রিমান্ড শেষে মহিলা দল নেত্রী সুলতানা কারাগারে

আগের সংবাদ

দেশে কোনো দুর্ভিক্ষ হবে না > সোহরাওয়ার্দীর জনসমুদ্রে প্রধানমন্ত্রী : যারা বলেছিল বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা হবে, তাদের মুখে ছাই পড়েছে

পরের সংবাদ

বাংলা সাহিত্যের দীপ্যমান নক্ষত্র

প্রকাশিত: নভেম্বর ১১, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ১১, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশের সর্বাধিক জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে সরাসরি পরিচয়ের বহু বছর আগেই তার সাহিত্যকর্মের সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে; সেই আশির দশকে, আমার ছাত্রজীবনে; কৈশোর পেরিয়ে যৌবনের প্রারম্ভে। বাংলা সাহিত্যের সমৃদ্ধির সেই হিরণ¥য় সময়ে তার লেখা আমি গিলেছি গোগ্রাসে; আর তার পরে আমি তার লেখা পাঠ করেছি; এবং তারও পরে আমি তার লেখা অধ্যয়ন করেছি; আর প্রতিবারই তাকে আমি আবিষ্কার করেছি নতুন নতুন রূপে। এমনটি হতে পারে আমার বয়স ও আবেগের ব্যবধানের কারণে; কিংবা জ্ঞান ও পরিপক্বতার ব্যবধানের কারণেও; কিন্তু তার লেখায় আমি তাকে বরাবরই আবিষ্কার করেছি তার সমসাময়িক লেখকদের মধ্যে এমন এক অনন্যসাধারণ শিল্পী হিসেবে; যিনি আমাদের মধ্যবিত্ত সমাজের একেবারে নিখুঁত ও প্রকৃত ছবিটি অত্যন্ত জীবনঘনিষ্ঠভাবে এবং চরম নৈপুণ্যের সঙ্গে অংকন করেছেন। তার ভাষাশৈলী সহজ ও গতি খুবই সাবলীল যা তার সমসাময়িক সাহিত্যিকদের থেকে তাকে এক স্বতন্ত্র পরিচিতি দিয়েছে।
তার প্রথম উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’ প্রকাশের মাধ্যমে আলোচনা ও জনপ্রিয়তার আসন দখল করা এই কথাসাহিত্যিকের প্রায় প্রতিটি উপন্যাসেই এদেশের মধ্যবিত্ত পরিবারের হাসি-কান্না আর আনন্দ-বেদনার কথা অত্যন্ত সহজ ও হৃদয়গ্রাহী ভাষায় বর্ণিত হয়েছে। আর এ কারণেই পাঠক খুব সহজেই তার গল্পের গভীরতায় ডুব দিতে পারতেন এবং নিজেকে তার বর্ণিত ঘটনার সঙ্গে মুহূর্তেই একাত্ম করে ফেলতে পারতেন। মূলত জীবনঘনিষ্ঠ ও সহজবোধ্যতার কারণে এবং উপস্থাপনার জাদুকরি মুন্সীয়ানার কারণে পাঠকের কাছে তার প্রায় প্রতিটি গ্রন্থই ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। অবশ্য তার প্রায় প্রতিটি উপন্যাসের কাহিনীই মধ্যবিত্ত পরিবারকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে এবং প্রতিটি কাহিনীরই একটি না একটি চমৎকারিত্ব থাকায় একই ধরনের কাহিনীও পাঠকের কাছে নতুনের মতোই মনে হয়েছে এবং সেকারণেই পাঠক কোনো একঘেয়েমিতে ভোগেননি।
তিনি শুধু জনপ্রিয় গল্প বা উপন্যাসই রচনা করেছেন এমন নয়; তিনি রচনা করেছেন বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী, গোয়েন্দা কাহিনী, ভ্রমণকাহিনী, মঞ্চনাটক এবং কিছু মৌলিক গান; এমনকি তিনি রচনা করেছেন কবিতাও; অর্থাৎ এই বহুমুখী প্রতিভাবান কথাসাহিত্যিক বাংলা সাহিত্যের প্রায় সব শাখায় তার পাণ্ডিত্যের ছাপ রেখেছেন এবং তার প্রায় সব সাহিত্যকর্ম অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।
টেলিভিশন নাটক ও চলচ্চিত্র নির্মাণে তিনি অত্যন্ত উঁচু মানের দক্ষতার ছাপ রেখেছেন। টেলিভিশন নাটক রচনায় আশি ও নব্বই দশকে তার ছিল আকাশ ছোঁয়া জনপ্রিয়তা। তার লেখা টেলিভিশন নাটক এদেশে মানুষের কাছে এত প্রবল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল যে, নাটকের একটি চরিত্র ‘বাকের ভাই’কে বাঁচিয়ে রাখার দাবিতে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মানুষ মিছিল নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল। এমন জনপ্রিয়তা শুধু এই দেশে নয়; পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও এক বিরল ঘটনা।
তার নাটকে অভিনয়ের মাধ্যমে অনেক অভিনেতা অভিনেত্রী অভিষেক করেছেন এবং জনপ্রিয়তা অর্জন করে তাদের ক্যারিয়ার গঠন করে এখনো দোর্দণ্ড প্রতাপে নাটকে অভিনয় করে যাচ্ছেন; এমন অভিনেতা-অভিনেত্রীর সংখ্যাও কম নয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে টিভি নাটকের জনপ্রিয়তা আকাশছোঁয়া করে তোলার ক্ষেত্রে হুমায়ূন আহমেদের ভূমিকাই প্রধান এবং একচ্ছত্র।
এদেশের বহু তরুণ তার একটি চরিত্র ‘হিমু’কে এত ভালোবেসেছিল যে তারা এই ‘হিমু’কে তাদের ব্যক্তিজীবনে অনুকরণ করা শুরু করে দিয়েছিল। পকেটবিহীন কটকটে হলুদ রঙের পাঞ্জাবি পরে রোদবৃষ্টিতে নগ্ন পায়ে হেঁটে বেড়ানোই ছিল যার কাজ। এটি একটি বিরল ঘটনা এবং যে কোনো সাহিত্যিকের ক্ষেত্রেই তার জনপ্রিয়তা ও ভালোবাসার স্বীকৃতি; আসলে এই স্বীকৃতিই একজন লেখককে আরো ভালো লেখার প্রেরণা জোগায়।
তিনি ছিলেন একজন প্রকৃতিপ্রেমী লেখক; গাছপালা, নদী আর আকাশের পাশাপাশি বৃষ্টি আর জোছনা ছিল সব সৌন্দর্যের মধ্যে তার সর্বাপেক্ষা প্রিয় সৌন্দর্য। তার বহু লেখায় আমরা এই বৃষ্টি এবং অবাক করা জোছনার বর্ণনা দেখতে পাই। এই জোছনা উপভোগ করা নিয়েও তিনি বেশ চমৎকার সব ঘটনা ঘটিয়েছেন; কি বাস্তবে কি তার লেখায়। বাংলাদেশের মানুষের কাছে; বাংলা ভাষাভাষী মানুষের কাছে তিনি জোছনার সৌন্দর্যকে এমন অপার্থিব করে বর্ণনা করেছেন যে, মানুষের ভেতরে জোছনার প্রতি এক তীব্র আকর্ষণ ও আগ্রহ জন্মগ্রহণ করেছে। একবার তিনি ঢাকা শহরের মেয়রকে কয়েক ঘণ্টার জন্য এই শহরের সব বাতি নিভিয়ে দিতে অনুরোধ করেছিলেন বলে জনশ্রæতি রয়েছে; যাতে করে মানুষ জোছনার হৃদয়হরণকারী সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারে। সত্য হোক কিংবা মিথ্যা; এমন একটি মোহময় মিথ্যা স্নিগ্ধ জোছনার অবাক করা সৌন্দর্যের প্রতিও একজন শিল্পীর চিরন্তন সৌন্দর্যবোধ ও ভালোলাগা নির্দেশ করে।
চলচ্চিত্র নির্মাণেও তিনি অসামান্য দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। অন্য অনেক ক্ষেত্রের মতোই এখানেও তিনি ছিলেন এক বিশেষ আসনের অধিকারী। তিনি এক ভিন্ন মাত্রা এনেছিলেন নাটকের মতো বাংলাদেশের চলচ্চিত্রেও। চলচ্চিত্রের ধারাকে বদলে দিতে চেয়েছিলেন তিনি। তার চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত গান আজো মানুষের হৃদয়ে দোলা দেয়; মানুষের মুখে মুখে ফেরে। এত সহজ আর সাবলীলভাবে চলচ্চিত্রকে মানুষের হৃদয়ের কাছাকাছি নিয়ে যেতে পেরেছিলেন খুব কম নির্মাতাই।
বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় শাখা ‘উপন্যাস’। আর তার উপন্যাসের জনপ্রিয়তা এতটাই আকাশচুম্বী ছিল যে, বাংলা একাডেমির বইমেলায় মেলা চলাকালীন সময়েই তার বহু বইয়ের মুদ্রণ শেষ হয়ে যেত এবং বারবার এই পুনর্মুদ্রণের কাজটি করতে হতো। এমনকি হুমায়ূনের উপন্যাসই বাংলাদেশে অনেক বছর একচ্ছত্রভাবে বেস্ট সেলারের তালিকায় থাকত। বাংলা একাডেমির বইমেলায় মানুষ লাইন ধরে তার বই কিনত এবং অটোগ্রাফ সংগ্রহ করত। বাংলাদেশের কোনো কথাসাহিত্যিক কিংবা নাট্যকার তার মতো এত বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করতে সক্ষম হননি।
অনেক অনেক বিষয়ের মধ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ এক বিশেষ ঔজ্জ্বল্যে দীপ্যমান হয়ে উঠেছে তার নির্মাণ করা নাটক ও চলচ্চিত্রে। মূলত হুমায়ূনের লেখায় অসম প্রেম যেমন প্রবলভাবে উপস্থাপিত হয়েছে; তার চেয়েও প্রবলভাবে এসেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিষয়টি। আজ থেকে অন্তত সাড়ে তিন দশক আগে হুমায়ূনই তার নাটকের মাধ্যমে এদেশের জনগণের কাছে তুলে ধরেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন বাস্তবায়নে আমাদের করণীয়ের কথা; মুক্তিযোদ্ধাদের একটি তালিকা তৈরি ও সংরক্ষণের কথা; তার নাটক ও উপন্যাসেই আমরা আবিষ্কার করি মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সম্মান ও পরাজিত শক্তির এদেশীয় দোসর বেইমান-বিশ্বাসঘাতক রাজাকার-আলবদরদের প্রতি এক আকাশ সমান ঘৃণা। এদেশের টিভি নাটকে যখন অলিখিতভাবে নিষিদ্ধ ছিল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কথা বলা কিংবা রাজাকারদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করা; তখন এই হুমায়ূনই চমৎকার এক কৌশলে তার নাটকে পোষা টিয়া পাখির কণ্ঠে উচ্চারণ করিয়েছিলেন সেই কুখ্যাত শব্দ ‘তুই রাজাকার’। বাংলাদেশের টিভি নাটকের ইতিহাসে তার এই চমৎকারিত্ব এবং বিপুল জনপ্রিয়তা এখনো এতটুকু মøান হয়নি।
মুক্তিযুদ্ধের পাশাপাশি তার নাটকের আরেকটি লক্ষণীয় বিষয় ছিল মানুষকে নৈতিক শিক্ষার প্রতি আকৃষ্ট করে তোলা। একজন লেখক, নাট্যকার, শিল্পী এককথায় প্রতিটি সৃজনশীল মানুষই সমাজ তথা রাষ্ট্র ও বিশ্বের কল্যাণে তাদের সৃষ্টি প্রসব করেন আর হুমায়ূন এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। তিনি তার লেখা উপন্যাস, নাটক ও চলচ্চিত্রের মাধ্যমে পরিবারের সবার প্রতি এবং পৃথিবীর সব মানুষের প্রতি পারস্পরিক সহমর্মিতা, সহযোগিতা ও মানবতার শিক্ষা প্রচার করেছেন। বিশেষ করে সত্য কথা বলা ও আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে এর চর্চা করা; পারস্পরিক সহানুভূতি ও ভালোবাসার পাশাপাশি খারাপ কাজ ও দুর্নীতি থেকে বিরত থাকার বার্তাও বারবার তার লেখা ও নির্মাণে ধ্বনিত হয়েছে। একজন লেখক, শিল্পী কিংবা কথাসাহিত্যিক হিসেবে তিনি যে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন, ভবিষ্যতে আর কোনো লেখক, শিল্পী কিংবা কথাসাহিত্যিক তার রেকর্ড ভঙ্গ করতে পারবেন কিনা সেটা হয়তো সময়ই বলে দেবে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়