বিশ্বে দূষিত শহরের তালিকায় চতুর্থ ঢাকা

আগের সংবাদ

দায়িত্ব নিলেন রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন

পরের সংবাদ

নজরুল কাব্যে ঈদ ভাবনা ও তার সাম্যবাদ

প্রকাশিত: এপ্রিল ২১, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: এপ্রিল ২১, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বাঙালি জাতিসত্তার যেমন সর্বশ্রেষ্ঠ রূপকার, তেমনি হিন্দু-মুসলিম সাংস্কৃতিক সত্তারও শ্রেষ্ঠ রূপকার। বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতম কবি, শ্রেণিসংগ্রামের কবি, মানবতাবাদী ও অসাম্প্রদায়িক কবি হিসেবে তিনি যেভাবে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে আসীন, তেমনি সংগীত রচয়িতা ও সংগীতের বিষয় বৈচিত্র্য এবং সুর বৈচিত্র্যের অনুপম ¯্রষ্টা হিসেবে মিয়া তানসেনের পর তার সমকক্ষ আর কেউ নেই।
আর বাংলা সাহিত্য ও সংগীতজগতে ইসলামী মূল্যবোধ, ইসলামী ঐতিহ্য, ইসলামী সংস্কৃতি, ইসলামী আদর্শ ও ধ্যানধারণার প্রণয়ন, প্রচার-প্রসারের তিনিই পথিকৃত।
‘ইসলাম যে শুধু শান্তি ও প্রেমের নয়; সাহস, শক্তি ও বীর্যের, শুধু আধ্যাত্মিকতার নয়; মানবিকতার, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার এবং সমাজ জীবনে ন্যায়ের নিয়ামক ভূমিকার তথা সমাজ বিপ্লবের- সেই বাস্তবতার প্রতিফলন। তারই মহিমাময় প্রতিচ্ছবি তার ইসলামী গান’। (নজরুল ইসলাম : ইসলামী গান- আবদুল মুকিত চৌধুরী)
ভারতীয় মুসলিম সমাজে সংগীত চর্চায় যখন হারামের ফতোয়া চলছে, কাজী নজরুল ইসলামই সর্বপ্রথম ‘হামদ্’, (আল্লাহ প্রশস্তি), ‘নাত-ই-রাসুল’, [মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর প্রশস্তি], ইসলামী জাগরণী গান, মরমী গান রচনা করে বাংলা সাহিত্য ও সংগীতে নতুন ধারার প্রবর্তন করেন। নজরুলের ইসলামী গান কুরআন ও হাদিসভিত্তিক। তার ‘হামদ’, ‘নাত’ আল্লাহর প্রশস্তি ও রাসুলের মহিমা বর্ণনা, কোনো ভক্তিমূলক গান নয়। তার এসব গানের আবেদনের মধ্যে আল্লাহ ও রাসুলের প্রতি বিশ্বাস ও শ্রদ্ধার ভাব প্রকাশিত হয়েছে।
আজ তার রমজানবিষয়ক কাব্য-সংগীত নিয়ে সংক্ষিপ্ত আকারে আলোচনা করা হলো।
কুরআনুল কারিম নাজিল হয়েছে এই পবিত্র রমজান মাসে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন, ‘শাহরুল রামাদানাল্লাজি উনযিলা ফি হিল কুরআন’ অর্থাৎ রমজান সেই মাস, যেই মাসে কুরআন নাজিল করেছি।’
আর কাজী নজরুল ইসলামও আল্লাহর এই নিয়ামতের কথা তার কাব্যে যেভাবে উল্লেখ করেছেন-
‘ওগো রমজান!
আনিয়াছিলে দুনিয়াতে তুমি
পবিত্র কোরআন….।’
মুসলমানদের জন্য রোজা ফরজ। আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য ধনী-গরিব সবাই এক মাস কঠোর সিয়াম সাধনায় রত থাকেন। মাসের শেষে পশ্চিমাকাশে যখন নতুন ‘আল-হেলাল’ নজরে আসে, তখন বিশ্বের মুসলমানদের মধ্যে যে আনন্দ-উন্মাদনা-উচ্ছ¡াস জেগে ওঠে, তাদের মনের সেই ভাব প্রকাশ করে নজরুল তার প্রথম ইসলামী সংগীত রচনা করলেন-
‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ,
তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে, শোন আসমানী তাগিদ।
তোর সোনা-দানা বালাখানা সব রাহে লিল্লাহ,
দে যাকাত, মুর্দা মুসলিমের আজ ভাঙাইতে নিঁদ।
আজ ভুলে যা তোর দোস্ত-দুশমন, হাত মেলাও হাতে,
তোর প্রেম দিয়ে কর বিশ্ব নিখিল ইসলামে মুরিদ …’।
ঈদের চাঁদ দেখার সঙ্গে সঙ্গে টিভি চ্যানেল
সমূহ ও বেতারে একসঙ্গে যন্ত্র সহযোগে এই সংগীত যখন বেজে ওঠে, তখন ঈদের আনন্দ, জোশ হাজারগুণ বেড়ে যায়। আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সবার মনে এক অনন্য পুলক শিহরণ জাগে। আব্বাসউদ্দিনের ছেলে ও মেয়ে মুস্তাফা জামান আব্বাসি ও ফেরদৌসি রহমানও গানটি জনপ্রিয় করেছেন।
কিন্তু গরিবের জন্য এই ঈদ তো শুধু ঈদ নয়, এটি যে ধনীদের কাছ থেকে, ধনীদের সঞ্চিত অর্থে আল্লাহর নির্ধারিত তাদের যে হিস্যা/প্রাপ্য অংশ রয়েছে, তারও পাওয়ার, আদায়ের সময়। তাই নজরুল ইসলাম কুরানের বাণীর ‘আকিমুস সালাতা ওয়াতুয জাকাত’ (নামাজ কায়েম কর এবং জাকাত দাও) অনুসরণে লিখলেন-
‘দে জাকাত, দে জাকাত, তোরা দে রে জাকাত,
তোর দিল খুলবে পরে- ওরে আগে খুলুক হাত।
দেখ্ পাক কোরান, শুন্ নবীজির ফরমান,
ভোগের তরে আসেনি দুনিয়ায় মুসলমান।
তোর একার তরে দেননি খোদা দৌলতের খেলাত।
দে জাকাত, দে জাকাত …’
কাজী নজরুল ইসলাম মানবতার কবি। সাম্যের কবি। শ্রেণিসংগ্রামের কবি। গরিব, কৃষক, মুটেমজুর আর দৌলতবান মানুষের ঈদ-আনন্দ কেমন, তা তিনি জানেন। তাইতো ‘কৃষকের ঈদ’ কবিতায় ক্ষুব্ধ কবি লিখেন-
‘বেলাল! বেলাল! হেলাল উঠেছে পশ্চিম আসমানে,
লুকাইয়া আছ লজ্জায় কোন মরুর গোরস্তানে!
হের ঈদগাহে চলিছে কৃষক যেন প্রেত-কঙ্কাল,
কশাইখানায় যাইতে দেখেছ শীর্ণ গরুর পাল?
রোজা এফতার করেছে কৃষক অশ্রæ- সলিলে হায়,
বেলাল! তোমার কণ্ঠে বুঝি গো আজান থামিয়া যায়!..
জীবনে যাদের হররোজ রোজা ক্ষুদায় আসেনা নিঁদ,
মুমূর্ষু সেই কৃষকের ঘরে এসেছে কি আজ ঈদ …?
তিনি এই শ্রেণিগত ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের অবসান চেয়েছেন। সে বৈষম্যহীন সমাজব্যবস্থা কায়েম হলেই তবে-
‘রোজা ইফতার করিব সেদিন সেই দিন ঈদ হবে।’
শ্রেণি বৈষম্য, নির্যাতিত, নিপীড়িত, মজলুমের আহাজারি, অসাম্য, দরিদ্রতার নির্মম কশাঘাত থেকেই নজরুলের বিদ্রোহী-সত্ত্বার জন্ম। জন্ম তার প্রেম ও দ্রোহের।
তার সাম্যবাদ মূলত, ইসলামী সাম্যবাদ। আল্লাহ তায়ালার নির্দেশিত আল কুরআনের সাম্যবাদ। এখানে আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার মতো ‘নাই অধিকার সঞ্চয়ের’। ধনীর ধনে গরিবেরও অংশ রয়েছে। জাকাতের মাধ্যমে তা গরিবের হাতে তুলে দিতে হবে। এটা কোনো করুণা নয়, প্রাপ্য অধিকার। তাই নজরুল ইসলাম শুনালেন-
‘মোরা শুধু জানি, যার ঘরে ধন-রতœ জমানো আছে,
ঈদ আসিয়াছে, জাকাত আদায় করিব তাদের কাছে।
এসেছি ডাকাত জাকাত লইতে পেয়েছি তাঁর হুকুম,
কেন মোরা ক্ষুধা- তৃষ্ণায় মরিব, সহিব এই জুলুম?’ (ঈদের চাঁদ)
তবে ধনী গরিব সব মুসলমান যে যেভাবে পারুক, তারা আল্লাহর হুকুম আহকাম পালনে তৎপর থাকেন। ঈদের চাঁদ দেখার সঙ্গে সঙ্গে আনন্দে আত্মহারা হয়ে ওঠেন। কাজী নজরুল ইসলামের কাব্যে তার প্রতিফলন রয়েছে-
‘এলো ঈদুল-ফেতর এলো ঈদ্ ঈদ্ ঈদ্
সারা বছর যেই ঈদের আশায় ছিল নাকো নিঁদ।
রোজা রাখার ফল ফলেছে দেখরে ঈদের চাঁদ,
সেহেরি খেয়ে কাটুক রোজা আজ সেহেরা বাঁধ..
প্রেমাশ্রæতে অজু করে চল ঈদগাহ্ মসজিদ।’
কাজী নজরুলের প্রতিটি কবিতা, গানের কথা গণমানুষের নিজের কথা, তাদের নিজেদের অভিব্যক্তি। তাদের মনের উচ্ছ¡সিত ভাব প্রকাশ। ঈদের দিনে কবি তাদের মুখে ভাষা দিলেন-
‘পথে পথে আজ হাঁকিব বন্ধু ঈদ মোবারক! আসসালাম!
ঠোঁটে ঠোঁটে আজ বিলাব শিরনী ফুল-কালাম,
বিলিয়ে দেয়ার আজিকে ঈদ।’
মানুষে মানুষে নাই ভেদাভেদ, নাই ইসলামে আতরাফ আশরাফ। নাই কুলীন, অকুলীন, উচ্চ-নিচ। ঈদের জামাতই তার প্রমাণ-
‘দোস্ত-দুশমন এক জামাত,
আজি আরাফাত ময়দান পাতা গাঁয়ে গাঁয়ে,
কোলাকোলি করে বাদশাহ ফকিরে ভায়ে ভায়ে,
কাবা ধরে নাচে লাত-মানাত।’
সোনাদানা, বহুমূল্য হীরা মুক্তা, জেওয়ারাত ছাড়াও আল্লার রাহে নিজেকে উৎসর্গকৃত একজন গরিব মুসলমান নারী প্রার্থিব জেওরাত ছাড়া কীভাবে আল্লাহ রাসুল মা ফাতেমা, হাসান হোসেন এবং চার খলিফাকে জেওরাত হিসেবে ব্যবহার করে ঈদের সাজে সাজিয়েছেন, তা নজরুল ইসলাম তার ‘ঈদ’ নাটিকায় নায়িকা গুলশানের কণ্ঠে জানিয়েছেন-
‘নাই হলো মা বসন ভূষণ এই ঈদে আমার,
আল্লাহ আমার মাথার মুকুট, রসুল গলার হার।
নামাজ রোজা ওড়না শাড়ি, ওতেই আমায় মানায় ভারী,
কলমা আমার কপালে টিপ, নাই তুলনা তার।
(আমার) হাতে সোনার চুড়ি যে মা, হাসান হোসেন মা ফাতেমা,
(মোর) অঙ্গুলিতে অঙ্কুরী মা নবীর চার ইয়ার।’
কাজী নজরুল ইসলাম ঈদকে শত্রæ-মিত্র, আতরাফ আশরাফ ও গোত্র বর্ণ নির্বিশেষে মহামিলনের উৎসব হিসেবে বর্ণনা করে সবাইকে সালাম, প্রণতি জানিয়েছেন-
‘ঈদ মোবারক, ঈদ মোবারক-
দোস্ত- দুশমন পর ও আপন
সবার মহলে আজি হউক রওনক
সবারে জানাই এ দিল্ আশক….
মিলিয়া ফকির শাহানশাহে
এ ঈদগাহে গাহুক ইয়াহক’
এটি নজরুলের একার অভিব্যক্তি বা আহ্বান নয়। এটি তার পক্ষ থেকে মুসলমানদের প্রতি একটি ঈমানি দাওয়াত। ইসলামের ভ্রাতৃত্বভাবের শিক্ষা।
কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের জাতীয় কবি। আমাদের জাতীয়-সাহিত্যের ¯্রষ্টা। বাঙালি জাতীয়তাবাদের সঙ্গে সঙ্গে তার কাব্য সাধনার মধ্য দিয়ে ইসলামী রেনেসাঁ তথা বাঙালি মুসলমানদের নব-জাগরণ সাধিত হয়েছে।
তিনিই মুসলিম জাগরণের কবি। বাংলাসাহিত্যে তার আবির্ভাবের পূর্বে মুসলমান কবি সাহিত্যিক ও তাদের রচিত সাহিত্যের কোনো মূল্যই ছিল না। মুসলমান কবি ও তাদের রচিত সাহিত্য বটতলার কবি, বটতলার সাহিত্য নামে অভিহিত হতো। সাহিত্যের এমনি এক অরাজক সময়ে পরম করুণাময়ের আশীর্বাদ হিসেবে ধূমকেতুর রথে চড়ে আবির্ভূত হলেন মানবতার কবি, সাম্যবাদের কবি, অসাম্প্রদায়িক কবি, মুসলিম রেঁনেসার কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তাকে কেন্দ্র করেই আজ মুসলমান কবি, সাহিত্যিক ও তাদের সাহিত্য বাংলাসাহিত্যের ইতিহাসে বিশেষ স্থান লাভ করার সুযোগ পেয়েছে।
নজরুল ইসলামের সাহিত্য চিরকালের। তার সাহিত্য অবিনশ্বর। আজকে ঈদের এই আনন্দক্ষণেও মুসলিম বিশ্বে অনৈক্য, বিভেদ, হানাহানি আর পরাশক্তির দুর্বিষহ নির্যাতন, জুলুম বিরাজমান। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা পাঠে ঋদ্ধ হই-
‘ঊর্ধে আদেশ হানিছে বাজ,
শহীদী-ঈদের সেনারা সাজ,
দিকে দিকে চলে কুচকাওয়াজ-
খোল্ রে নিঁদমহল”।
নজরুলের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে এই ঈদে আমাদেরও একান্ত কামনা-
‘তওফিক দাও খোদা ইসলামে
মুসলিম জাঁহা পুনঃ হোক আবাদ’।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়