এডিটরস গিল্ড বাংলাদেশের নিন্দা

আগের সংবাদ

পারাপারে প্রস্তুত স্বপ্নের সেতু : প্রধানমন্ত্রী সময় দিলেই উদ্বোধন, ১৫ দিনের মধ্যে শতভাগ প্রস্তুত হবে সড়কপথ

পরের সংবাদ

বিপন্ন বিস্ময়ে তনুর সঙ্গে

প্রকাশিত: মে ২০, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মে ২০, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ব্যাপারটা অভাবনীয় শুধু নয়, কারো কারো কাছে স্বপ্নেও কল্পনার অতীত। তনুর পরিবার কেন, তাকে এই দুইদিন আগেও যারা চিনত না তাদের কাছেও ভাবনার বাইরে ছিল। অথচ ঘটনাটা কিন্তু ঠিকই ঘটে গেছে। টেলিভিশন রিপোর্টাররা ভুল উচ্চারণে রিপোর্ট পড়লেও যেহেতু চেহারা দেখা যায় তাই অভিব্যক্তি দেখে বোঝা যায় তাদের কাছেও কিছুটা অবাস্তব ঠেকে ঘটনাটা।
যেদিন তনুর ক্ষতবিক্ষত মরদেহটা পাওয়া যায় সেদিনের খবরেই ইঙ্গিত ছিল হত্যাকাণ্ডের আগে তাকে ধর্ষণ করা হয়েছিল। মর্গের ভিসেরা রিপোর্ট এখনো আসেনি অথবা এমন খবর প্রচার হয়েছে কেউ শোনেনি। তার আগেই ঘটে গেল সেই ঘটনাটা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল ছাত্রজোট তাৎক্ষণিক বিক্ষোভ মিছিল শেষে শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরে ঘোষণা দিয়েছিল পরদিন জেলায় জেলায় বিক্ষোভ মিছিল হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনির্দিষ্টকালের জন্য ছাত্র ধর্মঘট।
একদিনে দাবানলের মতো সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ল সে বিক্ষোভের আগুন। কৃষক, ছাত্র-জনতার মুষ্টিবদ্ধ হাত প্রসারিত দেখা গেল। মসজিদের ইমাম, মাদ্রাসার হুজুর, মন্দিরের পুরোহিত, গির্জার পাদ্রী, প্যাগোডার ভিক্ষু নিজ নিজ প্রার্থনা সভায় তনুর আত্মার শান্তি কামনা করেছেন, করেছেন অপরাধীর শাস্তি দাবি।
প্রধান প্রধান দৈনিকগুলো শুধু এ ঘটনা নিয়ে লিড নিউজের বাইরে চতুর্থ পৃষ্ঠায় বিশেষ একপাতা সংবাদ করেছে প্রধান প্রধান জেলা প্রতিনিধিদের পাঠানো সংবাদ ও ছবি দিয়ে।
ঢাকা মহানগর :
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন এমনকি প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর সাথে চলাফেরা করতে দেখা যেত যাদের তারাও মিছিলে যোগ দেয়। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, বুয়েট, ইডেন কলেজ, তিতুমীর কলেজসহ দেশ জাতি নিয়ে উদাসীন বলে ভাবা হতো যাদের সেই নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়, ইন্ডিপেন্ডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা পর্যন্ত প্রতিবাদ মিছিল সহকারে ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করে। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার কয়েকটি সড়ক ঘুরে আসে প্রতিষ্ঠিত কয়েকটি নামি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের ইন্টার্ন শিক্ষার্থীরা এদিন কর্মবিরতি পালন করে।
জুমাবার না হলেও বাইতুল মোকারমের উত্তর গেটের সামনে দিয়ে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে সরকারের পদত্যাগ পর্যন্ত দাবি করে বসে কয়েকটি ইসলামিক দলের নেতারা। তাদের ব্যানারে শোভা পায় পত্রিকায় প্রকাশিত ‘তনু’র ছবি।
তার আগে তনুর জন্য বিশেষ দোয়া করা হয়। ঢাকেশ্বরী মন্দিরে বিশেষ প্রার্থনা, কাকরাইল গির্জায় সান্ধ্য সংগীতের সুরে পাদ্রীর সুললিত কণ্ঠে তার নামোচ্চারণ আর বাসাবো বৌদ্ধ মন্দিরে তনুর জন্য চাওয়া হয় নির্বাণ প্রাপ্তি।
চট্টগ্রাম প্রতিনিধি :
চট্টগ্রামের জামালখানে প্রেস ক্লাবের সামনে ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান চোখে পড়ার মতো। চেরাগী পাহাড় মোড়ে উদীচী শিল্পগোষ্ঠী গণসংগীত পরিবেশন করে। চেরাগী পাহাড়ের সমাবেশ যোগ দেয় মহানগর খেলাঘরসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠন। ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রফ্রন্ট ও ছাত্র ফেডারেশনের কর্মীরা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে আলাদা সমাবেশ করে।
এই সুযোগে ছাত্রশিবির চট্টগ্রাম কলেজ, হাজী মুহাম্মদ মহসীন কলেজ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মিছিল পর্যন্ত বের করে ফেলে পুলিশ ও ছাত্রলীগের দৌড়ানি খেয়ে তারা ব্যানার ফেলে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। পালানোর সময় শিবির লিফলেট ছড়িয়ে যায়। তারা লেখে, ‘জনগণের ভোটহীন ক্ষমতায় আসা এই সরকারের কাছে দেশ, জনগণ, নারী, শিশু কেউই নিরাপদ নয়। সরকার যে দেশের আঠারো কোটি জনগণের সবার আস্থা হারিয়েছে ‘তনু ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের’ এই অভিনব প্রতিবাদে মুখর জনতার রোষ দেখে প্রমাণিত। তাই সরকারের উচিত অবিলম্বে পদত্যাগ করে নিরপেক্ষ ব্যক্তির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা।
আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ, দামপাড়া জমিয়াতুল ফালাহ মসজিদ, আসকার দীঘির পাড়ের রামকৃঞ্চ মঠ ও মিশন, পাথরঘাটা ক্যাথলিক চার্চ ও নন্দনকানন বৌদ্ধ মন্দিরে ‘তনুর’ জন্য বিশেষ প্রার্থনা করা হয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, চট্টগ্রাম কলেজ, হাজী মুহাম্মদ মহসীন কলেজ, সিটি কলেজ, কমার্স কলেজসহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালন করা হয়।
রাজশাহী প্রতিনিধি :
নগরীর সাহেব বাজার জিরোপয়েন্টে প্রগতিশীল ছাত্রজোটের সমাবেশে সংগীত পরিবেশন করে মহানগর ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী। তার আগে বক্তব্য রাখেন কথাসাহিত্যিক ও বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক হাসান আজিজুল হক, অধ্যাপক সনত কুমার সাহা ও অধ্যাপক নাট্যব্যক্তিত্ব মলয় কুমার ভৌমিক। ইসলামী ছাত্রশিবিরও রুয়েট ক্যাম্পাস এবং বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ঝটিকা মিছিল বের করে। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ, রাজশাহী কলেজ, রুয়েট, রাজশাহী মহিলা কলেজ ও বোয়ালিয়া ডিগ্রি কলেজে ধর্মঘট পালিত হয়।
খুলনা প্রতিনিধি :
নগরীর হাদিস পার্কে নাগরিক কমিটির ব্যানারে সমাজের সব পেশাজীবী সংগঠন, মহিলা পরিষদ, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও ছাত্র সংগঠনের কর্মীরা সমবেত হয়। প্রতিবাদী গান কবিতায় মুখরিত হয়ে ওঠে গোটা এলাকা। ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবার এমন সম্মিলিত প্রতিবাদ ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবির সময়েও দেখা যায়নি। তখন খুলনার বড় রাজাকার খান এ সবুর এর বড় সমর্থক গোষ্ঠী বরং বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল আন্দোলনে। অথচ আজ জামায়াত-শিবিরসহ সব সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী পর্যন্ত এই ‘তনু’ ধর্ষণ ও হত্যার বিচার দাবিতে রাস্তায় নেমে এসেছে।
সিলেট প্রতিনিধি :
সিলেটের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণের প্রতিবাদ সভায় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক দলের সমাবেশে কয়েকটি নাটকের দলের তাৎক্ষণিক রচিত পথনাটিকা পরিবেশিত হয়। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে আগে থেকেই নারী নিপীড়ন বিরোধী একটি সংগঠন ছিল। দ্রুতই তারা জমায়েত করতে পারে। তাদের এবারের মিছিলটি ইতিহাসের সব থেকে বড় মিছিল। এবারের মিছিলের অভিনবত্ব হচ্ছে বোরকা হিজাব পরিহিত ছাত্রীদের ব্যাপক অংশগ্রহণ। সবাই এটাকে পজিটিভ পরিবর্তন বলে সাধুবাদ জানালো। তনুর ছবি দেয়া ব্যান্ড সবার মাথায়। যেন মৃত তনু অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে একে অপরের দিকে। শাহজালালের মাজারে বেড়াতে আশা হিন্দু মুসলমান পুণ্যার্থীরা অনেকে এসে যোগ দিয়েছেন নগরীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্বরে।
বরিশাল প্রতিনিধি :
বরিশালের অশ্বিনী কুমার দত্ত টাউন হল প্রাঙ্গণে প্রতিবাদ সমাবেশের ডাক দিয়েছিল জেলা বাসদ। সব বিভেদ ভুলে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাকের পার্টি, চরমোনাইর পীরের দলসহ কয়েকটি ইসলামিক দলও যোগ দিয়েছে। শাহী মসজিদ, ক্যাথলিক গির্জা ও কালীমন্দিরে প্রার্থনা হয়েছে তনুর জন্য। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে হয়েছে মিছিল। শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ, বিএম কলেজ, বরিশাল সরকারি কলেজ, সরকারি মহিলা কলেজ, অমৃতলাল দে কলেজ ও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো ক্লাস হয়নি। মাত্র কয়েক বছর আগেও নগরীর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বাসদ পদপ্রার্থী ডা. মনীষা চক্রবর্ত্তীর জনসমর্থনে ভীত হয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতারা একযোগে বাসদের বিরুদ্ধে একাট্টা হয়ে তাদের এড়িয়ে চলার চেষ্টা করত। আজ সেখানে বাসদের ডাকা অনুষ্ঠানে সবাই এক কাতারে উপস্থিত এটাও অভিনব।
ময়মনসিংহ, যশোর, ফরিদপুর, কুমিল্লা, কক্সবাজার, রাঙ্গামাটি, নোয়াখালী, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, হবিগঞ্জ সব জেলার সংবাদদাতাদের সব খবরকে মোটামুটি একই সুতায় গাঁথা যায়।
যে কোনো সমাজবিজ্ঞানের গবেষণার জন্য খুবই ইন্টারেস্টিং একটি বিষয় নিসন্দেহে।
পড়তে পড়তে মনে পড়ে গেল গতকাল বিকালের কায়সার ভাইয়ের পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলা কথাটি।
বেশ আগ্রহ নিয়েই গতকাল উপস্থিত ছিলাম শাহবাগের সমাবেশে। প্রাক্তন বাম ছাত্র নেতা, বর্তমানে একটি বহুজাতিক করপোরেট হাউসের এডমিন এর বড় কর্মকর্তা আবু কায়সার ভাইয়ের সাথে দেখা হয়ে যাওয়ায় বললেন, “তোমার প্রায় সব লেখা আর সোশ্যাল মিডিয়ার পোস্টে দেখি সমাজ ও এদেশের জনগণকে নিয়ে একরাশ হতাশা। তারা সবাই আত্মকেন্দ্রিক আর সাম্প্রদায়িক হয়ে যাচ্ছে বলে যে আক্ষেপ তোমার তা নিশ্চয় আজ ঘুচে গেছে আশা করি!”
আমার ক্যাম্পাস জীবনের সার্বক্ষণিক সঙ্গী অনিক চাকমা, জগন্নাথ হল ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক পাশে থাকলেও তার সাবেক সিনিয়র নেতা আবু কায়সার সম্পর্কে কেমন জানি বীতশ্রদ্ধ ভাব নিয়ে উদাসীন থাকে কেবল। জিজ্ঞেস করায় রহস্য নিয়েই বলে, “পাতি বুর্জোয়া একটা”!

গতকাল কায়সার ভাইয়ের এই কথার পরেও অনেকখানি সন্দেহ থাকলেও এখন আমার স্বীকার করতে মোটেই দ্বিধা নেই। পাশাপাশি নিজের উপর রাগই হচ্ছে। আসলেই এদেশের জনগণকে আমি এতদিন ঠিকই বুঝতে পারিনি। স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর রেসকোর্স ময়দানে দেয়া বঙ্গবন্ধুর ভাষনের কথাটিই মনে পড়ছে বারবার। রবি ঠাকুরকে উদ্ধৃত করে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বঙ্গবন্ধু সেদিন বলেছিলেন, ‘সাত কোটি সন্তানের হে মুগ্ধ জননী/রেখেছ বাংগালি করে / মানুষ করোনি। তুমি এসে দেখে যাও রবি ঠাকুর, আমার বাংগালি আজ মানুষ হয়েছে”।
কখন যে পড়তে পড়তে আমার দুচোখ বেয়ে কয়েক ফোঁটা জল পেপারের উপর পড়েছে বুঝতেই পারিনি।
প্রশাসনে বেশ চাঞ্চল্য তৈরি করে এ ঘটনা। এই সরকার ২০১৩ সালে শাহবাগ গণজাগরণ ও শাপলা চত্বরের হেফাজতি তাণ্ডব সামলিয়েছে। এখন মনে হচ্ছে এটা ২০১৩ সালের চেয়েও চ্যালেঞ্জিং। সেবার শাহবাগ আর শাপলা চত্বর ছিল পরস্পরবিরোধী। আজ দুই পক্ষই একই দাবিতে এক কাতারে। যুদ্ধাপরাধীর বিচার দাবির আন্দোলন সরকারবিরোধী আন্দোলন ছিল না। বরঞ্চ আন্দোলনকারীরা মনে করত তারা সরকারেরই সহযোগী এই বিচারে। কেবল একটা অপ্রাপ্তি থেকে ক্ষোভ জেগেছিল কাদের মোল্লার সর্বোচ্চ শাস্তি না হওয়ায়। তখনকার আন্দোলনে আন্দোলনকারীদের সাথে ছিল না বড় একটি গোষ্ঠী। অপরাধী জামায়াত-শিবির, ইসলামপন্থি দলগুলো, হেফাজতে ইসলাম, এমনকি বড় রাজনৈতিক দল বিএনপিও ওই আন্দোলনে ছিল না। কিন্তু আজকে মওকা পেয়ে সরকারবিরোধী আন্দোলনে রূপ দিতে চাইছে সবাই। তাই জরুরি মিটিং তলব করেছেন প্রধানমন্ত্রী। তার আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিবৃতি দিয়েছেন, ‘অপরাধী যেই হোক, যত বড় ক্ষমতাশালীই হোক ছাড়া পাবে না’।
সাবেক এক কমিউনিস্ট নেতা যিনি এখন সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী, প্রধান করে একটি কমিটি করা হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে একটি সুষ্ঠু সমাধান বের হয়ে আসবেই।
সরকারদলীয় একটি প্রতিনিধিদল রওনা হয়ে গেছে তনুর পরিবারের সাথে কথা বলতে। এলাকার বিভিন্ন স্তরের জনতার সাথে কথা বলে ঠিক করবে করণীয়। ইতোমধ্যে ‘তনু ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের’ বিচার দাবিতে জাতীয় কমিটি হয়ে গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ছাত্রনেতাদের সামনে রেখে বিভিন্ন সময়ের সাবেক ও বর্তমান ছাত্রনেতাদের সমন্বয়ে প্রায় সব দলকেই কমিটিতে রাখা হয়েছে।
একটু আগে ঘোষণা হয়েছে আজ সন্ধ্যা ঠিক ৭টায় প্রত্যেক জেলা উপজেলা এমনকি যদি সম্ভব হয় ইউনিয়ন পর্যায়েও গুরুত্বপূর্ণ স্থানে জমায়েত হয়ে মোমবাতি প্রজ্বলন করবে।
মনে পড়ে গেল ২০১৩ সালের কথা। শাহবাগ গনজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের পঞ্চম দিন ৯ ফেব্রুয়ারি প্রদীপ প্রজ্বলন মুহূর্তটি। দৈনিক সমকাল প্রথম পৃষ্ঠাটি পূর্ণ পাতা শাহবাগ মোড়ের প্রদীপ প্রজ্বলনের অভিনব দৃশ্যটি দিয়ে অনন্য একটি সংখ্যা করেছিল ফেব্রুয়ারির ১৫ তারিখ যা একটি ইউনিক প্রকাশনার দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। এবার নিশ্চয় সারাদেশে আরো বেশি প্রদীপ প্রজ্বলন হবে আশা করাই যায় যেহেতু বায়তুল মোকারমে পর্যন্ত সমাবেশ হয়েছে। যদি মাদ্রাসার ছাত্রছাত্রীরাও মোমবাতি না হোক অন্য কোনো উপায়েও অংশ নেয় তাও প্রভাব ফেলবে দাবি আদায়ে।

দুপুরে হলের ক্যান্টিনে খেতে গিয়ে টিভি স্ক্রলে দেখতে পেলাম বিকাল ৫টায় নিহত তনুর মায়ের বক্তব্য সরাসরি সম্প্রচার করবে একযোগে প্রায় সব রেডিও ও টেলিভিশন চ্যানেল। আরো অবাক করা ব্যাপার সরকারি ‘বাংলাদেশ বেতার’ ও ‘বাংলাদেশ টেলিভিশন’ও বাদ যাবে না এই সম্প্রচারে। এতেই বোঝা যায় জনগণের পালস্ বুঝতে পেরেছে। নিশ্চয় তনু ন্যায়বিচার পাবে। টিভি রুমের ফিসফাস কানে আসতে লাগল। অনিকের সাথে দেখা হতেই প্রশান্তির হাসি বোঝা গেল। ঘূর্ণি উপদ্রুত এলাকায় ত্রাণ বিতরণ থেকে ভোটের দিনে সংখ্যালঘু নির্যাতনের প্রতিবাদে ব্যানার হাতে রাস্তায় নামা, বিহারী কলোনী তে আগুনে সর্বস্ব মানুষের সহায় হতে এগিয়ে যাওয়া থেকে ক্যাম্পাসে ছাত্রী নিপীড়নের প্রতিবাদে সবার আগে যাকে দেখা যায় তাকে উৎফুল্ল দেখতে কার না ভালো লাগে!
কি হে কমরেড চল বিকালে একসাথে যাই মোমবাতি হাতে প্রজন্ম চত্বরে
আমার কথার কোন উত্তর মুখে না দিয়েই সম্মতি জানালো মুচকি হাসি দিয়ে।
দুপুরের পর থেকেই ব্যাংকের কাস্টমারের লাইন ছোট হতে থাকে। বাসের হেলপার ডাকাডাকি করেও দুই তিন জনের বেশি প্যাসেঞ্জার পাচ্ছে না। ফুটপাতের খাবারের দোকানিরাও দোকান গুটাতে শুরু করে। ট্রাফিক সার্জেন্টরা ঝিমিয়ে পড়ে। কিন্তু ব্যস্ততা বেড়ে যায়, রেডিও টিভি চ্যানেল এবং অনলাইন নিউজপোর্টালগুলোয় আপডেট ভার্সনে যারা কাজ করে তাদের।
ঢাকার শাহবাগে, চট্টগ্রামের শহীদ মিনার ও জামালখানের চেরাগী পাহাড়ে, খুলনার শিববাড়ি মোড়ে, রাজশাহীর সাহেব বাজার জিরো পয়েন্টে, সিলেটের শহীদ মিনারে, বরিশালের অশ্বিনী কুমার দত্ত টাউন হল চত্বরসহ সারাদেশের গণজমায়েতের স্থানসমূহে টিভি চ্যানেলে লাইভ ব্রডকাস্টিংয়ের যন্ত্রপাতি পৌঁছাতে শুরু করল। টাকাওয়ালা টিভি চ্যানেলগুলো হেলিকপ্টার ভাড়া করেছে শাহবাগসহ সারাদেশে চক্কর দিয়ে দিয়ে লাইভ সম্প্রচার করার জন্য।
দীর্ঘদিন লসে থাকা মিডিয়াগুলোরও টি আর পির পারদ উঠতে শুরু করেছে। বহুজাতিক টেলকোগুলো ব্রেকিং নিউজ স্পন্সর করছে। দূর-পাল্লার বাসগুলোর দুপুরের পর থেকে যাত্রীর অভাবে যাত্রা বাতিল শুরু করতে হচ্ছে। কয়েকটি বাসের যাত্রীদের একত্র করে উপায়হীন যাত্রী দের এক একটি বাসে উঠিয়ে দিচ্ছে কেউ কেউ।
আজ সবার মুখে মুখে কেবল একটিই শব্দ ‘তনু’। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া এর আগে সম্ভবত শুধু একবার আর একজনের নাম উচ্চারিত হয়েছিল, ‘শেখ মুজিবর রহমান’। তাও প্রায় আটাশ পার্সেন্টস লোক উচ্চারণ করত ঘৃণাভরে তাদের পেয়ারা পাকিস্তানকে ভেঙে ফেলছে বলে।
হলের ক্যান্টিনে দুপুরের খাবার খেয়ে টিভিতে কিছুক্ষণ এসব খবর দেখে রুমে ফিরে ফেসবুকে ঘুরার চেষ্টা করলাম। আজকের শাহবাগের ইভেন্টে ‘গোয়িং’ অপশনে ক্লিক করে পৌনে ৫টাতেই রুম থেকে বেরিয়ে পড়লাম। আমাদের জগন্নাথ হলের মূল গেটের সামনেই পেয়ে গেলাম অনিক চাকমা কে। কিছুদূর এগুলেই শামসুন নাহার হলের সামনেই দেখলাম কয়েকটি মেয়ে জায়গা পরিষ্কার করছে। সম্ভবত শাহবাগের প্রচণ্ড ভিড় এড়াতে তারা নিজ হলের সামনেই প্রদীপ প্রজ্বলন আয়োজন করতে চায়। আরেকটু এগিয়ে টিএসসির মোড়ে ডাস এ গিয়ে দুজনে দুটি সমুসা আর দু কাপ লাল চা পান করে হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে চলি শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরের দিকে। ফ্লাইওভার নির্মাণ কাজের জন্য কয়েক গজ দূরের মানুষকেও চিনতে কষ্ট হয়। একদম সামনে আসলেই চেনা যায় মানুষ টিকে। অথচ আগে নজরুল সমাধির সামনে দিয়েও কে হেঁটে আসছে তা টিএসসির মোড় থেকেই চেনা যেত। হয়তো এ এক সাইকোলজিক্যাল ব্যাপার।
নজরুল সমাধির আগে বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশের গেটের সামনে আসতেই আবু কায়সার ভাইয়ের সাথে দেখা। হন্তদন্ত হয়ে বের হচ্ছিলেন ক্যাম্পাস থেকে। পিঠ চাপড়ে দিয়েই অভ্যাস মতো বললেন,
কী শাহবাগে যাচ্ছ নাকি?
হ্যাঁ কায়সার ভাই। আপনি যাবেন না?
আমার একটু কাজ আছে পিডব্লিউডিতে। এই সাতটার আগেই পৌঁছে যাব। তোমরা যাও। দেখা হবে ঠিক সময়ে।
আচ্ছা ঠিক আছে কায়সার ভাই।
অনিক সবসময়ের মতো ভাবলেশ হীন তাকিয়ে আছে বিরক্তি নিয়ে।
আমরা এগোতে থাকি পাবলিক লাইব্রেরির সামনের ফুটপাত ধরে। আশপাশের অনেকের মোবাইলে বিভিন্ন অ্যাপসের মাধ্যমে লাইভ টেলিভিশন সম্প্রচারের আওয়াজ শোনা যায়। আমার মোবাইলে এসব অ্যাপস ইনস্টল করা থাকলেও সবসময় ইন্টারনেট ডাটা থাকে না বলে দেখা হয় না। আর ফোরজি ছাড়া টিভি অ্যাপস ঠিকমতো চলেও না। কিছু কিছু লোকজন আসা শুরু হয়েছে। অনেকেই, অনেকেই কেন বেশিরভাগই রওনা দিবে পাঁচটায় বা ঠিক সময়ে না হলেও সাড়ে পাঁচটার পর তনুর মায়ের বক্তব্য প্রচার হবার পর। মানুষের আবেগ বা অনুভুতি এভাবেই পরিচালিত হয়। আমরা আলোচনায় এভাবেই সিদ্ধান্তে আসি।
জাতীয় জাদুঘরের সামনে একটা ট্রাকে অস্থায়ী মঞ্চ বানানো হয়েছে। ব্যানার ফেস্টুনে চারদিক ভরে গেছে। অসংখ্য টিভি ক্যামেরা বুম হাতে সাংবাদিকদের ঘোরাফেরা। আকাশে বার কয়েক চক্কর দিয়ে ফেলল দু’তিনটি হেলিকপ্টার।
কিন্তু পৌনে সাতটাতেও দেখা গেল প্রজন্ম চত্বরে আকাক্সিক্ষত জনতার চেয়ে ক্যামেরাম্যান ও সাংবাদিক বেশি। আলোচিত বিশেষ বক্তা, বুদ্ধিজীবী যাদের উপস্থিত হবার কথা তাদের মধ্যে মাত্র চারজন উপস্থিত।
‘তনু ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি’র আহ্বায়ক কমিটির নেতাদের মধ্যে কেবল ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রফ্রন্ট ও বিপ্লবী ছাত্রমৈত্রীর যেসব নেতাকর্মীর ‘জুতা সেলাই থেকে চণ্ডিপাঠ’এর মতো সব প্রতিবাদ মিছিলে পাওয়া যায় কেবল তারাই উপস্থিত। আমাদের মতো সবাই হতভম্ব। ঠিক ৭টায় আমি পকেট থেকে দুটি লাল মোমবাতি বের করলাম। একটি অনিকের হাতে দিয়ে দাঁড়ালাম পাশাপাশি। কেউ একজন এসে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিল দুজনের মোমবাতি। সামনে পেছনে ডাইনে ও বাঁয়ে যে কয়জন আছে ইচ্ছে করলেই গোনা যেত, কিন্তু করলাম না। সাতটা দশ কি পনেরোয় হাঁটা ধরলাম। হলের দিকে। আমাদের কারো মুখে কোনো কথা নেই। রাস্তায় চলাচল পুনরায় স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে।
হলের টিভি রুমে ফিরে সবার মুখের ভাষা বোঝার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হই। একটি নিউজ চ্যানেলে ব্রেকিং নিউজ হচ্ছিল। হতবাক করে সারাদেশের কোন কোন শহরের প্রতিবাদ সভায় আনুমানিক কতজন লোক সমবেত হয়েছে তার বর্ণনা। এত কম সমাবেশ নিয়ে পর্যালোচনা চলছেই।
সংবাদ পাঠিকা বলে যেতে থাকে, ‘চট্টগ্রামে ১৫০ জন, খুলনায় ৭০ জন, রাজশাহীতে ৪৫ জন, সিলেটে ১৭০ জন, বরিশালে ৪০ জন, ময়মনসিংহে, চুয়াডাঙ্গায়, কক্সবাজারে কয়েকজন করে। আমার কানে ঝি ঝি ডাকে!
এরপর বিশ্লেষণ হবে কেন এভাবে শেষ মুহূর্তে লোকজন জমায়েতে অংশগ্রহণ করেনি সেই ঘোষণাও দিয়ে গেল। অনিকের সংগঠনের কিছু নেতাকর্মী এসেছে হলের টিভি রুমের বাইরে। একজন এসে জানিয়ে গেল একটু বাইরে যেতে অনিক কে।
তখনই সংবাদ পাঠিকা পরের সংবাদ পড়া শুরু করে… ‘এর আগে আজ বিকাল পাঁচটায় তনুর মা তার মেয়ে ধর্ষণ ও হত্যার বিচার চেয়ে বক্তব্য রাখেন। সে বক্তব্য সরাসরি রেডিও ও টিভি চ্যানেলে প্রচারিত হয়। দর্শক আমাদের নিজস্ব খুলনা প্রতিনিধি খুলনা জেলার রুপসা উপজেলার ঘাটবোট ইউনিয়নের শিয়ালি গ্রাম থেকে সরাসরি সংযুক্ত হচ্ছেন’।
চরম উত্তেজিত ভঙ্গিতে টেলিভিশন চ্যানেলের নিজস্ব প্রতিনিধি বলতে থাকেন, ‘আজ বিকাল পাঁচটায় ধর্ষণের পর হত্যাকাণ্ডের শিকার তনু তথা তনুশ্রী রানী শীলের মা পূর্ণিমা রানী শীল মেয়ে ধর্ষণ ও হত্যার বিচার চেয়ে যে বক্তব্য রাখেন সেটি আগে শুনে আসি”।
ততক্ষণাৎ আমার পাশে থেকে প্রচণ্ড শব্দে দরজা বন্ধ করে অনিকের বের হতে দেখা গেল কি গেল না বুঝতে পারার আগেই বাইরে থেকে ভেসে আসা অজানা এক ক্ষুব্ধ শব্দের তোড়ে টেলিভিশনের পর্দায় পূর্ণিমা রানী শীলের কান্না মিশ্রিত বক্তব্যের পুরোটাই দুর্বোধ্য ঠেকে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়