টিপটিজিং : এবার সিলেটে এক পুলিশ কর্মকর্তার আপত্তিকর পোস্ট

আগের সংবাদ

হাওরের বাঁধে অনিয়মের খেসারত : অনেক স্থানে ভাঙন, ডুবছে ফসল, উৎকণ্ঠায় কৃষক, পিআইসিতে নেই স্থানীয়রা

পরের সংবাদ

এক বীরশ্রেষ্ঠর গল্প

প্রকাশিত: এপ্রিল ৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: এপ্রিল ৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

২ জুলাই ১৯৭১। তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের শিয়ালকোটের এক হোটেলে এসে উঠলেন এক দল বাঙালি সৈনিক। কিন্তু তাদের পরণে সাধারণ শার্ট-প্যান্ট। পরিচয় গোপন রেখেই হোটেলে এসে উঠেছেন তারা। কিন্তু কেন?
পরদিন দুপুরের পর বেরিয়ে পড়লেন সবাই। দরগা জিয়ারতের উদ্দেশে একটা ট্যাক্সি ভাড়া করলেন। তাদের গন্তব্য শিয়ালকোট থেকে ২২-২৩ কিলোমিটর দূরে মারালা নামক জায়গা। ভাড়া ৪০ টাকা। সন্ধ্যার ঠিক আগে আগে ট্যাক্সিটা টিলার নিচে আসতেই একজন চেঁচিয়ে উঠলেন, অ্যাই থামো! থামো!
ট্যাক্সিওয়ালা অবাক, এখানে?
হ্যাঁ এখানে।
কিন্তু দরগা তো টিলার উপর। আপনারা দরগা জিয়ারত করতে যাবেন না?
দরগা জিয়ারত করতেই তো এসেছি।
তাহলে ট্যাক্সি নিয়ে উপরে উঠে যাই!
দরকার নেই। তুমি এখানেই থাকো। আমরা হেঁটেই উপরে উঠব। তাহলে বেশি সওয়াব পাব-
বলেই ট্যাক্সি থেকে নেমে পড়লেন সবাই। ট্যাক্সিওয়ালার দিকে একটা ১০০ টাকার নোট বাড়িয়ে দিলেন একজন। ‘এই নাও তোমার ভাড়া।’
আপত্তি জানাল ট্যাক্সিওয়ালা, ‘ভাংতি নেই।’
‘ফেরত দিতে হবে না। আমরা দরগা শরিফে ২-৩ ঘণ্টা থাকব। মাগরিবের পর তুমি এসে আমাদের আবার ফেরত নিয়ে যাবে।’
‘আচ্ছা’। বলে মাথা ঝাঁকাল ট্যাক্সিওয়ালা। এ সময়টুকুতে নতুন কোনো খ্যাপের আশায় ট্যাক্সি নিয়ে চলে গেল।
ট্যাক্সিওয়ালা চলে যেতেই একজন বললেন, ‘ট্যাক্সিওয়ালাকে ১০০ টাকা দেয়া কি ঠিক হলো?’
কৈফিয়ত দিলেন দলের সবচেয়ে তুখোড় সৈনিক, ‘ভাংতি তো ছিল। কিন্তু ওকে ১০০ টাকা দিয়েছি ইচ্ছে করেই। পাকিস্তানিরা যেরকম হারামি, ওই ১০০ টাকা লোপাট করার জন্য ও আর ফেরত আসবে না। আর ও ফেরত না এলে আমাদেরই সুবিধা। কারো মনে কোনো রকম সন্দেহ থাকবে না। আমাদের খোঁজ পড়লেও ওই ট্যাক্সিওয়ালা মুখ বুঁজে থাকবে।’
বাকি চার সৈনিক এবার তাকালেন তুখোড় সৈনিকের দিকে। বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা। দুচোখ দিয়ে যেন বুদ্ধির ঝিলিক বেরুচ্ছে। এর নেতৃত্বে আস্থা রাখা যায়।
ট্যাক্সিওয়ালা চলে যেতেই তারা আর টিলার উপর উঠলেন না। মাজার জিয়ারত করা তো তাদের উদ্দেশ্য নয়। তারা অন্য উদ্দেশ্যে বেরিয়েছেন।
পূর্ব পাকিস্তানে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানের সৈন্যরা। সেটা জানার পর থেকে তাদের কারো মনেই শান্তি নেই। কী করে পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়া যায় সবাই গোপনে সেই চেষ্টা করছিলেন কয়েক মাস ধরে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর বাঙালি সৈনিকদের চোখে চোখে রাখতে শুরু করল পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ। সে কারণে চট করে পালিয়ে আসতে পারেননি কেউ। তবে এই সুযোগ খুঁজতে গিয়ে তারা কয়েকজন বাঙালি সেনা অফিসার একত্র হতে পেরেছেন। কারা ছিলেন এই অফিসার? ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর, ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন মমতাজ, ক্যাপ্টেন শাহরিয়ার রশিদ খান, ক্যাপ্টেন আবদুল আজিজ পাশা ও ক্যাপ্টেন আনাম।
টিলার নিচেই মাগরিবের নামাজ পড়লেন তারা। নামাজ শেষে অন্ধকার গাঢ় হওয়ার অপেক্ষা করলেন বেশ কিছুক্ষণ।
আগে থেকেই মিলিশিয়াদের পোশাক-কালচে ছাই রংয়ের সালোয়ার কামিজ কিনে রেখেছিলেন তারা। অন্ধকার জেঁকে বসতেই শার্ট-প্যান্ট খুলে মিলিশিয়াদের পোশাক পরে নিলেন সবাই। সবার কোমরে একটা করে পিস্তল। সালাউদ্দিনের হাতে একটা ছোট্ট কুরআন শরিফ। রাতের ঘুটঘুটে অন্ধকারে তারা নেমে পড়লেন অনিশ্চয়তার পথে।
২-৩ দিন ধরে শিয়ালকোটে প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছিল। বৃষ্টিতে কোথাও হাঁটুপানি, কোথাও কোমরপানি আবারা কোথাও গলাপানি। ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যেই হাঁটতে লাগলেন তারা। হাঁটতে হাঁটতে একসময় পাকিস্তানের রেঞ্জারদের এক ক্যাম্পের সামনে এসে পড়লেন। রেঞ্জাররা এখানে উটে চড়ে টহল দিচ্ছিল। তাদের চোখ এড়ানোর জন্য পানির নিচে কোনোরকমে নাকটাকে উপরে রেখে শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ে লুকিয়ে রইলেন।
তখনো অনবরত বৃষ্টি হচ্ছিল। ভাগ্যিস বৃষ্টি হচ্ছিল। নইলে ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। রেঞ্জাররা কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজি করে ফিরে গেল।
আবার এগোতে শুরু করলেন সবাই। রাত প্রায় ১টার দিকে পৌঁছলেন মুনাওয়ার তাবী নদীর ধারে। খুশিতে লাফিয়ে উঠলেন সবাই। ওই তো মুনাওয়ার তাবী নদী! তাদের পরিকল্পনাই ছিল ওই নদীর উপর মারালা হেডওয়ার্ক নামের বাঁধ পেরিয়ে পালাবেন। নদীটা পার হলেই ভারত।
কিন্তু হায়! নদীর কাছে এসে হতাশ হলেন সবাই। এখন তো ওই নদী পাড়ি দেয়া মুখের কথা নয়।
পদ্মা-মেঘনা-যমুনার মতো বিশাল নদীর দেশের মানুষ তারা। প্রত্যেকে তুখোড় সাঁতারু। নদীতে তীব্র ¯্রােত। এমন খর¯্রােতা নদী কখনো দেখেননি। নদীর পানিও অসম্ভব ঠাণ্ডা। ছুরির ধারের মতো হিং¯্র এই ¯্রােতে নদী পাড়ি দেয়া আত্মহত্যার শামিল। কিন্তু নদী তো পেরোতেই হবে। তাহলে উপায়?
যতই অসম্ভব হোক, নদী পেরোতেই হবে। নদী না পেরোলেও মৃত্যু। কী করা যায়-চটপট পরামর্শ করে নিলেন সবাই। ঠিক করলেন পাড় ধরে ২-৩ মাইল উজানে হেঁটে যাবেন। যেখানে নদীটা সরু মনে হবে, সেখান দিয়ে নদী পাড়ি দেবেন।
উজানের দিকে হাঁটতে লাগলেন তারা। একটা জায়গায় আসার পর মনে হলো, ওখান দিয়ে পার হওয়ার ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে কম। তীব্র ¯্রােতের মধ্যেই নেমে পড়লেন নদীতে।
খর¯্রােতা নদীতে ডিগবাজি খেতে খেতেই বেশ কয়েকবার মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন তারা। তবু হাল ছাড়েননি কেউ। শুধু মনে হচ্ছিল যেভাবেই হোক নদীটা পেরুতে হবে। শেষ পর্যন্ত তাদের প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তির কাছে হার মানে হিমশীতল তুমুল ¯্রােত। পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে লড়াই করার আগে পাকিস্তানি নদীর ¯্রােতের বিরুদ্ধে তুুমুল লড়াই শেষে জয়ী হন তারা। নদী পাড়ি দিয়ে পা রাখেন ভারতের মাটিতে। আর তাতেই তাদের আত্মবিশ্বাস সেদিন হিমালয়ের চূড়া ছুঁড়ে যায়। তারা সেদিন উপলব্ধি করতে পারেন, পাকিস্তানি সৈন্যদের বিরুদ্ধে তারা জয়ী হবেনই।
নদী পেরিয়ে কাছাকাছি বিএসএফের ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তরে পৌঁছলেন সবাই। সেখান থেকে দিল্লি হয়ে কলকাতা পৌঁছলেন। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ৫ জন বাঙালি অফিসার পালিয়ে এসেছেন, এটা জানাজানি হওয়ার পর বাঙালি, মুক্তিবাহিনী ও বাঙালি শরণার্থীরা যেন নতুন প্রাণ পেলেন। বিপুল উৎসাহ আর উদ্দীপনা তৈরি হলো। তাদের আগমনের খবর পেয়ে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানী পর্যন্ত রণক্ষেত্র থেকে কলকাতায় এসেছিলেন এই পাঁচ বীরকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য।
এই পাঁচ দুঃসাহসী সৈনিকদেরই একজন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর। মাত্র ২৩ বছর বয়সে অসামান্য বীরত্ব দেখিয়ে দেশের জন্য প্রাণ দিয়ে হয়েছেন বীরশ্রেষ্ঠ।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়