সম্পাদক পরিষদ : সাংবাদিক নির্যাতনের হাতিয়ার সাইবার নিরাপত্তা আইন

আগের সংবাদ

বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন চায় যুক্তরাষ্ট্র : সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী

পরের সংবাদ

টোপ

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২২, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: সেপ্টেম্বর ২২, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

তিন দিন আগে শিউলীমালা বাপের বাড়ি গিয়েছিল, আজ ফিরছে। তার সঙ্গে তার সাত বছরের ছেলে মানিক মিয়া। বাপের বাড়িতে নাইওর গিয়েছিল বলা যাবে না। তার চেয়ে বলা ভালো উপযাচক হয়েই গিয়েছিল। শিউলীমালার বাপ তাদের গ্রামের হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। সেটা ব্রিটিশ আমলের কথা। গ্রামের চাষার মেধাবী ছেলে আব্দুল হালিম পড়তে গিয়েছিল কলকাতায়। সেখান থেকে ইতিহাস বিষয়ে এমএ করে তার ধারণা হয়েছিল, তার মতো মেধাবী মানুষ কি ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের চাকরি করতে পারে? যেহেতু তার বাপ-দাদারা সবাই ছিলেন চাষাভুষা, কাজেই তারা কেউ প্রতিবাদ করলেন না। তারা বিনা বাক্য ব্যয়ে সায় দিলেন- ‘তাইতো! কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএ! তার কি আর ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হলে চলে!’ যেখানে তার এক শ্যালকই বিএ পাস করে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটগিরি করছে! আব্দুল হালিমের তো নিদেনপক্ষে প্রেসিডেন্ট হওয়া লাগে! এই করে করে আব্দুল হামিদ ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হলেন না। এরপর নাকি তিনি ভারত সরকারের আবগারি শুল্ক বিভাগের পরিদর্শকের চাকরিও পেয়েছিলেন। ঘুষ খাবার ভয়ে নাকি সেই চাকরিও তিনি করেননি। তাহলে কি আর করা, তিনি তার বাপের জমি-জিরাত বিক্রি করে গ্রামেই একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করলেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি সেই স্কুলেরই প্রধান শিক্ষক ছিলেন। এর মাঝে একবার তিনি নাকি গ্রামের মানুষের অনুরোধ ফেলতে না পেরে ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচনও করেছিলেন। কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীদের চক্রান্তে পাস করতে পারেননি। সেই ষড়যন্ত্রকারীদের চক্রান্তে পরাস্ত হয়ে তিনি অল্প বয়সেই মৃত্যুবরণ করলেন। ষড়যন্ত্রকারীরা নাকি তাকে বাণ মেরেছিল।
এসবই আব্দুল হালিমের পারিবারিক লোকজনের ভাষ্য। বাজারে অবশ্য আরেকটি ভাষ্যও প্রচলিত আছে। সে বিষয়ে আর গেলাম না। আমাদের গল্পের সঙ্গে তার কোনো সংযোগ নেই। আব্দুল হালিমের মৃত্যুর পর তার স্ত্রী রাবেয়া খাতুন মহাবিপদে পড়লেন। বাচ্চাকাচ্চার একটা ফুটবল টিম নিয়ে প্রায় না খেয়ে থাকার জোগাড়। যদিও তাদের ধারণা ছিল তারা বিশাল বনেদি পরিবার, সমগ্র উপজেলায় তাদের বিরাট নামডাক। তাদের পিতাকে সবাই এক নামে চেনে। কথাটি আবার মিথ্যা না। কলকাতার এমএ, তাকে তো একনামেই চিনবে। ব্যস, সত্য বলতে কেবল এটুকুই ছিল। বাকিটা আত্মপ্রসাদ। সেই আত্মপ্রসাদ ভাতের অভাবে পালিয়ে গেল। আব্দুল হালিম এবং রাবেয়া খাতুন দম্পতির বড় ছেলে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেই কেরানিগিরিতে যোগদান করল। অভাব কিছুটা ঘুচলেও, তাতে তো আর স্বাচ্ছন্দ্য আসে না। রাবেয়া খাতুন তার অল্প বিদ্যায় সহজ সমাধানে এগোলেন এবং বিশ্বাস করতে লাগলেন এর চেয়ে জ্ঞানী সিদ্ধান্ত আর কেউ নিতে পারত না। মেয়েগুলো কেবল মাত্র উচ্চ মাধ্যমিকে ঢুকতেই প্রথম যে বিয়ের প্রস্তাবটি আসত, রাবেয়া খাতুন সেখানেই মেয়েদের পাত্রস্থ করলেন এবং মেয়ের বিষয়ে ভুলে গেলেন।
এই রাবেয়া খাতুনেরই মেয়ে শিউলীমালা। শিউলীমালার বিয়ে হয়েছিল পাশের উপজেলার আব্দুল গফুরের সঙ্গে। আব্দুল গফুর আবার এমএ পাস। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামের ইতিহাসে এমএ। এই এমএ ডিগ্রি দেখেই রাবেয়া খাতুন রাজি হয়ে গেলেন। মেয়ের বাপও এমএ পাস, জামাইও এমএ পাস। কী আনন্দ আকাশে-বাতাসে! কিন্তু সেই আনন্দ বেশি দিন রইল না। জামাই তো বেকার! বেকার না হয়ে যাবে কোথায়? দেশ স্বাধীন হয়েছে দশ বছরও হয়নি। কোনো কলকারখানা, অফিস-আদালত সেভাবে গড়ে ওঠেনি। গরিব দেশ, চাকরির বাজার নেই। চাকরি বলতে কেবল সরকারি চাকরি আর ব্যাংকের চাকরি। তাও আবার বছরে-দুই বছরে একটা নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। এই ডামাডোলে আব্দুল গফুর চাকরি পাচ্ছিল না।
আব্দুল গফুরের পিতার মৌলভী মোহাম্মদ ইদ্রিস অনেক আশা নিয়ে ছেলেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়েছিলেন। তারও ছিল বাচ্চাকাচ্চার একটা ফুটবল টিম। জমি-জিরেত তেমন কিছু ছিল না। গ্রামের মসজিদে ইমামতি করে কিছু টাকা পেতেন, সঙ্গে অল্প জমির স্বল্প আয় দিয়ে কোনোরকমে খেয়ে না খেয়ে বছরটা পার হয়ে যেত। তার একমাত্র সম্ভাবনার আলো হয়ে ছিল আমাদের আব্দুল গফুর। পাস করে চাকরি-বাকরি না পেয়ে আর ঢাকায় টিকতে পারল না আব্দুল গফুর। গ্রামে ফিরে এলো। বেকার ছেলে শূন্য হাতে গ্রামে ফিরে আসায় মৌলভী মোহাম্মদ ইদ্রিস আহাম্মক বনে গেলেন, আর আব্দুল গফুর বনে গেল বেকুব। বিশ্ববিদ্যালয় পাস দিয়ে এসে চাকরি না পেলেও আব্দুল গফুর তো অনেক কেতা শিখে এসেছিল। তাকে প্যান্ট-শার্ট পরতে হতো, বিড়ি-সিগারেট খেতে হতো, প্রতিদিন না হোক দুই-তিন দিনে একবার দাঁড়ি কামাতে হতো। হাজার হোক সে তো আর কামলাদের মতো লুঙ্গি পরে চলাচল করতে পারে না! কিন্তু প্রতিটি বিষয়ের জন্যই তো তাকে মৌলভী মোহাম্মদ ইদ্রিসের কাছে হাত পাততে হতো। সেই বাজে অবস্থা থেকে বেরুবার জন্য আব্দুল গফুর চেষ্টার কোনো কমতি করেনি, কিন্তু কী করবে? দেশে চাকরি তো থাকতে হবে! এর মধ্যে সে রসুলপুর ফাজিল মাদ্রাসায় প্রভাষক হিসেবে চাকরি পেয়ে গেল। দুই-তিন মাস চাকরি করার পরও কোনো বেতন পেল না। প্রিন্সিপালের সঙ্গে দেখা করলে তিনি নানা অজুহাত দেন, ছাত্ররা বেতন দিচ্ছে না ইত্যাদি। দেখি, আগামী মাসে একটা ব্যবস্থা করব নে ইত্যাদি। কয়েক মাস পর পর আব্দুল গফুর ভেঙে ভেঙে বেতন পেতে লাগল, আজ একশ কাল পঞ্চাশ ভিত্তিতে। এদিকে সরকারি চাকরির কোনো বিজ্ঞাপন নেই, কোনোদিন হবে সেই সম্ভাবনাও নেই। দেখতে দেখতে আব্দুল গফুরের চাকরির বয়স চলে গেল। কাজেই তাকে মাদ্রাসার শিক্ষকতাই করতে হবে, এটাই সে মেনে নিয়েছিল। মাদ্রাসা থেকে যে ক’টাকা সে পেত তা দিয়ে তার নিজের হাত খরচই চলত না, কাজেই বাপের সংসারে সে কোনো অবদান রাখতে পারছিল না। এ নিয়ে পিতার সঙ্গে, মায়ের সঙ্গে খিটিমিটি লেগেই থাকত।
মৌলভী মোহাম্মদ ইদ্রিস পুত্রের কাছে অর্থকড়ি আশা করতেন, তাতে তো তার দোষ দেয়া যায় না। তথাপি পিতার দায়িত্ব তিনি ভুলে যাননি। ছেলের বয়স হয়ে যাচ্ছে দেখে তিনি পাত্রী দেখায় নেমে গেলেন। একসময় পেয়ে গেলেন শিউলীমালাকে। কন্যা সুশ্রী, উচ্চ মাধ্যমিক পাস, ডিগ্রির ছাত্রী, বিশাল বনেদি পরিবার, কাজেই মৌলভী মোহাম্মদ ইদ্রিস চোখ বন্ধ করে রাজি হয়ে গেলেন। বিয়ের পর শিউলীমালা যখন শূন্যহাতে শ্বশুরবাড়ি উঠে এলো, মৌলভী মোহাম্মদ ইদ্রিস দ্বিতীয় দফা আহাম্মক বনে গেলেন। যদিও বিয়েতে তাদের কোনো ডিমান্ড ছিল না, তথাপি বনেদি ঘরের মেয়ের সঙ্গে নিদেনপক্ষে মেয়ের গা ভর্তি গহনা, দু’একটা আসবাবপত্র ছেলের বাড়িতে আসবে তাতো সে সময় স্বাভাবিকই ছিল। মেয়ের বাড়ির বনেদিপনা বাস্তবে অনুদিত না হওয়ায় মৌলভী মোহাম্মদ ইদ্রিস মুষড়ে পড়লেন, শিউলীমালার শাশুড়ি আঙ্গুরী বেগম হলেন হতাশ। বিয়েতে শিউলীমালা একটি গহনাই পেয়েছিল, আঙ্গুরী বেগমের একটি সোনার চেইন। মেয়েকে যেহেতু বাপের বাড়ি থেকে কিছুই দেয়া হয়নি, সেই রাগে আঙ্গুরী বেগম সেই সবেধন নীলমণি সোনার চেইনটিও শিউলীমালার কাছ থেকে কৌশলে কেড়ে নিলেন।
শিউলীমালার জীবনে নতুন বাস্তবতার সূচনা হলো। একজন বিবাহিত মেয়ের কত কিছু লাগে। প্রতিটির জন্যই আব্দুল গফুরকে মৌলভী মোহাম্মদ ইদ্রিসের কাছে হাত পাততে হয়। নব দম্পতির প্রেম গড়ে ওঠার আগেই ফুরিয়ে গেল। সমস্যা এতটা প্রকট হতো না, সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করার অন্যতম কারণ শিউলীমালার বনেদি বাড়ির ইতিহাস। শিউলীমালা বৈবাহিক সূত্রে শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে হালিখানেক দেবর আর হালিখানেক ননদ পেয়েছিল। রান্নাটা তো আমাদের বাড়ির মতো হয় না, তরকারিতে তো এরা দেখি বেশি ঝাল খায়, এদের বাড়িতে তো কোনো পুকুর নেই। পুকুর ছাড়া বাড়ি, সে আবার কোনো বনেদি বাড়ি হতে পারে নাকি! অচিরেই শিউলীমালা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলো যে, তার শ্বশুরবাড়ির লোকরা তাদের বাড়ির মতো বনেদি নয়। এই উপসংহার সে আবার নিজের ভেতর চেপে রাখল না, উচ্চস্বরে দিগি¦দিক প্রচার করতে লাগল। কিন্তু বাড়ির লোকরা সে কথা মানবে কেন? বনেদি বাড়িই যদি হয়ে থাকে তাহলে শিউলীমালাকে তার মা-ভাইয়েরা কেন শূন্য হাতে শ্বশুরবাড়ি পাঠাল? এটা আবার কোন ধরনের বনেদি? ইত্যাদি নানা বিতর্ক কিছুদিন পরপরই মৌলভী মোহাম্মদ ইদ্রিসের বাড়ির পরিবেশ বিষণ্ন করে তুলতে লাগল।
আব্দুল গফুর পড়লো মহাসমস্যায়। সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য সে তার সর্বস্ব নিয়োজিত করল, কিন্তু ফলাফল শূন্য। দুটি টাকা উপার্জনের কোনো পথ সে করতে পারল না। একদিকে পিতার চাপ, অন্যদিকে স্ত্রীর চাপে সে পিষ্ট হওয়ার জোগাড়। দিনকে দিন সুন্দরী শিউলীমালা মুখরা হতে লাগল। একসময় সে বুঝে গেল, সব সমস্যার জন্যই তার স্বামী আব্দুল গফুর দায়ী। তার চোখে কেবল আব্দুল গফুরের দোষ ধরা পড়তে লাগল। আব্দুল গফুর আনস্মার্ট, আব্দুল গফুর চালাক নয়, আব্দুল গফুর মানুষের সঙ্গে মিশতে পারে না, আব্দুল গফুরকে কেউ পাত্তা দেয় না, কোনো কিছু করার ক্ষমতা আব্দুল গফুরের নেই, আব্দুল গফুর সঠিকভাবে কাপড়-চোপড় পরতে পারে না, যে কেউ তাকে দেখলেই বুঝতে পারে সে একটি আহাম্মক, তার আরো অনেক ভালো বিয়ে হতে পারত, আব্দুল গফুর তার মতো সুন্দরী মেয়ের জীবন নষ্ট করেছে, ইত্যাদি নানা বাক্যবাণ বিভিন্ন সময়ে সে আব্দুল গফুরের ওপর প্রয়োগ করতে লাগল।
আব্দুল গফুর শুনত, কিছু বলত না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাস করা একজন লোকের স্মার্টনেস যদি উচ্চ মাধ্যমিক পাস মুখরা তরুণীর বিচার্য বিষয় হয়ে ওঠে, তাহলে তো দোষ আব্দুল গফুরেরই। আব্দুল গফুর মেনে নিয়েছিল। তবে সবসময় মাথা ঠিক থাকত না, মাঝে মাঝে আব্দুল গফুরের মনে হতো একটা থাবড়া মেরে এই মুখরা রমণীকে অজ্ঞান করে করে ফেলে। সে বুঝত বউকে থাবড়া মারা যদিও ভালো নয়, থাবড়া সবাই মারতে পারে না, তার জন্যও যোগ্যতা লাগে। অবশ্য সব সময়ই যে এ রকম হতো তা তো আর না। যখন সময় ভালো যেত তখন তারা তাদের বাড়ির পেছনের ফল বাগানের জলপাই গাছ থেকে জলপাই পেড়ে ভর্তা করে খেত, শিউলীমালা লিচুগাছের ডালে বসে লিচু পেড়ে ছিলে ছিলে আব্দুল গফুরকে খাওয়াত। সেইসব সুসময়ের ফলাফল হিসেবেই কিছুদিন পরে তাদের ঘর আলো করে আবির্ভূত হলো মানিক মিয়া। নতুন নতুন কয়েকদিন নানা আধিখ্যেতা হলো, তারপর যে কে সেই। তথাপি দিনকে দিন পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছিল। প্রতিবেশী সবাই জেনে গেল, আব্দুল গফুরের বউ বিরাট বনেদি পরিবারের মেয়ে, ভাগ্যদোষে মৌলভী মোহাম্মদ ইদ্রিসের সংসারে এসে ভাত-কাপড়, তেল-সাবানের সমস্যায় পড়েছে। এই প্রচারে শিউলীমালার কোনো লাভ হলো না, বরং হিতে বিপরীত হলো।
খবর ধীরে ধীরে শিউলীমালার বাপের বাড়িতেও পৌঁছাল। শিউলীর বড় ভাই শামছু, যে কেরানির চাকরি পেয়েছে। কেরানি বোঝে না পৃথিবীতে এমন কিছু তো নেই! সেই শামছু কেরানির এক কথা- ‘এইতা ছুডুলুকের সঙ্গে সংসার করতারতি না। এক কাপড়ে আয়া পর। তরে আবার বেয়া দেয়াম।’ শিউলীমালা জানত, স্বামীর সংসার ছেড়ে ভাইয়ের সংসারে ফিরে গেলে দাসীর জীবন ছাড়া অন্য কিছু জুটবে না। কাজেই সে তার ভাইদের আশা বাদ দিল।
তবে তার এটাও বুঝতে বাকি রইল না, এভাবে চললে তার ভাগ্য পরিবর্তন হবে না। যেভাবেই হোক এ বাড়ি থেকে তাকে বের হতে হবে। কাজেই সে নিজেই চেষ্টায় নামল। অনেক চেষ্টার পর জেলা সদরের এক বাচ্চাদের স্কুলে মাস্টারির চাকরি পেয়ে গেল। আব্দুল গফুরকেসহ সে উঠে এলো জেলা সদরের এক কমদামি ছাপড়া ভাড়া ঘরে। এদিকে আব্দুল গফুরের মাদ্রাসাটি আবার শিউলীমালার শ্বশুরবাড়ির উপজেলায়। আব্দুল গফুর ট্রেনে আসা-যাওয়া করতে লাগল, শিউলীমালা স্কুল করতে লাগল, মানিক মিয়া বড় হতে লাগল। শিউলীমালার চাকরির কারণে অভাব কিছুটা ঘুচলেও পুরোপুরি চলে গেল না। মাসের শেষ দশ দিন শিউলীমালাকে ধার-কর্য করে চালাতে হতো। স্কুলের অন্য শিক্ষিকাদের কাছে হাত পাততে হতো। শিউলীমালা অবাক হয়ে আবিষ্কার করল যে, তার সহকর্মী নারীরা কেউ ম্যাজিস্ট্রেটের স্ত্রী, কেউ এসিল্যান্ডের স্ত্রী, কারো স্বামী ব্যাংকার। যদিও তারা কেউ তার মতো রূপবতী না, তার মতো বনেদি পরিবারের মেয়ে না। সুতরাং শিউলীমালা নিশ্চিত হয়ে গেল যে, তার বিয়েটা একদম ভালো হয়নি। তার বাক্যবাণ আরো তীক্ষè হলো, আব্দুল গফুরের আরো দোষ বের হলো।
সহকর্মী মেয়েরা আঙুলে আংটি, গলায় সোনার চেইন, হাতে সোনার চুড়ি পরে ক্লাসে আসে। প্রতিদিন না হলেও সপ্তাহে নতুন শাড়ি পরে। অনুষ্ঠান-ফাংশনে জামদানি-কাঞ্জিভরম, সোনার হার, বালার প্রদর্শনী হয়ে যায়। শিউলীমালাকে নীরব দর্শকের মতো দেখে যেতে হয়। তাকে পরতে হয় সস্তা বটল গ্রিন জর্জেটের শাড়ি, নিরাভরণ। শিউলীমালার মন খারাপ হয়। তার দামি শাড়ি-গহনা পরার শখ কেবল সে জন্য নয়, দামি শাড়ি-গহনা আরো যে কী কারণে প্রয়োজন তা শিউলীমালার থেকে বেশি আর কেউ জানে না। সুন্দরী মেয়ের প্রতি পুরুষের আকর্ষণ পৃথিবীর রীতি। তার শাড়ি, তার নিরাভরণ আগুন রূপ মুহূর্তে ঘোষণা করে দেয় যে সে দরিদ্র, তার স্বামী সে অর্থে সক্ষম নন। শাড়ি-গহনা যে নারীর স্বামীর সক্ষমতার পরিচয় বহন করে তা শিউলীমালার জানা ছিল না। যে না সেই হাত বাড়াতে চায়। সহকর্মীর স্বামী শ্যালিকা শ্যালিকা বলে গায়ে ঢলে পড়তে চায়, স্কুলের হেডমাস্টার স্কুল ছুটির পর সুখ-দুঃখের গল্প করতে চায়, বাড়ির মালিকের ছেলে সরাসরি বিছানায় নিতে চায়। শিউলীমালা এর কারণ আবিষ্কার করেছে, এর কারণ শুধুমাত্র তার রূপ নয়, কারণ সে দরিদ্র। তাদের দাবিও অযৌক্তিক না। তারা বলতে চায়- ‘যেহেতু তোমার স্বামী তোমাকে কাপড়ে-গহনায়-নিরাপত্তায় ভালো রাখতে পারছে না, আমি তো অনায়াসে তা পারব। তাহলে কেন আমার হবে না?’ তারা এটা বুঝতে চায় না, তাদের এ আবদার নারীর চূড়ান্ত অবমাননা। শিউলীমালার মন বোঝার জন্য তাদের বয়েই গেছে। অন্যের রূপবতী স্ত্রীর কাছে নিজের পৌরুষ জাহির করার পাশবিক আনন্দ তারাই বা কেন ছাড়বে?
শিউলীমালার সব রাগ গিয়ে পড়ত আব্দুল গফুরের ওপর। এই অথর্ব তার মতো বনেদি ঘরের রূপবতী মেয়ের জীবনটা নষ্ট করেছে। তার সামনে প্রতিদিন কত কত প্রলোভন আসে, যদিও সে জানে সবাই তার মন বুঝবে না, সবাই তাকে আজীবনের জন্য চায় না, তথাপি সে যদি চাইত তাহলে এদের ভিতর থেকে একজন উপযুক্তকে তো খুঁজে বের করতে পারতই। কত সব উপেক্ষা করে সে আব্দুল গফুরের সংসার করছে, আব্দুল গফুরের তো ধন্য হয়ে যাওয়া উচিত। আব্দুল গফুর ধন্য না হলেও বুঝতে পারত শিউলীমালা অনেক প্রলোভন বিসর্জন দিয়েই তার সঙ্গে আছে। এ কারণেই সে শিউলীমালার সব বাক্যবাণ মেনে নিত।
তিন দিন আগে শিউলীমালা বাপের বাড়িতে যাওয়ার কারণটা ভয়াবহ। তিন মাস ধরে আব্দুল গফুরের মাদ্রাসার বেতন বন্ধ আছে। তিন মাসের ঘর ভাড়া বাকি, মানিক মিয়ার স্কুলের বেতনও বাকি পড়েছে। মাস চলতেই প্রতিমাসে শ’পাঁচেক করে ধার হয়ে যায়। সব মিলিয়ে সে হিসাব করে দেখেছে আপাতত হাজার দুয়েক টাকা হলেই সংকট সামাল দেয়া যায়। বাপের বাড়ি গেলেই যে টাকাটা সে পেয়ে যাবে তার কোনো ভরসা ছিল না। তাছাড়া যাতায়াতে তো কোনো খরচ নেই, ট্রেনে উঠে পড়লেই হলো। স্টেশন থেকে বাড়ি পর্যন্ত রিকশা ভাড়াটাই যা খরচ। তাছাড়া অনেকদিন বাড়ি যাওয়া হয় না। কাজেই সে মানিক মিয়াকে নিয়ে বাপের বাড়ি রওনা দিয়েছিল।
তাদের দেখে রাবেয়া খাতুন খুশি না হলেও বেজার হলেন না। দুদিন যাওয়ার পর গতকাল যখন শিউলীমালা টাকার প্রসঙ্গটা তুলল, তখন তিনি বেজার হলেন। শিউলীমালার শশুরবাড়ির লোকরা ভালো না, জামাইটা একটা অথর্ব, তাদের তো এ অবস্থা হবেই, ইত্যাদি নানা পুরনো কাসুন্দি খুলে বসলেন কিন্তু টাকার বিষয়ে কোনো কথা বললেন না। সাফ জানিয়ে দিলেন কোনো প্রকার টাকা দেয়া সম্ভব হবে না, এমনকি ধার হিসেবেও না। তিনি টাকা দেবেন কোথা থেকে, তার কি টাকার গাছ আছে। শিউলীমালাও জানত ফলাফল এটাই হবে, সে আর টাকার প্রসঙ্গ তুলল না।
আজ যখন সে ফেরার জন্য ট্রেনে উঠেছে, বজলু আগে থেকেই ট্রেনে ছিল। ট্রেনটি ঢাকা থেকে ছেড়ে আসে, লোকাল ট্রেন। এই রুটে কোনো ভালো ট্রেন নেই। প্রতিটি স্টেশনে দশ-পনেরো মিনিট থামে। শিউলীমালা যে বগিতে উঠল সেখানে প্রচণ্ড ভিড়, পুরো ট্রেনেই ভিড়, তাদের বগিটাই তুলনামূলক কম ভিড় ছিল। তাই দেখে শিউলীমালা মানিক মিয়াকে নিয়ে ট্রেনে উঠল। মানিক মিয়াকে জানালা দিয়ে ট্রেনে তোলার সময় বজলু হাত বাড়িয়ে টেনে তুলল। শিউলীমালা ট্রেনে ওঠার পর বজলু তার সিট ছেড়ে দিল। শিউলীমালা বসতে বসতে ট্রেন চলতে শুরু করল। এতক্ষণ খেয়াল করেনি, এবার ভালো করে তাকাতে দেখতে পেল এই গরমের মাঝেও বজলু কমপ্লিট স্যুট পরে আছে, গলায় একটা দামি রয়েল ব্লু কালারের টাই ঝুলছে, শার্টের কাফলিংকগুলো সিনেমার নায়ক বুলবুল আহমেদের কথা মনে করিয়ে দেয়। বজলুর গা থেকে ভুরভুর করে সেন্টের গন্ধ বেরুচ্ছে। আপাদমস্তক টাকার কুমির অথবা ধনীর দুলাল অথবা দিগি¦জয়ী আলেকজান্ডার যাকে বলে। লোকটা প্রায় ছয় ফুট লম্বা, নাকের নিচে একটা গোঁফ ঝুলছে। অবশ্য গোঁফ শিউলীমালার দুচোখের বিষ, তথাপি এই লোকের মুখে গোঁফটা মানিয়ে গেছে। অবশ্য সফল পুরুষের সবই মানিয়ে যায়।

শিউলীমালা যখন প্রায় দৌড়ে ট্রেনের দিকে আসছিল, তখনই বজলুর নজর কেড়েছে। এমন আগুনের মতো মেয়ে! নজরে না পড়ে তো পারে না। চোখাচোখি হতে বজলু আশ্বস্ত করার একটা হাসি দিল। এদিকে শিউলীমালার বেশভুষা, তার মুখের বিষণ্নভাব তার সঙ্গীন অবস্থার বিজ্ঞাপন প্রচার করে যাচ্ছিল। লোকটা কথা বলা শুরু করল। হাজার হোক এই ভিড়ের মাঝে লোকটা মানিক মিয়াকে টেনে তুলেছে, তাকে সিট ছেড়ে দিয়েছে, কাজেই শিউলীমালা তাকে অগ্রাহ্য করতে পারল না। চলতে চলতে তার জানা হয়ে গেল, লোকটার বাড়ি বিক্রমপুর। ঢাকায় ইন্ডেন্টিংয়ের ব্যবসা আছে, পুরানা পল্টনে তার অফিস। এদিকে একটা কাজে এসেছিল। এখন যাচ্ছে জেলা শহরে তার বোনের বাড়ি। চানাচুরওয়ালা পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় মানিক মিয়া বায়না ধরল, শিউলীমালা পড়ল বিপদে। সে মানিক মিয়াকে চানাচুর কিনে দিতে চাচ্ছিল না, দুইটা টাকাও এখন তার বড় সহায়। মুখে বলল- ‘এইসব চানাচুর ড্রেনের পানি দিয়ে বানায়’। কিন্তু এসব কথা মানিক মিয়া পাত্তা দিচ্ছিল না। অবশেষে বজলুই তাকে চানাচুর কিনে দিল, শিউলীমালা অবশ্য মানা করেছিল।
বজলুরও জানা হয়ে গেল শিউলীমালা এসেছিল বাপের বাড়ি, সে একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলের শিক্ষক, সামনের বছর বিএ পরীক্ষা দেবে, পাশাপাশি ভালো একটি চাকরি খুঁজছে, স্বামী একটি মাদ্রাসার প্রফেসর। বজলু এবার তার একটি কার্ড শিউলীমালার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল- তার প্রতিষ্ঠানের জন্য সে একজন প্রাইভেট সেক্রেটারি খুঁজছে। শিউলীমালা যদি আগ্রহী হয় তাহলে সে পরবর্তীতে যোগাযোগ করতে পারে। শিউলীমালা এসবের অর্থ বোঝে, লোকটি তার দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারছে না। বজলুর দৃষ্টি শিউলীমালার শরীরে ঘুরে বেড়াতে লাগল। শিউলীমালা বিষয়টি অনুভব করছিল, উপভোগ করছিল কিনা তা বোঝা গেল না। দেখতে দেখতে জেলা সদর চলে এলো, ট্রেনের গতি ধীর হচ্ছে। এই সময় বজলু প্রস্তাব দিল তার সঙ্গে গাড়ি আছে, শিউলীমালা চাইলে সে তাকে বাসায় নামিয়ে দিতে পারে। শিউলীমালা ধন্যবাদ জানিয়ে প্রত্যাখ্যান করল। কী কথা! কত সস্তা মনে করে। ভাবটা এমন যেন তার সঙ্গে গাড়ি থাকলেই বলা মাত্র শিউলীমালাকে ঢ্যাং ঢ্যাং করে রাজি হয়ে যেতে হবে। আবারো সব রাগ গিয়ে পড়ল আব্দুল গফুরের ওপর। শিউলীমালার মেজাজ চড়তে লাগল। ট্রেন থেকে নামার পর মানিক মিয়া গাড়ি দিয়ে যাওয়ার বায়না ধরল, কিছুতেই তাকে টেনে নেয়া যায় না। শিউলীমালা অনেক কষ্টে মানিক মিয়াকে টেনে-হিঁচড়ে বজলুর কাছ থেকে দূরে সরে এলো। মানিক মিয়া তখনো নাছোড়বান্দা, সে গাড়ি দিয়ে যাবেই। রাগে-দুঃখে শিউলীমালার কান্না চলে এলো, সে মানিক মিয়াকে এলোপাতাড়ি চড়-থাপ্পড় দিতে লাগল। মানিক মিয়া অবাক বিস্ময়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইল।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়