আইজিপি : নির্বিঘ্নে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবেন

আগের সংবাদ

সুষ্ঠু নির্বাচনে জনগণের বিজয় > সাংবাদিক ও পর্যবেক্ষকদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সৌজন্য বিনিময় : ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ে তোলাই এখন লক্ষ্য

পরের সংবাদ

আমার হৈমন্তী

প্রকাশিত: জানুয়ারি ৮, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ৮, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

অফিস থেকে বাসায় ফিরতে আজ একটু দেরিই হয়ে গেল। বাবা-মা ঘুমিয়ে গেছেন। তাই আর ডাক দিলাম না।
‘নীরা, নীরা’। ঘরে ঢুকেই নীরার নাম ধরে ডাকা আমার অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। তবে আজ নীরা কোনো জবাব দিল না। ওহ্ হো, নীরা কীভাবে জবাব দেবে! সে তো বাসায় নেই। আজ সকালেই অফিসে যাওয়ার আগে নীরাকে ওর বাবার বাসায় নামিয়ে দিয়ে এসেছি। মেয়েটা অনেক দিন ধরেই বলছিল যাওয়ার কথা। কিন্তু আমার মা, মানে নীরার শাশুড়ি বউমাকে ছাড়া থাকতে পারেন না। এমন অবস্থা, যেন আমার চেয়েও মায়ের কাছে নীরাই বেশি আপন!
ফ্রিজ থেকে খাবার বের করে খেয়ে বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিয়েছি। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলাম নীরা এখনো মেসেজ দেয়নি। থাক, অনেক দিন পর বাড়ির সবার সঙ্গে সময় কাটাচ্ছে, আমিও আর বিরক্ত না করি।
এরপর চোখ পড়ল টেবিলের ওপর থাকা ডায়রিটার দিকে। আমাদের একটা কমন ডায়রি আছে। সেটাতে আমরা আমাদের বলতে না পারা কথাগুলো লিখি, আমাদের স্বপ্নের কথা লিখি। এটা আমাদের কাছে ভালোবাসার নিঃশব্দের শব্দ। ডায়রিটা খুলে দেখলাম নীরার লেখা একটা চিঠি। সম্ভবত কাল রাতে লিখেছে।
“খোলা হাওয়ায় উড়ো চিঠি লিখে গল্পের সূচনায় রূপোর আলিঙ্গন, ঊষার ক্ষণজীবনী শিশিরের স্পন্দনহীন ভালোবাসার উপসংহার। আর জীবন প্রাত্যহিকতায় অব্যক্ত অকুণ্ঠ ধ্বনির পুঞ্জ সাজিয়ে নন্দিত-নিন্দিত কুঞ্জবনে প্রজাপতির গুঞ্জরণ, নিখাদ হীরকের প্রফুল্ল দ্যুতি।
প্রহেলিকার সেই হীরার অনুরাগী আমি, উদয়াস্ত তোমার পাঁজরের তীব্র সুখ, অভিমান, ব্যথা আর আর্তনাদেও চিৎকার করে বলব- ‘ভালোবাসি’।
– তোমার হৈমন্তী।”
নীরাকে আমি একসময় হৈমন্তী বলে ডাকতাম। রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত ‘হৈমন্তী’ ছোটগল্পের অনুরক্ত হয়ে তো বটেই, পাশাপাশি এর অন্য একটি বিশেষ কারণও আছে। নীরার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছিল হেমন্তের আবির রাঙা সাঁঝের এক নিবদ্ধ প্রহরে। তার সারল্য, শান্ত-সৌম্য মুখশ্রী, স্থির পল্লব আমার হৃদয়ে হিল্লোল তুলেছিল। লাল বেনারসি আর মেরুন হিজাবে সে যেন সৌন্দর্যের অমরাবতী। হেমন্ত ঋতুর মতোই তার অনির্বচনীয় কল্যাণী রূপ, নেই তেমন উচ্ছ¡াস, নেই চপলতা। নীরবে এসে সে দিয়েছে পূর্ণতা। তাই দেখে সেদিন আমিও বলে উঠেছিলাম, ‘আমি পাইলাম, আমি তাহাকে পাইলাম।’
তখনো আমি চাকরি-বাকরি জুটাতে পারিনি। টুকটাক গল্প লিখে যা রোজগার হতো, পুরোটাই সঞ্চয় করতাম। সেই সঞ্চয়ের অর্থ দিয়ে নীরার জন্য ছোট ছোট খুশি কিনতাম।
দুঃসম্পর্কের এক আত্মীয়ের নিমন্ত্রণে নীরাকে নিয়ে গ্রামে গিয়েছিলাম গত অঘ্রাণে। প্রকৃতির খুব কাছাকাছি গিয়ে একসঙ্গে সূর্যোদয় দেখার উদ্দেশ্যে খুব ভোরে নীরাকে নিয়ে বাইরে বের হয়েছি। গ্রাম বলেই কিনা শীত একটু বেশিই লাগছে। কিছুক্ষণ পর মৃদু কুয়াশার বুক চিড়ে নতুন প্রভাতের সূর্যটা উঠে এলো। চিকচিক করে উঠল সবুজ ঘাস, পাতার প্রতিটি ফোঁটা। সেই শিশির ভেজা ঘাসের উপর দিয়ে নীরা যখন হেঁটে যাচ্ছিল, তার পায়েল পরা পায়ের প্রতিটি চিহ্ন যেন কল্পনাসুন্দর আলপনা এঁকে যাচ্ছিল। হেমন্তকন্যা বুঝি তার সঙ্গিনীকে চিনতে পেরেছে!
নিয়মতান্ত্রিক জীবনের বাইরে এসে বুকভরে নিঃশ্বাস নিতে সেদিন মাঝরাতে ছাদে বসে ছিলাম। আকাশের দিকে তাকিয়ে বিক্ষিপ্ত চিন্তার মাঝে হঠাৎ নীরা এসে হাজির।
‘আজ\ আকাশে কয়টা তারা?’
নীরার এমন উদ্ভট প্রশ্নে মোটেই অবাক হলাম না। তার এমন ঠাট্টা যে আমার ক্লান্তি আর পেরেশানি দূর করার টনিক, এটা সে জানে। আমি কোনো জবাব দিলাম না। সে আমার পাশে বসে কাঁধে মাথাটা রাখল।
‘এত রাতে তুমি এলে কেন?’
‘আপনার কাছে কবিতা শোনার জন্য। কতদিন হলো আপনি কবিতা শোনান না!’
‘তুমি কি আমাকে সারা জীবন আপনি বলেই ডাকবে?’
‘আমার আপনি বলতেই ভালো লাগে। দেখবেন হুট করে একদিন তুমি ডেকে ফেলব।’
চন্দ্রিমার সবটুকু আলো সেদিন উজাড় করে লেপ্টে দিয়েছিল রাতের বুকজুড়ে। একখানি শাল গায়ে জড়িয়ে নিদ্রাহীন গল্প করে চলেছি দুজন। হেমন্তের হিম ঝরে পড়ছিল ফুলের ঘ্রাণেও।
‘কই, কবিতা শোনালেন না যে!’ 
কিছুক্ষণ চুপ থেকে অতঃপর নীরার চোখের দিকে তাকিয়ে বলতে থাকলাম-
‘যখন নিঝুম রাত, জোছনা এসে ছুঁয়ে যায় তোমার গাল, আমার হিংসে হয়।
ধোঁয়া ওঠা গরম চায়ের কাপটা যখন আলতো করে ছুঁয়ে ফেলে তোমার কোমল ঠোঁট, আমার হিংসে হয়।
হিংসে হয় তোমার শত চঞ্চলা ভাবনার রংতুলিতে হারানো সময়গুলোর ওপর।
আমার হিংসে হয়, দখিন হাওয়ায় উড়তে থাকা তোমার অগোছাল চুলের অবাধ্য ঝাপটার ওপর।’
নীরা কোনো কথা বলল না। রাতের শেষে মায়ার পরশে অপার্থিব দাবি নিয়ে বলাই যায়- এই রাত আমার, এই চাঁদ আমার। তবে কি তা সত্যি আমার হয়ে যায়! আমার তো সেই, হাজার বছর সাধনার পর যাকে আমি পেয়েছি। তার মন, প্রাণ, শরীরজুড়ে শুধু আমি একা থাকতে চাওয়াটা ন্যূনতমও অনধিকার চর্চা নয়। সে যে একান্তই আমার সম্পদ। আমার প্রতিটি নিঃশ্বাসে মিশে যাওয়া সেই মায়াবতী, আমার হৈমন্তী। যে কাছে থাকলে অন্তত বলার মতো কয়েকটা কথা খুঁজে পাওয়া যায়। যাকে হারানোর ভয় করি প্রতি মুহূর্তে।
রাত অনেক হয়েছে। ডায়রিটা রেখে লাইটটা বন্ধ করে দিলাম। কিন্তু নীরাকে ছাড়া কিছু ভালো লাগছে না। এই ঘরের প্রতিটি বিন্দুকণায় লেগে থাকা তার স্পর্শ ক্রমেই ব্যাকুল করছে তার শূন্যতায়। আর অস্থির লাগছে আরেকটি কথা ভেবে। রবী ঠাকুরের সেই ছোটগল্পের মতো আমার হৈমন্তীও যদি কখনো তিনাঞ্জলি বলে দেয় এই মায়ার বাঁধনকে। ভাবতেই মুখটা বিষণ্ন মলিন হয়ে গেল।
জীবনের রাস্তায় চলতে চলতে কারো সঙ্গে অনেকটা পথ চলে আসার পর তার হাত ছেড়ে দেয়াটা খুব কঠিন। তার সঙ্গ ছাড়া বাকি পথটা চলা, আরো বেশি কঠিন।

:: বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়