাংলা ভাষা রক্ষার জন্য আন্দোলন পুরো দেশ অর্থাৎ অখণ্ড বাংলা ভাষাভাষীর সর্বস্তরের মানুষ উত্তাল হয়ে উঠেছিল বলেই আমরা অর্জন করেছি এই ভাষাকে। ধর্মীয় বাধা, সামাজিক বাধা, প্রাতিষ্ঠানিক ও রাষ্ট্রীয় বাধা অতিক্রম করে নারীদের এগিয়ে আসা কতটা সাহসের এবং কতটা দুঃসাধ্য ছিল তা আমরা এই সময়ে এসেও উপলব্ধি করতে পারি। তবে ভাষা আন্দোলনে নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণকে আমি মনে করি সচেতনতার প্রকাশ। পৃথিবীর ইতিহাসে ভাষার জন্য প্রাণ উৎসর্গ করেছে একমাত্র বাংলা ভাষাভাষী জাতি। বাঙালি জাতি। এই গৌরব একমাত্র আমাদেরই। আর এই আলোকোজ্জ্বল গৌরবের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে আছে নারীরাও। এই সত্যকে অবহেলা বা উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ নেই। একুশে ফেব্রুয়ারি তাই স্বীকৃতি লাভ করেছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা। তবে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির কথা আমাদের জানা থাকলেও আমরা অনেকেই জানি না বিভক্ত বাংলাদেশ আসামের কথা। আসামের বারাক উপত্যকায় তৎকালীন অবিভক্ত কাছাড় জেলার শিলচরে বাংলা ভাষাকে সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ের জন্য ১৯৬১ সালের ১৯ মে যে ১১ জন তরুণ বাঙালি আত্মাহুতি দিয়েছিলেন, তাদের মধ্যেও একজন ছিলেন নারী। কমলা ভট্টাচার্য। ১৬ বছরের এই তরুণী বাংলা ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে ভাষা শহীদ হিসেবে সমস্ত বাঙালি নারী সমাজের প্রতিনিধিত্ব করছেন বলেই আমি মনে করি। হোক সেটা আসামে। হোক সেটা ১৯৬১ সালে। ভাষার জন্য অকাতরে প্রাণ দেয়ার শিক্ষা, ভাষার জন্য লড়াই করার পাঠ কমলা ভট্টাচার্য নিয়েছিলেন ১৯৫২ সালেই। সুতরাং এ কথা বলাই যায় যে, বাঙালি হলো এমন এক জাতি যারা মাতৃভাষাকে রক্ষার জন্য ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সর্বোচ্চ উদাহরণ সৃষ্টি করতে পেরেছে। তাই আমি মনে করি, রক্তের বিনিময়ে পাওয়া আমাদের এই মধুর ভাষাটির সঠিক ব্যবহার হোক সবখানে। মানুষের মুখে মুখে ভাষার যে বিকৃতি আজ ঘটেই চলেছে, সে ব্যাপারে কঠোর হওয়ার সময় আবারো এসেছে। বাংলা ভাষা এবং বানানরীতিতে বারবার যে পরিবর্তন এ ব্যাপারেও সচেতনতার দরকার। বারবার বানান পরিবর্তনের ফলে মানুষ বিভ্রান্ত হচ্ছে। ফলে ভুল বানানের চর্চা হচ্ছে বেশি। অথচ কষ্টার্জিত এই বাংলাভাষার অবমাননা মেনে নেয়া মানেই ভাষা শহীদদের প্রতি অবমাননা বলেই আমি মনে করি। যা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে ভুল দিকনির্দেশনা দেবে।
১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি মহান ভাষা আন্দোলনের দীর্ঘ এই যাত্রায় নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জীবন বাজি রেখেছিলেন যেসব মহৎ প্রাণ নারী ও পুরুষরা, ইতিহাসের যুগ সন্ধিক্ষণে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে আমরা যেন তাদের স্মরণ করি। সঠিক মর্যাদা দিতে পারি। এই হোক আমাদের এবং আমাদের আগামী প্রজন্মের অঙ্গীকার। আর এই অঙ্গীকার বাস্তবায়নের মধ্য দিয়েই হবে সব ভাষা শহীদের আত্মার প্রতি আমাদের সঠিক মর্যাদা এবং সম্মান প্রদর্শন করা। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বীজ বপনে সাহসী অংশীদার এই বাঙালি নারীরা। ভাষা আন্দোলন ছিল যাদের সূচনা পর্ব। তাদের অবদান হোক সর্বজন স্বীকৃত। সম্মানিত।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়