রিমান্ড শেষে মহিলা দল নেত্রী সুলতানা কারাগারে

আগের সংবাদ

দেশে কোনো দুর্ভিক্ষ হবে না > সোহরাওয়ার্দীর জনসমুদ্রে প্রধানমন্ত্রী : যারা বলেছিল বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা হবে, তাদের মুখে ছাই পড়েছে

পরের সংবাদ

রমজান মাহমুদ : দায়িত্ব সচেতন লেখক

প্রকাশিত: নভেম্বর ১১, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ১১, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বাংলা ছড়ার বিবর্তনের ধারা বড় উজ্জ্বল। মৌখিক ঐতিহ্য থেকে লৈখিক ঐতিহ্যে উত্তরণের পর ছড়াকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। সুধী সজ্জনের পাঠ ও শ্রæতি তপ্তির দাবি মিটিয়ে ক্রমে ছড়া এখন সম্মানজনক সাহিত্য মাধ্যমের মর্যাদায় আসীন। অনেক শিক্ষিত কৃতী বিদ্বান ব্যক্তি এখন নিজেদের প্রতিভা চারণার প্রধান মাধ্যম হিসেবে বেছে নেন কেবল ছড়াকে। সারা জীবন ছড়াচর্চায় নিবিষ্ট থেকে হয়েছেন প্রতিষ্ঠিত সাহিত্য ব্যক্তিত্ব। বাংলাদেশেও এই দৃষ্টান্ত বিরল নয়। সুকুমার বড়–য়া, রফিকুল হক, ফারুক হোসেন প্রমুখ শিশুসাহিত্যিক প্রধানত ছড়াই লিখেছেন। এই ধারায় সম্প্রতি আরো অনেকেই যুক্ত হয়েছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম উজ্জ্বল নাম রমজান মাহমুদ।
রমজান মাহমুদ ছড়া লেখেন অন্তত ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে। মোটামুটি নিরবচ্ছিন্নভাবে ছড়াচর্চা করে চলেছেন তিনি। অত্যন্ত সাবলীল তার প্রকাশভঙ্গি, যেন ছড়া লেখা তার জন্য অনায়াসসাধ্য একটি ব্যাপার।
ছড়া সাহিত্যের একটি বিশেষ প্রকরণ। ছড়া তো শুধু অসংলগ্ন চিন্তার প্রকাশ নয়। আপাত অসংলগ্ন কিন্তু সুসংহত ভাবনার সমাহারে গভীর চিন্তাশীলতার ছন্দময় শিল্প সৃষ্টিই ছড়া। সাধারণত ছন্দ-অন্ত্যমিল সহযোগে সহজ-সরল প্রকাশভঙ্গির ছোট পরিসরের কবিতাবিশেষকে ছড়া নামে আখ্যায়িত করা হয়। বোঝাই যাচ্ছে পদ্য ও কবিতা থেকে ছড়া আলাদা। যারা সহজেই পদ্য ও কবিতা লিখতে পারেন তাদের অনেকেই প্রকৃত ছড়া লিখতে পারেন না। গুরু-গম্ভীর পাণ্ডিত্যনির্ভর নয় হালকা চালের এমন সমিল রচনা সবার হাতে হয় না। সেই বিরলপ্রজদের একজন রমজান মাহমুদ। ছড়া যেন তার সহজাত প্রবৃত্তি। তার ছড়ার ম্যাজিক যথাযথ শব্দ প্রয়োগে আনকোরা বিষয়ের মজাদার উপস্থাপন এবং চমকপ্রদ সমাপ্তি উপহারে। অসংলগ্নতার সঙ্গে হাস্যরসের মিশ্রণ তার ছড়ার প্রধান বৈশিষ্ট্য। বিদ্রুপাত্মক পরিহাস প্রবণতাও বিশেষভাবে লক্ষণীয়। লিখেছেন নানা ধরনের, নানা আঙ্গিকের ছড়া। অন্ত্যমিলের ছড়া, আদ্যমিলের ছড়া, মধ্যমিলের ছড়া, ঘনবিন্যস্ত মিলের ছড়া, অনুপ্রাসের ছড়া, প্রশ্নোত্তরের ছড়া, ছোট ছড়া, বড় ছড়া, পাঁচ পঙ্ক্তির লিমেরিক আঙ্গিকের ছড়া, কত পরীক্ষা-নিরীক্ষাই না তিনি করেছেন। প্রায় সব কটিই শিল্পোত্তীর্ণ বলা যায়। কয়েকটি উদাহরণ :
‘গন্ধ বুঝে চলার রাস্তা
বুনতে সবাই পারে না।

অন্ধ লোকের চোখ কতটি
গুনতে সবাই পারে না।

নীরবতার শব্দগুলো
শুনতে সবাই পারে না।’
(বুঝতে পারা/ ডিম আগে না মুরগি আগে, ২৩ পৃ.)

কী নেই এই ছড়ায়! বিষয়ের নতুনত্ব, প্রকাশভঙ্গির চমৎকারিত্ব, ব্যঞ্জনাময় কবিত্ব সবই বিদ্যমান। এ সবকিছুর সমন্বয়েই এটি হয়ে উঠেছে একটি মনোজ্ঞ ছড়া। আরেকটি ছড়া-

‘যদু চান কলা খায়
মধু কান মলা খায়।
হাতিয়ার খুশি রায়
লাথি আর ঘুষি খায়।
বেচারাম ঘেঁটে খায়
পেঁচারাম খেটে খায়।
আবু ঘাটে হাওয়া খায়
বাবু হাটে ধাওয়া খায়।
জব্বার আলি খায়
সব্বার গালি খায়।’
(খাওয়া/টানাটানি, ২৯ পৃ.)

খায় শব্দটি নিয়ে আদ্যমিল, মধ্যমিল ও অন্ত্যমিলের কী চমৎকার খেলা! রসময় অর্থের কারুকাজে একটি অনবদ্য ছড়া এটি।
এডওয়ার্ড লিয়র লিমেরিক নামে বিশেষ ধরনের এক ছড়ার প্রবর্তন করেছিলেন, যাতে বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন ছোট-বড় পাঁচ পঙ্ক্তির মধ্যে হাস্যরস বা কৌতুকরস ফুটিয়ে তুলতে হয়। রমজান মাহমুদ এই লিমেরিক লেখায় বেশ স্বচ্ছন্দ। ছড়ার পাশাপাশি লিমেরিক, ক্লেরিহিউ, কিশোর কবিতা ইত্যাদিও লিখেছেন নিয়মিত। শুধু লিমেরিক নিয়ে দুটি একক বই প্রকাশ করেছেন তিনি। এবার দুটি লিমেরিক-
‘দুর্ভাগা বলে আজ হয়ে আছি পিচ্চি
গালভরা বক্তৃতা মাথা ভরে নিচ্ছি
ভুল-ত্রæটি না খুঁজেও
আগা-মাথা না বুঝেও
সাততালি শার্ট গায়ে হাততালি দিচ্ছি।’
(একশো লিমেরিক, ১৪ পৃ.)

অথবা-
‘বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে সোজা হেঁটে চলে
ছাতাখানা থাকলেও রেখেছে বগলে
ভিজে যায় সারা মাথা
তবু আদরের ছাতা
একদম খুলছে না ভিজে যাবে বলে।’
(সে/চিৎপটাং, ১৩ পৃ.)

রমজান মাহমুদ হৃদয়গ্রাহী কিশোর কবিতাও লিখে থাকেন। বাংলাদেশ শিশু একাডেমি প্রকাশিত ‘নূপুর বাজে দুপুর সাঁঝে’ বই থেকে একটি কিশোর কবিতার অংশবিশেষ এখানে উদ্ধৃত হলো-
‘কবিরা বোঝেন পাখিদের ভাষা
কবিরা খোঁজেন চন্দ্রের হাসা
নদীর চলাতে খুঁজে পান সুর
সেই সুর নাকি শুনতে মধুর
ছবির ভেতরে ছবি খুঁজে পান
কিছুটা ঢাকেন কিছুটা বোঝান
কবির ভাষাতে সবকিছু হয়
রূপে রূপে অপরূপ
আলোতে কেমন করে ঝলমল
রঙ ঝরে টুপ টুপ।’
(কবির চোখে/ নূপুর বাজে দুপুর সাঁঝে, ১৭ পৃ.)

রমজান মাহমুদ দুটি সুন্দর গল্পের বইও লিখেছেন। এ পর্যন্ত তার সতেরোটি বই প্রকাশিত হয়েছে। বইগুলো হলো- ‘চিৎপটাং’ (ছড়া, ১৯৯৭), ‘একশো লিমেরিক’ (লিমেরিক, ২০০০), ‘আবোল তাবোল’ (ছড়া, ২০০২), ‘অদলবদল’ (ছড়া, ২০০৬), ‘টানাটানি’ (ছড়া, ২০০৬), বাঁচার লড়াই’ (ছড়া ২০০৮), ‘নূপুর বাজে দুপুর সাঁঝে’ (কিশোরকবিতা, ২০০৯), ‘জগৎ জুড়ে আলোর মেলা’ (ক্লেরিহিউ, ২০১১), ‘রঙবেরঙ’ (লিমেরিক, ২০১২), ‘মিলঅমিল’ (ছড়া, ২০১৫), ‘ধূমধাম’ (ছড়া, ২০১৫), ‘যখন যেমন তখন তেমন’ (ছড়া, ২০১৫), ‘পিঁপড়া ও শিপরা’ (গল্প ২০১৭), ‘গাছবন্ধু’ (গল্প, ২০১৭), ‘ডিম আগে না মুরগি আগে’ (ছড়া, ২০২১), ‘নাদুসনুদুস’ (ছড়া ২০২১), ‘থোকায় থোকায় স্বপ্ন জ্বলে’ (কিশোরকবিতা, ২০২২)। রমজান মাহমুদের ছড়ার বইয়ের নামগুলো বিশেষভাবে লক্ষণীয়। এমন শব্দবন্ধ দিয়ে তিনি প্রতিটি ছড়ার বইয়ের নামকরণ করেছেন যেন নামের মধ্যেই ছড়া লুকিয়ে আছে। এটিও জাতছড়াকারের একটি লক্ষণ।
বইগুলোর প্রকাশকাল থেকে এটিও স্পষ্ট যে, রমজান মাহমুদ লেখালেখির কর্মকাণ্ডে কতটা ধারাবাহিক, কতটা সক্রিয়। শিশুসাহিত্যবিষয়ক বিভিন্ন পত্রিকা সাময়িকী সম্পাদনায়ও অবদান রাখছেন তিনি। সম্পাদিত উল্লেখযোগ্য পত্রিকা সাময়িকীর মধ্যে রয়েছে ‘ছড়ার কাগজ’ (ছড়াবিষয়ক ছোট পত্রিকা), ‘কিশোর কাগজ’ (ছোটদের ছোট পত্রিকা), ‘লিমেরিক’ (লিমেরিকবিষয়ক ছোট পত্রিকা), ‘ম্যাজিক লণ্ঠন (কবিতাবিষয়ক সংগঠন ও পত্রিকা)।
রমজান মাহমুদ বিভিন্ন সাহিত্য সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গেও নানাভাবে যুক্ত। তিনি বাংলা একাডেমির সদস্য, চট্টগ্রাম একাডেমির পরিচালক, ম্যাজিক লণ্ঠনের সম্পাদক, বাংলাদেশ লিমেরিক সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক, ছড়া একাডেমির পরিচালক, বাংলাদেশ গণিত সমিতির আজীবন সদস্য ও অক্ষর সাহিত্য গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক।
শিশুসাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য রমজান মাহমুদ অগ্রণী ব্যাংক বাংলাদেশ শিশু একাডেমি শিশুসাহিত্য পুরস্কার (১৪১৪ বঙ্গাব্দ), এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ সম্মাননা (২০১১) লাভ করেছেন।
রমজান মাহমুদ পেশায় সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের একজন কৃতী শিক্ষক। শিক্ষকতা পেশার সব আদর্শ গুণাবলি তিনি আপাদমস্তকে ধারণ করেন চরিত্রে ও ব্যক্তিত্বে। তার সাহিত্যকর্মেও এর ছাপ সুস্পষ্ট। সামাজিক অঙ্গীকারবদ্ধ অত্যন্ত দায়িত্ব সচেতন মেধাবী লেখক তিনি। রমজান মাহমুদের লেখালেখি বিষয়ে সবচেয়ে বড় সার্টিফিকেট দিয়েছেন বরেণ্য কবি-ছড়াসাহিত্যিক সুকুমার বড়–য়া। তিনি লিখেছেন,
‘রমজান মাহমুদ
এনেছেন খাঁটি দুধ
যাতে আছে সার
ছড়া আর লিমেরিক
সব লিখে ঠিক ঠিক
খাঁটি ছড়াকার।’

রমজান মাহমুদের জন্ম ১০ নভেম্বর ১৯৭১, চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলায়। ১০ নভেম্বর তার ৫১তম জন্মবার্ষিকী। জন্মদিনের শুভক্ষণে তাকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। জয়তু রমজান মাহমুদ।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়