বাংলাদেশ শিল্পী কল্যাণ ট্রাস্টের যাত্রা শুরু

আগের সংবাদ

সিন্ডিকেটে চড়ছে চালের বাজার : প্রতি কেজিতে পরিবহন খরচ বেড়েছে ৫৮ পয়সা, বিপরীতে দাম বেড়েছে ৫ থেকে ৬ টাকা

পরের সংবাদ

অব্যাহত লোডশেডিংয়ের প্রভাব : চায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়ে শঙ্কা

প্রকাশিত: আগস্ট ১৩, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: আগস্ট ১৩, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

সালেহ এলাহী কুটি, মৌলভীবাজার থেকে : চা পাতা উৎপাদন প্রক্রিয়া খুবই স্পর্শকাতর। প্রক্রিয়াজাতে কোথাও থেমে গেলে ওই পাতাগুলো নষ্ট হয়ে যায়। চায়ের ভরা মৌসুমে দেশব্যাপী বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সাশ্রয়ে লোডশেডিং ব্যবস্থা চালু হওয়ার কারণে ব্যাহত হচ্ছে চায়ের উৎপাদন। শঙ্কা দেখা দিয়েছে চায়ের গুণগতমান রক্ষা নিয়েও। দিনে ৫-৬ ঘণ্টা লোডশেডিংয়ের কারণে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন চা সংশ্লিষ্টরা।
তাই চা বাগান মালিক ও শ্রমিকদের মধ্যে এক ধরনের হতাশা দেখা দিয়েছে। দিনে একাধিকবার লোডশেডিংয়ের কবলে পড়ার কারণে ব্যবহার করতে হচ্ছে জেনারেটর, আর তাতে বাড়ছে উৎপাদন খরচ। পাশাপাশি সরকার জ্বালানি তেলের কৃচ্ছ্রতা সাধনের নীতি প্রয়োগ করায় জেনারেটর চালানোর জন্য পর্যাপ্ত ডিজেলেরও সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন বাগান কর্তৃপক্ষ।
বিশেষজ্ঞদের মতে ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে ব্যাহত হচ্ছে চায়ের উৎপাদন। শঙ্কা দেখা দিয়েছে চায়ের গুণগতমান রক্ষা নিয়েও। এর প্রভাব পড়বে চা রপ্তানি বাজারেও। চায়ের মান খারাপ হলে চা পাতা রপ্তানিও করা যাবে না। আবার রপ্তানি করা গেলে সেটি ফেরত আসার আশঙ্কা থাকবে। তখন বিশ্ববাজারে বাংলাদেশি চায়ের মান নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেবে।
দেশের সিংহভাগ চা উৎপাদন হয় চায়ের রাজধানী খ্যাত মৌলভীবাজার জেলায়। সারাদেশের মোট ১৬৭টি চা বাগানের মধ্যে এই জেলায় রয়েছে ৯২টি। জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত চা উৎপাদনের ভরা মৌসুম। দেশের অভ্যন্তরীণ চায়ের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও চা রপ্তানি করা হয় এখানকার চা। লোডশেডিংয়ের কারণে কচি পাতা প্রক্রিয়াজাত করতে সমস্যায় পড়ছেন বাগান কর্তৃপক্ষ। প্রতিটি বাগানের ফ্যাক্টরির ট্রাফ হাউসে বিদ্যুৎ না থাকায় কাঁচা পাতা গরমে লালা হয়ে যাচ্ছে। এতে চায়ের গুণগতমান কমে যাওয়ার পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সমগ্র উৎপাদন প্রক্রিয়া। মৌলভীবাজারের রাজনগর মাথিউড়া চা বাগানের ট্রাফ হাউসে বাগান থেকে নিয়ে আসা কচি চা পাতা ট্রাফ হাউসে বিচাচ্ছেন শ্রমিকরা। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কারেন্ট না থাকায় কাঁচা চা পাতা দ্রুত মেলে দিতে হবে। নতুবা গরমে পাতা লাল হয়ে নষ্ট হয়ে যাবে। কর্মরত শ্রমিকরা জানান, কারেন্ট থাকলে ফ্যান ছেড়ে দিলে কাঁচা পাতা নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে না।
চা শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, লোডশেডিং তীব্র হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে উৎপাদন প্রক্রিয়া। জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত চা উৎপাদনের ভরা মৌসুম। এই সময় প্রতিটি বাগানের ফ্যাক্টরিতে ক্ষেত্রভেদে পাঁচ হাজার থেকে ৭০ হাজার কেজি চা পাতা আসে প্রক্রিয়াজাতের জন্য। কিন্তু বিদ্যুৎ বিভ্রাটের ফলে কাঁচা পাতা প্রক্রিয়াজাত করতে সমস্যা হচ্ছে। যার কারণে প্রক্রিয়াজাত গুণগতমান সম্পন্ন চা উৎপাদন কমে যাচ্ছে। এতে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিল্প। এ ব্যাপারে ইটা চা বাগানের সহকারী ব্যবস্থাপক মো. আদিল বলেন, চা উৎপাদনে ৪ থেকে ৫টি ধাপে প্রক্রিয়াকরণ করতে হয়। বিদ্যুৎ না থাকার কারণে যদি ১টা ধাপে সমস্যা দেখা দেয় তাহলে চায়ের উৎপাদন ব্যাহত হয়। এই অবস্থায় সময়ে-অসময়ে ৪-৫ ঘণ্টার বিদ্যুৎ বন্ধ থাকছে। ১ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকলে পরের ২ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকছে না। একটানা যদি ফ্যাক্টরি না চলে তাহলে চায়ের গুণগতমান নষ্ট হয়।
এ ব্যাপারে রাজনগর মাথিউরা চা বাগানের ব্যবস্থাপক মো. সিরাজুদ্দৌলা বলেন, বাগান থেকে কাঁচা পাতা এনে ফ্যাক্টরিতে ট্রাফ হাউসে ১২ থেকে ১৬ ঘণ্টার মতো রাখতে হয়। কারণ এই কাঁচা পাতাতে ৭৫ থেকে ৮৫ শতাংশ ময়েশ্চার থাকে। এই ময়েশ্চার থাকার কারণে পাতাগুলো সতেজ থাকে। যেটা প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য সিটিসি মেশিনে দেবো তখন ময়েশ্চার থাকে তা হলে লিচিং হয়ে চলে যাবে। আর না হলে গ্যাস হয়ে উড়ে যাবে। এতে চায়ের যে নির্ধারণকারী কোয়ালিটি কেমিক্যালগুলো আছে তাও নষ্ট হয়ে যাবে।
তিনি আরো বলেন, বাগান থেকে পাতা তোলে দ্রুত সময়ের মধ্যে ট্রাফ হাউসে বিছিয়ে বাতাস দেই। যদি নির্দিষ্ট একটা সময়ের মধ্যে বাতাস দিতে না পারি তাহলে চায়ের গুণগতমান নষ্ট হবে। বর্তমান সময়ে লোডশেডিংয়ের জন্য চায়ের গুণগতমান অক্ষুণ্ন রাখার জন্য যুদ্ধ করছি। আর এই সময়ে লোডশেডিং চা শিল্পের জন্য হুমকি। তিনি আরো জানান- জেলার ৪টি গোল্ডমাইন্ড বাগানের মধ্যে ফুলতলা চা বাগান অন্যতম। তাদের জেনারেটর নষ্ট অন্যদিকে বিদ্যুৎ সংকটে ফুলতলা চা বাগান বন্ধ। কোন চা চয়ন হচ্ছে না। তিনি আরো জানান, ফ্যাক্টরিতে প্রক্রিয়াজাতকরণে সময় বারবার কারেন্ট চলে গেলে মেশিন ব্রেকডাউন হয় তাতে পরবর্তীতে আইডিয়েল পজিশনে আনতে মারাত্মক সমস্যা হয়। ফ্যাক্টরিতে চারটি স্তরে বিদ্যুৎ প্রয়োজন। বর্তমানে লোডশেডিংয়ের কারণে উন্নতমানের চা উৎপাদন করা খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে। এতে চাষের মূল্য কমে যাচ্ছে।
চাঁনভাগ চা বাগানের ম্যানেজার মুজিবুর রহমান বলেন, এই মুহূর্তে যে বাগানে চা পাতা একেবারেই কম, তাদেরও ৯-১০ হাজার কেজি পাতা ফ্যাক্টরিতে আসে। এসব পাতা প্রক্রিয়াজাত করতে ১০-১২ ঘণ্টা সময় লাগে। এ কারণেই আমাদের ২৪ ঘণ্টা কারখানা চালু রাখতে হয়। আমরা পাতা সংরক্ষণ করে রাখতে পারি না, দিনেরটা দিনেই প্রসেস করতে হয়। তাই লোডশেডিংয়ের কারণে আমরা মারাত্মক সমস্যায় পড়েছি। আমাদের খরচ বেড়ে গেছে। বিদ্যুতের বিকল্প আমাদের জেনারেটর চালাতে হয় আর জেনারেটর চালানোর জন্য প্রয়োজন হয় ডিজেল। ডিজেলের লিটার ১১৫ টাকা করে। কিন্তু সেই ডিজেলও আমরা চাহিদামতো পাচ্ছি না। যে কারণে উৎপাদন ঠিক রাখা যাচ্ছে না।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ টি এসোসিয়েশন সিলেট শাখার চেয়ারম্যান জি এম শিবলী ভোরের কাগজকে বলেন, এখন চা উৎপাদনের ভরা মৌসুম। বিদ্যুৎ সমস্যার কারণে আমাদের সব বাগানেই চা উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। চা উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত সব যন্ত্রপাতি আবার অনেক সময় জেনারেটরে চালানো সম্ভব হয় না। চা পাতা উৎপাদন প্রক্রিয়াটা খুবই স্পর্শকাতর। কোথাও কোনো ব্যত্যয় ঘটলে পাতার মান নষ্ট হয়ে যায়। এই সমস্যার জন্য গুণগতমান যদি কমে যায় তাহলে চায়ের দামও কমে যাবে।
মৌলভীবাজার পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির জেনারেল ম্যানেজার প্রকৌশলী সাখাওয়াত হোসেন জানান, সহসাই এই সমস্যা থেকে উত্তরণের পথ নেই। বিশ্ববাজারে যদি পরিস্থিতি স্থিতিশীল হয় তাহলে একটা সুরাহা হবে। চা শিল্পের বিদ্যুৎ সমস্যার ব্যাপারে তিনি বলেন, এখানে একাধিক কারখানা রয়েছে। তাই আমাদের পক্ষে কিছু করা সম্ভব হচ্ছে না। তিনি আরো বলেন, জেলায় বর্তমানে চাহিদা পিক আওয়ারে ৯৬ মেগাওয়াট আর সরবরাহ প্রায় ৫৫ মেগাওয়াট। অফপিক আওয়ারে চাহিদা ৫৫ মেগাওয়াট এবং সরবরাহ প্রায় ৩০ মেগাওয়াট। জেলার ৯২টি চা বাগানের ৫৩টি কারখানায় ২৫ মেগাওয়াট চাহিদা রয়েছে। যদি অতিরিক্ত বরাদ্দ পাওয়া যায় তাহলে এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হবে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়