চিনি আমদানিতে শুল্ক কমলো অর্ধেক

আগের সংবাদ

বাজারের আগুনে অবরোধের ইন্ধন : নতুন করে প্রভাব পড়েছে চাল সবজি মাছের বাজারে, উত্তাপ বেড়েছে গরম মসলার

পরের সংবাদ

মাহবুব : হার না মানা সম্প্রদায়ের মানুষ

প্রকাশিত: নভেম্বর ৩, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ৩, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

জীবন যখন এগোবার একটা রাস্তা তৈরি করে দেয়। কখনো সরু, কখনো চওড়া, কখনো উঁচুনিচু হোঁচট খাওয়ার, কখনো মসৃণ বা পিচ্ছিলতার বাঁকে বাঁকে নানা মানুষজনেরও দেখা পাই। তারা পাশে চলে, হাত ধরে, এক সময় হাত ছেড়ে দূরে চলে যায়, কিন্তু মনের মধ্যে তাদের ছবি জেগে থাকে। ভালোবাসার ছবি, প্রশংসা ও শ্রদ্ধা মেশানো মমতার ছবি। তারা আমার আপন ঘনিষ্ঠ বৃত্তে মধ্যে এস চিরকালের জন্য আশ্রয় নেয়।
মাহবুব আমার জীবনে এই রকমই একটি মানুষ। তার সঙ্গে এক ঘরে বসে কাজ করার গভীর আনন্দ যাপন করেছি সে অনেকদিন হলো, এখন আর নিয়মিত যোগাযোগও নেই। তবু সে আমার খুব কাছের মানুষ হয়ে আছে। শুধু তার পাণ্ডিত্যে বা প্রতিষ্ঠায় নয়। শুধু সে এক কেন? তার সহধর্মিণী সালেহা, তার পুত্র ও কন্যারা সবাই আমার আপন মানুষ। দূর থেকে মাহবুবের শারীরিক সমস্যার কথা শুনে উদ্বিগ্ন থাকি, আমার জ্যেষ্ঠ কন্যাকে নিয়ে ২০২২-এর অক্টোবরে চট্টগ্রামে গিয়ে একবার দেখাও করে এলাম তার বাড়িতে, বিপুল ভোজন আর আপ্যায়নের সুস্বাদ গ্রহণ করে।
তার ৭৫ বছর পূর্ণ হচ্ছে, সে জীবনের এক সন্ধিক্ষণ বটে; কিন্তু আমরা সবাই চাই এই বছরের হিসাব পার হয়ে সে আরো অনেক অনেক বছর আমাদের মধ্যে সক্রিয় থাকুক, তার জ্ঞান, কর্ম ও জীবন-নির্মাণের সাধনা নিয়ে। তার বহুমুখী পাণ্ডিত্যের বিষয়ে বলার সমস্ত সামর্থ্য যে আমার আছে তা নয়। তার সাহিত্য সমালোচনা, তার ব্যাকরণজ্ঞান, তার লোকসংস্কৃতি আর লোকসাহিত্যে গভীর প্রবেশ, তার রুশ দিগন্তে পরিক্রমা- এ সব নিয়ে আমার টুকরো-টাকরা ধারণা আছে, সব ক্ষেত্রেই তার কাজ উচ্চাঙ্গের, নিখুঁত, সর্বাঙ্গীণ- এই পর্যন্ত বলতে পারি। আমি অন্যান্য বাঙালি পাঠকের মতো তার অনেক বই পড়ে সমৃদ্ধ হয়েছি।

দুই.
মাহবুবের সঙ্গে আমার পরিচয় সম্ভবত এই শতাব্দীর গোড়াতে, যাদবপুরে এসে সে আমার সঙ্গে দেখা করেছিল। এসব ব্যাপারে আমার স্মৃতি আমার বশে থাকে না। সে কি টুলুর (ত্রিদিনের) সঙ্গে তার গবেষণার বিষয়ে আমার সঙ্গে কথা বলতে এসেছিল? এ ব্যাপারে বৃত্তান্তের জন্য তার স্মৃতি আমার চেয়ে অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য হবে। সে আমার সম্বন্ধে অনেক খবরই রাখত দেখে খুশি হয়েছিলাম, বিশেষ করে ব্যাকরণ-চিন্তায় তার ও আমার ভাবনার মিল আমাকে উৎসাহিত করেছিল। আমি তখনই জেনেছিলাম যে সে পাঠ্যপুস্তক ও ব্যাকরণ নিয়ে অনেক কাজ করেছে এবং পত্রিকা ও টেলিভিশনে ব্যাকরণ ও বানান নিয়ে নিয়মিত বলে।
তারপর তো এক সঙ্গে কাজ করারই একটা চমৎকার সুযোগ জুটে গেল। ২০০৯ সালে আমি ঢাকায় আহমদ শরীফ স্মারক বক্তৃতা দিতে আমন্ত্রিত হওয়ায় বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক প্রয়াত বন্ধুর শামসুজ্জামান খান প্রমিত বাংলা ব্যাকরণের গতিপ্রকৃতি কেমন হওয়া উচিত- এ বিষয়ে একটি আলোচনাচক্রে আমাকে জুড়ে নিলেন। সেই আলোচনা থেকেই তিনি, সম্ভবত একটি প্রমিত বাংলা ব্যাকরণ প্রস্তুত করার পরিকল্পনার দিকে এগোলেন। আমার এই বর্ণনার ধারাবাহিকতা ঠিক আছে কি না জানি না, এ ব্যাপারেও আমি মাহবুবের স্মৃতির ওপর নির্ভর করব। জামান ভাই আনিস ভাই ও একাডেমির অন্যদের নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির রবীন্দ্র-ওকাকুরা ভবনে এসেও একটি আলোচনা করেছিলেন, তাতে এই বাংলারও অনেক ব্যাকরণবিদ অংশ নিয়েছিলেন। যাই হোক, এর যোগফল এই দাঁড়ায় যে, অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম আর আমি প্রমিত বাংলা ভাষার ব্যাকরণের যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হই। এটি আমারও বিদ্যাজীবনের একটি বড় ধাপ।
স্থির হয়ে যে, ঢাকায় বাংলা একাডেমির কার্যালয়ে ‘ওয়ার্কশপ মোডে’ কাজটি হবে। আমি বছরে চার-পাঁচবার ঢাকায় গিয়ে তিন সপ্তাহের জন্য থানা গাড়ব, আর একাডেমিতে গিয়ে ব্যাকরণ-নির্মাণের তত্ত্বাবধান করব রফিক ভাইয়ের সঙ্গে। আমার সঙ্গে নানা রকম সহযোগিতার জন্য যাবেন কলকাতার তরুণ ভাষাবিজ্ঞানী রাজীব চক্রবর্তী, যার কম্পিউটারে দখল আমাদের বিশেষ কাজে লেগেছে। ফলে ২০১০-এর মাঝামাঝি থেকেই আমাদের ঢাকায় যাতায়াত শুরু হয়ে গেল। আমরা থাকতাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান-উৎকর্ষ কেন্দ্রের অতিথিশালা ‘সেন্টার ফর এক্সসেলেন্স’-এ। সেখান থেকে সকাল ৮টায় একাডেমিতে হাজিরা আর কাজ চলত রাত ৭টা-৮টা পর্যন্ত। তাতে চা, জলখাবার, দ্বিপ্রাহরিক ভূরিভোজন, বিকেলের জলখাবার, কখনো রাত্রের ডিনার- সব কিছুরই এলাহি বন্দোবস্ত ছিল। প্রকল্প-পরিচালক প্রয়াত ড. আবদুল ওয়াহাব ছিল সদা মনোযোগী, আর একাডেমির দুটি মহিলা আধিকারিক রুমানা আর সায়রা প্রæফ সংশোধনসহ চারপাশের নানা কাজ নিখুঁতভাবে নিষ্পাদন করত। এটা মোটেই কঠোর কাজের রুটিন ছিল না। হাসি-ঠাট্টা-গল্প-গুজব, রফিক ভাইয়ের চমৎকার সব মজাদার স্মৃতিকথা, বিকেলে বাংলাদেশের ডাকসাইটে বুদ্ধিজীবীদের উঁকি মারা ও আড্ডা- তাতে একটা বিচিত্র রসায়ন তৈরি করত, আমাদের কাজের শক্তি আর উৎসাহ যেন বাড়িয়ে দিত। আমাদের সম্পাদিত চূড়ান্ত কপিগুলো আল আমীন বলে একটি ছেলে কম্পিউটার নিখুঁত দক্ষতায় তুলে নিত। দুখণ্ডের পাণ্ডুলিপি টাইপ শেষ করে সে বলেছিল, ‘প্রায় বারোশ পৃষ্ঠা টাইপ করলাম, কিন্তু একটা বর্ণও বোঝলাম না!’
সেখানেই একাডেমি-নির্বাচিত সহকারী সম্পাদক হিসেবে পেলাম তিনজনের একটা চমৎকার দল মাহবুব, স্বরোচিষ সরকার, জীনাত ইমতিয়াজ আলী। পরে হাকিম আরিফ আর রাজীব চক্রবর্তীও সহযোগী হবেন। মাহবুব ছাড়া প্রথম তালিকার বাকি দুজনও নিজের নিজের ক্ষেত্রে বহুল খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, এবং তাদের সবার সাহচর্যেই আমার জীবন সমৃদ্ধ হয়েছে আমি অন্যত্র সবাইকে নিয়ে লিখেওছি (আমার ‘অল্প পুঁজির জীবন’ আর নানা প্রবন্ধ দ্র.)। কিন্তু এখানে মাহবুবের কথাই বিশেষ করে বলি।
আমি মাহবুবের মতো এত সদা-প্রস্তুত মানুষ আর দেখিনি। তার বহুমুখী পড়াশোনা, যা সে এখনো অক্লান্তভাবে চালিয়ে যাচ্ছে, আমাকে বিস্মিত করেছে। কিন্তু পড়াশোনার বাইরেও জীবনের নানা তুচ্ছ জিনিস, যা আসলে তুচ্ছ নয়, তার সমান মনোযোগ পায়। সে সবসময় একটা সাইড-ব্যাগ বহন করত, তাতে কী যে ছিল না ঠিক নেই। সুঁচ, সুতো, ছুরি, কাঁচি, একটা স্কেল, স্টেপলার সুদ্ধ আরো সব হাজারো জিনিস। বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের কমিটি রুমের শীতাতপ-নিয়ন্ত্রিত পুরনো কক্ষ এখনকার মতোই তার অফিসের লাগোয়া, কিন্তু আমাদের অফিসে ঢোকবার দরকারই হতো না ও সব তুচ্ছ কিন্তু কাজের জিনিসের জন্য। মাহবুব সব হাতের কাছে এগিয়ে দিত।
আগেই ঠিক হয়ে গিয়েছিল যে, কাকে দিয়ে কোনো বিষয়ে লেখানো হবে। ঢাকার ভাষাবিজ্ঞানীরা প্রায় সবাই এই কাজে সানন্দে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু সবার তাত্ত্বিক দীক্ষা এক ছিল না, শৈলীও আলাদা ছিল। মাহবুব আর স্বরোচিষের কাজ ছিল ওই ভাষাশৈলীর যথাসম্ভব সমতা আনার। এ কাজটা সহজ নয়। দুজনেই ল্যাপটপ নিয়ে বসে এই কাজটা নিখুঁতভাবে করত। সে আমাদেরও শৈলীর ব্যাপারে শাসন করত, বলত, ‘স্যার, লেখা যতটা সম্ভব নৈর্ব্যক্তিক হয় ততই ভালো, ‘আমার মতে’ না লিকে ‘আমাদের মতে’ লিখবেন, আর না হয় ‘আমি’র গন্ধ সম্পূর্ণ বর্জন করবেন, বলবেন, ‘এ রকম বলা হয়ে থাকে’ বা সোজা সিদ্ধান্তটা দিয়ে দেবেন।’ কর্তৃবাচ্যের বদলে ভাববাচ্য ব্যবহার করবেন। তখন আমরা হয়তো তাদের এই নিটপিটানি নিয়ে আড়ালে একটু হাসাহাসি করতাম, কিন্তু প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য লেখা ব্যাকরণে যে একটা বিদ্যায়তনিক গাম্ভীর্য থাকা দরকার, তা অস্বীকার করি কী করে। এই দুজনের খুঁটিনাটির প্রতি নজরে আমরা বিস্মিত হতাম। তার দ্বারা ওই ব্যাকরণের শৈলী ও ভাষা অনেক সমৃদ্ধ হয়েছে সন্দেহ নেই।

তিন.
শেষে ব্যাকরণ বা বিদ্যার সঙ্গে জড়িত নয়, এমন একটা মজার ঘটনা বলি। একদিন দুপুরে লাঞ্চের জন্য ঠিক করা হলো পুরান ঢাকার বিখ্যাত ‘নিরব’ হোটেলে খেতে যাওয়া হবে। রফিক ভাই আর জামান ভাই খাওয়াদাওয়ার ব্যাপরে খুবই উৎসাহী ছিলেন। আমরা শুনলাম, সেখানে পদের যেমন বৈচিত্র্য আছে, রান্নাও তেমনই চমৎকার। লোকে জায়গার জন্য লাইন দিয়ে অপেক্ষা করে নাকি। যাই হোক, আমাদের সঙ্গে জামান ভাই আর রফিক ভাইয়ের মতো ভিভিআইপিরা ছিলেন, আমরা পৌঁছানো মাত্রই সেবকরা হামলে পড়ে দুটো টেবিল আমাদের জন্য খালি করে ফেলল।
কিন্তু স্বরোচিষের ঘোরতর আপত্তি ছিল এই হোটেলে খাওয়ার, কারণ তার নামের বানানটা ভুল। আমরা যারা বানান আর ব্যাকরণ নিয়ে কাজ করি, তার মতে আমাদের ওখানে খাওয়া উচিত হবে না। কিন্তু রফিক ভাই তার শিক্ষকের মতো, তার ধমকধামকে সে দ্বিধা নিয়ে রাজি হলো। আমরা মাহবুবকে তার সঙ্গে লাগিয়ে দিলাম, দেখতে, যেন সে ঠিকঠাক খায়। সেখানে পদের পর পদ আসতে লাগল, …সবজি, ডাল, করলাচিংড়িসহ নানা মাছের পদ, মাংস আর মেটের ঝাল পর্যন্ত। মাহবুব সবই স্বরোচিষের দিকে পরম যতেœ এগিয়ে দিয়েছে এবং পরে তাকে জিজ্ঞেস করে জেনেছি যে স্বরোচিষ সব পদের প্রতিই সুবিচার করেছে। হোটেলের বানান ভুলের প্রভাব তার উপরে আর বেশিক্ষণ ছিল না।
সেদিন মাহবুব আমাদের ব্যাকরণ-কারিগরদের সংহতি রক্ষায় খুব সাহায্য করেছিল।

চার.
এখন আমাদের সেই দলের অনেকেই ভাষা, বানান, ব্যাকরণ আর খাওযাদাওয়ার পৃথিবী পার হয়ে অন্য কোথাও চলে গেছেন। সর্বনেশে করোনা ছিনিয়ে নিয়েছে আনিস ভাই, রফিক ভাই আর জামান ভাইকে। এমনকি বয়সে অনেক ছোট প্রকল্প পরিচালক আবদুল ওয়াহাবও বিদায় নিয়েছেন। আমি ওদের চেয়ে বয়সে এগিয়ে, আমি ঠুকঠুক করে চলছি। মাহবুব নিজে স্বাস্থ্য ইত্যাদি সম্বন্ধে অনেক সচেতন ছিল, তাকে অপ্রত্যাশিতভাবে নানা উপসর্গ আক্রমণ করেছে। কিন্তু সে হার-না-মানা সম্প্রদায়ের মানুষ, আমি জানি সে সচেতন আর সক্রিয়ে জীবন নিয়ে তার অগণিত ছাত্রছাত্রী, পাঠকপাঠিকা আর আমাদের মতো তার গুণমুগ্ধ মানুষদের আরো বহু বছর সঙ্গ দেবে। আমি তাকে কতদিন সঙ্গ দিত পারব তা অবশ্য অনিশ্চিত। তবু যেটুকু সঙ্গ পেলাম, দিলাম তার মূল্য কোথাও একটা থেকে যাবে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়