আ.লীগ নেতা টিপু হত্যার প্রতিবেদন পেছাল

আগের সংবাদ

মাদকের বিরুদ্ধে ‘নতুন যুদ্ধ’ : তালিকায় ৯৩ শীর্ষ মাদক কারবারি, এক লাখ মাদকাসক্ত, জনসচেতনতা বাড়াতে প্রস্তুত অ্যাপ

পরের সংবাদ

ময়ুখের দৃষ্টিলোকে ‘চরণেরা হেঁটে যাচ্ছে মুণ্ডহীন’

প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৩, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ১৩, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

অপূর্ব ভাবনা, শব্দশিল্পের নিপুণ কারুতায় ব্যতিক্রমী চিন্তন, স্বকীয় স্বরের রূপকল্প চিত্রায়নে রোমান্টিক কবি ময়ুখ চৌধুরীকে খুব সহজেই ‘বাংলা কাব্যের বাবুই’ হিসেবে অভিধায়িত করা যায়। এটা একবাক্যে স্বীকার করতে হয় যে স্বাধীনতাত্তোর বাংলা কাব্যে ভিন্নমাত্রা ও ভিন্ন স্বরের যে কতক আবেগী অথচ বাস্তবধর্মী রোমান্টিক কবিতার সংশ্লেষণ হয়েছে, সংযোগ ঘটেছে, উৎসারিত হয়েছে আর কালে যেসব শক্তিশালী কবিতার সঞ্জাত হয়েছে তার বেশিরভাগই এসেছে ময়ুখ চৌধুরীর কাব্যনিমগ্নতায়, শৈল্পিক চারুতায়। নতুন বিষয় এবং শব্দের নিগূঢ় বন্ধনে অগ্রগামী ভাষায় চিত্রকল্প নির্মাণে দক্ষ ময়ুখ চৌধুরীর কবিতা তৈরি করেছে নিজস্ব ঘরানা।
‘চরণেরা হেঁটে যাচ্ছে মুণ্ডহীন’ ময়ুখ চৌধুরীর অসাধারণ এক ব্যতিক্রমী দ্রোহের কাব্য যেখানে ঠুলি পড়া সমাজের চোখে পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ বৈষম্যের বিরুদ্ধে তিনি প্রতিবাদের তীর ছুড়ে দিয়েছেন। উৎসর্গে তাই বলেছেন;

‘মাথা বিক্রি করে যারা মুকুট কিনেছে এ চরণ তাদের চরণ নয়।
এ চরণ চারণের
এ চরণ ক্ষরণের
এ চরণ মরণের, শুধু
শিরোনামগুলো আমি রেখে যাবো পাথরের নিচে।
মাথা বিক্রি করে যারা মুকুট কিনেছে
এ চরণ তাদের চরণ নয়।’

‘প্রতিবাস্তবতা’ কবিতা দিয়েই উন্মোচন করলেন কাব্যের আঙিনা। অবহেলার একটা যন্ত্রণা প্রকট হয়েছে কবিতায়;

‘মেরুদণ্ড পুড়ে গিয়ে উড়ে গেছে বলে
মুখ থুবড়ে পড়ে আছে প্রেম।’

দেশপ্রেমের অনন্য ঝলক দেখি কবির ‘কবিতা : ১৯৭১’ এ শব্দের শৈল্পিক কারুকাজে স্পষ্ট করলেন মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা আর স্বতন্ত্র ভূমি ও পতাকা;

‘প্রচণ্ড দহনদীপ্ত পশ্চিমের সূর্য ডুবে গেল,
বঙ্গোপসাগর থেকে এইমাত্র স্নান সেরে উড়াল দিয়েছে এক পাখি
সবুজে ও লালে মেশা বিজয় পতাকা।’

আশ্চর্যজনক এক কৌতূহল, একটা জিজ্ঞাসা
সবসময় কবির কবিতায় দেদীপ্যমান।
আবার দেশের অরাজক পরিস্থিতি ও জাতির
জনকের হত্যায় প্রচণ্ড দ্রোহে ‘অপরাধ ১৯৭৫’ কবিতায় তেতে উঠে বললেন;

‘কোন অপরাধে বলো, সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসেছিল লাল নদী?…

শস্যের সবুজ আর লাল চাকা তুলে ধরেছিল
অহংকারী আকাশের বুকে
সেই অপরাধে!’

যার হাত দিয়ে স্বতন্ত্র একটা পতাকা, একটা মানচিত্র নিয়ে পৃথিবীর বুকে একটা দেশের উন্মেষ ঘটেছে সেই জাতির জনককে হত্যা করাতে কবি আক্ষেপে, দ্রোহে এ প্রশ্ন রেখেছেন। এখানে জাতির জনকের প্রতি কবির গভীর ভালোবাসা ও আবেগ উৎসারিত হতে দেখি। সেইসঙ্গে দেখেছেন আওয়ামী লীগের দীর্ঘ (১৯৯৬-১৯৭৫) ২১ বছরের নির্বাসন। এরপর তিনি দেশে ঘরে বাইরে রাজনীতিতে অপশক্তির কথা বলতে গিয়ে তার কবিতা ‘২১ বছর মুখে মুখে রাখা একটি পদ্য’ কবিতায় রামায়ন পুরাণে বর্ণিত কুচক্রী, ষড়যন্ত্রকারী, কুমন্ত্রণাদানকারী মন্থরার উপমা টেনে এনে লিখলেন;
‘মন্থরা, মন্থর পায়ে জারজসন্তানসহ ফিরে যাও
চোখের আড়ালে
নির্বাসনে শেষ হতে আর খুব বেশি দেরি নেই।’

অথচ রক্তের শোণিত ধারায় স্বাধীনতা নামের যে বৃক্ষে সুবাতাস খেলে, কৃষক শ্রমিক মেহনতী মানুষের আনন্দে শ্রমের সোচ্চারে ছায়া সুনিবিড়ে বেড়ে ওঠা প্রাণে দোলে শাখা প্রশাখা আজ কারা যেন বারবার কর্তনে ছুটে আসে নিষ্ঠুর কুঠার হাতে। এসব দেখে তিনি তার ‘হে ঈশ্বর, উহারা জানে না’ কবিতায় বললেন;
“মুহূর্তেই ‘কাব্য’ তাই ‘বাক্য’ হয়ে যায়
গুজবপ্রবণ কুয়াশায়।
‘হয়’-কে করেছে তারা ‘নয়’
‘নয়’-কে করেছে তারা ‘ছয়’।”

তারপরও মুণ্ডহীন চরণের চারণ দেখে কবি হতাশ। তিনি বলে উঠলেন তার ‘ভুসুকু পা’র বৌ’ কবিতায়;

‘এখানে চিৎকার বেশি, উচ্চারণ কম
কথার ক্ষরণ বেশি, বোধি ও বিন্যাসটুকু কম
তার মানে কথা আছে, কথার ভিতরে কথা নেই।’

সত্যি এখন কথা আছে কিন্তু কথার ভেতরে কথা নেই, নেই বোধের বিন্যাস ও বোধি। মেধাহীন মগজের জয়-জয়কার সর্বত্র।
২)
এখন পুরস্কৃত হচ্ছে তারাই যারা পুরস্কারের অযোগ্য। এখানে কবির প্রচণ্ড ক্ষোভ, দ্রোহ আর দুঃখ। ‘ধুলোবালি’ কবিতায় তার আক্ষেপ ঝরে পড়ল;

থাকুক ওসব কথা, আমার আশ্রয় হলে হলো
আমার নিকট প্রতিবেশী
উইপোকা
কেবল খনন করে কেবল খনন করে একজন বাল্মীকির খোঁজে।

আবেগকে সংযত রেখেই ‘শীর্ষস্থান’ কবিতায় সগর্বে বললেন;
‘হাজার বছর পর কার্বনের অন্ধকার থেকে
হীরাজন্ম নিয়ে যদি উঠে আসতে পারি
এখন যেখানে আছ সেইখানে থাকবে তো তুমি?’

অসাধারণ এক উচ্চারণ। যে উচ্চারণে উৎগীরিত হয়েছে দ্রোহ। তিনি দেখতে পাচ্ছেন ঔজ্জ্বল্যের আঁধারে গমন। অন্ধের মতো হেঁটে যাচ্ছে হাতড়ে হাতড়ে বোধ ও বোধি পরিচর্যার অসম বণ্টনে। তার ‘চরণেরা হেঁটে যাচ্ছে মুণ্ডহীন’ কবিতার চুম্বকাংশে কিছু কিছু পঙ্ক্তি হৃদয়কে জাগ্রত করে যেমন তেমনি বিদীর্ণও করে, আলোড়ন তোলে স্নায়ুর কোষে কোষে। তিনি ছোট ছোট অনেক কবিতাগুচ্ছে যেন সংলাপে আওড়ে গেলেন;
১.
‘আমার খারাপ লাগে আমি রোদ পোহাই, অথচ
আমার ছায়া তা পারে না (ওর শীত তো আরো বেশি)…
আজ জানালা দিয়ে স্পষ্ট দেখলাম আমার নিঃসঙ্গ ছায়াটা একা একা রোদ পোহাচ্ছে! এবং আমি নেই।’

পরাবাস্তবতাবাদের দারুণ কাব্য। ভবিষ্য পর্যবেক্ষণ।
২.
‘স্নায়ুর একুরিয়াম থেকে নেমে কয়েকটা রঙিন মাছ গরম কড়াইয়ের তেলে সাঁতার কাটছে। তার নিচে জ¦লছে, বন্ধুদের নিয়ে আমার দীর্ঘদিনের
অহংকার।’
৩.
‘জীবনেরও দুটো পা আছে এবং একজোড়া স্যান্ডেল, বাম পা-টা মা-বাবার সংসারে, ডান পা-টা ক্যাকটাসের টবে।’
ছোট ছোট কবিতাগুলো বাস্তবিকভাবে কাব্যগ্রন্থের নামকরণের যৌক্তিকতা আনয়নে এক বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখে। তাই নামকরণ সার্থক।
মেধাবী এই কবির কাব্যগ্রন্থের সব কবিতা সৃষ্টিশীল, কাল ও কালের প্রতিচ্ছবি। কবিতার কাব্যকথন অনিবার্য ও অনস্বীকার্য। ষাটের দশকের মেধাবী কবি ‘ময়ুখ চৌধুরী’ কিন্তু দশক দশক চিন্তনে বিশ্বাসী নন। তাই খুব সহজে তার ‘দশকওয়ারি সাম্প্রদায়িকতার পরিপ্রেক্ষিতে’ কবিতায় বললেন;
‘ষাটের মাঝরাতে যার স্বপ্নদোষ হয়েছে প্রথম
সে যদি বিবাহ করে আশির দশকে, তবে
তার কলমের কালি আঁকা হলো কোন বিছানায়?’
কালের অভিসারে মস্তিষ্কের অন্ধকার যাত্রাপথেও তিনি আলো খুঁজে চলছেন অক্ষিপটে ট্যাপেটাম লুসিডাম মানে অন্ধকারে আলো দেখার ক্ষমতা নিয়ে। তাই কাব্যগ্রন্থের শেষ কবিতা ‘ট্যাপেটাম লুসিডাম’ কবিতায় অন্ধকারে আলোর প্রত্যাশায় জেগে থাকতে চাইলেন;
‘সহস্র আলোকবর্ষ দূর থেকে দেখা…
সকলের আগে এই ভার্জিন আলোর ছোঁয়া পাব বলে
যথাযথ তৃষ্ণা মেখে বিড়ালের চোখ পরে
বসে আছি।
বড় দুঃখে আমি আজ স্বপ্নবিদ্ধ প্রাণী,
আমাকে মানুষ বলে ডেকো না তোমরা
অন্ধকারে সর্বশেষ বিশ্বাস ধরেছি এই চোখে।’

সব্যসাচী কবি ময়ুখ চৌধুরীর ‘চরণেরা হেঁটে যাচ্ছে মুণ্ডহীন’ সাড়ে তিন ফর্মার কাব্যগ্রন্থটি সেজেছে ৪৩টা কবিতার সমন্বয়ে। প্রচ্ছদ করেছেন সব্যসাচী মিস্ত্রি। ফেব্রুয়ারি ২০২০ সালে বইটি প্রকাশিত হয়েছে ‘কবিতাভবন’ মোমিনরোড, চেরাগি পাহাড় মোড় চট্টগ্রাম থেকে। বইটির বহুল পাঠক প্রিয়তা কামনা করছি।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়