রিমান্ড শেষে মহিলা দল নেত্রী সুলতানা কারাগারে

আগের সংবাদ

দেশে কোনো দুর্ভিক্ষ হবে না > সোহরাওয়ার্দীর জনসমুদ্রে প্রধানমন্ত্রী : যারা বলেছিল বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা হবে, তাদের মুখে ছাই পড়েছে

পরের সংবাদ

সাহিত্য ও সংগীতে হুমায়ূন

প্রকাশিত: নভেম্বর ১১, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ১১, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

হুমায়ূন আহমেদ সিনেমা দিয়ে দর্শককে হলমুখী করেছিলেন, তিনি তার নাটক দিয়ে সাধারণ দর্শককে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন টিভি সেটের সামনে আটকে রাখতে পেরেছিলেন, তিনি তার কল্পবিজ্ঞান লেখা দিয়ে শিশু-কিশোরকে আনন্দের জগতে প্রবেশ করাতে পেরেছিলেন। হুমায়ূন আহমেদ একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, বিজ্ঞান কল্প-কাহিনীকার, গীতিকার, নাট্যকার, নাট্য পরিচালক, নাট্যনির্দেশক, চলচ্চিত্র নির্মাতা, সংলাপ রচয়িতা, চিত্রশিল্পী প্রভৃতি বিষয়ে সুখ্যাতি অর্জন করেছেন। তার প্রতিটি কর্মে আনন্দ-বেদনায় একাত্ম হয়েছেন দেশের মানুষ। একজন হুমায়ূন আহমেদ প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন তার সৃজনশীল কর্ম দিয়ে। আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে অনুভব করি, তিনি যেখানে যে কর্মে নিজেকে সম্পৃক্ত করেছেন সেখানেই স্বর্ণ ফলেছে। আমরা এখানে তার একটি স্বর্ণ-ভাণ্ডার নিয়ে কথা বলছি; সেটা হলো হুমায়ূন আহমেদের সংগীত-সাহিত্য। সংগীতকে সাধারণত সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত করা হয়, কিন্তু যদি সেই লেখা সাহিত্যনির্ভর হয়, তবে তাকে সাহিত্যের মাপকাঠি দিয়ে বিচার করাই যুক্তিযুক্ত।

যদি মন কাঁদে তুমি চলে এসো
চলে এসো এক বরষায়
এসো ঝরোঝরো বৃষ্টিতে
জল ভরা দৃষ্টিতে
এসো কমল-শ্যামল ছায় \

যদিও তখন আকাশ থাকবে বৈরী
কদমগুচ্ছ হাতে নিয়ে আমি তৈরি
উতলা আকাশ মেঘে মেঘে হবে কালো
ঝলকে ঝলকে নাচিবে বিজলি আলো
তুমি চলে এসো, চলে এসো এক বরষায় \

এই গীতিকবিতাটি ভালোভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, এখানে প্রতিটি পঙ্ক্তিতে সাহিত্য জড়িয়ে আছে। আমরা জানি হুমায়ূন আহমেদ মূলত একজন বড় মাপের কথাসাহিত্যিক। কিন্তু তিনি এত সুন্দর গীতিকবিতা রচনা করতে পারেন, তা ভাবাই যায় না। যেমন সাহিত্যনির্ভর কথা, তেমন ছন্দ-মাত্রা বজায় রাখা। কাব্যিক ব্যঞ্জনার পাশাপাশি চমৎকার দৃশ্যকল্প এবং ধ্বনির দ্যোতনা ফুটিয়ে তুলেছেন। এ কাজটি রবীন্দ্রনাথ-নজরুল অনায়াসে করতে পারতেন, কারণ তাঁরা ছিলেন মূলত কবি। অথচ হুমায়ূন আহমেদ কী করে যেন তাঁদেরই একজন উত্তরসূরি হয়ে গেলেন। মাত্রাবৃত্ত ছন্দে ৬-এর চালে লেখা এই গানটি শুধু জনপ্রিয়ই হয়নি, এ বছর ২০১৮ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার গ্রহণ করেছেন শিল্পী মেহের আফরোজ শাওন- গানটিতে কণ্ঠ দেয়ার জন্য।
হুমায়ূন আহমেদ ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন- যার কাহিনী ও চিত্রনাট্য তিনি নিজেই লিখেছেন। এই চলচ্চিত্রে তার লেখা একটি গান-
আমার ভাঙা ঘরে
ভাঙা চালা ভাঙা বেড়ার ফাঁকে
অবাক জোছনা ঢুইকা পড়ে
হাত বাড়াইয়া ডাকে।

গানটি শুনলে অবাক জোছনার মতো নিজেও অবাক হই। হুমায়ূন আহমেদ যখন ভাঙা ঘর, ভাঙা চালা, ভাঙা বেড়া সংগীতে ব্যবহার করেন, তখন অন্য ধরনের মুগ্ধতা কাজ করে ভেতরে ভেতরে। অবাক জোছনা হাত বাড়িয়ে ডাকার মধ্যে যে সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে তা উপেক্ষা করে কার সাধ্য?
সত্যিই হুমায়ূন আহমেদ তার মিষ্টি কথামালায় আমাদের ভোলাতে পেরেছেন। বিশ্বাস করি তিনি আরও পারতেন। আমি তার মৃত্যুতে আবেগাপ্লুত হয়ে দৈনিক ইত্তেফাকে একটি লেখায় বলেছিলাম, ‘তুমি কি জানো আর মাত্র কয়েকটা বছর অপেক্ষা করলে নোবেলই তোমার জন্য অপেক্ষা করত?’ কথাটি নিজের বিশ্বাস থেকেই বলেছি, কারণ বাংলা সাহিত্য বিশ্বের কাছে সহজে পৌঁছায় না।
আরও আধুনিক একটি গানের কথা বলি। গানটি হলো-
আঁধার এই রাত ছিল
বইছিল পৌষের পাগলা বাতাস
আমরা কয়েকটি প্রাণী
অকারণে অভিমানী- কিছুটা হতাশ \

অর্থহীন কত কথা
টুং টাং গিটারের সুর
নাচিতেছে মৃত পাখি
পায়ে তার রুপালি নূপুর।

এটা শুধু আধুনিক নয়, আমি বলব অত্যাধুনিক। পুনরাবৃত্তি করছি একটি অংশ- অর্থহীন কত কথা/ টুং টাং গিটারের সুর/ নাচিতেছে মৃত পাখি/ পায়ে তার রুপালি নূপুর। নৃত্যরত মৃত পাখির পায়ে রুপালি নূপুর পরানোর কৌশল প্রয়োগের ক্ষমতা অনেকেরই থাকে না, যেটা হুমায়ূনের ছিল। প্রতিটি কথায় সাবলীল সাহিত্য। কথাসাহিত্য থেকে তিনি কীভাবে গীতিকাব্যে আবির্ভূত হলেন তা এক বড় বিস্ময়। মূলত তিনি গান খুব পছন্দ করতেন। বিশেষ করে ফোক গান বা লোকগীতি শুনতে বেশি ভালোবাসতেন। যে কারণে নাটক সিনেমায় উকিল মুন্সীর গানকে প্রাধান্য দিয়েছেন। বাদ যায়নি শাহ আবদুল করিমও। এমনকি একজন অচেনা-অজানা গীতিকবি গিয়াসউদ্দিন আহমেদকেও সবার সামনে এনেছেন ‘মরিলে কান্দিস না আমার দায়’ গানটির মাধ্যমে। এই যে খুঁজে বেড়ানোর স্বভাব, এই যে খুঁজে খুঁজে প্রতিভা আবিষ্কারের স্বভাব, যা দেখে বিস্মিত হতে হয়। হুমায়ূন আহমেদের কী দায় পড়েছিল যে ‘মরিলে কান্দিস না আমার দায়’ গানটির লেখক গিয়াসউদ্দিন আহমেদকে লোকের সামনে তুলে ধরার? তুলে ধরেছিলেন কুদ্দুস বয়াতীকেও। শুধু গানকে ভালোবেসেই হুমায়ূন আহমেদ এমন অনেক গানের মানুষকে ভালোবেসেছিলেন, আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছিলেন।
হুমায়ূন আহমেদের একটি বিশেষত্ব হচ্ছে, তিনি যে বিষয়টিকে নিয়ে নিরীক্ষা করেন সে বিষয়টি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে উপস্থাপন করতে পারেন। লেখার জগৎ থেকে তিনি যখন পরিচালনার জগতে প্রবেশ করলেন বা নির্মাতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেন তখন এই নিরীক্ষার জায়গাটি আরও বিস্তৃত হলো। ফলে তিনি তাঁর কাহিনীর মধ্যে মানানসই হবে এমন গান রচনা করতে ব্যাপৃত হলেন। তাতে দেখা গেল সেই কাহিনীটির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়ায় গানটি দর্শকদের চোখে যেমন দৃষ্টিনন্দন হলো, তেমনি শ্রোতাপ্রিয় হলো। সাধারণ মানুষের মুখে মুখে ফেরে তার এমন একটি গান-

একটা ছিল সোনার কন্যা মেঘবরণ কেশ
ভাটি অঞ্চলে ছিল সেই কন্যার দেশ
দুই চোখে তার আহারে কি মায়া
নদী জলে পড়ল কন্যার ছায়া
তাহার কথা বলি-
তাহার কথা বলতে বলতে
নাও দৌড়ায়া চলি \

দুটি চোখে মায়া পড়া, নদীর জলে ছায়া পড়া- এমন কাব্যিক কথার ভেতরে এক ধরনের রোমান্টিকতাও মানুষকে আনন্দের সাগরে ভাসিয়ে দেয়। হুমায়ূন আহমেদ সার্থক এই জন্য যে তিনি তার পাঠক বা দর্শক-শ্রোতার মন গণনা করতে জানতেন। তাদের রুচিবোধ সম্পর্কেও সচেতন ছিলেন এবং সেভাবেই তিনি তার সৃজনশীল সব কর্মকে উপস্থাপন করতেন। তিনি নিজে জনপ্রিয় হবেন এ কথা ভেবে কখনো লেখেননি, তিনি লিখেছেন নিজে আনন্দ পেতে। এটা তার কথা। কিন্তু আমরা জানি তিনি লিখে যেমন আনন্দ পেয়েছেন, আমরাও তেমন আনন্দ পেয়েছি তার লেখা পড়ে। তার লেখায় যেমন হাস্যরস আছে, তেমন আছে গভীরতা। একটি গানের উদাহরণ দিচ্ছি-

নদীর নামটি ময়ূরাক্ষী
কাক কালো তার জল
কোনো ডুবুরি সেই নদীটির
পায়নি খুঁজে তল \

এখানে নদীর তল খুঁজে না পাওয়ার ব্যাপারটা খুব সহজ নয়। এই গভীরতা অনুভব করা যায় কিন্তু স্পর্শ করা যায় না। ভেবে অবাক হই যে হুমায়ূন আহমেদ কতটা সাধনা করলে এমনভাবে ভাবতে পারেন। ময়ূরাক্ষী নদীর একেতে কাক-কালো জল তার ওপরে তার তল কেউ খুঁজে পায় না। একটি গানের কথায় এত অসাধারণ উপস্থাপনা হুমায়ূন আহমেদের পক্ষেই সম্ভব।
হুমায়ূন আহমেদ বিরহ-বিচ্ছেদ-প্রেম-আধ্যাত্মিক থেকে শুরু করে সব ধরনের গানেই ছোঁয়া দিয়েছেন এবং সর্বত্র সফল হয়েছেন। আনন্দদানের জন্যও কখনো কখনো গান লিখেছেন, হয়তো কাহিনীর প্রয়োজনেও। যেমন একটি গান-

ঢোল বাজে দোতরা বাজে, বাজে হারমোনি
সাজের কইন্যা সাজন কইরছে
তোমরা দেখছোনি \

সত্যিই প্রিয় গীতিকার হুমায়ূন আহমেদ, আমার ঘরের সামনে ঘর বানানো কোনো সহজ কাজ না। কে কখন কোন ঘরে থাকব তা আমরা কেউই বলতে পারি না। তুমি চলে গেছো অনেক দূরে, পৃথিবীর আকাশ থেকে অন্য কোনো আকাশে। এই ধূলোমাটি ছেড়ে অন্য কোনো প্রেমের মাটিতে। হয়তো পৃথিবীর সবুজ বৃক্ষ ছেড়ে অধিক সবুজ কোনো বৃক্ষের সঙ্গে তুমি কথা বলো। তোমার কথা, তোমার গান সেখানে কোনো আলো ছড়ায় কি না জানি না। কিন্তু এখানে, আমাদের জীবনে তুমি অতি আবশ্যক একজন। নিয়ত পাঠ করি তোমাকে। সুতরাং তোমাকে নিয়ে গাইতেই পারি-

ও হুমায়ূন, প্রেমের মানুষ কথার কারিগর
কথা দিয়াও চইলা গিয়া হইলা কেন পর
তুমি একবার আইসা এই সোয়াচান
নাম ধরিয়া ডাকো
হৃদয় জুড়ে আছো তুমি
জীবন জুড়ে থাকো \

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়