বিশেষ অধিকার ক্ষুণ্ন : এমপি হারুনের নোটিস নাকচ করলেন স্পিকার

আগের সংবাদ

ঢাকার তৃণমূলে আ.লীগের পদ পেলেন ৫৪ হাজার কর্মী : থানা-ওয়ার্ডে পদ পাচ্ছেন আরো সাড়ে ১২ হাজার > সংগঠন গোছাতে মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন নগর নেতারা

পরের সংবাদ

পদ্মা সেতুর গল্প : এক ছুটে মায়ের কাছে

প্রকাশিত: জুন ২৯, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ২৯, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বাবা আমাকে ঢাকার একটা কলেজে ভর্তি করে দিলেন। হোস্টেলে সিট পেলাম। বইপত্র, এটা-ওটা কিনে দিয়ে বাবা বাড়ি ফিরে গেলেন। বাবার সঙ্গে চলে গেল আমার মনও! এই অচেনা শহরে একা আমি কেমন করে থাকি!
ক্লাস বলতে এখনো কেবল শিক্ষক-ছাত্রছাত্রীদের পরিচয় পর্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ বলা চলে। এক-দুজন গুরুগম্ভীর স্যার তাদের বিষয়ের প্রথম অধ্যায় নিয়ে একটু ঘাঁটাঘাঁটি করেন, এই যা! এসএসসির বিজ্ঞান বই থেকে এক-দুটো সূত্র ঝালাই করেন। আমার মনে হয়- এই স্যাররা আসলে মেধাবী আর দুর্বল মেধার ছাত্রছাত্রীদের চিনে নিচ্ছেন শুরুতেই। কিন্তু শীতল স্যার যে আমাকে কী পেয়েছেন, ঘুরেফিরে আমাকে পড়া ধরেন আর উপদেশ দেন- ‘তুই গ্রাম থেকে এসেছিস। পড়াশোনায় নো ফাঁকিবাজি।’ যেন আমি একাই গ্রাম থেকে এসেছি! শাকিব, রাজু, শিমুল, ললিতা, নাবিলা; ওরা গ্রাম থেকে আসেনি!
আসলে বাবা শীতল স্যারের সঙ্গে দেখা করে আমার বিষয়ে কীসব বলে গেছেন! স্যার সেই সূত্র ধরে আমাকে তার মগজে গেঁথে ফেলেছেন।
এর মধ্যে ছুটি পাওয়া গেল তিনদিনের। বৃহস্পতি থেকে শনি। বাড়িতে মা যেখানে মাঝে মাঝে শুক্রবারেও ভুল করে বলে বসতেন- ‘কী রে, স্কুলে যাবি না?’ সেই মা-ও আজ ফোন করে বললেন, ‘তিনদিনের ছুটি আছে। বাড়িতে আসবি না বাবা?’
মনে মনে বলি- আমি তো বাড়িতেই মা। মন পড়ে আছে তোমার কাছে। মন নিজের সঙ্গে না থাকলে, কী আর থাকে?
বললাম, ‘আসব মা।’
‘কার সঙ্গে আসবি? একা তো আসতে পারবি না।’
‘পারব। বাবার সঙ্গে ঢাকায় আসতে আসতে পথ চিনে রেখেছি।’
‘খুব বড় হয়ে গেছিস, তাই না? একা আসতে হবে না। তোর বাবার সঙ্গে কথা বলে দেখি।’
বিকেলে ফোনে বাবা বললেন, ‘পাশের বাড়ির তোর ফজল চাচা আসবেন। তারও তো স্কুল ছুটি। তাকে বলে দিয়েছি। বুধবার দুপুরে তোকে আনতে যাবে। তার সঙ্গে চলে আসিস।’
রাতেই ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছি। কাল ক্লাস থেকে ফিরে চাচা এলে যেন দেরি না হয়।
আজ আর ক্লাসে মন নেই। কেবল অপেক্ষা- কখন দুপুর হবে? কখন ফজল চাচা আসবেন?
আজ দুপুরে ডাইনিংয়ে আমার প্রিয় মুরগির মাংস। মসুর ডাল ভুনা। তবু রুচি নেই যেন! কখন ফজল চাচা আসবেন…
ফজল চাচা সময়মতোই এলেন। হোস্টেলে একদম আমার রুমে এসে হাজির।
‘কী রে পাগলা, সব গুছিয়ে নিয়েছিস তো? জলদি চল। বাড়ি পৌঁছতে রাত হয়ে যাবে।’
রওনা হতে গিয়ে ক্লাসমেট, রুমমেট শাকিবের কাছ থেকে বিদায় নিতে গেলে বুঝলাম, ওর মন খারাপ। আমারও মন খারাপ হলো! এ তো দেখছি দোটানায় পড়ে গেলাম- এক দিকে মায়ের কাছে মন, আরেক দিকে শাকিবকে একা ফেলে যেতে মন কেমন করছে!
বললাম, ‘এই ক’টা দিন শিমুলদের রুমে গিয়ে ঘুমাস। একা থাকিস না।’
শাকিব মাথা কাত করে সায় দিল। ও সেই উত্তরবঙ্গ থেকে এসেছে। বেশ দূরের পথ বলে মন চাইলেও তিনদিনের ছুটিতে বাড়ি যেতে পারবে না!
গুলিস্থান থেকে মাওয়াঘাটের গাড়িতে উঠলাম আমরা।
চাচা বললেন, ‘পঁয়তাল্লিশ মিনিটের পথ।’
জানালার পাশে বসেছি।
‘জানালার বাইরে হাত রাখিস না।’ ফজল চাচা সতর্ক করে দিলেন। তিনি পেশায় শিক্ষক, তাই সবকিছুতে শিক্ষকের নজরদারি।
নয়াবাজার হয়ে বুড়িগঙ্গা দ্বিতীয় সেতু পেরিয়ে কিছুক্ষণের জ্যাম কাটিয়ে আমাদের গাড়ি ছুটে চলল। আমার কাঁধের পাশে জানালা দিয়ে অনেক কিছু দেখছি, তবু অন্যপাশের জানালায়ও দৃষ্টি ছুটে যাচ্ছে।
মাওয়াঘাটে যেতে যেতে মনে হলো- বিদেশের রাস্তায় চলেছি।
ফজল চাচা বললেন, ‘দেখেছিস সজল, সব কেমন গোছানো লাগছে! কী সুন্দর হয়েছে পথঘাট! আগের রাস্তা তো তুই দেখিসনি, তাহলে কতটা পরিবর্তন হয়েছে বুঝতি। রাস্তাঘাট চওড়া হয়েছে। গাড়ির জ্যাম নেই। দু’তিন দিক থেকে রাস্তা মিশেছে পদ্মা সেতুর সঙ্গে।’
মাওয়াঘাটে পৌঁছে গেলাম।
ফজল চাচা বললেন, ‘জলদি পা চালা। লঞ্চ ধরতে হবে।’
আমরা উঠতেই লঞ্চটা ছেড়ে দিল। যেন আমাদের অপেক্ষায়ই ছিল! সিট খালি নেই। চাচা আমাকে নিয়ে লঞ্চের পেছনে ছাদে উঠে বসলেন।
লঞ্চ এগিয়ে চলেছে। দূরের পদ্মা সেতু ক্রমশ দৃষ্টিসীমায় এসে ঢুকছে। সেতুর ওপর কয়েকটি গাড়ি চোখে পড়ল। আঙুল তুলে ফজল চাচাকে দেখালাম।
‘ওগুলো পদ্মা সেতু প্রকল্পের গাড়ি। সেতুর ইঞ্জিনিয়াররা চলাচল করেন হয়তো!’ ফজল চাচা বললেন।
পদ্মা সেতুর কাছাকাছি আমাদের লঞ্চ। দাঁড়িয়ে পড়লাম। ভালো করে তাকিয়েও সেতুর এ-মাথা-ও-মাথা দেখা যায় না। আনন্দে বলে উঠলাম, ‘কত বড় সেতু!’
‘পড়ে যাবি সজল। বসে দ্যাখ।’
বসতেই ফজল চাচা প্রশ্ন করলেন- ‘বল তো, পদ্মা সেতুর দৈর্ঘ্য কত?’
‘জানি না তো!’ বোকার মতো বললাম।
‘৬.১৫ কিমি। প্রস্থ ১৮.১০ মিটার বা ৫৯.৪ ফুট। আর দুই প্রান্তে সংযোগ সড়ক ১৪ কিমি। দ্বিতল পদ্মা সেতুর পিলারের সংখ্যা ৪২টি। স্প্যান ৪১টি। স্প্যানগুলো বসাতে সময় লেগেছে ৩৮ মাস। একেকটি স্প্যানের ওজন ৩১৪০ টন। মুন্সীগঞ্জ, মাদারীপুর, শরীয়তপুর- এই তিন জেলার অংশে অবস্থিত বিশ্বের ১১তম এই দীর্ঘ সেতু। এর কাজ শুরু হয় ৭ ডিসেম্বর ২০১৪ সালে। সেতুটির ডিজাইনার অঊঈঙগ। পাইলিং সংখ্যা ২৬৪টি। পাইলিং গভীরতা ৩৮৩ ফুট। ভূমিকম্প সহনীয় মাত্রা রিখটার স্কেল ৯।’
‘চাচা, আপনি এত কিছু জানেন কীভাবে?’
মুচকি হেসে ফজল চাচা বললেন, ‘শিক্ষকদের অনেক কিছু জানতে হয়। তবে তুইও এসব তথ্য খাতায় টুকে রাখবি। জানার কোনো শেষ নেই রে পাগলা! নিজের দেশ সম্পর্কে জানতে হয়।’
আমাদের লঞ্চ এখন সেতুর নিচ দিয়ে অতিক্রম করছে। সেতুর দিকে তাকিয়ে বুকের ভেতর কেমন করে উঠল! সেতু ছেড়ে দূরে যাওয়ার পরেও সেতুর দিক থেকে দৃষ্টি সরতে চায় না!
‘আর কটাদিন পরে গেলেই সেতুর ওপর দিয়ে যেতে পারতাম! তবে কিছু দিন পর থেকে দুদিনের ছুটিতেও মায়ের কাছে যেতে পারবি সজল। বড়জোর তিন-চার ঘণ্টা লাগবে! আর সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো- একাই বাড়িতে যাতায়াত করতে পারবি। ঢাকা থেকে গাড়িতে উঠে একদম বাড়ির কাছের স্টপেজে গিয়ে নামতে পারবি। তেমনি ওই স্টপেজ থেকে গাড়িতে ঢাকায় নেমে রিকশায় কলেজে পৌঁছে যাবি।’ ফজল চাচা বললেন।
চাচার কথা শুনে মন ভালো হয়ে গেল। মায়ের কথা মনে করে আর কষ্ট পেতে হবে না। সপ্তাহ শেষে এক ছুটে মায়ের কাছে। এক মা গড়ে দিয়েছেন আরেক মায়ের সঙ্গে সেতু!
ফজল চাচা হয়তো আমার মনের অবস্থা টের পেলেন! বললেন, ‘তাহলে মায়ের কাছে যাবার এমন সহজ সুযোগ যিনি করে দিলেন, তার জন্য দোয়া করতে হবে না? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা আমাদের নিজস্ব অর্থায়নে গড়ে দিয়েছেন এই পদ্মা সেতু। আমাদের গর্ব- আমাদের টাকায় আমাদের সেতু!
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার জন্য গর্বে ভরে উঠল সজলের বুক।
ফজল চাচার দিকে তাকিয়ে সজল বলল, ‘দেশপ্রেম থাকলে এমন সাহসী কাজও সহজ হয়ে ওঠে।’
সজলের পিঠ চাপড়ে দিলেন ফজল চাচা।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়