বিশ্বে দূষিত শহরের তালিকায় চতুর্থ ঢাকা

আগের সংবাদ

দায়িত্ব নিলেন রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন

পরের সংবাদ

বিল্লালের দিনকাল

প্রকাশিত: এপ্রিল ২১, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: এপ্রিল ২১, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

পাশের ঘরের কম বয়সি বউ সালেহা বারান্দায় শুয়ে আছে। ওর মুখ দেখা যাচ্ছে না। কনুইটা ভাঁজ করে রেখেছে চোখের ওপর। একটা পা হাঁটুমোড়া, অন্য পা একটু বাঁকাভাবে প্রসারিত করে রেখেছে মাদুরের বিছানায়। পায়ের গোড়ালি থেকে শাড়ির প্রান্ত হাঁটু ছাড়িয়ে উরুর কাছে উঠে গেছে। মাংসল পা আর কলার থোরের মতো মসৃণ গোলাপি উরুর বেশ খানিকটা অনাবৃত। বিল্লাল তার ঘরের বারান্দায় বসে নেশা ধরা চোখে সেই দিকে তাকিয়ে থাকল।
ন্যাংটো, গোলগাল নাদুস-নুদুস বাচ্চাটি মায়ের পাশে শুয়ে ছিল, কী মনে করে সে হামা দিয়ে বউটার নিভাঁজ ফর্সা পেটের ওপর উঠে এসে ছোট্ট হাত বাড়িয়ে বুকের কাপড় টানতে লাগল। একটু নড়ে উঠল সালেহা। চোখের ওপর থেকে হাতটা সরিয়ে বুকের আঁচল টেনেটুনে শিথিল করল। তারপর ব্লাউজের নিচে আঙুল ঢুকিয়ে ব্লাউজের প্রান্ত টেনে উপরে তুললে দুটো পুরুষ্ট গোলাপি স্তন টলমল করে বের হয়ে এলো ব্লাউজের তলা থেকে। বিল্লালের চোখের দৃষ্টি ইষৎ কেঁপে উঠে সেখানে স্থির হয়ে গেছে। তার ভেতর থেকে ভুস করে মাথা তুলে তাকাচ্ছে একটা মাংশাসী প্রাণী, খাঁচায় অবরুদ্ধ প্রাণীটা ক্ষুধার্ত।
শিশুটি চঞ্চল। সে পা দুটো পেছনে ভাঁজ করে নাচাচ্ছে আর চুকচুক করে স্তন খাচ্ছে। সালেহা ডান হাতটা মুড়ে আবার চোখ ঢেকে শুয়েছে।
বিল্লাল তাকিয়েই ছিল, হঠাৎ অস্ফুট বিরক্তিমাখা শব্দ করে শিশুটিকে ধাক্কা দিয়ে একপাশে সরিয়ে উঠে বসল সালেহা। মাথা নিচু করে স্তনের বোটায় আঙুল বুলাতে বুলাতে রাগান্বিত চোখে বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। বাবুটা বোধহয় স্তনের বোটায় কামড়ে দিয়েছে, বিল্লাল ভাবল, আর তখন সালেহা হঠাৎ মুখ তুলে তাকালে বিল্লালের সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল। ক্ষণিকের জন্য হলেও বিল্লাল লক্ষ্য করল মেয়েটির চেহারায় একটা রাগ রাগ ভাব, দুই ভুরু কুঁচকানো। হাত দিয়ে ঝট করে ব্লাউজটা টেনে নামিয়ে বুক ঢাকল সে। তারপর বাবুকে কোলে তুলে দ্রুত ঘরের ভেতর ঢুকে গেল।
গলির ভেতর দিকে এই জায়গাটা বেশ নিরিবিলি। পাশাপাশি দুটো মাত্র ঘর। হাঁটু সমান উঁচু ভাঙাচোরা একটা ইটের দেয়াল ঘর দুটোকে আলাদা করে রেখেছে। এ পাশটায় বিল্লাল থাকে। পাশের ঘরে নতুন ভাড়াটে মালেক তার স্ত্রী আর তাদের ছোট্ট বাবুকে নিয়ে থাকে। বাবুটা হামাগুড়ি দেয়। বিল্লাল কাকডাকা ভোরে গাড়ি নিয়ে বের হয়, ফিরে মধ্যরাতে। প্রতিবেশীর সঙ্গে তার দেখা-সাক্ষাৎ হয় না বললেই চলে। এলাকায় হঠাৎ করে লকডাউন ঘোষণা করায় এবং বাস চলাচল বন্ধ হয়ে গেলে বিল্লাল এখন গৃহবন্দি জীবন কাটাচ্ছে। তার ঘর লাগোয়া এক চিলতে বারান্দা। সেখান থেকে পাশের ঘরের ঘুপচিমতো বারান্দা নজরে আসে। প্রতিবেশীর বউ আর তার বাবুটাকে প্রায় সময়ই বারান্দায় দেখতে পায় বিল্লাল। তবে সালেহার স্বামী মালেককে দেখা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে বেশ ক’দিন থেকে মালেক বাড়িতে নেই। লোকটা উঁচু গলায় কথা বলে। তার গলা শোনা যাচ্ছে না। সাড়াশব্দও নাই।
সন্ধ্যা বেলা গলির মুখে অন্ধকার জমতে শুরু করেছে। সিগারেট ধরাতে গিয়ে বিল্লাল দেখল ম্যাচে কাঠি নেই। কী ভেবে সে পায়ে পায়ে পাশের ঘরের বারান্দায় এসে দাঁড়াল। দরজাটা বোজানো। দরজার ফাঁক গলিয়ে একটা ¤øান আলোর রেখা বারান্দার মেঝেতে গড়িয়ে পড়েছে।
রারান্দায় কারো উপস্থিতি টের পেয়েই বোধহয় ভেতর থেকে বউটা সন্দিগ্ন গলায় বলে উঠল, কে?
আমি, বিল্লাল, পাশের ঘরে থাকি। বলে খুক খুক করে দু’বার কাশল সে। ভেতরে চুড়ির শব্দ হচ্ছে। মনে হচ্ছে মেয়েলোকটি পরনের শাড়ি টেনেটুনে গায়ে জড়াচ্ছে। একটু পরেই বোজানো দরজার ফাঁকে তাকে দেখা গেল।
কী চান? ঘরের ভেতর টিমটিমে আলোর আভা পড়েছে সালেহার চোখেমুখে। বড় বড় দুই চোখে চাপা বিরক্তির ছাপ। আঁচলটা আঁটসাঁটভাবে কোমরে বাঁধা। বিল্লাল তার দিকে তাকিয়ে একটু হাসতে চেষ্টা করে বলল, ম্যাচের কাঠি ফুরায়ে গেছে। ক’টা কাঠি দিবা? সিগারেট ধরাব।
অইখানে খাড়ান। তার দিকে এক পলক তাকিয়ে সালেহা বলল। কণ্ঠস্বর ঝাঁঝাল শোনালেও তাতে যেন ভয়ের কাঁপন মিশে আছে। ভয়টা অমুলক নয়। জানাশোনা নেই এরকম কোনো লোক যদি রাতের অন্ধকারে একাকী থাকা একটি যুবতী মেয়ের ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ায়, তাহলে ভয় তো হবেই। এই ভাবে হুট করে চলে আসাটা ঠিক হয়নি বোধহয়। বিল্লাল বারান্দার আলো-আঁধারিতে দাঁড়িয়ে এই রকম ভাবছে। অন্ধকার দেয়ালের কোথাও একটা টিকটিকি টক্ টক্ করে ডেকে উঠল। বিল্লাল চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। একসময় দরজায় সালেহার সাড়া পেয়ে মুখ তুলে তাকাল। এক হাতে দিয়াশলাইটা বিল্লালের দিকে বাড়িয়ে ধরে আছে সে। ঘরের ভেতর থেকে উঁজিয়ে পড়া ¤øান হলদে আলোয় বউটির সুডৌল ফর্সা হাত যেন অস্পরীর হাতের মতো কোমল, পেলব, মায়াবী। বিল্লাল ম্যাচটা নিল। ক’টা কাঠি বের করে ম্যাচটা ফিরিয়ে দেবে ভাবছিল, দেখল সালেহা দরজা বন্ধ করে দিয়েছে।
ম্যাচটা রাইখা দেও। গলার স্বর খানিকটা উঁচু করে বিল্লাল বলল।
লাগবে না, ম্যাচটা আপনি নিয়া যান। ভেতর থেকে নিরাসক্ত গলায় সালেহা জানাল। দরজার তলায় ফাঁকটুকুতে যে আলোর রেখা দেখা যাচ্ছিল, সেটা হঠাৎ মিলিয়ে গেল। সালেহা ঘরের আলোটা নিভিয়ে দিয়েছে।
বিল্লাল বারান্দায় খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ফস করে সিগারেটে জ¦ালাল। জ¦লন্ত সিগারেটটা ঠোঁটে চেপে ক’টা টান দিল। তামাকের কড়া গন্ধমাখা ধোঁয়া তার মগজে নেশার সুড়সুড়ি দিচ্ছে। অন্ধকার কালিঝুলি মাখা বন্ধ দরজার ওপর একবার ধূর্ত চোখের দৃষ্টি বুলাল সে, তারপর চুপচাপ নিজের ঘরের দিকে হাঁটতে লাগল। হেঁটে হেঁটে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা নিম গাছটার নিচে এসে থামল। গাছের নিচে কাছাকাছি দূরত্বে দুটো বস্তা রাখা আছে। বস্তাগুলোর মুখ বাঁধা। ভেতরে ত্রাণের খাদ্যসামগ্রী হবে। নিশ্চয় পুলিশের লোকজন রেখে গেছে। দুই বাড়ির জন্য দুটি বস্তা। বিল্লাল মুখ ঘুরিয়ে তাকাল। সালেহাদের ছোট্ট বারান্দাটা অন্ধকারে ডুবু ডুবু। মনে হচ্ছে সালেহা আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়েছে। বিল্লাল বস্তা দুটো দুই হাতে ঝুলিয়ে নিজের ঘরে ফিরে এলো।
রোজকার মতো বিল্লালের ঘুম ভেঙেছে সেই কাক-ডাকা ভোরে। দেহ মনে প্রবল আলস্য নিয়ে সে বিছানায় এপাশ-ওপাশ করছে। কিছুদিন আগেও সে ভোরবেলা খুব তাড়াহুড়ো করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে। করোনার কারণে বাস চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর থেকে সকালটা আর তাকে তাড়িয়ে বেড়ায় না। এখন সে প্রতিদিন এভাবে বেলা পর্যন্ত বিছানায় গড়াগড়ি দেয়। দরজাটা খোলা। বিল্লাল অলস চোখে তাকিয়ে থাকে। মৃদু রোদের ঝাঁঝ নিয়ে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে পৃথিবীটা। কাছেই নিম গাছে একটা কাক ডাকছে। ক’টা চড়ই তার স্বরে ঝগড়া করছে কোথাও। রোজই পৃথিবীটা এইভাবে দরজায় এসে দাঁড়ায় তারপর সন্ধ্যায় রোদের তেজ ফুরিয়ে গেলে অন্ধকারের চাদর গায়ে জড়িয়ে ঘুমাতে যায়। পরদিন সকালে আবার আসে, সন্ধ্যা হলে আবার ফিরে যায়। ঘরে বসে এই যাওয়া-আসা দেখতে দেখতে হাঁপিয়ে উঠেছে বিল্লাল। ঘর থেকে বাইরে যাওয়ার জো নেই। অদৃশ্য মৌমাছির মতো বাতাসে উড়ে বেড়াচ্ছে করোনা আতঙ্ক। কখন কাকে হুল ফুটাবে কে জানে। তার ওপর আছে পুলিশের দাবড়ানির ভয়। রাস্তায় পা দিলেই পুলিশ লাঠি নিয়ে তেড়ে আসে। লকডাউনের ঘোরপ্যাঁচে এ এক অদ্ভুত, অনভিপ্রেত বন্দিজীবন।
এই যে, শুনছেন, বাইরে থেকে একটা মেয়েলি গলার স্বর শুনে তড়াক করে বিছানা থেকে নামল বিল্লাল। বারান্দায় পা দিয়ে অবাক হলো। দেয়ালের ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে প্রতিবেশীর বউ সালেহা।
সে এগিয়ে এসে সালেহার কাছে দাঁড়াল। সালেহার বড় বড় দুটি চোখ লাল। চোখে-মুখে রাতজাগা ক্লান্তি। তার দিকে এক পলক তাকিয়ে থেকে বিল্লাল জিজ্ঞাসা করল, কী সমস্যা?
আমার পোলাডার খুব জ্বর। বিচলিত গলায় সালেহা বলল। কথাটা কানে যেতেই সহসা একটা উদ্বেগ ফেনিয়ে উঠল বিল্লালের ভেতর। সময়টা খুব খারাপ। কারো সর্দি, কাশি, জ¦র, গলাব্যথার কথা শুনলেই একটা ভয় বুকের ভেতর দিয়ে ওঠে। সে শুকনো গলায় বলল, জ¦র কি খুব বেশি?
বেশিই তো। পোলাডা সারা রাত ছটফট করছে। ঘুমায় নাই। আমি এখন কী করব? খুব ডর লাগতেছে। সালেহা সন্দিহান চোখে বিল্লালের দিকে তাকিয়ে থাকল। ভয় লাগার কারণটা বুঝে নিয়েছে বিল্লাল। সে দ্রুত চিন্তা করছে। লকডাউনের কারণে আশপাশে সব ফামের্সি বন্ধ, ক্লিনিকগুলো দরজা এটেঁ দিয়েছে। ডাক্তাররা চেম্বারে বসে না। হাসপাতাল এখান থেকে অনেক দুর। যান চলাচল বন্ধ। হাসপাতালে যাওয়ার উপায় নেই। তাছাড়া হাসপাতালগুলো রোগী নিচ্ছে না।
ঘরে জ¦রের কোনো ওষুধ আছে? বিল্লাল জিজ্ঞাসা করলে অসহায় ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল সালেহা। তাকে দাঁড় করিয়ে বিল্লাল দ্রুত নিজের ঘরে এলো। মাঝে মাঝে জ¦র, মাথাব্যথা হলে প্যারাসিটামল বড়ি খায় সে। পাতায় কয়েকটা বড়ি রয়ে গেছে। ফিরে এসে সালেহার হাতে বড়িগুলো দিয়ে বলল, একটা বড়ির আর্ধেক গুঁড়া করে ছাওয়ালটারে খাওয়ায়ে দেও। জ¦র নেমে যাবে। সালেহা ফিরে যাচ্ছিল বিল্লাল তাকে ডাকল, শোন, ঘরে খাবার-দাবার আছে? তার কথা শুনে সালেহা মুখটা মলিন করে তাকাল। আড়ষ্ট গলায় বলল, পোলার বাপ চাল ডাল যা কিছু রেখে গেছিল সব শেষ। দুই দিন ধরে ঘরে চাল নাই। মেয়েটির লাবন্যভরা মুখে, চোখের কোঠরে কষ্টের কালিমা লেগে আছে। বিল্লাল একদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকল, কিছু বলল না।
খানিক পরেই একটা মুখ বাঁধা বস্তা হাতে ঝুলিয়ে প্রতিবেশীর বারান্দায় এসে দাঁড়াল বিল্লাল। আসলে বউটাকে ডেকে দেয়ালের এইপাশ থেকে বস্তাটা তার হাতে তুলে দিতে পারতো সে। চিন্তাটা মাথায় এসেছিল কিন্তু একটা তীব্র মৌ মৌ সুবাস পতঙ্গের মতো সালেহাদের ঘরের বারান্দা পর্যন্ত টেনে নিয়ে গেল তাকে। খাটের ওপর শোয়ানো অসুস্থ বাচ্চাটার কপালে জলপট্টি দিচ্ছিল সালেহা। তাকে দেখে মাথায় আঁচল টেনে দরজার কাছে এসে দাঁড়াল।
বিল্লাল হাত থেকে বোঝাটা নামিয়ে অভিভাবকসুলভ গম্ভীর গলায় বলল, এই বস্তায় চাল, ডাল, তেল, আলু আছে। ঘরে নিয়া রাখ। আর কিছু লাগলে আমাকে বলবা।
সব আমাদের দিলেন, আপনার জন্য আছে তো?
অসুবিধা নাই। আমি একা মানুষ। চালায়ে নেব, বিল্লাল বলল। সালেহা গভীর চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। বিল্লালের মনে হলো মেয়েটির বড় বড় চোখে কৃতজ্ঞতা ছাড়াও আরো যেন কিছু আছে। একটু চুপ থেকে সালেহা মৃদু স্বরে বলল, ঘরে আসেন, বসেন। সালেহার কথায় বিল্লালের ভেতরটা যেন চনমন করে উঠল। যে সুবাসটা তাকে এখানে তাড়িয়ে নিয়ে এসেছে, এখন মুখোমুখি দাঁড়ানো সালেহার শরীর থেকে যেন সেই সুবাসটা পাচ্ছে সে। ইচ্ছা করছে মেয়েটির আরো কাছে গিয়ে যেন দাঁড়ায়। তার শরীরের সুবাসে নাক ডুবিয়ে থাকে। তবে এরকম কিছুই করল না বিল্লাল। মৃদু প্রসন্ন হাসি টেনে বলল, এখন যাই, অন্য সময় আসব। তুমি বাবুর দিকে খেয়াল রাখ। বিল্লাল চলে আসছিল, হঠাৎ কিছু মনে হওয়ায় সালেহার দিকে ফিরে বলল, বাবুর বাপ বাড়িতে নাই? তাকে তো দেখতেছি না।
বিল্লালের দৃষ্টি এড়াল না। মেয়েটির সৌম্য মুখশ্রী মুহূর্তেই বিষাদে ছেয়ে গেছে। ছলছল চোখ দুটো আড়াল করতেই বোধ হয় সে মুখ নিচু করে মেঝের দিকে তাকাল। আড়ষ্ট গলায় বলল, সে তো কারখানায় গেছিল, সেখানে কাজে আটকে গেছে। কিছুক্ষণের জন্য বুঝি অন্যমনস্ক হয়ে গেল সালেহা। লোকটা সম্পর্কে আর কিছু জানার আগ্রহ দেখাল না বিল্লাল, মুখ ফিরিয়ে নিজের ঘরের দিকে হাঁটছে সে।
পড়ন্ত বিকালের ¤øান রোদ শরীরে মেখে দেয়ালের কাছে এসে দাঁড়াল সালেহা। তার মুখটা বিষন্ন, চিন্তাচ্ছন্ন। আঁচলের নিচ থেকে ঢাকা দেওয়া একটা থালা বিল্লালের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, আজ একটু রান্না করেছি। আপনার জন্য নিয়া আসলাম।
আহা, আমার জন্য আবার আনতে গেলা কেন? আমার ঘরে তো খাবার আছে। বিল্লাল ভুরু নাচিয়ে কপট বিরক্তির ভাব করে বলল। মুখের বিষন্নতা ছাপিয়ে একটা মিহিন হাসির দ্যুতি খেলছে সালেহার ঠোঁটে। সেই দিকে তাকিয়ে না করতে পারল না বিল্লাল, হাত বাড়িয়ে থালাটা নিল। অনেকটা ইচ্ছাকৃতভাবেই যেন সালেহার মাখনের মতো নরম আঙুলগুলোর সঙ্গে তার কঠিন কর্কশ আঙুলের ছোঁয়াছুঁয়ি হলে গেল।
বাবু এখন কেমন আছে? বিল্লাল জিজ্ঞাসা করলে সালেহার চোখেমুখে আবার বিষন্নতা ফুটে উঠল। বলল, জ¦র নামতেছে আবার আসতেছে। পোলাডারে ডাক্তার দেখাতে পারলে ভালো হতো।
কথাটা লুফে নিয়ে বিল্লাল বলল, জ¦রের গতিক তো ভালো ঠেকতেছে না, ডাক্তার দেখানো দরকার।
এই লকডাউনে রাস্তায় বাইর হওয়া যাবে? পুলিশকে আমার ভয় করে। সংশয় জড়ানো গলায় সালেহা বলল।
ভয়ের কিছু নাই। আমি তোমাদের নিয়া যাব।
তার কথায় সালেহা ভরসা পেল বোধহয়। দুই পাশে মাথা ঝাঁকালো সে। তার চোখেমুখে নীরব সম্মতির ইঙ্গিত লক্ষ্য করে মনে মনে খুশি হলো বিল্লাল। মেয়েটির লাবন্যমাখা মুখের দিকে তাকিয়েই ছিল সে, সেই সময় ভেতর থেকে বাবুর কান্নার শব্দ ভেসে এলে দ্রুত ঘরের দিকে দৌড়ে গেল সালেহা। ছুটে যাওয়ার কারণে তার কোমরটা নদীর ঢেউয়ের মতো দুলে দুলে উঠল। সেই ঢেউয়ের ভেতর বিল্লালের লোলুপ চোখদুটো হাবুডুবু খাচ্ছে।
আজ অনেক দিন পর বিল্লাল খুব তৃপ্তির সঙ্গে ভাত খেয়েছে। খাওয়ার পর আয়েশ করে একটা সিগারেট ধরিয়েছে। প্রতিবেশী বউটার চিন্তা ঘুর ঘুর করছে মাথায়। কাল বাবুসহ তাকে নিয়ে বের হবে। লকডাউনের জন্য আশপাশে সব দোকানপাট এখন বন্ধ। বন্ধ থাকলেই ভালো, ডাক্তারের খোঁজে সালেহাকে নিয়ে সে এক চেম্বার থেকে আরেক চেম্বারে যাবে। এক ক্লিনিক থেকে আরেক ক্লিনিকে যাবে। প্রয়োজন হলে সারা শহর ঘুরে বেড়াবে। পুলিশের তাড়া, করোনার ভয়, সড়কের ভৌতিক নির্জনতায় অ্যাম্বুলেন্সের চিৎকার এসব কিছুই যেন তার কাছে বাধা মনে হচ্ছে না। যুবতী মেয়েটির সঙ্গ পাওয়ার জন্য একটা উম্মাদনা এখন তার মাথার ভেতর দুষ্টু মাছির মতো ভোঁ ভোঁ করে উড়ছে।
ভোর বেলা তন্দ্রার মধ্যে ছিল বিল্লাল। হঠাৎ কেউ যেন চিৎকার করে কেঁদে উঠল। শব্দটা সালেহাদের ঘর থেকেই আসছে। মনে হল সালেহার কণ্ঠস্বর। একটা অশুভ চিন্তা মনে উঁকি দিলে সে দ্রুত বিছানা ছেড়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। গলা চড়িয়ে বলল, ও বাবুর মা, কি হইছে, কান্নাকাটি করতেছো কেন, কী সমস্যা? প্রতিবেশীর ঘরের দরজা হা করে খোলা। দরজায় সালেহাকে দেখা গেল না। দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে সালেহার স্বামী মালেক। সে বিল্লালকে উদ্দেশ করে আবেগ জড়ানো গলায় বললো, কিছু হয় নাই। আমাকে করোনা ধরেছিল, বউ ভেবেছিল আমি শেষ। তাই আমাকে দেখে বউ খুশিতে চিৎকার করে উঠল। ভাই আপনে ভালো আছেন তো? ঘরে থাকবেন, সাবধানে থাকবেন।
মালেককে দেখে মনে মনে চুপসে গেল বিল্লাল, খুশি হলো না মোটেও। মালেকের কথার কোনো উত্তরও দিল না। ভুরু উঁচিয়ে বিতৃষ্ণ মুখে ঘরে এসে বিছানায় শুয়ে পড়ল। আজকের দিনটা সালেহার সঙ্গে কাটাবে ভেবেছিল। এই সময়ে মালেকের ফিরে আসাটা একটা দুঃস্বপ্নের মতো লাগছে। করোনা এতো লোককে নিয়ে গেল মালেককে ছেড়ে দিল কেন? কথাটা যতই ভাবছে, ততই বিল্লাল ড্রাইভারের চাঁদি গরম হয়ে উঠছে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়