ওয়ান ব্যাংক লিমিটেড : সাবেক পরিচালক এজাজ আহমেদ মারা গেছেন

আগের সংবাদ

সন্ত্রাসীদের হাতে অস্ত্রের মজুত : অরক্ষিত মিয়ানমার-ভারত সীমান্ত পেরিয়ে পাহাড়ে আসছে অত্যাধুনিক অস্ত্র

পরের সংবাদ

জন্মদিন : মঙ্গলবোধের অন্বেষণ

প্রকাশিত: এপ্রিল ৭, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: এপ্রিল ৭, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

: কেন্দ্রে কী?
: প্রকৃতি।
: প্রকৃতির রূপজ প্রভা আর বহুমাত্রিক সভারূপ কী?
: নারী।
: তা হলে পুরুষের অস্তিত্ব কোথায়?
: প্রকৃতির প্রাণপূর্ণতার মধ্যে।
: প্রকৃতির মৌলিক কর্ম কী?
: আনন্দে নিঃস্বার্থ দান।
: মানুষ ঐ দানকে কি নষ্ট করছে।
: হ্যাঁ।
প্রশ্নোত্তরে যে বিভাব-আলো-কথার প্রকাশের চেষ্টা হলো তার কাব্যরূপের পর্বভিত্তিক বিস্তার আমরা পাবো, বিশেষ ‘কুরশিনামা’য় (কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতা) বসে যদি অধ্যয়ন করি, মজিদ মাহমুদের ‘মাহফুজামঙ্গল’।
‘মাহফুজামঙ্গল’ পর্বে রচিত ৭টি সনেটের রসায়ন কী বলছে, কেন বলছে তার গভীর শেকড় অনুধাবন করতে হবে। সনেটগুলো ১৪ পঙ্ক্তির। মাত্রাপর্ব, সচেতনভাবেই প্রয়োজন মতো ব্যবহৃত। এবং ঐ সাতটি সনেট এই গ্রন্থের সুষুম্নাকাণ্ড। মেরুদণ্ডের মধ্যে ঐ সাদাটে নরম কাণ্ডে জীবনের অনুভব, অনুভূতির প্রবাহ চলিষ্ণু। আমরা বলতে পারি, মজিদ ঐ সাতটি সনেটে যা যা বলবার চেষ্টা করেছেন, তার বিভিন্নমাত্রিক বিস্তার, পুনরাবৃত্তি না করেই, ঘটিয়েছেন গ্রন্থের অন্য কবিতাগুলোর মধ্যে।
মানুষ যাপনের পথ খোঁজার কোনো এক সময় থেকে বুঝতে চেষ্টা করে, নৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থাপনায় মাঙ্গলিক আলোর প্রকাশ থাকা বাঞ্ছনীয়। পেগান-স্তরে নির্মিত- এই শতাব্দীতে এসেও পৌত্তলিকতা থেকে মানুষ মুক্ত নয়- রূপের মধ্যে মঙ্গলচেতনার আশ্রম খোঁজে ক্ষত, বিক্ষত মানুষ। ‘মঙ্গল’ শব্দটি পড়া বা শোনামাত্রই আমরা বোঝার চেষ্টা করি কোথাও আছে একটা শুভভাব, উপকারের চিত্র, হিতকর বাস্তব এবং কল্যাণময়তার প্রতিবিম্ব।
আমাদের মধ্যযুগে দেব-দেবীর মহিমা-কীর্তন করে রচিত হয়েছে মঙ্গলকাব্য। ‘চণ্ডীমঙ্গল’, ‘মনসামঙ্গল’ ও ‘ধর্মমঙ্গল’, ‘সারদামঙ্গল’ স্মর্তব্য। ‘চণ্ডী’ দুর্গার একরূপ বা দুর্গামূর্তি। এবং ‘মনসা’ হচ্ছেন সর্পদেবী বা সাপের অধিষ্ঠাত্রী। কাহিনীকাব্যের বয়ানে তাদের মাহাত্ম্য-কীর্তন আমরা পড়ি।
‘চণ্ডী’ ও ‘মনসা’ দুজনই নারী। মজিদ মাহমুদের ‘মাহফুজা’ বড় ইঙ্গিতপূর্ণ ‘মঙ্গল’-বারতার বাহিকা।
‘মঙ্গল’ আর অ-মঙ্গল মানুষের জীবনে, সমাজ ও রাষ্ট্রের চড়াই-উতরাই পর্বে কীভাবে, কতখানি ইতিবাচক ও নেতিবাচক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় সচল থাকে, যার নির্মাণ ও বির্নিমাণ হয় মানুষের হাতে, তার স্বরূপ বহুবিধ আঙ্গিকে চিত্রিত করবার চেষ্টা করেন সৃষ্টিশীলতার সঙ্গে জড়িত কতিপয় মানুষ। ঐ কতিপয়ের মধ্যে একজন হচ্ছেন কবি।
গ্রন্থের ‘যুদ্ধমঙ্গল’-পর্ব’র ৬ সংখ্যক কবিতায় ‘মাহফুজা, আমাদের আত্মা থেমে আছে একটি যুদ্ধের ভেতর, হতে পারে দুই কুড়ি কিংবা দুই হাজার বছরের পুরনো সে যুদ্ধ, লোক ক্ষয় এবং হত্যা’- এমত উচ্চারণ আমাদের বলে : মানুষের যুদ্ধ শেষহীন।
‘মাহফুজামঙ্গল’-এ বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে যে বুনন, সেখানে আমরা পাচ্ছি সমকালের ভাঙনরূপ, জীবনের সংহতি-অসংহতির রেখা, রাজনীতির নিষ্ঠুরতা, সমাজের করজশাসন, ইতিহাসের পাকদণ্ডীঘোর এবং ভবিষ্যতের স্বপ্ন।
বিশেষ নোট : ১
‘মাহফুজামঙ্গল’-এ একজন কথক আমাদের জানান :
অভিযোগ (বল, কোন সম্রাট মৃত পিতার মূল্য বুঝেছে : যুদ্ধ ৬),
অনুরাগ (তুমি জেগে আছ আমার নীরবতা ও কোলাহলের ভেতর/তুমি জেগে আছ আমার অবিন্যস্ত অগ্রন্থিত চিন্তার ভেতর : বর্ম ও শিরস্ত্রাণ),
বিরাগ (আমি জানি না এমন মারি আর মড়কের দেশে/ কেমন বিশ্বাসে তুমি নড়ে ওঠো গোলাপের ঠোঁট : মাহফুজামঙ্গল পর্বের সাত সংখ্যক কবিতার পঙ্ক্তি),
নিবেদন (তুমি এসো মাহফুজা/এই শীতের মৌসুমে তুলে নাও/ আমার বিবর্ণ হাত : দাক্ষিণ্যে),
যৌনতা : ঘুমের মধ্যেই মাহফুজা তুলে নিল হাত; বলল, এখানে/ এই বুকে আর নাভির নিচে বেদনায় লেখা স্বপ্নের মানে : ‘মাহফুজামঙ্গল’ পর্বের এক নং সনেট।),
প্রেম (তোমার অনাঘাত শরীর আমাকে ডেকেছিল পৃথিবীর পথে : গল্প),
মানুষের সৃষ্ট দুঃসহ অবস্থা (তুমি আজ বিধ্বস্ত একাকী দাঁড়িয়ে আছো সমর প্রান্তরে/ অতি হৃতসর্বস্ব ভিক্ষুকের বেশে : সন্ধি),
আশ্রয় (তোমাকে না ছুঁলে আমি হই বন্ধ্যা মহিরুহ আদিম পৃথিবী : মাহফুজামঙ্গল পর্বের চার নং সনেট),
প্রার্থনা (আমার তো আলাদা কোনো নাম নেই/লুকিয়ে আছে তোমার নিরানব্বই নামের ভেতর/আমি কি করতে পারি সে নামের শরিক/তুমিই তো ডাকতে থাকো মাহফুজ মাহফুজ : নাম)।
মাহফুজার অস্তিত্ব : ‘তুমি তো পাঁচ হাজার বছর আগের মাহফুজা/ তুমি তো পাঁচ লাখ বছর আগের মাহফুজা/তুমি তো সৃষ্টির প্রথম মাহফুজা’ : দেবী।
মাহফুজ শব্দটি আরবি। অর্থ যাকে রক্ষা করা হয়। ‘মাহফুজা’ স্ত্রীলিঙ্গ। ‘নাম’ কবিতায় ‘মাহফুজ মাহফুজ’ স্মর্তব্য।
(পাঠক, ‘মাহফুজামঙ্গল’ পড়বার সময় তথ্যগুলো মনে রাখতে পারেন।)
মাহফুজা একজন নিবিড় শ্রোতা। ঐ একজন ধারণ করছে সমষ্টিকে। ঐ সমষ্টির শ্বাস-প্রবাহের নানান প্রেক্ষাপটের স্রোত-প্রকরণ কবিতাগুলোতে বিদ্যমান। বলবার শৈলী বৈঠকি মেজাজ, স্বর বিনয়ী, কাব্যভাষা স্মিত।
একজন নারীর মধ্যে মানবের কল্যাণবোধের স্থিতি প্রশ্নে ও সংশয়ে কখনো বিষয়ভাবনায় ভেসে যেতে যেতে (যেন অদূরে আছে বেলাভূমি), কখনো বাস্তবের পাথরে বসে এবং ঊর্ধ্বশ্বাসে চড়াই-উতরায়ে দৌড়াতে দৌড়াতে, কখনো স্বপ্নচারিতায় থেকে মজিদ মাহমুদ নির্মাণ করেছেন ‘মাহফুজামঙ্গল’।
২.
আমরা যখন মাহফুজামঙ্গল ও মজিদ মাহমুদ-এর নাম নিঃশ্বাসে বিরতি দিয়ে, বা না দিয়েই বলি তখন যে ধ্বনিগত অনুপ্রাস (ম, হ এবং জ) তৈরি হয় তার থেকে অন্য একটি কাব্যরসের ভাবনা করা যেতেই পারে, পুরুষ মজিদ কি তার লিঙ্গসত্তা বদলে এই কাব্যগ্রন্থে মাহফুজা হয়ে যান? (স্মর্তব্য : রাধা+কৃষ্ণ = প্রকৃতি ও জীবন।) ‘নাম’ কবিতায় আমরা পড়ি, ‘মাহফুজ মাহফুজ’।
প্রকৃতির একটি অংশ পৃথিবী। পৃথিবীর সখ্যসহনরূপে মানুষ নিজের, সংঘাত, বিচ্ছিন্নতা, ব্যভিচার ইত্যাদির জালবুনন থেকে মানুষের বা অন্য সব প্রাণের মুক্তি নেই। সৃষ্টিকর্তা মানুষকে বড় দৃর্বল করে সৃষ্টি করেছেন। গ্রন্থের ‘কুরশিনামা’ কবিতায় পবিত্র কোরানের প্রভাব (বলা ও বিষয়ের দিক থেকে) লক্ষ্যণীয়।
কবিতাই কবিগণ কষ্টকথা, স্বপ্নহীনতার কথা এবং মঙ্গলকথা কথা শোনাতে আগ্রহী।
বিশেষ নোট : ২
মাহফুজামঙ্গল পাঠের জন্য পাঠককে আমার বিবেচনায় কয়টি বোধপর্ব ধারণ করতে হবে :
‘কুরশিনামা’ থেকে ‘রিনিঝিনি’ (৭-২২ পৃষ্ঠা পর্যন্ত প্রথম পর্ব),
‘মাহফুজামঙ্গল’ (২৪-৩৩ পৃষ্ঠা দ্বিতীয় পর্ব। সনেট।),
‘উত্তরখণ্ড’ (৩৫-৮৭ পৃষ্ঠা তৃতীয় পর্ব),
‘যুদ্ধমঙ্গল’ (৮৯-৯৬ চতুর্থ পর্ব। ১-৬ পর্যন্ত টানা গদ্যে রচিত। এই পর্বে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ পাওয়া যাবে)।
‘নদী’, ‘গল্প’, ‘ক্রীতদাসী’, ‘বিষকাঁটা’, ‘পুরস্কার’, ‘সংগীতের ভেতর’… এই কবিতাগুলো ছাড়াও আরো কিছু কবিতায় মজিদ কোনো যতিচিহ্ন ব্যবহার করেনিনি। না করবার জরুরি কারণ হতে পারে, কবিতাগুলোর নাম যে দৃশ্যের বাস্তবতা ধারণ করছে তা আসলে এক নিরন্তর প্রবাহ, সেখানে যতিচিহ্ন অক্ষম ও পঙ্গু।
আলেকজান্ডার, ফ্রয়েড, নিউটন, ভিক্টোরিয়া, বাহাদুর শাহ জাফর (দ্র. ‘মাহফুজামঙ্গল’ সনেটপর্ব)- এসব নামের উল্লেখ কবিতায় যখনই ব্যবহার করা হয় তখনই তাদের বিশেষ কর্মধর্ম সম্পর্কে পাঠককে অবগত হতেই হবে। মজিদ তাদের নাম ব্যবহার করে বিষয়ের প্রয়োজনে মান্যতা দিয়েছেন।
ক্যাটালগিক ফর্মে লেখা হয়েছে ‘মাহফুজাং শরণাং গচ্ছামি’। শেষ দুটি পঙ্তিতে ক্যাটালগের ইতি টানা হয়েছে। পরীক্ষাটি সুন্দর।
‘সে আমার প্রেম তারে রাখিয়া এলেম’, ‘মাহফুজামঙ্গল’-এর ‘কেমন আছেন’ কবিতার পঙ্ক্তিটি পড়া মাত্রই রবীন্দ্রনাথের ‘শেষের কবিতা’র পঙ্ক্তি মনে পড়বে। মজিদ ঊর্ধ্বকমার মধ্যে পঙ্ক্তিটি রাখেননি। ভালো করেছেন। রুকু, সেজদা, জায়নামাজ, এবাদত- আরবি-ফারসি শব্দগুলো ‘প্রার্থনা’র সঙ্গে সম্পর্কিত।
তাওরাত-এ আমরা পড়ি ‘পয়দাদেশ’। শব্দটির অর্থ সৃষ্টির বিবরণ। লেখক : হজরত মুসা (আ.)। রচনার সময় : ১৪৪৫-১৪০৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। এবং মজিদ মাহমুদ ‘পয়দাদেশ’ লিখেছেন গত শতাব্দর আশির দশকে। তাওরাতে সৃষ্টির বিবরণে যা বলা হয়েছে তার সঙ্গে মজিদ যোগ করেছেন, ‘অথচ অর্ধেক দিলে তুমি সৃষ্টির ক্ষমতা/বাকি অর্ধেক রেখেছ মাহফুজার ভেতর’ (মজিদ এই কবিতায় সঙ্গত কারণেই শেষে যতিচিহ্ন দেননি।)
৩.
গ্রন্থটির প্রথম কবিতা ‘কুরশিনামা’ এবং ‘যুদ্ধমঙ্গল’ পর্বের শেষ কবিতা ‘সন্ধি’। মাহফুজার জন্য একটা আসন রেখে (কুরশি স্থিতি অর্থে), তার সঙ্গে তর্ক-বিতর্কের শেষে একজন মানুষকে সন্ধিতে আসতে হয়েছে। ঐ সন্ধি শান্তি পাবার একটা স্তর।
শব্দ সংবেদনশীল। শব্দ উদ্ধত। শব্দ বিনয়ী। উচ্চারণমাত্র, লিখিত হওয়ামাত্র শব্দ কী রূপে জায়মান তার প্রকাশ যদি শ্রোতা বা পাঠক বিচারাঙ্গম না করতে পারেন, তার দায় যিনি বললেন বা লিখলেন তার নয়। এখানে বুঝতে হবে মজিদ মাহমুদের নয়।
কাব্যের রূপ বা রূপের কাব্য দুই জিনিস। ঐ রূপ নানানরকম গ্রহণ, অ-গ্রহণ এবং বিগ্রহে প্রকাশিত। ‘মাহফুজামঙ্গল’-এ তার বিস্তার বিষয়-সাপেক্ষে রচিত। এবং গ্রন্থটির অধ্যয়ন শেষে পাঠককে অবধারিতভাবে যেন এক নিয়তি তাড়িত জলবায়ুর, যে জলবায়ুর কল্যাণ-অকল্যাণ নির্মিত হয় অনেকরকম কার্যকারণের ফলে, প্রভাবে দাঁড়াতে হবে জীবন নামের আরশির সামনে। ঐ আরশিতে মাঙ্গলিক জীবনের পারা কতটা আছে আর নেই তা চিন্তার উপলব্ধিতে, শব্দটি উপলব্ধি কিন্তু, জারিত হতে থাকে।
‘মাহফুজামঙ্গল’ কাব্যগ্রন্থটি একটা আরশি। যার সামনে দাঁড়ালে একজন বা বহুজন বা একটা দেশ দেখতে পারে তার কর্ম ও কর্মহীনতার রূপ। এবং আশা কীভাবে বাস্তব হতে পারে, তার ভূমিস্তর।
এ পর্যন্ত পৃথিবীতে যত কবিতা রচিত হয়েছে, সবই মন্ত্র। মন্ত্র-উচ্চারণে সবই বলা যায়। ‘মাহফুজামঙ্গল’-এর মন্ত্রভাব আমাদের দিনযাপনের গ্রাহ্যে আসে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়