আ.লীগ নেতা টিপু হত্যার প্রতিবেদন পেছাল

আগের সংবাদ

মাদকের বিরুদ্ধে ‘নতুন যুদ্ধ’ : তালিকায় ৯৩ শীর্ষ মাদক কারবারি, এক লাখ মাদকাসক্ত, জনসচেতনতা বাড়াতে প্রস্তুত অ্যাপ

পরের সংবাদ

আত্মার শব্দঘর : কবি অরুণ দাশগুপ্ত

প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৩, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ১৩, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

অরুণ দাশগুপ্ত এই মহৎ আলোকিত মানুষটার এক প্রিয় মাস্টারমশাই নাম- শ্রী সুধীর কুমার চৌধুরী পটিয়া কেলিশহর থাকতেন। তিনি ছিলেন জার্মান ভাষা ও সাহিত্যের একজন বিদগ্ধ জন। তিনি বলতেন- ‘বাছা, তুমি আগে মনস্থ করো, পড়বে-না লিখবে’। অরুণ দাশগুপ্ত মাস্টার মশাইয়ের এই দর্শনের পড়াকেই আত্মার ধারণ করেছিলেন। তিনি সারা জীবন পড়তে পড়তেই পার করে দিলেন। বিরতিহীন লেখাপড়ার ফাঁকে লিখেছেন খুবই কম। যা লিখেছেন তার প্রতিটি লেখা মানুষের জ্ঞানী হৃদয়কে ভাবিয়ে তুলেছেন। শিল্প সাহিত্যের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে বিচরণ করলেও কৈশোর, যৌবন, তারুণ্য, বৃদ্ধ জীবনের প্রায় স্তর চলে গেছে- তবুও তিনি ইচ্ছে করে বই প্রকাশ করেননি। এর খেশারত তাকে পেতে হয়েছে। অনেক নিম্নমানের মানুষ এমনকি স্বাধীনতাবিরোধীরা যারা ফণা তুলেছিল একসময় তাদের অনেকে পেলেও-অরুণ দাশগুপ্তের রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ কোনো পুরস্কার পাননি। জীবনের শেষ বয়সে তার মাত্র দুটি বই ‘রবীন্দ্রনাথের ছয় ঋতুর গান এবং অন্যান্য’ এবং ‘যুগপথিক কবি নবীনচন্দ্র সেন’ প্রকাশ হয়েছে। তিনি আমার প্রকাশিত ছোটকাগজ ‘পান্থ’র প্রতিটা সংখ্যায় নতুন নতুন এক একটি অপূর্ব লেখা লিখেছেন। এসবও ঠিকঠাকভাবে ছাপালে একটা বই হয়- তাই হলো না। আমি ওনার জীবদ্দশায় প্রচুর চেষ্টা করেছি- বই প্রকাশ করতে, ওনার ওপর ছোট কাগজ ‘পান্থ’ সংখ্যা করতে- ওনার ধমকে চুপসে গেছি- প্রকাশ করতে পারিনি। অথচ জীবন মরণের টানাটানিতে মৃত্যুর বেশ কিছু দিন আগে থেকে ওনার আপ্রাণ ইচ্ছে ছিল তার কিছু বই প্রকাশ হোক- অসুস্থ হয়ে থাকা মানুষটির সেই আশা আর পূর্ণ হয়নি।
মৃত্যুর কাছাকাছি আসা অরুণ দাশগুপ্ত ধলঘাট নিজের বাড়িতে পড়ে থাকা অবস্থায় আমি বহুবার গিয়েছিলাম। এই ‘করোনাকালীন’ সময়েও আমার স্ত্রী রীতা, আমার সন্তান ঋভু ও অর্নি দামণিকে দেখতে গিয়েছিল। তখনও তিনি বারবার বলেছিলেন- ‘খড়িমাটি’ প্রকাশক মনিরুল মনিরকে একটু বল আমার বইগুলো প্রকাশ করতে। বহুবার আমি মনিরুল মনির ভাইকে বিষয়টা বলেছি- এমনও বলেছি আমি প্রয়োজনে কিছু টাকা-পয়সা দেব, বইগুলো প্রকাশ করেন। কিন্তু বেচারা কীভাবে বইগুলো প্রকাশ করবে? দামণি মাত্র চার হাজার টাকা প্রকাশের জন্য দিয়েছিলেন। সেই মনিরুল মনির ভাই ২৫ আগস্ট ২০২২, বৃহস্পতিবার শিল্পকলায় অনুষ্ঠান করলেন। অথচ দামণি প্রয়াত হন ১০ জুলাই ২০২১-এর মধ্যে দামণির জন্য কোনো অনুষ্ঠান হয়নি। প্রকাশক খড়িমাটি অরুণ দাশগুপ্তের বই প্রকাশ করবে- ‘খাণ্ডবদহন’ কবিতার বই। ‘কবিতাচিন্তা ও অন্যান্য প্রবন্ধ’ নামে প্রকাশ হবে প্রবন্ধ বই। বিদ্যুৎ কুমার দাশ সম্পাদিত ‘কবি অরুণ দাশগুপ্ত : আত্মার শব্দঘর’ প্রকাশ হবে। রবীন্দ্রনাথের গানের সুরে বলি- ‘তোমার জ্ঞানে তোমার ধ্যানে তব নামে কত মাধুরী যেই ভক্ত সেই জানে, তুমি জানাও যারে সেই জানে। ওহে, তুমি জানাও যারে সেই জানে।’
সাংবাদিক ও কবি অরুণ দাশগুপ্তের সঙ্গে আমার সম্পর্ক গুরুশিষ্যের এক পিতা ও পুত্রের। আমি আমার বাবা স্বর্গীয় দীপক দাশকে শ্রদ্ধা ও সম্মানে রেখে বলি- আমি দামণিকে বলতাম, আপনি বিয়ে করেননি বলে আমি আপনার সরাসরি সন্তান হতে পারিনি। বিয়ে করলে সরাসরি আমি আপনার সন্তান হতাম। আমার বাবার সঙ্গেও দামণির খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। জীবনের দুঃখ-কষ্ট আবেগ ভালোবাসা সবখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলেন কবি অরুণ দাশগুপ্ত, বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী ড. জামাল নজরুল ইসলাম, দেশের কিংবদন্তি রাজনৈতিক নেতা আতাউর রহমান খান কায়সার। তিনজনকেই হারিয়ে ফেলেছি, হারিয়েছি বাবাকেও এখন আমি শূন্য হৃদয়ে বেঁচে আছি। অরুণ দাশগুপ্ত বাংলা ও বাঙালির কাছে যতটুকু না পরিচিতি নাম তার থেকেও বেশি পরিচিতি তার নাম দামণি। অক্টোবর-২০০০ আমি আমার প্রাণের বন্ধু যাযাবর মিন্টু এবং বর্তমান লন্ডন প্রবাসী কবি আলী মোহাম্মদ মনসুর ভারত বেড়াতে যাই। মিন্টু আমাদের কলকাতার অনেক বড় একজন পুলিশ কর্মকর্তার কাছে বেড়াতে নিয়ে যায়। পুলিশের ওই অফিসার আমাকে জিজ্ঞাসা করেন আপনার বাড়ি কোথায়? আমি বলি চট্টগ্রাম। চট্টগ্রাম বলতেই- তিনি খুশিতে বলে উঠলেন আপনি অরুণ দাশগুপ্ত দামণিকে চিনেন? আমার আনন্দে শরীরটা দোলা দিয়ে উঠেছিল। দাদামণি আমার দামণি! ওই ভারত সফর নিয়ে ১৪/১০/২০০০ থেকে ০২/১২/২০০০ লেখা আমার বিশাল একটা ভ্রমণ কাহিনী আছে। ২০/২২ বছর আগে লেখা ভ্রমণ কাহিনী ‘শূন্য প্রেমের তৃপ্তি ভ্রমণ’ এখনো টাকার অভাবে প্রকাশ করতে পারিনি। তাই আবার কবি অরুণ দাশগুপ্তের জন্য রবীন্দ্রনাথের গানের সুরে বলি- ‘তোমারি গেহে পালিছ স্নেহে, তুমি ধন্য ধন্য হে। আমার প্রাণ তোমারি দান, তুমি ধন্য ধন্য হে।’
‘কবি অরুণ দাশগুপ্ত : আত্মার শব্দঘর’। তার জীবন চর্চা ও মনন চর্চার সংস্কৃতিজুড়ে ছিল রবীন্দ্রনাথ। সঙ্গীতেও অরুণ দাশগুপ্তের খুব ভালো অবস্থান ছিল।
তিনি যখন কলকাতা ছিলেন তখন সঙ্গীতে তালিম নিয়েছিলেন ওস্তাদ শৈলজার রঞ্জন মজুমদার এবং শুভ গুহঠাকুরতার কাছে। তাই তিনি প্রায় গুন গুন করে রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইতেন। উপস্থাপনা, বক্তৃতায় ছিলেন অরুণ দাশগুপ্ত এক অপূর্ব শৈল্পিক ব্যক্তিত্ব। চট্টগ্রাম বেতার এবং চট্টগ্রাম টেলিভিশনের তিনি ছিলেন সঙ্গীতের ওপর অসাধারণ ভিন্ন মেজাজের উপস্থাপক। শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি, সংগীত, দর্শন, ইতিহাস সব বিষয়ে অরুণ দাশগুপ্ত ছিলেন- অসাধারণ জ্ঞানের আলোর বাতিঘর। তার বৌদ্ধ মন্দির সড়ক সংলগ্ন ‘কল্যাণী’ বাড়িতে ছিল বাংলা ও বাঙালি কবি সাহিত্যিক, সাংবাদিক, রাজনৈতিক নেতাদের এক ঠিকানা। ড. অনুপম সেন এবং কবি অরুণ দাশগুপ্ত ছিলেন মামা ভাগ্নে। অরুণ দাশগুপ্তের ‘রবীন্দ্রনাথের ছয় ঋতুর গান ও অন্যান্য’ বইয়ের ভূমিকায় ড. অনুপম সেন লিখেছেন- অরুণ দাশগুপ্তের ‘রবীন্দ্রনাথের ঋতুর গান ও অন্যান্য’ বইটি আমাদের রবীন্দ্রসঙ্গীতের সেই সীমাহীন সুন্দর ভুবনে নিয়ে যাওয়ার পথপ্রদর্শী এক অমূল্য গ্রন্থ। বই এর ‘নিবেদন’ শিরোনামে প্রথম পৃষ্ঠায় অরুণ দাশগুপ্ত। অনেকের কাছে বইটি প্রকাশের সহযোগিতা করার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। বিশেষ করে বইটির প্রকাশক, লেখক, বলাকা প্রকাশনের স্বত্বাধিকারী জামাল উদ্দিনের কাছে সীমাহীন কৃতজ্ঞতার কথা প্রকাশ করেছেন। বইটিতে ‘শরতের গান : ভাবে ও সুরে’ এক প্রবন্ধের শুরুতে প্রিয় দামণি অরুণ দাশগুপ্ত লিখেছেন- ‘রবীন্দ্রনাথ বিশ্বের মহত্তম কবিদের যে একজন-এ কথা বাঙালি সাহিত্য পাঠকদের শতাধিক বছর আগেই জানা হয়ে গেছে। তিনি যে শুধু কবি নন, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম গীত স্রষ্টাদের একজন, আমরা জেনে গেছি। রবীন্দ্র-জন্মশতবার্ষিকীতে দেশে-বিদেশে আয়োজিত নানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে।’
কবি পাবলো নেরুদা (১৯০৪-১৯৭৩) বলেছিলেন- ‘আমি কোনো সমালোচক বা প্রবন্ধকার নই। আমি সাধারণ কবি মাত্র। কবিতা ভিন্ন অন্য ভাষার কথা বলা আমার পক্ষে অত্যন্ত কষ্টসাধ্য ব্যাপার।’ অরুণ দাশগুপ্ত শুধু কবি নয়- তিনি প্রায় ৫০ বছরের কাছাকাছি সাহিত্য সম্পাদক ছিলেন- দেশের প্রাচীন পত্রিকা আমাদের শিল্প সাহিত্যের অস্তিত্বের শেকড় দৈনিক আজাদীতে। তিনি বৃহৎ করপোরেট অফিসের মতোই কবি, সাহিত্যিক তৈরি করেছেন। তার প্রশ্রয় ও আশ্রয়ে আমি কবিতা ও সাহিত্যে গতিময়তা ফিরে পেয়েছি। আমি কয়েকদিন দৈনিক আজাদীতে না লিখলে বিশেষ সংখ্যা প্রকাশের সময় ফোন করে আজাদী অফিসে নিয়ে যেতেন। তারপর সামনাসামনি লিখে নিয়ে পত্রিকায় ছাপাতেন। আবার সুখ-দুঃখে সবসময় লেখার বিল লিখে দিতেন আমি আজাদী কাটাপাহাড় অফিস থেকে টাকা তুলে নিতাম। প্রায় ৩০/৩৫ বছর ধরে অরুণ দাশগুপ্তের সঙ্গে আমার লেখালেখি জগতের আত্মার সঙ্গে আত্মার সম্পর্ক চলছিল। তিনি অসুস্থ হয়ে সাহিত্য সম্পাদকের পদ থেকে সরে গেলে আমি আর এ যাবৎ কোনো পত্রিকায় লিখিনি। বই প্রকাশ করেছি। ফেসবুকে লিখেছি টুকটাক, ম্যাগাজিনে লিখেছি। আমার অবশ্য গত ৪০ বছরের কাছাকাছি উপমহাদেশের পত্র-পত্রিকায় লেখা পত্রিকা কাটিং খাতাগুলোর ওজন হবে কমপক্ষে ১০ কেজি। আমার জীবন যখন টানাটানিতে তাল-বেতাল হতো তখন যেতাম দামণির কাছে। তিনি আমাকে স্নেহ মায়ায় হৃদয় ভরিয়ে দিতেন। বলতেন চট্টগ্রামের ভাষায়- ‘ও বাজি জীবন লাল গোলাপ ফুলর বিছানা নয়।’
চট্টগ্রামের হাজার হাজার কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, সংস্কৃতিকর্মীর উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন অরুণ দাশগুপ্ত।
জ্যৈষ্ঠ ১৪১২, জুন ২০০৫ আমার স্মৃতিকথা মূলক বই- ‘অবেলার যৌবনে ছেলেবেলাকে দেখা’ প্রকাশিত হয়। উৎসর্গ পৃষ্ঠায় লেখা ছিল- আমার জীবনের আলোকিত ছয়টি তারা- বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী প্রফেসর জামাল নজরুল ইসলাম। দেশবরেণ্য প্রবীণ সাংবাদিক অরুণ দাশগুপ্ত। আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান সমাজ বিজ্ঞানী ড. অনুপম সেন। সু-পরিচিত ও স্ব-প্রতিষ্ঠিত সম্পাদক আবেদ খান। একজন সৎ ধার্মিক এবং উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা।
এএনএমএ মোমেন (হুজুর মোমেন)। দেশের প্রধানতম ব্যাংকারদের একজন এসএম খোরশেদ আলম। এই ছয়জন উৎসর্গের প্রথম চলে গেলেন জামাল স্যার। এরপর চলে গেলেন অরুণ দাদামণি। তার মানে রবার্ট ফ্রস্টের ‘যে রাস্তায় যাইনি’ কবিতার প্রথম পঙ্ক্তির মতো- ‘দুটি পথ গেছে বেঁকে দুটি হলুদ বনে।’
একদিন রোদ্দুরের ক্লান্তি শহরের চেরাগী মোড়ে। আমার মেয়ে অর্নি দাশ স্কুল থেকে আমার সঙ্গে হেঁটে আসছে। দাদামণি দেখেই সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দুজনকে ওনার রিকশায় তুলে নিলেন। সেই সময় আমি পথের এক মানুষকে মোবাইলটা দিয়ে ছবি তুলে নিলাম। স্বামী বিবেকানন্দ সভ্যতার সংজ্ঞার সঙ্গে তার ধর্মের সংজ্ঞা ছিল- ‘মানুষের অন্তরে সতত বিদ্যমান দেবত্বের বিকাশ সাধনই ধর্ম।’ (জবষরমরড়হ রং ঃযব গধহরভবংঃধঃরড়হ ড়ভ ঃযব উরারহরঃু ধষৎবধফু রহ গধহ) ‘কবি অরুণ দাশগুপ্ত : আত্মার শব্দঘর’ ছিলেন এমন।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার আগে থেকে বার বার বলছিলেন- ‘বিশ্ব আজ দুই ভাগে বিভক্ত। একদিকে শোষক, অন্যদিকে শোষিত, আমি শোষিতের পক্ষে।’ বঙ্গবন্ধুর আদর্শের মানুষ সাহিত্যিক অরুণ দাশগুপ্ত ও এমন ছিলেন। ছোটবেলা থেকে কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গেও কলকাতায় তিনি জড়িত ছিলেন। শ্রী রামকৃষ্ণ সনাতন হিন্দু ধর্মের বিভিন্ন দর্শনে সাধন করেই বলেছেন- ‘যত মত তত পথ।’ কবি অরুণ দাশগুপ্তের জীবন দর্শন ছিল এমনই। হিন্দু-মুসলমানের ঐক্যের মাধ্যমে ধর্মনিরপেক্ষতা বাস্তবায়িত করার এক নেতা মৌলানা আবুল কালাম আজাদের ভারতবর্ষে অরুণ দাশগুপ্তের তারুণ্য ও যৌবনের বেশ সময় কাটে। স্বাধীন ভারতের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী মৌলানা আবুল কালাম আজাদের শিক্ষা মানবতার কি ছাপ পড়েছিল অরুণ দাশগুপ্তের শরীর ও মনের ভেতর?
১৯৯৬ সালে বিশ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। ১৯৯৭-এর দিকে আমার ঠাকুরদাদা স্বর্গীয় জ্ঞানেন্দ্র লাল দাশ এবং আমার ঠাকুরমা শৈল প্রভা দাশের নামে ‘জ্ঞান-শৈল’ বৃত্তির এক অনুষ্ঠান হয়। আমার পরিবারের মূল উদ্যোক্তা স্বর্গীয় প্রদীপ দাশের নেতৃত্বে এই অনুষ্ঠান হয়। আমাদের ‘রতনপুর, উচ্চ বিদ্যালয়’-এর মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য ৩০ বছর ধরে এই বৃত্তি প্রদান প্রদান করা হয়। তেমনি ‘আল্লা উত্তরভূর্ষি প্রাথমিক বিদ্যালয়’-এর মধ্যেও এই বৃত্তি ৩০/৩৫ বছর ধরে চলতে থাকে। এসব নিয়ে ১৯৯৭-এর দিকে বিশাল এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আমাদের পরিবার। এই অনুষ্ঠান হয় রতনপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে। এই অনুষ্ঠানে আমাদের বাড়িতে যান অরুণ দাশগুপ্ত, ড. অনুপম সেন। এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন সাবেক মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি, বিশিষ্ট শিল্পপতি তিনকড়ি চক্রবর্তী, শিল্পপতি স্বর্গীয় প্রদীপ দাশ এবং আরও অগণিত গণ্যমান্য লোকজন। সারা দেশের পত্র-পত্রিকায় এই অনুষ্ঠানের খবর ছাপানো হয়। কবি অরুণ দাশগুপ্তের বক্তব্য বিশেষভাবে রতনপুরকে আলোকিত পথ দেখায়।
লালনের এক গান আছে-
‘জাত গেল জাত গেল বলে এ কি আজব কারখানা।
যখন তুমি ভবে এলে
তখন তুমি কী জাত ছিলে
কী জাত হবা যাবার কালে
সে কথা কেন বল না’
লালনের এই গানের সুরের মতই অরুণ দাশগুপ্ত জাত-টাত এইসব বিশ্বাস করতেন না। মানুষের শ্রেণি-বৈষম্যও তার ছিল না। আমি কায়স্থর ছেলে আমার স্ত্রী রীতা চক্রবর্ত্তীকে বিয়ে করতে গেলে ঘরে বাইরে এর বিরুদ্ধে অনেক মানুষ লেগে যায়।
আমার বিয়ে এর মধ্যেও দধিমঙ্গল থেকে বৌভাত পর্যন্ত সব হয়। বিয়ে হয় আমার মামার বাড়ি পটিয়া উপজেলার মোটপাড়া গ্রামে। আমার দাদামণি শহীদ ডাক্তার অশ্বিনী সেন এর বাড়িতে। আজ আমার এই বড় মামার নামে সড়ক হয়েছে-
‘অজিত সেন বাড়ি সড়ক’। এই মামার বাড়িতে আমার বিয়েতে প্রচুর কাদার মধ্যে ঝড় বৃষ্টি ঠেলে রাতে চলে যান অরুণ দাশগুপ্ত। দামণির সঙ্গে সারা রাত ছিলেন কবি আশীষ সেন। দার্শনিকের মতো যিনি চলা ফেরা করেন। জুন-২০০৫ প্রকাশিত ‘অবেলার যৌবনে ছেলেবেলাকে দেখা’ বইয়ের প্রচ্ছদের ফ্ল্যাপে নাম প্রকাশ না করে লিখেছেন। ‘স্মৃতি সততই সুখের’ কিংবা ‘স্মৃতি তুমি বেদনা’- এর কোনটা সত্যি বলা মুশকিল। মানুষ বিচিত্র। বিচিত্র তার অনুভূতি। যে যার অভিজ্ঞতা দিয়েই অনুভব করেন স্মৃতির আনন্দ সত্তা অথবা দুঃখময়তা। কবি বিদ্যুৎ কুমার দাশের স্মৃতি আনন্দ ও বেদনার সমাহার। তার স্মৃতিকথা ‘অবেলার যৌবনে ছেলেবেলাকে দেখা অন্তত সে কথাই বলে। কবি সাংবাদিক অরুণ দাশগুপ্তের সঙ্গে আমার জীবনে দুঃখ-কষ্টের স্মৃতির কথা শেষ হবে না। একদিন হলো কী? আমি সরকারি এক চাকরিতে ‘রিটেন’ পরীক্ষায় পাস করেছি। তখন দামণি এক চিঠি দিলেন তখনকার সহকারী সচিব নাকি উপসচিব, লেখক রণজিৎ বিশ্বাসকে। বার বার ফোন করে আমার চাকরির বিষয়টার কথা বললেন। যদিওবা শেষ পর্যন্ত আমার চাকরিটি হয়নি। ওই চিঠির ফটোকপি আমার এখনো আছে। একবার আমাকে নিয়ে পরিচিতি লিখে দিয়েছিলেন এই হাতের লেখাটাও। আমি স্মৃতি হিসেবে রেখেছি। তিনি বলতেন- তোর ‘এই আঙুর ঝড়ের হাওয়ায়’ প্রথম কাব্যগ্রন্থ মানুষ সহজে ভুলবে না। দামণির জন্য কবি জর্জ হার্বাট (১৫৯৩-১৬৩৩)-এর কবিতার সুরে বলতে ইচ্ছে করে। ‘তোমার পথে ছড়িয়ে দিলাম ফুল; বৃক্ষ থেকে নিলাম গুচ্ছ পাতা; রাত পোহালে উদয় হলে তুমি। মিষ্টিঘ্রাণে জড়িয়ে দেহলতা।’
অথচ দামণি চলেছেন জীবনে খুব কষ্ট করে।
কবি, লেখক অরুণ দাশগুপ্ত জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩৬ সালের ১ জানুয়ারি। তার পিতা-প্রয়াত অবিনাশ চন্দ্র দাশগুপ্ত, মা- প্রয়াত হেমপ্রভা দাশগুপ্ত। জমিদারের সন্তান হয়েও পিতার সম্পত্তি, ধনের প্রতি কোনো লোভ-লালসা ছিল না। জীবনে বিয়েও করেননি। মানুষ এমন নির্লোভ, মানবিক এবং এত বড় জ্ঞানী হয় তার প্রমাণ অরুণ দাশগুপ্ত। সমাজে এমন মহামানব যুগে যুগে জন্মগ্রহণ করেন না। বহুকাল অপেক্ষা করতে হয় একজন অরুণ দাশগুপ্তের জন্য। বিদায় দামণি। যেখানেই গেছেন ভালো থাকবেন। আমি শ্মশান খোলায় গেলেও আপনাকে কোনোদিন ভুলব না।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়