প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৩, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ১৩, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
শিমুলের কয়েক দিন থেকে বুকের ভেতর চিন চিন ব্যথা। সে কোনোভাবে ডাক্তারের কাছে যাবে না। এরকম হলে নিচের দোকান থেকে গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ ‘সেকলো’ এনে খেলে সেরে যায়। কিন্তু আজ ওষুধ খাওয়ার পরও তা যাচ্ছে না। পাশের ওষুধের দোকানে সন্ধ্যার পরে একজন মেডিসিনের মহিলা ডাক্তার বসেন।
শিমুলের বউ করবী নিজে গিয়ে ডাক্তারের সিরিয়ালটা দিয়ে আসছেন। শিমুলের আবার মহিলা ডাক্তার পছন্দ না। তাই শিমুল বউকে বলে আমার ব্যথা সেরে গেছে।
দেখতে আসা বাসার আশপাশের মহিলাদের মন্তব্যের কোনো শেষ নেই। নিজের থেকে কেউ বলেন এইটা হার্ট ব্লকের লক্ষণ। আর কেউ বলেন আমার এক আত্মীয়ের এমন ব্যথা শুরু হয়েছিল। মেডিকেলে নেয়ার সময়ও পাইনি। শিমুলের এমন কথা শুনে মনের মধ্যে ভয় শুরু করে দিয়েছে। করবীর মনের মধ্যে কু-ডাক ডাকছে। নিশ্চিত শিমুলের কিছু হয়েছে। ব্যথায় শিমুল বিছানার সঙ্গে লেপ্টে পড়ে আছে। করবীর মনে ঝড় শুরু হয়ে গেছে। রাতে যদি কিছু হয়ে যায়। মনে মনে শুধু আল্লাহকে ডাকছে।
করবীর চেঁচামেচিতে সন্ধ্যায় বাধ্য হয়ে ডাক্তারের কাছে গেলেন শিমুল।
ডাক্তার অনেক কিছু জিজ্ঞাসা করলেন শিমুলকে। তারপর মাথা নাড়িয়ে বললেন, আপনার তো দেখি সবকিছু ঠিক আছে। যদি মনে করেন তবে একটি ইসিজি করাতে পারেন। আপনার পরিবারের দিকে একটু তাকান, আপনি ওনাকে কি ভয় ধরিয়ে রেখেছেন। ডাক্তার হিসেবে আমার বিশ্বাস আপনার হার্টের কোনো দিন সমস্যা হবে না। আপনার হার্ট খুব শক্ত। এসব বলে ডাক্তার মুখের উপরে অদ্ভুত হাসি দিলেন। এমনিতে দেখতে খুবই সুন্দরী এই ডাক্তার। তার উপরে টোল পরা হাসি। একবার দেখলে মন ভরবে না।
ওষুধ লেখতে লেখতে ডাক্তার মুখের ভেতর থেকে কী একটা বললেন।
আশা করি এই ওষুধগুলো খেলে সেরে যাবে। তবে সময় সুযোগ করে জিইসি মোড়ে চট্টগ্রাম মেডিকেলের একজন নাম করা হার্ট স্পেশালিস্ট ডাক্তার বসেন। ওনাকে দেখাতে পারেন। ভিজিটিং কার্ডে ডাক্তারের নাম দেখাতে করবী ডাক্তারকে বললেন, উনি আমার বড় ভাই। মানে আমার হাজবেন্ডের আপন বড় ভাই। ডাক্তার আর কিছু বলেন নাই।
আবার শিমুলকে বললেন। আপনি একটুখানি বাইরে গিয়ে বসেন। আমি আপনার স্ত্রীর সঙ্গে একটু কথা বলি। ভয়ে শিমুলের মনে মোচড় দিয়ে উঠে। সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে। কী সমস্যাটা শিমুল বুঝতে পারছে না। মহিলা ডাক্তার হওয়াতে ওনার সঙ্গে বেশি কথা শিমুল বললেন না। মনে মনে ভাবে- মনে হয় শরীরের ভেতরে বড় রকমের রোগে বাসা বেঁধেছে। ক্ষতি হবে বলে ডাক্তার রুম থেকে সরায়ে দিলেন। শিমুল বাইরে বসে সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করছে।
ডাক্তার করবীকে কী বলল শিমুল জানে না। ডাক্তারের রুম থেকে বের হয়ে করবী রক্তচক্ষু নিয়ে শিমুলের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। শিমুল মুচকি হেসে করবীকে বললেন।
: আমি বলেছিলাম না আমার গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা। অকারণে তুমি দুশ্চিন্তা করলে।
করবী চোখমুখ লাল করে খেচিয়ে, এত রোগীর সামনে বলল,
: তুমি কি ডাক্তার? বেশি বুঝো না। আগে বাসায় চলো। কাল সকালে আমি নিজে গিয়ে তোমাকে মেডিকেলে ভর্তি করায়ে আসব।
অন্য রোগীরা করবীর মুখের দিকে থাকিয়ে আছে। শিমুল মনে মনে বলল ইজ্জত মনে হয় এখানে শেষ। নরম সুরে শিমুল বলল, বাসায় চলো। করবী বাসায় এসেই হাতের ব্যাগ, মোবাইল, বিছানায় আছড়ে ফেলে দিল। এসব দেখে শিমুলের বুকের ব্যথা মোবাইলটার জন্য আরো বেশি বেড়ে গেল। বিশ হাজার টাকা দামের মোবাইল বলে কথা। করবী বাসায় আসার পর থেকে হাউ মাউ করে কান্না শুরু করেছে। বুকের ভেতরে অচেনা ভয়ে মোচড়ে উঠল শিমুলের। আমার কী হলো আবার। হার্ট ব্লক না তো?
এরই মধ্যে বাপের বাড়িতে ফোন করে ফেলেছে। শিমুলের বড় ভাবিকে ফোন করে জানিয়ে দেয়, শিমুলের সঙ্গে সে আর সংসার করবে না। ওনারা কেউ এসে কালকে যেন ডিভোর্সের ব্যবস্থা করে দেয়। বাপের বাড়ি থেকে লোক আসতে বলে দিয়েছে। সকালে যেন ওকে নিয়ে যায়।
শিমুলের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। এমন দুঃসময়ে বড় দুই ভাইও আজ পাশে নেই। মনটা কু ডাকে। নিশ্চয়ই ছোঁয়াচে বা খারাপ কিছু। মাথাটা ভোঁ ভোঁ করছে। এতবড় অসুখের সময় সে কি আমাকে ছেড়ে যাবে? আজ ১৪ বছর ধরে সংসার করে আসছি।
দুই.
এমন কী অন্যায় করলাম আমি? জীবনে খারাপ কাজে কোনো সময় লিপ্ত হইনি। দুঃসময়ে আমাকে একা হয়ে যেতে হবে? ভাবতে ভাবতে শিমুলের চোখের কোণে জল আসে।
শিমুল চাইলে দ্বিতীয় বিবাহ করতে পারত। সংসার জীবনে ছেলে-মেয়ে না থাকা সত্ত্বেও শিমুল অন্য কাউকে গ্রহণ করে নাই। এক সময় করবীর মনে এইটির জন্য অনেক ভয় ছিল। যদি শিমুল আরেকটি বিয়ে করে ফেলে। কারণ শিমুলও জানে করবী ওকে পাগলের মতো ভালোবেসে।
আত্মীয়-স্বজন, কত বুদ্ধি না দিয়েছিল, শিমুলকে। আর একটা বিয়ে করে নেওয়ার জন্য। শিমুল মনে মনে চিন্তা করে যে মানুষটি আমাকে প্রচণ্ড ভালোবাসে, তাকে কী করে অবহেলা করি।
শিমুলকে বড় ভাবি রাত ১টার দিকে ফোন করে বললেন, শিমুল তুই কি করবীর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছিস?
হতবাক হয়ে গেল শিমুল। জীবনে যার সঙ্গে উচ্চবাক্য হয়নি, আজ তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করব কেন?
ভাবিকে বলল, কী হয়েছে আমি নিজেও জানি না। তুমি কি কাল সকালে একবার আসতে পারবে বুবু। বড় ভাবি আবার শিমুলকে বেশ আদর করে। শিমুল ওনাকে বড় বোনের মতো সম্মান করে বুবু বলে ডাকে।
নিদ্রাহীন সারারাত এভাবে কেটে গেল শিমুলের। সকাল না হতেই ভাবি এসে হাজির। তারপর করবীর মা-ও, সঙ্গে ছোটভাই, ভাইয়ের বউ। ছোট ভাই রনি বেশ গম্ভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে বড়দের মাঝে কী কথা হচ্ছে। একটি মাত্র বোন ওদের। ছোট ভাইটির এমন ভাব, শিমুলকে এখন তুলে নিয়ে যাবে। কাঁদতে কাঁদতে করবীর মা মেয়েকে জড়িয়ে ধরল। শিমুল এসব দেখে হতবাক। শিমুলের হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে শরীর কাঁপতে শুরু করল। খারাপ কিছু হলো না-তো। না কোনো বড় অপরাধ করে বসে আছি।
করবী বুবুর সঙ্গে কান্নার জন্য কথা বলতে পারছে না।
ভাবি করবীকে প্রশ্ন করলেন! আহ্ কি হলো আগে আমাকে বলবি? শিমুল তোর সঙ্গে কি খারাপ ব্যবহার করেছে?
বুবু আমার বিয়ের আগে ওর সঙ্গে কি, কোনো ডাক্তার মেয়ের সঙ্গে এনগেজমেন্ট হয়েছিল? তুমি আমাকে সবার সামনে এখন বলবে। জানি তুমি কোনো সময় মিথ্যা বলো না।
: হ্যাঁ এনগেজমেন্ট হয়েছিল, তো! এখন কী হয়েছে?
তুমি দেখো, সে কত বড় মিথ্যাবাদী। এতবড় একটি ঘটনা তোমরাও আমার থেকে গোপন করে গেলে। কাল আমি যে ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম উনি আপনার আদরের দেবরকে চিনে ফেলেছে। ডাক্তার আমাকে সব কিছু বলেছেন। ওনার সঙ্গে ডা. শিউলি নামে এক মেয়ের সঙ্গে এনগেজমেন্ট হয়েছিল। সেই অনুষ্ঠানে ওই ডাক্তারও ছিল। ডা. না-কি শিউলির প্রিয় বান্ধবী।
সেজন্যই তো বলি আপনার আদরের দেবর প্রায় সময় মনমরা হয়ে থাকেন। বিয়ের পরপর আমার কিছুটা সন্দেহ হয়েছিল। সে আমার থেকে কিছু গোপন করছে।
ভাবি করবীকে ধমক দিয়ে বললেন, তুই যেটা জানিস না সেটা নিয়ে বাড়াবাড়ি করিস না। বেলায় বেলায় বয়স অনেক হয়েছে। তোর দুর্ভাগ্য তুই মানুষ চিনতে ভুল করেছিস। সে এখনকার যুগের ছেলের মতো না। শুনতে খারাপ লাগবে হয়তো তোর। বড় ভাইকে মান্য করে বলে সে ওই ডাক্তার মেয়েকে বিয়ে করে নাই। যে ডাক্তারকে বিয়ে করে নাই, ওই ডাক্তারের পরিচয় কি জানিস? ডাক্তার তোকে কিছু বলেন নাই?
: হ্যাঁ বলেছে, সে ডাক্তার না-কি ওর আত্মীয় হয়।
আমার থেকে তাহলে শোন, তোকে কে কী বলেছে আমি জানি না। আমরা তিন বোন। সবাই ডাক্তার। আমার বাসায় যে মেয়েটা পঙ্গু, প্যারালাইসিস হয়ে পড়ে আছে বিগত পনের বছর ধরে। সে আর কেউ না। আমার ছোট বোন ডা. শিউলি। সে সবার ছোট বলে আমার কাছে সন্তানের মতো। শিমুল ও শিউলি একজন আরেকজনকে বেশ পছন্দ করত। আবার ঝগড়া করত দুজনে বেশ। দুজনের বিয়ের সব ঠিকঠাক হয়েছিল। এনগেজমেন্ট হয়ে গিয়েছিল। শিউলি পিএইচডি করার জন্য কানাডা চলে যাবে। দুজন একসঙ্গে যাওয়ার কথাও হয়েছিল। হঠাৎ শিমুল সিদ্ধান্ত চেঞ্জ করে ফেলে। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে শিউলি ঘুমের ওষুধ খেয়ে বসে। সেই কারণে তোর বড় ভাই রাতে শিউলির গায়ে হাত তোলে। অপমানে শিউলি আত্মহত্যার জন্য ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে। সারা জীবনের জন্য শিউলির দুই পা-সহ নিচের অংশ অবশ হয়ে যায়। সেদিন যদি শিউলি মরে যেত এই ছেলেটা হয়তো বাঁচত।
তিন.
আরেকটা কথা না বললে আমি আমার এই সন্তানের কাছে ছোট হয়ে রইব। তোর বিয়ের পর কোনো দিন দেখেছিস সে আমাকে ভাবি ডাকতে। সে আমাকে বুবু ডাকে। কেন জানিস? তাও বলি, সে আমাকে ওর থেকে একটা কিডনি দিয়েছে। আজকে তুই আমার এই সন্তানের গায়েও কলঙ্ক লেপে দিলি। ছিঃ।
ওদের বিয়েটা তারপরও হতো। শিমুল চেয়েছিল সারাজীবন শিউলির দায়িত্ব নিতে। একটু পাশে থাকতে।
তোর বড় ভাইয়া চায়নি যে বিয়েটাই হোক এবং শিউলির সঙ্গে কোনো রকমের সম্পর্ক থাকুক। তোর ভাই আমাকে কোনো সন্তান নিতে দেয়নি। যাতে শিউলির প্রতি কোনো অবহেলা হয়। শিউলি তোর ভাইয়ের মেয়ে হয়ে অন্তরে জায়গা করে নিয়েছে।
সেদিন থেকে তোর বড় ভাইয়ার নির্দেশে শিমুল আমার বাসায় আর যায় না। তুই মনে করিস এদের ভাইয়ে ভাইয়ে ঝগড়া বিবাদ, না! মূলতঃ কারণ এটাই। ওদের ভাইয়ে ভাইয়ে এখনও চমৎকার মিল।
ভাবি করবীর সঙ্গে রাগারাগি করে চলে যায়। যাওয়ার সময় করবীকে বললেন এত সন্দেহ ঠিক নয়।
করবীর মা, ভাইও রাগারাগি করে চলে যাওয়ার সময় বলল, করবী আমরা মনে করেছিলাম তোর স্বামীর বড় রোগ বা কিছু হয়েছে। সামান্য জিনিসকে তুই কোথায় নিয়ে গেলি। আসলে মা হিসেবে বলি, তুই শিমুলের উপযুক্ত না। সবাই চলে যাওয়ার পর বাড়িটা ফাঁকা হয়ে গেল।
করবীর মনের মধ্যে ঝড় শুরু হয়েছে। প্রকৃতির অন্ধকারের মতো নিজের অস্তিত্ব অন্ধকার হয়ে আসছে। এই মুহূর্তে শিমুলের মনকে শান্ত করতে একবার বুকে জড়িয়ে নেয়ার প্রয়োজন। কিন্তু শিমুলের মুখ দেখে বোঝা যায়, বিদ্যুতের ঝলকানিতে অনাগত ঝড়ের আবাস।
শিমুল জানালার উপরে হাত রেখে নীল আকাশের প্রাণে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। একঝাঁক সাদাবক পাখা মেলে শিমুলকে জানিয়ে দিচ্ছে, ওদের ভালোবাসার ঘর আছে। সূর্যের লাল আভা ফিকে হয়ে আসে।
শিমুল আজ সত্যিই বুকের মধ্যে কিসের যেন ব্যথা অনুভব করল। মনের অজান্তে বৃষ্টির ফোঁটার মতো টপ টপ করে অশ্রæ নেমে আসে। সে জানে এই অশ্রæর আদিকারণ! প্রথম ভালোবাসা ভোলা কি সম্ভব?
শেয়ার করুন
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।