রিমান্ড শেষে মহিলা দল নেত্রী সুলতানা কারাগারে

আগের সংবাদ

দেশে কোনো দুর্ভিক্ষ হবে না > সোহরাওয়ার্দীর জনসমুদ্রে প্রধানমন্ত্রী : যারা বলেছিল বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা হবে, তাদের মুখে ছাই পড়েছে

পরের সংবাদ

জন্মদিনে হুমায়ূননামা

প্রকাশিত: নভেম্বর ১১, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ১১, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

হুমায়ূন আহমেদ আমাদের বাংলাদেশের বাঙালির জীবনে কয়েকটি কারণে মুক্তিদূত। তার আগে-পরে স্বনামধন্য খ্যাতিমান কালজয়ী লেখকদের তালিকা দীর্ঘ। তাকে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে অস্বীকার করে তাবড় যত বড় লেখকেরা যাই বলেন না কেন, তাদের সবার জানা একা হুমায়ূন আহমেদই বদলে দিয়েছিলেন আমাদের লেখার জগৎ। কীভাবে?
একটা গল্প দিয়ে শুরু করি। আমি তখন নবম বা দশম শ্রেণির ছাত্র। চট্টগ্রামের নন্দনকানন থেকে প্রকাশিত হতো দৈনিক মিছিল নামের একটি পত্রিকা। সে পত্রিকার মালিক সম্পাদক ছিলেন সজ্জন এক ধনী ব্যবসায়ী। ওই কাগজের ছোটদের পাতার নিয়মিত লেখক ছিলাম আমি। ছোটদের মিছিল নামে সে পাতাটি সম্পাদনা করতেন প্রয়াত লেখক অগ্রজ খন্দকার আখতার আহমদ। একদিন দুপুর বেলায় তিনি গোপন কোনো বইয়ের মতো শার্টের ভেতর থেকে ঘামে ভেজা একটি বই বের করে দিয়েছিলেন আমাকে। চটি একটি গল্পের বই। আদেশ দিলেন বইটি যেন অবশ্যই পড়ে তাকে আমার অভিমত জানাই। বুঝতে পারছিলাম না গোপনীয়তা কেন? পরে টের পেয়েছিলাম আমরা তখনো পাঠজগতে ভারতনির্ভর। হাতে হাতে ঘুরতেন বিমল মিত্র, শংকর, নীহাররঞ্জন, ফাল্গুনি, সুনীল কিংবা শীর্ষেন্দু। লজ্জা লজ্জা ভাব যায়নি তখনো। নন্দিত নরকে নামের বইটি ছিল মুদ্রণ প্রমাদে ভরা। দুর্বল ছাপা। কিন্তু পড়ার পর রাতভর ঘুমাতে দেয়নি সে চটি উপন্যাস। চোখের জলে ভেসে যাওয়া কিশোর বা তরুণ পাঠকের মনে সেই প্রথম হুমায়ূনের প্রবেশ। এরপর আখতার ভাই আমাকে দিয়েছিলেন, শঙ্খনীল কারাগার। এটি পাঠ করার পর আমার কান্না আটকে গেছিল গলার কাছে। সে এক ভয়াবহ কষ্ট। তারপর শ্যামল ছায়া। এরপর আমি আর তার কোনো উপন্যাসে তেমন কষ্ট বা আনন্দ পাইনি, যা পেয়েছিলাম শুরুর দিকে। কিন্তু ততদিনে তিনি একাই বদলে দিয়েছিলেন আমাদের পাঠক হৃদয়। বাংলাদেশের বাঙালি যারা কোনোদিন শওকত ওসমান, শওকত আলী আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বা রণেশ দাশগুপ্তের মতো লেখকদের বই উপহার দিতে পারতো না, তারাই দলে দলে বিবাহ উৎসব বা যে কোনো অনুষ্ঠানে হুমায়ূন আহমেদের বই উপহার দিতে শুরু করলেন। এ এক মাইলফলক, এ এক জীবন্ত ইতিহাস আমরা যার সাক্ষী।
দুই.
হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে অনেকে দ্বিধাদ্ব›েদ্ব ভোগেন এই কারণে যে, তিনি নাকি তার অনুজ মুহম্মদ জাফর ইকবালের মতো প্রগতিশীলদের হয়ে লড়াই করেননি। আসুন হুমায়ূন আহমেদের স্মৃতিচারণ থেকেই পড়ি : রাত ন’টার মতো বাজে।
আমি কি যেন লিখছি হঠাৎ আমার মেজো মেয়ে ছুটতে ছুটতে এসে বলল, বাবা একজন খুব বিখ্যাত মানুষ তোমাকে টেলিফোন করেছেন। আমি দেখলাম আমার মেয়ের মুখ উত্তেজনায় চকচক করছে। ব্যাপারটা ঠিক বুঝলাম না। বিখ্যাত মানুষরা যে আমাকে একেবারেই টেলিফোন করেন না তাতো না। মেয়ে এত উত্তেজিত কেন?
‘বাবা তুমি কিন্তু আবার বলতে বলবে না যে তুমি বাসায় নেই।
তোমার বিশ্রী অভ্যাস আছে বাসায় থেকেও বলো বাসায় নেই।’ আমি বললাম, টেলিফোন কে করেছে মা? আমার মেয়ে ফিসফিস করে বলল, জাহানারা ইমাম। এই নাম ফিসফিস করে বলছ কেন? ফিসফিস করে বলার কি হলো?
‘বাবা উনি যখন বললেন, তার নাম জাহানারা ইমাম তখন আমি এতই নার্ভাস হয়ে গেছি যে, তাকে আসসালামালাইকুম বলতে ভুলে গেছি।’
‘বিরাট ভুল হয়েছে।
তিনি আমাকে বললেন, ‘আমি কিন্তু আপনাকে টেলিফোন করেছি কিছু কঠিন কথা বলার জন্যে।’
‘বলুন।’ ‘আপনি রাগ করুন বা না করুন কথাগুলো আমাকে বলতেই হবে।’ ‘আমি শঙ্কিত হয়ে আপনার কথা শোনার জন্য অপেক্ষা করছি।’
‘আপনি স্বাধীনতাবিরোধীদের পত্রিকায় লেখেন কেন? আপনার মতো আরো অনেকেই এই কাজটি করে। কিন্তু আপনি কেন করবেন?’
তিনি কথা বলছে নিচু গলায়, কিন্তু বলার ভঙ্গিতে কোনো অস্পষ্টতা নেই। কোনো আড়ষ্টতা নেই।’
আমি আপনার কাছ থেকে যুক্তি শুনতে চাচ্ছি না। আপনাকে কথা দিতে হবে ওদের পত্রিকায় লিখে ওদের হাত শক্তিশালী করবেন না। আপনি একজন শহীদ পিতার পুত্র। ‘তুই রাজাকার’ সেøাগান আপনার কলম থেকে বের হয়েছে। বলুন আর লিখবেন না।’ আমি সহজে প্রভাবিত হই না। সে রাতে হলাম। বলতে বাধ্য হলাম, আপনাকে কথা দিচ্ছি আর লিখব না। এবার বলুন আপনার রাগ কি কমেছে? তিনি হেসে ফেললেন। বাচ্চা মেয়েদের এক ধরনের হাসি আছে কুটকুট হাসি, বড়দের বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে যে হাসি, তারা হাসে সেই হাসি।
এটাই তার কৃতিত্ব নিজের দুর্বলতাও তিনি অকপটে বলতেন, লিখতেন। যে কথাটা শহীদ জননী বলতে ভোলেননি সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেশের বড় বড় পরিচিত যত নেতা চেতনাধারী আওয়ামী দলের বলে পরিচিত লেখক বুদ্ধিজীবীরা এরশাদ ও পরবর্তী খালেদা জিয়ার আমলে গা বাঁচিয়ে চলতেন। মুখে বললেও কাজের সময় তাদের পাওয়া যেত না। অথচ হুমায়ূন আহমেদ বিটিভিতে অঘোষিতভাবে মুক্তিযুদ্ধ, রাজাকার, দালাল- এসব নিষিদ্ধকালীন সময়েই তার অমর সৃষ্টি বহুব্রীহি নাটকে তোতার মুখ থেকে প্রথম বের করে এনেছিলেন : তুই রাজাকার গালিটি। প্রয়াত অভিনেতা তারকা আলী যাকের আর লাকী ইনামের অনবদ্য অভিনয় সম্পন্ন সে দৃশ্যগুলো এখনকার ভাষায় ভাইরাল হতে সময় নেয়নি। এখন যদি আপনি বিবেচনা করেন, তো দেখবেন, না ছিল মোবাইল, না কোন সোশ্যাল মিডিয়া। দুঃসাধ্য যোগাযোগের সে সময়েও মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছিল ‘তুই রাজাকার’ যা পরবর্তীকালে এমনকি এখনও স্বাধীনতাবিরোধীদের জন্য অপমান ও অস্বস্তির। হুমায়ূন আহমেদ তার নাটক এবং সাহিত্যে যতবার যতভাবে মুক্তিযুদ্ধ, তার পিতা ও স্বাধীনতার শহীদের কথা এনেছেন এবং মানুষের মন জয় করেছেন, তা আর কেউ করতে পারেননি।
তিন.
তার ব্যক্তিজীবন যে চর্চিত হবে, এটাও স্বাভাবিক। এতবড় একজন সেলিব্রেটি তারকা লেখকের আনুকূল্য যেমন কাম্য ছিল, তেমনি তার জীবনযাত্রা বা যাপিত জীবনের যে কোনো ব্যতিক্রমই ছিল মানুষের নখ দর্পণে। জানা শোনা মানুষ থেকে সাধারণ জনগণ সবাই জানত তিনি দ্বিতীয়বার বিয়ে করেছিলেন। অসঙ্গতি যেখানে মানুষের নিত্যদিনের স্বভাব যে সমাজে নানা ধরনের অনৈতিক সম্পর্ক আর অনাচার রোজ নিউজ হয়, ভাইরাল হয়; সে সমাজ তাকে গালমন্দ করত এটা ভাবলেই আমার হাসি পায়। কারণ গুলতেকিন আহমদ বা খানের সঙ্গে তার বনিবনা হয়নি এটা যেমন বেদনার তেমনি এটাও সত্য তিনি পুনর্বার শাওনকে বিয়ে করেছিলেন। অর্মত্য সেন থেকে উত্তম কুমার কে করেননি? অথচ আমাদের সমাজের এক শ্রেণির বুদ্ধিবাজ চতুর এবং সংকীর্ণ মধ্যবিত্ত এ নিয়ে কথা বলে। তাদের মনে হুমায়ূন আহমেদের প্রভাব তাদের প্রিয় লেখকের তালিকায় তিনি অথচ মুখে বিরোধিতা। এখানেও তিনি অনন্য। নিজের জীবন দিয়েই প্রকাশ্য করে দিয়ে গেছেন আমাদের হিপোক্রেসি।
চার.
ম্যাজিক ছিল তার প্রিয় বিষয়। কোনোদিন বুঝতে দেননি তিনি কি আস্তিক না নাস্তিক। একদিকে যেমন সংস্কার ও আচরণগত ধর্মের বিরুদ্ধে বলেছেন অন্যদিকে এমন সব গল্প লিখেছেন, এমন সব কাহিনী- যা অলৌকিকতার দিকেই ঝুঁকে আছে। আমার ধারণা এই দ্বৈততা অথবা সংশয়বাদীতাই হুমায়ূনের মতো লেখকদের ক্রমাগত রহস্যময় ও বড় করে তোলে।
যে যাই বলুক এখনো তারুণ্যে হিমু একটি আকর্ষণীয় চরিত্র। এখনো হিমু হওয়ার সাধনা করে তরুণরা। বাংলাদেশের তারুণ্যে প্রেম-ভালোবাসা ও আনন্দের নাম হুমায়ূন আহমেদ। তিনি মাথাভারী গবেষণা করেননি। তিনি আনন্দের সন্তান। আজীবন আমাদের দেশ ও জাতিকে আনন্দ-বেদনার কাব্য, গল্প, নাটক, সিনেমা উপহার দেয়া বহুমাত্রিক এক প্রতিভা। শত সীমাবদ্ধতা মেনেও আমি মনে করি হুমায়ূন আহমেদ আমাদের দেশের সেরা লেখকদের অন্যতম। যাকে সমালোচনা করা যায় কিন্তু এড়ানো যায় না, যাবেও না।
শুভ জন্মদিন প্রিয় হুমায়ূন আহমেদ।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়