সম্পাদক পরিষদ : সাংবাদিক নির্যাতনের হাতিয়ার সাইবার নিরাপত্তা আইন

আগের সংবাদ

বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন চায় যুক্তরাষ্ট্র : সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী

পরের সংবাদ

ইসহাক খানের মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস ‘যারা যুদ্ধ করেছিল’

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২২, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: সেপ্টেম্বর ২২, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বীর মুক্তিযোদ্ধা ইসহাক খানের সঙ্গে পরিচয়টা ঘটে অনুবাদক প্রবন্ধকার বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল কাইয়ুম চাচার মাধ্যমে। চাচাই বইমেলায় দাদার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। তারপর কবিতা লেখার সুবাদেই এই গুণীজনের স্নেহাশীর্বাদ ও ভালোবাসায় ঋদ্ধ হয়েছি।
একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হয়ে একাত্তর এবং দেশ রক্ষার্থে এসব অকুতোভয় সৈনিকের প্রতি জন্মগতভাবেই আমি দুর্বল, চিরকৃতজ্ঞ এবং আজন্ম ঋণী।
২০২৩ সালে অমর একুশে বইমেলায় অন্বয় প্রকাশ থেকে প্রকাশিত হয় ‘যারা যুদ্ধ করেছিল’ উপন্যাস। উপন্যাসের নাম থেকেই অনুমেয় হয়- স্বাধীনতার নির্মম ইতিহাসের এক খণ্ড চিত্রের পটভূমি আর এই পটভূমিজুড়েই আছে মৌলবাদসমৃদ্ধ পাকিস্তান আর এর দোসর রাজাকার, আলবদর ও খুনি, দেশদ্রোহী, বিশ্বাসঘাতকদের নানান যড়যন্ত্রের আত্মজৈবনিক বর্বরতার আখ্যান/কথা।
এই সত্যতার জন্য উপন্যাসে বর্ণিত একজন কুখ্যাত রাজাকার শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ফজলুর রহমানের ধর্মান্ধতার ভাষ্য তুলে ধরলাম-
সে (ফজলুর রহমান, রাজাকার) তার স্ত্রী, সাকিবের মা আয়েশা বেগমকে বলে- ‘ওই মেয়েটা মালে গনিমত ? শত্রæ পক্ষের সম্পত্তি। ওকে আমরা যুদ্ধে গনিমতের মাল হিসাবে অধিকার করেছি। ওরা আমাদের যুদ্ধ বন্দিনী, দাসী। ওদের দাসী হিসেবে সহবত করা জায়েজ। তোমার ছেলে মোটেও পাপ করছে না।’
কী ভয়াবহতার চিত্র যুদ্ধকালীন সময়ে বাংলাদেশজুড়ে। ধর্মের অপব্যবহার আর সরলমনা মানুষকে স্বার্থবাদের কথা বলে মা, মাটি, মানুষ থেকে বিচ্যুত করেছে এসব পাকিস্তানপ্রীতি রাজাকার, পিচ কমিটির সদস্যরা। নিজের আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধবদের এরা শত্রæ ভেবে কাফের বলেছে এবং বিধর্মী বলে ধর্মের উন্মাদনায় নরনারীকে খুন, ধর্ষণ করেছে এবং নিজেদের দোষ-ত্রæটি থেকে পার পাওয়ার জন্য গনিমতের মাল বলে মা-বোনদের বর্বর জঘন্য সাম্প্রদায়িক কামুক পাকিস্তানিদের কাছে ছেড়ে দিয়েছে।
পরক্ষণেই স্ত্রীর কথার প্রতিবাদে এই রাজাকার ফজলুর রহমান বলে, ‘ধর্মের কাছে আত্মীয়তা বলে কিছু নাই। অবশ্যই তারা কাফের, মুশরিক।
আওয়ামী লীগের লোকজন, মুক্তিবাহিনী এবং হিন্দুরা সব পাকিস্তানের শত্রæ। তাদের বাড়িঘর লুট করা মুসলমানদের দায়িত্ব। তাদের সব নারী যুদ্ধ বন্দিনী এবং দাসী।’
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যদি বলি-
’৭১ সালে আপামর বাঙালি তথা সব মুক্তিযোদ্ধার- পাকিস্তান নামক স্বৈরশাসক থেকে নিজেদের স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনের যে দেশপ্রেম সম্পন্ন বোধবুদ্ধির একাগ্রতা তথা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের যে ঐতিহাসিক ভাষণে মুক্তির বারতার যে আলোকোজ্জ্বল ক্ষিপ্রতা, তার কতটুকু স্পিরিট আমরা মন ও মননে ধারণ করতে পেরেছি?
এই প্রশ্নের উত্তরে যদি বলি-
স্বাধীনতার ৫২ বছর পর আজো দেখতে পাই সেই সব রাজাকার বা তাদের দোসররা ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে অবাধে বিচরণ করছে এবং প্রশাসনের নাকের ডগায় তৎকালীন সময়ের নাশকতাপূর্ণ ঘটনার পুনরাবৃত্তি করে পার পেয়েও যাচ্ছে! তখন ফিল্টারাইজেশনের জন্য হাহুতাশ করে মরে একাত্তর প্রজন্ম।
মুক্তিযোদ্ধা ইসহাক খান রচিত ‘যারা যুদ্ধ করেছিল’ উপন্যাসকে আমার কাছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসভিত্তিক খণ্ডচিত্রের একটা দলিল মনে হয়েছে। ঘটনাক্রমে এখানে ওঠে এসেছে রাজাকারের বীভৎসতা। যা জানলে বা পড়লে অজানা আশঙ্কায় শরীরের লোমকূপ থেকে দরদরিয়ে ঘাম বেরিয়ে আসে। যুদ্ধকালীন তেমনই একটা ঘটনার অবতারণা করেছেন এই যোদ্ধা লেখক-
মুক্তিযোদ্ধা মমিনের বাল্যবন্ধু সাকিব। সে রাজাকার ফজলুর রহমানের ছেলে এবং দেশবিরোধী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সেও সম্পৃক্ত বিধায় গনিমতের মাল বলে মমিনের বোন সাথীকে প্রতিনিয়ত ধর্ষণ করে। বাপ ফজলুর রহমানও এই গনিমতের মালে হক আছে বলে যুক্তি উপস্থাপন করে। হিন্দু মেয়েদের পাক আর্মি ক্যাম্পে তুলে দেয়ার সময় সাকিব রাজাকার ফজলুর রহমানকে বলে-
‘কালিপদ রায় আমার শিক্ষক। খুবই ভালো মানুষ।’
কিন্তু শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান রাজাকার ফজলুর রহমান পুত্রকে উদ্দেশ্য করে বলে-
‘সে মালাউন। মালাউনরা কোনোদিন ভালো হয় না। ওরা মুশরিক, কাফের। ওরা ইসলামের শত্রæ।
যতক্ষণ ওরা ইসলাম গ্রহণ না করবে ততক্ষণ ওরা মুসলমানদের শত্রæ। ওদের হত্যা করার বিধান দিয়েছেন আল্লাহপাক।’
তারপরই শিক্ষক কালিপদ রায়ের ওপর নেমে আসে নির্মম অত্যাচার। রাধানগর গ্রামের সুশিক্ষক কালিপদ রায় ও তার স্ত্রীকে গুলি করে হত্যা করার পর কলেজপড়ুয়া মেয়ে হৈমন্তীকে তুলে নিয়ে রাজাকার আলিম, জহর আর গেদু গনিমতের মাল ভোগ করে নিজেদের রক্ষার্থে ছেড়ে দিয়ে আসে হায়েনার খাঁচা পাক আর্মি ক্যাম্পে।
তারপর রাতে তিনজন মিলে আলিমের বাড়িতে এই বলে আনন্দোল্লাস করে যে, হিন্দু নারী ভোগ করে তারা অসীম ছোয়াবের ভাগীও হয়েছে।
স্বাধীনতা অর্জনের যে ত্যাগ-তিতিক্ষা, তা এভাবেই আমাদের পূর্বপুরুষদের দিতে হয়েছে। এটা অস্বীকার করার কোনো হেতু নেই। যারা মনে করে ‘স্বাধীনতা’ ছেলের হাতের মোয়া; তারা হয়তো সহজলভ্যতায় পাওয়া দেশটাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে উপরন্তু দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা তথা মিনার সমৃদ্ধ বাংলাদেশকেই অস্বীকার করছে!
যুদ্ধকালীন সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের যে শত্রæবেষ্টিত প্রতিকূল অবস্থা, তা উপন্যাসের পরতে পরতে পরিলক্ষিত হয়েছে এবং সবিস্তার বর্ণনায় একজন মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধকালীন সময়ের অভিজ্ঞতালব্ধ প্রজ্ঞা ও জ্ঞানের যে দূরদর্শিতার সাক্ষ্য দিয়েছেন তা স্পষ্টত এই উপন্যাসে।
একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে পূর্বপুরুষ প্রদত্ত রক্তের যে হিল্লোল তা থেকেই শুধু অনুমান করি যে জাগতিক মোহ মুক্ত হয়েই দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন স্বাধীনতাকামী সব মুক্তিযোদ্ধা। আর এই ডাকে পিতা-মাতা, ভাইবোন, স্ত্রী-সন্তানসহ তুচ্ছ করেছিল জাগতিক প্রেম-ভালোবাসার নিরবচ্ছিন্ন বন্ধন।
তাইতো…
সদ্য স্বাধীন দেশে মুক্তিযোদ্ধা মুমিন বাড়ি ফিরে এসে বীরাঙ্গনা বোন সাথীর হাতে তুলে দেয় রকিবের দেয়া আলোকোজ্জ্বল সূর্যসম লাল-সবুজের পতাকা। শত পুত্রের বিয়োগান্তে পাথর চাপা বুকে কান্নারহিত করে নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে শুধু বাংলাদেশ স্বরূপা এক রমিছা বিবি ‘মা’।
পরিশেষে বলব, একজন প্রজ্ঞাবান বীর মুক্তিযোদ্ধা ইসহাক খান দাদার উপন্যাসের জ্ঞানগর্ভ পাঠ প্রতিক্রিয়া আসলেই ক্ষুদ্র পরিসরে আমার মতো পাঠকের পাঠ-পরবর্তী প্রতিক্রিয়া দুরূহ বলেই মনে হয়। আর এই মনে হওয়াটাই বাস্তব কারণ একজন অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধাকে নিজ আত্মবিশ্লেষণে নতুন করে স্বীয় স্বরূপে ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। আর এই সম্ভব নয় বলেই একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা শ্রদ্ধেয় ইসহাক খান দাদার প্রতি সশ্রদ্ধ সালাম জানিয়ে ভুল-ত্রæটি মার্জনায় ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ রাখবেন।
আমাদের নিজ আত্মপরিচয় লাভে দিন শেষে শেকড়ের সন্ধানে ফিরতে হয়। আর এই ফিরে যাওয়াটা নিশ্চয়ই ‘একাত্তর’। তাই নিজের আত্মপরিচয়টা জানার জন্যই পড়তে হবে উপন্যাসিক বীর মুক্তিযোদ্ধা শ্রদ্ধেয় ইসহাক খান রচিত মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস ‘যারা যুদ্ধ করেছিল’।

গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে অন্বয় প্রকাশ, প্রকাশকাল বইমেলা ২০২৩।
মূল্য ৪০০ টাকা।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়