ওয়ান ব্যাংক লিমিটেড : সাবেক পরিচালক এজাজ আহমেদ মারা গেছেন

আগের সংবাদ

সন্ত্রাসীদের হাতে অস্ত্রের মজুত : অরক্ষিত মিয়ানমার-ভারত সীমান্ত পেরিয়ে পাহাড়ে আসছে অত্যাধুনিক অস্ত্র

পরের সংবাদ

গল্প : নূরের জুলেখা

প্রকাশিত: এপ্রিল ৭, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: এপ্রিল ৭, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

নূর আহমদ ছিল ফার্স্ট বয়। কালো কুচকুচে এক ছেলে। গোল গোল মায়াবী চোখ ছাড়া মুখের কিছুই দেখা যেত না। নূর আহমদ ভালো করে শুদ্ধ বাংলা বলতে পারত না। ওর প্যান্টের ঘের ছিল স্বাভাবিকের চাইতে লম্বা। মাটিতে ঘষতে ঘষতে হাঁটা নূরের বাংলা-ইংরেজি খারাপ হলেও বাকি সব বিষয়ে সবচেয়ে বেশি নম্বর পাওয়া ছেলে। স্যারেরা বলতেন, নূর ডাক্তার হবেই। ওর মেডিকেলে পড়া নিশ্চিত।
ক্লাস নাইন-টেনে পড়ার কালে সামাজিক কোনো শ্রেণিবিভাগ থাকে না। তা ছাড়া আমি পড়তাম জনগণের স্কুলে। মিউনিসিপ্যাল স্কুলে সাধারণ ও মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেদের ভিড়। নূর আহমদ বা আমি বা আমরা সবাই বন্ধু। কী কারণে যেন ওর সাথে আমার একটা নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। একটা বিষয় খেয়াল করতাম, প্রায়ই একটা শার্ট গায়ে দিয়ে স্কুলে আসত। গলার বোতাম আটকানো তেল জবজবে চুলের নূরের সাথে খাতির হওয়ার একটা কারণ ছিল, ও আর আমি বাড়ি ফিরতাম একসাথে। কিন্তু মজার বিষয় ছিল, তিন পুলের মাথা পেরিয়ে এনায়েতবাজার আসতেই ও কোনো না কোনো অজুহাতে অন্যদিকে সরে যেত। একসাথে এগোত না।
জোর করে একদিন ধরে নিয়ে গিয়েছিলাম বাসায়। লাজুক নূর আহমদ মুখে তেমন কিছু না বললেও ওর চোখ বলছিল, মায়ের দেয়া দুধ-চিড়া খেয়ে খুশি হয়েছিল ভীষণ।
ক্লাস টেনের টেস্ট পরীক্ষার ঠিক আগে নূর আহমদ অনুপস্থিত। এক-দুই দিন করে করে বেশ কয়েক দিন। স্যারেরা দু-একবার জানতে চেয়েছিলেন, এরপর কেউ কিছু বলত না।
একদিন ওকে খুঁজতে চলে গেলাম ওদের গলিতে। বরফ কল গলি নামে পরিচিত বড় গলিটায় খুঁজে পাওয়া সহজ ছিল না, কিন্তু তখনকার সমাজ ছিল অন্য ধরনের। পাড়ায়-মহল্লায় সবাই চিনত সবাইকে। খবর রাখত। নূর আহমদের বাসা খুঁজে দিয়েছিল খালি গায়ে লাটিম-মার্বেল নিয়ে হৈ হৈ করা একদল ছেলে। ভেঙে পড়া বাঁশের ঘর, পাতা ও ছনের ছাউনি। উঠানে থকথকে কাদা। ওদের বাসার ঠিক সামনে গলির দিকে মুখ করে ছোট একটা ছাপড়া দোকান। যার ময়লা কাচের বাক্সে পড়ে ছিল গত দিনের অবিক্রীত পিঁয়াজু, বেগুনি, ভাজি, ছোলা, পাশে প্লাস্টিকের ঠোঙায় ঝুলছিল বাটার বন, চামড়া উঠে যাওয়া কয়েকটা কলা। বুঝতে পেরেছিলাম এটাই ওদের ব্যবসা। জ্বর গায়ে উঠে আসা নূর আহমদ অপ্রস্তুত কিছুটা অবাক কিন্তু তার চেয়েও ছিল শরমিন্দা। হয়তো তাদের ঘরবাড়ি, দোকান হয়তো খালি গায়ে হাঁটুর ওপর লুঙ্গি তোলা তার পিতা, হয়তো বা অন্য কিছুর জন্য। স্বভাবসুলভ মিতভাষী নূর আহমদ জ্বর গায়ে আমাকে গলির মোড় পর্যন্ত এগিয়ে দিতে দিতে বলেছিল, ওর হয়তো এসএসসি পরীক্ষা দেয়া হবে না। মন খারাপ করে চলে আসার সময় বলেছিলাম, তুই পরীক্ষা না দিলে তো এ বছর আমাদের কেউ ডাক্তার হতে পারবে না।
নূর আহমদ এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছিল। পাঁচ বিষয়ে লেটার মার্ক নিয়ে প্রথম বিভাগে পাস করেছিল। এইচএসসিতে আমি মানবিক বিভাগে চলে যাওয়ায় কলেজে ওর সাথে যোগাযোগ কমে যায়। কিন্তু এটা জানতাম, সেখানেও ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট করেছিল নূর আহমদ। এটা ধরে নিয়েছিলাম নিশ্চয়ই ডাক্তার হয়ে গেছে ও। নয়তো কোনো ইঞ্জিনিয়ার। সময়ের সাথে সাথে বদলে যাওয়া জীবনে নূর আহমদ প্রায় মুছে গিয়েছিল স্মৃতি থেকে।
এনায়েতবাজার বরফ কলের পাশের গলিতে এখন দিদিরা থাকে। চট্টগ্রাম গেলে সেখানেই থাকা হয় আমার। দুই বছর আগে এক বিকালে তড়িঘড়ি করে কোথাও যাওয়ার জন্য বের হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম গলির মোড়ে। মুখে খোঁচা দাড়ি, মাথায় সাদা গোল টুপি, সাদা শার্ট, চেক লুঙ্গি পরা একজন লোক বারবার তাকাচ্ছিল আমার দিকে। তার চোখে-মুখে একধরনের প্রসন্নতার হাসি। কেন জানি মনে হলো, ওই মুখটি খুব পরিচিত আমার। এগিয়ে গিয়ে কথা বললাম। হাতে বাজারের ব্যাগ, হেঁটে যাওয়ার জন্য পা বাড়ানো ও ছটফট করছিল চলে যাওয়ার জন্য। আমিও নাছোড়বান্দা। কথায় কথায় ফিরে গেলাম জীবনের সুন্দরতম সময়ে। ওর বাবা আরেকটি বিয়ে করে মা-ভাই-বোনসহ ওদের ছেড়ে দিয়ে চলে যায়। মেডিকেল কলেজে চান্স পেলেও এক বছরের মাথায় চলে আসতে হয় তাকে। ওর বাপ তখন নতুন বউ নিয়ে চলে গেছে দূরে কোথাও। সংসারের বোঝা কাঁধে দিশাহারা ও ফিরে যায় তাদের সেই ছোট ব্যবসায়। দোকানটা একটু বড় হয়েছে। সামনের কাচের আলমারিতে এখন নানা ধরনের বিস্কুট, কেক, পিঠা। তাকে বেশ কিছু খাবার। কিছুতেই ছাড়ল না আমাকে। বলল, কত কিছুতে তোর ছবি দেখি, তোর কথা শুনি। তোর কথা, স্কুলের কথা খুব মনে পড়ে। যে হাতে খুব নিপুণভাবে বায়োলজি পরীক্ষায় ব্যাঙ কাটত, কেমেস্ট্রির প্র্যাকটিকেলের পাইপে মুহূর্তে গ্যাসের রং বদলে তাক লাগিয়ে দিত সে হাতে টুংটাং চামচ নাড়িয়ে অসাধারণ এক কাপ চা বানিয়ে দিল আমাকে। সাথে দামি কেক, বিস্কুট। সেদিনকার দেখায় জীবনের এক আশ্চর্য অনুভূতির গল্প দেখিয়েছিল নূর আহমদ। সাধারণত আমরা গল্প শুনি। সেদিন নিজের চোখে দেখলাম তার জীবন বদলে দেয়ার গল্পকে। ছিপছিপে কিন্তু মুখখানা যেন দেবীর মতো। সারা গায়ে কাপড় জড়িয়ে এসেছিল রান্নাঘর থেকে। নূর আহমদের ডাক এড়িয়ে থাকতে না পারা জুলেখাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছিল জীবনযুদ্ধে ক্লান্ত অথচ তৃপ্ত একখানা মুখ। এমন সুন্দর মুখ বিরল। এটাও বুঝতে পারছিলাম সচরাচর সে বাইরে আসে না। পরপুরুষের সমানে তো না-ই।
জুলেখাই মূলত বদলে দিয়েছে নূরের জীবন। যখন মেডিকেলে পড়াশোনা শেষ করতে না পারা নূর সংসারের দায়িত্ব সামলাতে হিমিশিম খাচ্ছিল, একসময় সে জীবন থেকে পালানোর সিদ্ধান্ত নেয়। লোমহর্ষক সে ঘটনা যে কাউকে স্তব্ধ করে দিতে পারে। আত্মহননের জন্য জান দিতে যাওয়া নূর আহমদ বেঁচে যায় এই মেয়েটির জন্য। রেললাইনে শুয়ে থাকা নূরকে দেখে ফেলে জুলেখা। নিজ দায়িত্বে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে সবার শাসন অগ্রাহ্য করে জুলেখা সময় দিতে থাকে তাকে। তার জীবনের ঘটনায় অভিভূত জুলেখা না থাকলে কোনো দিনও জীবনে ফিরতে পারত না নূর।
কোনোভাবে বিয়েটা করেই সংসার গোছানোর কাজে মন দেয় জুলেখা। হাতের বালা, কানের দুল, গলার চেইন খুলে দোকান সাজায়। নিজে এক বেলা, আরেক বেলা নূর পালা করে দোকান চালু রেখে ব্যবসা বড় করে সে। তাদের এক ছেলে, এক মেয়ে। মেয়েটি এখন আইনের ছাত্রী। ছেলেটি স্কুলের শেষ ধাপে। লেখাপড়া তেমন করেনি জুলেখা। কিন্তু সন্তানদের মানুষ করে জীবনে দাঁড় করাতে বাপের স্বপ্ন এবং বাপ যা পারেনি তা করাতে এক পায়ে খাড়া জুলেখা।
ওকে দেখে আমার মনে হয়েছিল বহুকাল পর আমি খাঁটি কোনো মা, নিখাদ কোনো স্ত্রী আর বাংলা মেয়েকে দেখলাম। জুলেখাকে বললাম, তোমাকে অনেককাল মনে থাকবে আমার।
নূরকে বুকে জড়িয়ে ধরে বিদায় নেয়ার সময় অনুচ্চ কণ্ঠে বলছিল, পারিনি দোস্ত, আমি পারিনি। কাঁধে হাত রেখে বলেছিলাম, তুই সেলফিস না বলে পারিসনি। তুই তোর মা-বোন-ভাইকে ভালোবাসতি বলে পারিসনি। তুই অসৎ, অভদ্র, স্বার্থপর না বলে পারিসনি। এই সমাজ তোকে পারতে দেয়নি। আর তুই যা পেরেছিস তা আমরা কেউই পারিনি। চলে আসার মুহূর্তে হাতে প্লাস্টিকের কাপে আরেক কাপ চা ধরিয়ে দিয়ে বলল, আঁই জানি তুই চা বেশি খাস। যাতে যাতে ইবা খাইস।
পেছন ফিরে তাকানোর সাহস হয়নি। সাহস হয়নি ফার্স্ট বয়ের চোখের দিকে তাকানোর। চায়ের দোকানের সওদাগর নূর আহমদ তুই ভালো থাকিস। তুই-ই আমার শৈশব পেরনো কৈশোরের বন্ধু আমার বাংলাদেশ।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়