পাগলায় মানববন্ধন : মন্দিরের জায়গা উদ্ধারের দাবি

আগের সংবাদ

স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে দ্বিধা করবে না যুক্তরাষ্ট্র : মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর

পরের সংবাদ

রপ্তানির বহুমুখীকরণ এখনো বহুদূর

প্রকাশিত: জুন ২২, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ২২, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

কাগজ প্রতিবেদক : এক পণ্যে নির্ভরতা দেশের রপ্তানি প্রবৃদ্ধিকে পরের ধাপে নিয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়, বিশেষজ্ঞরা এমনটাই মনে করেন। তবে দেশের অন্য কোনো খাতও এখন পর্যন্ত নিজের পারফরম্যান্স দিয়ে তৈরি পোশাক (আরএমজি) শিল্পের কাছাকাছিও আসতে পারেনি। রপ্তানি ঝুড়িতে বৈচিত্র্য আনার সম্ভাবনা আছে, এমন খাতগুলোর মধ্যে আছে- চামড়া ও জুতা, হালকা প্রকৌশল এবং প্লাস্টিক। কিন্তু মাসিক রপ্তানির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এ উৎপাদিত পণ্যগুলোর কোনোটিই এক নম্বর অবস্থানে থাকা খাতটির ধারেকাছেও নেই। আরএমজি খাতের রপ্তানির হিসাব বিলিয়নে করা হলেও অন্যগুলোর হিসাব এখনো কয়েক মিলিয়নেই আটকে আছে।
তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে অন্য খাতগুলোর মধ্যে শুধু চামড়া খাতের রপ্তানি ১ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করতে পেরেছে। প্রকৌশল পণ্যের রপ্তানি আধা বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি। আর প্লাস্টিক ২০০ মিলিয়ন ডলারও ছুঁতে পারেনি। বিদায়ি অর্থবছরের জুলাই-মে সময়কালে তৈরি পোশাক একাই দেশে এনেছে ৪২ বিলিয়ন ডলার। সামগ্রিক রপ্তানিতে তৈরি পোশাকের হিস্যা ৮৪ শতাংশের বেশি আর চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের হিস্যা ২ দশমিক ২ শতাংশ, প্লাস্টিকের হিস্যা মাত্র শূন্য দশমিক ৩৮ শতাংশ এবং প্রকৌশল পণ্যের হিস্যা ১ শতাংশ।
৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় সরকার এলডিসি থেকে টেকসই উত্তরণের জন্য রপ্তানি খাতের বহুমুখীকরণকে শীর্ষ অগ্রাধিকার দিয়েছে। পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, ২০২৫ সাল নাগাদ দেশের মোট রপ্তানিতে চামড়া, প্রকৌশল, জাহাজ নির্মাণ, ওষুধ, সিরামিক ও প্লাস্টিকের মতো শিল্পগুলোর হিস্যা হবে ২৫ শতাংশ। সর্বশেষ রপ্তানির তথ্য অনুসারে, এই অনুপাত এখন মাত্র ৪ শতাংশ। শিল্পসংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রধান নীতি সহায়তাগুলোতে এখনো মূলত পোশাক খাতের ওপরই গুরুত্ব দেয়া হয়। যার ফলে পোশাক খাত এখনো অপরাজেয় এবং অন্য সম্ভাবনাময় খাতগুলো পেছনে পড়ে রয়েছে। বাজেটের আগে রপ্তানি খাতগুলো সরকারের কাছে তাদের দাবি-দাওয়া ও সুপারিশ পেশ করেছে।
গত ১ জুন সংসদে পেশ করা নতুন বাজেটে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল রপ্তানিমুখী শিল্পের ওপর জোর দেন। তিনি বলেছেন, রপ্তানির বহুমুখীকরণের জন্য আমরা তথ্য-প্রযুক্তিচালিত এবং পরিবেশবান্ধব বৈচিত্র্যপূর্ণ শিল্প স্থাপনে উৎসাহিত করছি। বিনিয়োগ বাড়ানোর লক্ষ্যে ১০০টি নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণ, ওয়ান-স্টপ সার্ভিস এবং লজিস্টিকসের উন্নতির অঙ্গীকারসহ কিছু ছাড় ও প্রণোদনা অতীত আগে থেকেই অব্যাহত আছে কিংবা বাজেট বক্তৃতায় নতুন করে দেয়া হয়েছে। প্রায় ৯০ হাজার নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, জুতা এবং প্লাস্টিক ও হালকা প্রকৌশল খাতের রপ্তানি বাড়াতে অবকাঠামোগত বিনিয়োগের জন্য এক্সপোর্ট কম্পিটিটিভনেস ফর জবস প্রকল্পের আওতায় ৪০ মিলিয়ন ডলারের নতুন তহবিল নিয়ে সরকারের একটি প্রকল্প রয়েছে। অন্যদিকে একসময় বিলিয়ন ডলার আয় করা খাত- হোম টেক্সটাইল, পাট ও পাটজাত পণ্য, কৃষিপণ্য এখন বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দায় ও সরকারের পর্যাপ্ত নীতি সহায়তার অভাবে নিজেদের গতি বজায় রাখতে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে।
তবে রপ্তানি শিল্পকে পরবর্তী গন্তব্যে নিয়ে যাওয়ার জন্য শুধু এতটুকুই যথেষ্ট না বলে রপ্তানি খাত সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। অ্যাপেক্স ফুটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ নাসিম মঞ্জুরের মতে, রপ্তানি প্রণোদনা বৈষম্যমূলক, এখনো একটি একক পণ্যের প্রতি পক্ষপাতমূলক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক্সপোর্ট ফ্যাসিলিটেশন ফান্ড প্রসঙ্গে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, আরএমজির জন্য বরাদ্দ ২০০ কোটি টাকা, অথচ প্লাস্টিক ও জুতার মতো তথাকথিত বৈচিত্র্যপূর্ণ খাতের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৭ কোটি টাকা। তাহলে কেউ বৈচিত্র্য আনতে যাবে কেন?
লেদার গুডস এন্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স এন্ড এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি নাসিম মঞ্জুর বলেন, সরকারের উচিত চামড়া শিল্পসহ বৈচিত্র্যময় রপ্তানি খাতগুলোর জন্য প্রণোদনাসহ বিদ্যমান সহায়তা অব্যাহত রাখা, যাতে খাতগুলো শক্তিশালী হয়ে নিজেদের রপ্তানি বাজার বড় করে দেশের মসৃণ এলডিসি উত্তরণে অবদান রাখতে পারে।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি জসিম উদ্দিন বলেন, সত্যিই যদি আমাদের রপ্তানি ঝুড়িতে বৈচিত্র্য আনতে চাই, তাহলে আমাদের অন্তত চারটি সম্ভাবনাময় খাত নিয়ে বসতে হবে- হালকা প্রকৌশল, চামড়া, জুতা এবং প্লাস্টিক। তিনি বলেন, শুধু এ চারটি খাতই নয়, ওষুধ শিল্পসহ মোট ১২টি খাতের রপ্তানি বাজার বড় হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে তিনি মনে করেন। এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, এই বাজেট যেহেতু এখনো প্রস্তাবিত, তাই পণ্যে বৈচিত্র্য আনার জন্য কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নিতে সরকারের সঙ্গে আমাদের আলোচনার সুযোগ রয়েছে। রপ্তানিমুখী শিল্পগুলোকে আন্তর্জাতিক পরিবেশগত মানদণ্ড বজায় রাখতে হবে। শিল্পগুলোতে দক্ষতার ঘাটতিও রয়েছে। এফবিসিসিআই প্রধান জানান, ২০২২ সালে ‘প্রোডাক্ট অব দ্য ইয়ার’ হিসেবে ঘোষিত হালকা প্রকৌশল খাতে দক্ষ জনবলের ঘাটতি আছে ৬২ শতাংশ। ‘প্রতিটি খাতেই দক্ষ জনবলের ঘাটতি আছে। জসিম উদ্দিন তার নিজের খাত প্লাস্টিকে কমপ্লায়েন্স চাহিদার কথা উল্লেখ করে বলেন, কমপ্লায়েন্সের চাহিদা পূরণ করতে এবং রপ্তানি বাড়াতে খাতটির একটি সুসজ্জিত শিল্প ক্লাস্টার প্রয়োজন।
চামড়া শিল্পের জন্য পরিবেশগত মানদণ্ড আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ। শিল্প নেতারা জোর দিয়ে বলেন, সাভার ট্যানারি শিল্প অ্যাস্টেটের কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার (সিইটিপি) পুরোদমে চালু করা এবং একটি নতুন শোধনাগার স্থাপন করা দরকার সরকারের। জসিম উদ্দিন বলেন, কমপ্লায়েন্স সমস্যার কারণে স্বনামধন্য ব্র্যান্ডগুলোর কোনোটিই এ দেশের চামড়া ব্যবহার করতে চায় না। সে কারণে চামড়া রপ্তানিকারকরা আমদানিকৃত চামড়া ব্যবহার করেন। তিনি আরো বলেন, ‘সিইটিপি পুনরুদ্ধার বা নতুন সিইটিপি স্থাপনের জন্য খুব বেশি অর্থ বরাদ্দ লাগে না; তাই চামড়া শিল্পের স্থানীয় চামড়া ব্যবহার করার সুযোগ রয়েছে। এফবিসিসিআই প্রধান পরামর্শ দেন, আরেকটি বিকল্প হলো, সরকার উদ্যোক্তাদের ইটিপি স্থাপনের অনুমতি ও সাহায্য দিতে পারে। এটা তো কোনো রকেট সায়েন্স না। এর জন্য শুধু কিছু টাকা দরকার।
বাংলাদেশ ট্যানার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি শাহীন আহমেদ পণ্যের বহুমুখীকরণের জন্য বিশেষ করে চামড়া খাতকে সহায়তা দেয়ার কোনো উদ্যোগ দেখছেন না বলে জানান। নিজস্ব ইটিপি স্থাপনের জন্য শিল্পগুলোকে বর্জ্য শোধনাগারের যন্ত্রপাতি শুল্কমুক্ত আমদানির অনুমতি দেয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, স্থানীয় কাঁচামালের সুযোগ কাজে লাগাতে চাইলে আগে আমাদের কমপ্লায়েন্স সমস্যার সমাধান করা উচিত।
বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশের প্রত্যেক মিশনের জন্য নির্দিষ্ট টার্গেট নির্ধারণ করে দেয়া হয়। মিশনগুলোর পারফরম্যান্সও মূল্যায়ন করা হয়। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি), বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও বাণিজ্য সংগঠনগুলো বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় বাণিজ্য প্রদর্শনীর আয়োজন করে। কিন্তু রপ্তানি কমবেশি কয়েকটি ঐতিহ্যবাহী বাজারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ আছে। ইপিবির সা¤প্রতিক প্রতিবেদন বলছে, শুধু চার ঐতিহ্যবাহী বাজার- ইইউ, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও জাপান থেকেই বিদায়ি অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিলের সময়কালের রপ্তানি আয়ের ৬৯ শতাংশ এসেছে। শিল্পসংশ্লিষ্টরা বলছেন, তাদের সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে আয় করার জন্য কাগজে-কলমে নয়, বাস্তবে যথাযথ নীতি সহায়তা প্রয়োজন।
এফবিসিসিআই সভাপতি জসিম উদ্দিন বলেন, আমাদের সম্ভাবনাময় খাতগুলোকে কমপ্লায়েন্স, দক্ষতা, বাজার বা গবেষণা এবং পণ্যের মানোন্নয়ন নিয়ে কাজ করতে হবে। তাদের শিল্প পার্কে যেতে হবে। এসব চাহিদা পূরণে সরকারকে সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। পণ্যের বৈচিত্র্য নিয়ে আমরা অনেক দিন ধরে কথা বলছি। এমনকি আমাদের প্রধানমন্ত্রীও পণ্যে বৈচিত্র্য আনতে আহ্বান জানিয়েছেন। এজন্য একটা বিস্তৃত নীতি থাকা উচিত, যা আমাদের নেই।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়