পুঁজিবাজারে ব্যাংকের অতিরিক্ত বিনিয়োগ সীমার মেয়াদ বাড়ল

আগের সংবাদ

নয়া কৌশলে মাঠে কোচিংবাজরা > নতুন শিক্ষাক্রমের কার্যক্রম হবে হাতে-কলমে, নতুন শিক্ষাক্রমে কোচিংয়ের প্রয়োজন পড়বে না : শিক্ষামন্ত্রী

পরের সংবাদ

চেনা সেই ছেলেটা

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২১, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ডিসেম্বর ২১, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ওহির একটা বদঅভ্যাস হয়ে গেছে। রাতে বাবার কাছে শুয়ে গল্প না শুনলে তার মোটেও ঘুম আসে না। তার ঘুম আসার শর্ত তিনটি- ১. বাবার কাছে ঘুমাতে হবে ২. বাবাকে অবশ্যই তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে হবে ৩. একটি সুন্দর গল্প শুনতে হবে।
আজ ওহির বাবা অফিস থেকে আসতে দেরি করছে। কাজের খালার বকুনি খেয়ে ওহি বিছানায় গেছে ঠিকই কিন্তু তার ঘুম আসছে না। বিছানায় এপাশ ওপাশ করছে।
বাবা ঘুমাতে আসেন রাত ১১টায়। ওহিকে তখনো জেগে থাকতে দেখে তিনি তো অবাক।
– কি ওহি এখনো জেগে আছো?
– তুমি এত দেরি করলে কেন আজ? বাবার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ওহি পাল্টা প্রশ্ন করে।
– অফিসে অডিট এসেছিলরে, বাবা।
– একটা ফোন করতে পারতে। আমার বুঝি টেনশন হয় না?
– ফোনের চার্জ কখন শেষ হয়ে গেছে বুঝিনি বাবা, আমি সরি। খেয়েছ তুমি?
– খেয়েছি, খালার ধমকে না খেয়ে উপায় আছে।
এই তো আমার ওহি গুড বয়। খালাতো ঠিকই করেছে। আমার তো অফিসের কাজে দেরি হতেই পারে। তাই বলে না খেয়ে থাকতে হবে?
– তুমি তো জানোই বাবা, আমি একা খেতে পারি না, একা ঘুমুতে পারি না।
– জানি, সব জানি। এই তো আমি এসে গেছি। এখন তোমার ঘুম আসবেই।
বাবা এসে ওহির পাশে শুয়ে ওহিকে বুকে টেনে নেন।

২.
এ বাড়িতে ওহি, তার বাবা হাসান এবং কাজের খালা ছাড়া আর কেউ নেই। ওহিকে জন্ম দিয়েই ওর মা মারা গেছেন। হাসানই ওকে বাবা-মা দুজনের ভালোবাসা দিয়ে বড় করেছেন।
অদ্ভুতভাবে কাজের খালাটাও ওদের পরিবারের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। ওহির মাকে যখন হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তখন কুলসুম খালা ওই হাসপাতালে আয়ার কাজ করতেন। একদিনের পরিচয়ে ওহির মায়ের সঙ্গে কুলসুম খালার ভীষণ ভাব হয়ে যায়।
ওহির মাকে যখন ডেলিভারি রুমে নিয়ে যাওয়া হয় তখন নাকি কুলসুম খালার হাত ধরে সে বলেছিল, কুলসুম খালা আমার একটা ফুটফুটে ছেলে হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমি তার মুখ দেখতে পারব না। খালা আমার ছেলেটার ভার আমি তোমাকে দিয়ে গেলাম।
ডেলিভারি রুম থেকে জীবিত ফেরেনি ওহির মা। হাসপাতাল থেকে ফেরার সময় হাসানের সঙ্গে তেমন কেউই ছিল না। কারণ হাসান ও তার স্ত্রী আসমার আত্মীয়স্বজন কেউ নেই। এমন দুর্দিনে কুলসুম খালা হাসানের কোল থেকে ওহিকে তুলে নেন।
‘আজ থেকে এই ছেলের দায়িত্ব আমার, ওর মা আমাকে ওর দায়িত্ব দিয়ে গেছে।’ মায়ের বয়সি কুলসুম খালার কণ্ঠের দৃঢ়তায় হাসান ভীষণরকম আস্থা খুঁজে পায়। সেই থেকে হাসান আর ওহির ভরসার জায়গা কুলসুম খালা।
পুরনো সব কথা ভাবতে ভাবতে হাসানের বুক ফেটে দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে।
– বাবা কী হলো তোমার? আজ গল্প বলবে না? হ্যাঁ বাবা বলব। আজ তোমাকে একটা সত্য গল্প বলব, শুনবে?
– বলো বাবা, আমি শুনতে চাই।
– কিন্তু রাত তো অনেক হলো। কাল তোমার স্কুল। দেরি করে ঘুমালে উঠতে তো দেরি হবে।
– বাবা, কাল শুক্রবার। স্কুল ছুটি। তোমার কিছুই মনে থাকে না দেখছি।
– তাইতো, কাল তো শুক্রবার। আমার মনেই নেই। আচ্ছা তাহলে গল্প শুরু করি। হাসান বলতে শুরু করেন, পিরোজপুর জেলার একটি ছোট গ্রাম পোরগোলা। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে বলেশ্বর নদী। বড় বড় সুপারি আর নারকেল বাগান যেন গ্রামটিকে ঘিরে রেখেছে পরম মমতায়। সে গ্রামেই বাস করত মরিয়ম বেগম। সংসারে মাত্র চারজন মানুষ। স্বামী রহিম শেখ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক, তার দুই সন্তান। এক মেয়ে, এক ছেলে। বড় মেয়ের বয়স দশ বছর। দীর্ঘদিন পর মাত্র এক বছর আগে তার একটি পুত্র সন্তান হয়েছে।
– তার ছেলে মেয়ের নাম কী বাবা?
– নামটা এখন মনে করতে পারছি না। গল্পটা শোনো, নাম দিয়ে কী হবে?
– তাই তো, নাম দিয়ে কী হবে। তুমি বলো বাবা, তারপর কী হলো?
১৯৭১ সাল। মার্চ মাসের শেষের দিকে বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের যুদ্ধ শুরু হলো। কী ভীষণ যুদ্ধ। পোরগোলা গ্রামের মানুষ শুনত সেসব যুদ্ধের খবর। কিন্তু তাদের বিশ্বাস ছিল হয়তো কখনো পাকিস্তানিরা তাদের গ্রামের ঢুকতে পারবে না। কারণ এত পানি ডিঙিয়ে গ্রামে প্রবেশ করা তাদের কাজ নয়। কিন্তু অবিশ্বাস্যভাবে একদিন পাকবাহিনী তাদের গ্রামে প্রবেশ করে।
– তারপর? তারপর কী হলো বাবা? ওহি প্রচণ্ড উত্তেজনায় উঠে বসতে চাইলে বাবা আবার তাকে শুইয়ে দেন।
– তারপর আর কি! গ্রামের সবাই যার যার মতো নিরাপদ আশ্রয়ে লুকিয়ে পড়ল, বিশেষ করে সুপারির বাগানের ভিতরে। মরিয়ম বেগমও তার স্বামী-সন্তানদের নিয়ে অন্য সবার মতো লুকিয়ে পড়ল। মরিয়ম বেগমের কোলে এক বছরের ছেলে। এত ছোট বাচ্চা বিপদ বোঝে না। সে তো রীতিমতো চিৎকার করতে শুরু করল।
– তারপর? তারপর কী হলো বাবা?
– ওর চিৎকার শুনে আশপাশের লুকিয়ে থাকা লোকজন ভীষণ ক্ষেপে গেল। তারা বলল, আপনার ছেলের জন্য আমরা প্রাণ হারাব নাকি? ছেলের মুখ চেপে ধরুন নয়তো অন্য কোথাও ফেলে দিয়ে আসুন। বাধ্য হয়ে মরিয়ম বেগম ছেলের মুখ চেপে ধরে। দম বন্ধ হয়ে গেলে আবার খুলে দেয়। কিন্তু ছেলের চিৎকার আর থামে না।
– কী ভয়ংকর ব্যাপার বাবা!
হ্যাঁ ভীষণ ভয়ংকর। তারপর মরিয়ম বেগম কোনো উপায় না দেখে স্বামী এবং ছেলে মেয়েকে নিয়ে ওখান থেকে চলে যায়। কিন্তু পথেই তারা পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে এবং সঙ্গে সঙ্গেই মরিয়মের স্বামীকে পাকসেনারা গুলি করে মেরে ফেলে।
– মরিয়ম এবং তার ছেলেমেয়েদের কী হলো বাবা?
– মরিয়মের মেয়েটা পাকসেনাদের পা ধরে প্রাণ ভিক্ষা চাইল কিন্তু তারা তাকে লাথি মেরে ফেলে দিল।
– আর ছেলেটা?
– পাকবাহিনী মরিয়মের কোল থেকে ছেলেটিকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে মরিয়মকে ধরে নিয়ে গেল।
– কী বলো, বাবা!
– হ্যাঁ রে বাবা, আমি সত্য বলছি।
– ছেলেটি কি মরে গিয়েছিল, বাবা? ওর বোনেরই বা কী হলো?
– না বাবা, ছেলেটি মারা যায়নি সেদিন। ওর বোন ওকে মাটি থেকে তুলে নিয়েছিল।
– ওদের মা কি আর ফিরেছে?
– না, ওদের মায়ের খোঁজ ওরা আর কোনোদিন পায়নি। এখন ঘুমাও ওহি। গল্প শেষ।
গল্প শেষ হলে ওহি তার বাবার বুকের খুব কাছে সরে আসে। সে তার বাবার বুকের মধ্যে একটা শব্দ টের পায়। মানুষ কাঁদলে এমন শব্দ হয় বুকে। এর মানে ওর বাবা কাঁদছে।
ওহি বাবাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। মুখে কিছুই বলে না। কিন্তু মনে মনে বলে- ‘বাবা, তুমি নাম না বললেও আমি সেই ছেলেটাকে চিনি। সেই চেনা ছেলেটার নাম হাসান। সে আমার অনেক প্রিয় বাবা।’

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়