ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার বিরুদ্ধে সাক্ষ্যশুরু

আগের সংবাদ

অর্থ পাচার উৎসাহিত হবে! পাচার হওয়া টাকা অর্থনীতির মূল¯্রােতে আনতে চান অর্থমন্ত্রী > বৈষম্যের শিকার হবেন সৎ করদাতারা : বিশ্লেষকদের অভিমত

পরের সংবাদ

ছবি বিশ্বাস : বাংলা সিনেমার অবিস্মরণীয় পিতৃপুরুষ

প্রকাশিত: জুন ১১, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ১১, ২০২২ , ১:৪০ পূর্বাহ্ণ

একটা সময় ছিল যখন বাংলা ছবিতে বাবা বা পরিবারের কর্তা চরিত্রের জন্য অপরিহার্য ছিলেন ছবি বিশ্বাস। ওই বয়সি মানুষের কাছে তিনি যেন রোল মডেল হয়ে ছিলেন। ১৯০০ সালের ১৩ জুলাই জন্ম হয়েছিল উত্তর কলকাতার আহিরিটোলায় বনেদি বিশ্বাস পরিবারে। শোনা যায় ছবির মতো চেহারা নিয়ে জন্মেছিলেন বলেই মা প্রিয়দর্শন ছেলের নাম রেখেছিলেন ছবি। খুব ছোট বয়সে মা প্রয়াত হলেও তার দেয়া নামটাই ইতিহাসে অমর হয়ে রয়ে গেছে। বাবা ভূপতিনাথের দেয়া নাম ছিল শচীন্দ্রনাথ।
হিন্দু স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করবার পর প্রেসিডেন্সি কলেজ ও তারপরে বিদ্যাসাগর কলেজ থেকে স্নাতক পাস করেন। কলেজে পড়ার সময় নাট্যকার ও কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, নরেশ মিত্র, শিশিরকুমার ভাদুড়ির প্রভাবে নাট্যাঙ্গনে প্রবেশ। পাড়ার ক্লাব, কাকুড়গাছি নাট্য সমাজ, শিকদার বাগান স্ট্রিটের বান্ধব সমাজ ইত্যাদি স্থানে নাট্যচর্চা ও শখের যাত্রাপালায় অভিনয় করে খ্যাতি অর্জন করেন। নদের নিমাই নাটকে গৌরাঙ্গের চরিত্রে অভিনয় সে সময় বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। কিন্তু শিক্ষিত পরিবারের ছেলের যাত্রা-থিয়েটার নিয়ে মাতামাতি পরিবারের অপছন্দ ছিল। তাই নাটকে অভিনয়ে বিরতি নিয়ে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন বিমা কোম্পানির এজেন্সি, বেঙ্গল টেলিফোন কোম্পানিতে চাকরি, ক্রমান্বয়ে পাটের ব্যবসা ইত্যাদি। কিন্তু রঙ্গমঞ্চের হাতছানি এড়াতে না পেরে আবারো ফিরে আসেন নাট্যজগতে।
রুপালি পর্দায় প্রথম অভিনয় ১৯৩৬ সালে ৩৪ বছর বয়সে তিনকড়ি চক্রবর্তীর পরিচালনায় ‘অন্নপূর্ণার মন্দির’ চলচ্চিত্রে। ছবিটি সেভাবে বাণিজ্যিক সফলতা পায়নি। এরপর আরো ছয়-সাতটি ছবিতে কাজ করলেও সাফল্য সেভাবে ধরা দেয়নি। এরপর কাজের আশায় এখানে-ওখানে ঘুরে নিউ থিয়েটার কোম্পানির রেগুলার আর্টিস্ট হয়ে যান। অবশেষে সাফল্য ধরা দিল ১৯৪১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত নিউ থিয়েটার্সের ব্যানারে তৈরি হেমচন্দ্রের পরিচালনায় ‘প্রতিশ্রæতি’ ছবিটি। এরপর আর পিছে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। পরের বছরই পরপর ১৩টি ছবি মুক্তি পায়। ১৯৫৫-৫৭ সালে একেকটি বছরে তার মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ছিল ২১-২৭টি। তথাকথিত নায়ক চরিত্রে না থাকলেও ছিলেন সফল চরিত্রাভিনেতা। যদিও নায়কোচিত সুদর্শন রূপ, আভিজাত্যপূর্ণ চেহারা এবং অভিনয়ক্ষমতা সবটাই ছিল তার। ১৯৫৭ সালে মুক্তি পেয়েছিল তার রাষ্ট্রপতি স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত ও বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে উচ্চ প্রসংশিত ছবি তপনসিংহ পরিচালিত ছবি ‘কাবুলিওয়ালা’। কলকাতার বাইরে সারা ভারতে হৈচৈ পরে যায়। তপনসিংহ এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আমার তো মনে হয় কাবুলিওয়ালা আমার ছবি নয়। ছবি বিশ্বাসেরই ছবি।’ সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে প্রথম কাজ ‘জলসাঘর’ সিনেমাতে। জমিদার বিশম্ভর রায় চরিত্র অমর হয়ে আছে সিনেমাপ্রেমীদের মনে। সত্যজিৎ রায় বলেন, ‘ছবিবাবুর মতন অভিনেতা না থাকলে এ চিত্ররূপ দেয়া সম্ভব হতো কিনা জানি না।’ ১৯৬২ সালের ৯ নভেম্বর মুক্তি পেয়েছিল ‘দাদাঠাকুর’। কিন্তু যার জীবনী নিয়ে ছবি সেই দাদাঠাকুর শরৎচন্দ্র পণ্ডিত তখনো বহালতবিয়তে জীবিত। কোনো কাজে তিনি চঙ্গীপুর থেকে কলকাতায় এসেছেন। শিয়ালদহের দিকে হেঁটে যেতে সেখানকার এক সিনেমা হলে দাদাঠাকুর সিনেমা দেখতে এত লোকের ভিড় অথচ বাস্তব দাদাঠাকুরের দিকে কোনো খেয়াল নেই। এ ব্যাপার দেখে শরৎ পণ্ডিতকে তার সফরসঙ্গী বললেন, ‘দেখেছেন, আপনি বাস্তব থাকতেও আপনাকে না নিয়ে আপনার চরিত্রে ছবি বিশ্বাসকে নিয়েছে।’ দাদাঠাকুর তখন বললেন, ‘ছবি দেখে লোকে বিশ্বাস করবে বলেই তো ছবি বিশ্বাসকে নেয়া।’ দাদাঠাকুরের এ কথার মধ্যেই প্রকাশ পেয়েছে বাংলা সিনেমার পিতৃপুরুষ ছবি বিশ্বাসের অভিনয়দক্ষতা ও জনপ্রিয়তার কথা। দেবী ছবিতে কালিকিঙ্কর চৌধুরী কিংবা তপন সিংহের ক্ষুধিতপাষাণ, প্রতিশ্রæতি, শুভদা, হেড মাস্টার ইত্যাদি ছবির সঙ্গে তার নাম মিশে রয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন পরিচালকের বিচারক, যমালয়ে জীবন্ত মানুষ, বড়দিদি, হেডমাস্টার, পৃথিবী আমারে চায়, পথে হল দেরী, সবার উপরে, সাধক বামাক্ষ্যাপা, সাহেব বিবি গোলামের মতো আরো বহু ছবি। এছাড়া তিনি বহু বাণিজ্য সফল চলচ্চিত্রে পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। তিনি মূলত সাহেবী এবং রাশভারি ব্যক্তিত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয়ের জন্য খ্যাতিলাভ করেন। মাত্র ২৬ বছরের অভিনয়জীবনে ২৫৬টি বাংলা ও ৩-৪টি হিন্দি সিনেমায় অভিনয় করে গেছেন। ১৯৫৯ সালে ‘সঙ্গীত নাটক একাডেমী’ তাকে শ্রেষ্ঠ অভিনেতার সম্মান জানায়। চলচ্চিত্রের পাশাপাশি পেশাদার মঞ্চঅভিনয়েও বিখ্যাত ছিলেন। সমাজ, ধাত্রীপান্না, মীরকাশিম, দুইপুরুষ, বিজয়া, পথের দাবী, শাজাহান প্রভৃতি নাটকে তার অভিনয় উল্লেখযোগ্য। ছবি বিশ্বাস প্রতিকার (১৯৪৪) এবং যার যেথা ঘর (১৯৪৯) ছবি দুটির পরিচালক ছিলেন।
আভিজাত্যের বাইরে রসবোধের বিক্রিয়ায় যে ব্যক্তিত্ব সৃষ্টি হয় তার প্রমাণ তিনি। শৌখিনতায় পূর্ণ ছিলেন তিনি। অভিনয়ের বাইরে ছবি আঁকার শখ ছিল। শোনা যায় সুঁই-সুতোর কাজও জানতেন। আবার ভালো টেবিল টেনিসও খেলতেন। তার টালিগঞ্জের বাড়িতে বরাবরই গান-বাজনার পরিবেশ ছিল। বাড়ির বিরাট বড় হলঘরে প্রায়ই গান-বাজনা, অভিনয় আর আবৃত্তির আসর বসত। বাড়িতে নিজের করা বাগানে নানারকম ফুল ও সবজি ছিল দেখার মতো। তিনি ছিলেন সম্ভ্রান্ত জমিদার বংশের ছেলে। তাই জমিদারি চলে গেলেও তার মেজাজ তাকে যে কখনো ছেড়ে যায়নি সেটা তা অভিনয়ের মধ্যেই ফুটে উঠেছে। ছবি বিশ্বাস মূলত সাহেবি এবং রাশভারি ব্যক্তিত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয়ের জন্যই প্রখ্যাতি লাভ করেছিলেন। যে কোনো চরিত্রে অভিনয়ের সময়েই তার সহজাত প্রতিভার প্রকাশ ঘটত।
ছবি বিশ্বাস নাম শুনলেই এক বিশেষ ব্যক্তিত্বপূর্ণ, গুরুগম্ভীর স্বরের একটি বিশিষ্ট ব্যক্তির ছবি ভেসে ওঠে আমাদের মানসপটে। হিন্দি ছবিতে অভিনয় করবেন বলে রাজকাপুর কথা বলতে এলে তিনি সরাসরি জানিয়ে দিলেন তার অপঘাতে মৃত্যুর আশঙ্কা, তাই তিনি প্লেনে চড়বেন না, ট্রেনে যাবেন। ট্রেনেই গিয়েছিলেন তিনি। একবার তার মৃত্যুর গুজব ছড়িয়েছিল কলকাতায়। উদ্বিগ্ন বন্ধু-পরিজনরা টেলিফোনে যোগাযোগ করলে তিনি হো হো করে হেসে বলেছিলেন, ‘আমি চোরের মতো চুপি চুপি মরব কেন রে? তোদের সবাইকে জানিয়েই মরব।’ কিন্তু ১৯৬২ সালের ১১ জুন ৬১ বছর বয়সে ড্রাইভারকে সরিয়ে নিজে গাড়ি চালানোর সময় মধ্যমগ্রামের কাছে গঙ্গানগরে ওল্ড যশোর রোডে উল্টো দিক থেকে আসা ভ্যানের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে গাড়ির সঙ্গে স্টিয়ারিংয়ের চাপে প্রায় ছয় ফুটের মতো দীর্ঘ দেহটি দুমড়েমুচড়ে যায়। হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করলে হাসপাতাল থেকে উত্তমকুমারসহ সহকর্মীদের কাঁধে চেপে স্টার থিয়েটারে আসেন ছবি বিশ্বাস। বাংলা সিনেমার পিতৃবিয়োগে সেদিন একপ্রকার অবরুদ্ধ হয়ে যায় কলকাতা। তার মৃত্যুর সংবাদে সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন, ‘তার মৃত্যুজনিত ক্ষতি আমার কাছে অপরিমেয়, অপূরণীয়। তার উপযুক্ত অনেক চরিত্র, অনেক কাহিনী আমার পরিকল্পনায় ছিল। এসবই তার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে আমার মন থেকে মুছে দিতে বাধ্য হচ্ছি।’
তার মৃত্যু বাংলা সিনেমার জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। তবে ছায়াছবি যতদিন থাকবে ছায়াছবির ছবি বিশ্বাসও থেকে যাবেন কাজের গুণে। এই কীর্তিমানের মৃত্যুদিনে তাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছে ‘মেলা’।
:: তৌফিক আহমেদ

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়