সংসদের মুলতবি অধিবেশন শুরু আজ

আগের সংবাদ

নানামুখী চাপে অর্থনীতি : সুশাসনে গুরুত্ব, বাড়াতে হবে বেসরকারি বিনিয়োগ, নতুন অর্থবছরেও পুরোনো চ্যালেঞ্জ

পরের সংবাদ

খুশির আলো

প্রকাশিত: জুলাই ৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুলাই ৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

অবশেষে কুসুমপুর। ট্রেন থেকে নেমে ভ্যানরিকশায় চার-চারটে গ্রাম পেরিয়ে এই কুসুমপুর। কী আনন্দ, মার মুখে খুশির রং ধরে। সেই রং সায়নের মুখেও ছড়িয়ে পড়ে। ভ্যানরিকশা মেঠো পথ ধরে বেশ জোরেই ছুটতে থাকে। কত দৃশ্য সরে সরে যায়। সারা গ্রামে পাকা বাড়ি হাতে গোনা কয়েকটা। সাজানো-গোছানো ছবির মতো সব বাড়ি। ফলের গাছ, ফুলের গাছ। আম-জাম থেকে শিউলি! কী নেই, গাছে গাছে কত রকমের পাখি। উড়ছে, ঘুরছে প্রজাপতি। গঙ্গাফড়িংটাকে ভালো করে দেখার চেষ্টা করে সায়ন। হঠাৎই দৌড়ে পালায় ছোট্ট এক কাঠবেড়ালি।
কখন যে দাদানের বাড়ির কাছে পৌঁছে গেছে, সেটাই বুঝতে পারেনি সায়ন। দাদান বলতেই লাফিয়ে ভ্যানরিকশা থেকে নেমে, বাগান পেরিয়ে পায়ে পায়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়ে। পিছু পিছু বাবা। মা তো রাস্তায় দাঁড়িয়েই গল্প জুড়ে দেন ঠাম্মার সঙ্গে। কত কথা জমে আছে।
দাদানের কী সুন্দর বাড়ি, ঝকঝকে-তকতকে। ছবির মতো। বারান্দায়, দাদানের ঘরে জলরঙে আঁকা বেশ কটা ছবি টাঙানো। সায়ন জানতে চায়, ‘ছবিগুলো কার আঁকা?’
দাদানের মুখ লজ্জায় রাঙা হলো কিনা, বোঝা গেল না। খুব আস্তে, গলা নামিয়ে বলেন, ‘ছোটবেলায় ছবি আঁকতাম। আবার আঁকছি এই বুড়ো বয়সে। এখন আমার সময় কাটে ছবি এঁকে। রোজই বসি রং-তুলি নিয়ে।’ বলতে বলতে সায়নকে নিয়ে যান তিনি দোতলার ঘরে। ছাদ থেকে চারপাশ কী অপূর্বই না লাগে! আদিগন্ত ধানক্ষেত। কত গাছগাছালি, পাখপাখালি। দূরের নদীও স্পষ্ট দেখা যায়।
নদীর বুকে ভেসে চলে নৌকা। দূরের নৌকা অবশ্য তেমন স্পষ্ট নয়। সায়ন অবাক চোখে এদিকে দেখে, ওদিকে দেখে। কাছে-দূরে যেদিকে চোখ যায়, সেদিকেই কত বিস্ময়। সায়ন স্তব্ধ হয়ে সেসব দেখতে থাকে। সেই স্তব্ধতা ভেঙে যায় দাদানের কবিতায়। ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া সায়ন এ কবিতা আগে শোনেনি। শুনতে শুনতে তার মনে হয়, এই কুসুমপুর নিয়েই বুঝি লিখেছেন কবি। দাদান বলতে থাকেন, ‘আমাদের ছোট গাঁয়ে ছোট ছোট ঘর/থাকি সেথা সবে মিলে নাহি কেহ পর।’
চারপাশে চোখ জুড়নো দৃশ্য দেখতে দেখতে, মন ভালো করা কবিতা শুনতে শুনতে সায়ন খানিক আক্ষেপের সুরে দাদানকে বলে, ‘এ কবিতা আমায় শিখিয়ে দেবে?’ শুনে দাদান হাসেন, যেন জয়ের হাসি। হাসতে হাসতে বলেন, ‘এই রকমই তো চেয়েছিলাম। আমার নাতি কবিতা আবৃত্তি করবে। গান গাইবে। ছবি আঁকবে। কিন্তু নাতিকে পাই কোথায়! সে তো অনেক দূরে থাকে, সেই দূর-শহরে, কলকাতায়।’
বলতে বলতে দাদান মনের সব বেদনা গোপন করে হাসার চেষ্টা করেন। বেদনা আর আনন্দ মিলেমিশে এক অদ্ভুত হাসি খেলে যায় তার মুখে। একটু আগেও কেমন সুন্দর করে হাসছিলেন। তার মুখের সে হাসিটুকু সায়নের চোখে এখনো লেগে আছে।
কী আনন্দেই না সময় কাটে! সায়ন সারাদিনই দাদানের সঙ্গে। সন্ধ্যার পর যত গল্প হয় ঠাম্মার সঙ্গে। দাদান গাছ চেনান, ফুল চেনান, সায়নকে নিয়ে যান নদীর ধারে। জেলে-নৌকাতেও চড়ান। বিকালের আলো কমে আসছে, নদীর জলে সূর্যের বিদায়-ছায়া। লালের আভা।
গরুর গাড়ি দেখে সায়নের চাপতে ইচ্ছা করে। দুপুরের দিকে সে ব্যবস্থাও করেছেন দাদান। পুকুরে তারই বয়সি কয়েকটা ছেলে আনন্দ-হুল্লোড়ে সাঁতার কাটছে দেখে ইচ্ছা হয় তার ঝপাং করে জলে ঝাঁপিয়ে পড়তে। যারা সাঁতার কাটছিল, তাদেরই একজন মজা করে ডাক দেয় তাকে, ‘কীরে সাঁতার কাটবি?’
মনে হয়, না-চেনা হয়েও কতকালের চেনা। বন্ধু যেন। অচেনা বন্ধুর ডাক শুনে সায়নের চোখ-মুখ যে ঝলমলিয়ে ওঠে, তা দাদানের নজর এড়িয়ে যায় না। পুকুর-জলে নামার জন্য তাকে উৎসাহিত করে বলেন, ‘যা না, প্যান্ট-জামা খুলে আমার হাতে দে। আমি ধরছি। তলায় তো ছোট প্যান্ট পরা আছে। ভাবনা কী!’
দাদানের কথায় সায়ন সত্যিই উৎসাহিত হয়। প্যান্ট-গেঞ্জি খুলে ঝাঁপিয়ে পড়ে পুকুর-জলে। সুইমিংপুলের মতো স্বচ্ছ জল নয়, ঘোলাটে, শ্যাওলা-রঙা জলেও যে এত আনন্দ আছে, তা কুসুমপুরে না এলে, পুকুরে ঝাঁপ না দিলে সায়নের অজানাই রয়ে যেত।
টানা ঘণ্টাখানেক ছেলেগুলোর সঙ্গে সমানে পাল্লা দিয়ে আনন্দে সায়নের মন ভরে যায়। মনে হয়, সুইমিংপুলে নয়, ঢের বেশি আনন্দ কুসুমপুরের পুকুরে।
দুপুরের জম্পেশ খাওয়া, তারপর দাদানের কাছে ছবি আঁকতে বসা। সায়ন আঁকল গাছ-ছায়ায় ঘেরা এক শান্ত গ্রামের ছবি। একটু দূরেই নদী। নদীর সামনে একটা গাছ। সেই গাছের ডালে পাখি। সে পাখি যে মাছরাঙা, তা ঠিকঠাক রংয়ের ব্যবহারে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সায়নের আঁকা ছবির তারিফ করে পিঠ চাপড়ে দাদান বলেন, ‘এত সুন্দর তোর ছবি আঁকার হাত। সেই ছবি আঁকাটাই ছেড়ে দিলি?’
দাদানের কথা সায়নকে দুঃখ দেয়। আবার আনন্দও। তাকে সামনে বসিয়ে পর পর আরো ক-টা ছবি আঁকে।
দাদানের সঙ্গে সায়ন গ্রামের এ-মাথা থেকে ও-মাথা ঘুরেছে সর্বত্র। সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন তিনি। তারই বয়সি কয়েকজনের সঙ্গে ভাবও হয়ে গেছে। প্রথমে ছেলেগুলোর মধ্যে যথেষ্ট আড়ষ্টতা ছিল। সায়নের সঙ্গে কথা বলছিল না। পরে সেই আড়ষ্টতা কেটে গেছে। পুকুরের দিকে প্যাঁকপ্যাঁকাপ্যাঁক হাঁসের সারি। চলেছে দুলকি চালে, ধীর গতিতে। কুসুমপুরের গৌরবকে সঙ্গে নিয়ে সায়ন সেই হাঁসের দলকে এমন তাড়া করে যে, মুহূর্তের মধ্যে প্রায় দৌড়ে গিয়ে ঝাঁপ দিয়েছে ঘোষালদের পুকুরে। ছাগলের পেছনেও সায়ন দৌড় দেয়। সাদা-কালোয় ছাপছোপ এক ছাগলছানাকে কতবারই না কোলে নিয়েছে, আদর করেছে! ছাগলটা যার, সেই মলিনামাসি সায়নকে বলেছে, ‘এটা তোমায় দিলাম। শহরে নিয়ে যাও। পুষো। দুধ দিলে খাবে।’ গড়গড়িয়ে এসব বলে একটু থামেন। তারপর হেসে বলেন, ‘তোমরা তো প্যাকেটের দুধ খাও। এবার খাঁটি দুধ খাবে।’
মলিনামাসির কথায় সায়নের মুখ ঝলমলিয়ে উঠলেও মুখে কিছু বলেনি। তার কথার উত্তর দিয়েছেন দাদান। বলেছেন, ‘দূর-শহরে ফ্ল্যাট বাড়িতে থাকে ওরা। ছোট ছোট ঘরদোর। সেখানে আবার ছাগল পুষবে কী করে?’
বিকালে সবাইকে নিয়ে দাদান গেলেন নদীর পাড়ে। পায়ে পায়ে আরো কিছুদূর। সামনেই ভাঙাচোরা মন্দির। মন্দিরের গায়ের টেরাকোটার কারুকাজে শ্যাওলা জমেছে। মন্দির লাগোয়া বটগাছের ঝুরিতে সায়নের কী দোলদুলুনি। মা অবাক চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকেন। চেনা সায়নকে অচেনা লাগে।
পরের দিন সকালেই আসে বাবার ফোন। মা সায়নকে নিয়ে একদিনের জন্য রয়ে গিয়েছিলেন। বাবা অনিচ্ছা সত্ত্বেও সন্ধ্যার পর ফিরে গিয়েছিলেন। খাওয়াদাওয়া করে সায়নকে নিয়ে মা ফিরে যাবেন, এমনই কথা। বাবা যে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হতে চাইছেন, তা বুঝতে সায়নের অসুবিধা হয় না।
মা বাজতে থাকা ফোনটা তাড়াতাড়ি হাতে তুলে নিয়ে কথা বলতে থাকেন। সেসব কথা সায়নের কানে আসে। ক্রমেই তার মুখ শুকিয়ে যায়। ফিরে যেতে হবে ভেবে আষাঢ়ের কালো কুচকুচে মেঘ মুখে ভিড় করে। মা ফোনে দু-চারটে কথা বলার পর সায়নের দিকে তাকিয়েই বুঝতে পেরে যান, ফিরে যেতে হবে ভেবে মুষড়ে পড়েছে সে।
দাদান বাবার সঙ্গে কী নিয়ে কথা হচ্ছে বুঝতে পেরে সায়নকে বোঝাতে থাকেন, ‘মন খারাপ করো না। সামনের মাসে না হয় আমরাই দুই বুড়াবুড়ি যাব তোমাদের কাছে।’ দাদানের এ কথাও সায়নের মনে ধরে না। কালো মুখে আলো ফোটে না। মুখ বেজার করে, থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকে।
ঠাম্মা ছিলেন পাশের ঘরে। ‘কী হয়েছে? কে ফোন করেছে?’ বলতে বলতে ঘরের বাইরে আসেন। তাকে দেখা মাত্র সায়ন জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কেঁদে ওঠে। ঠাম্মা বুঝতে পারেন, সায়ন কলকাতায় ফিরতে চাইছে না। আরো দুদিন কুসুমপুরে থাকতে চাইছে।
শেষে ঠাম্মাই সামাল দিলেন। মার হাত থেকে মোবাইলটা নিয়ে ডায়াল করলেন বাবাকে। বাবা কী বললেন, সায়ন তা শুনতে পায়নি ঠিকই, কিন্তু এটা বুঝতে পেরেছে, আরো দুদিন থাকার পারমিশন দিয়েছেন। ‘সায়নের স্কুলে এখন গরমের ছুটি। থাক না আরো দুদিন’, এ কথাই বলেছেন তিনি।
আরো দুদিন কুসুমপুরে থাকা যাবে, তা ভেবেই সায়নের কী আনন্দ! চোখে-মুখে খুশির আঁকিবুঁকি ফুটে ওঠে। ভাবতে থাকে দাদানের সঙ্গে ছবি আঁকবে, পুকুরে সাঁতার কাটবে, ঘুরবে! একটু আগেই ঠাম্মাকে জড়িয়ে ধরে সে কাঁদছিল, কে বলবে! সায়নের চোখে-মুখে আলো পড়েছে। খুশির আলো, আনন্দের আলো।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়