দুদককে টিআইবি : সিন্ডিকেটের চাপেই কি শরীফ উদ্দিনের চাকরিচ্যুতি?

আগের সংবাদ

জীবনযাপনে মানসিক সুস্থতাও জরুরি

পরের সংবাদ

সন্ধ্যার সুর আকাশের অস্তরাগে

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

সুচিত্রা সেন ও সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের যুগলবন্দি যেন রূপকথাতুল্য। বাঙালির সঙ্গে তার এমনই অব্যক্ত ভালোবাসার বন্ধন। ভারতে, কণ্ঠের দেবত্বের নিরিখে একমাত্র গীতশ্রীই হয়তো লতার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারতেন। ‘বোল পপিহে’ গানটা শুনুন। অবিশ্বাস্য ডুয়েটে লতা ও সন্ধ্যা, মধুবালা ও শ্যামার লিপে। তখন শচীন দেব বর্মণের আগ্রহে সন্ধ্যা বম্বেতে কাজ করছেন। মীনাকুমারীর লিপেও ভারী খুলছিল সন্ধ্যার স্বরতন্ত্র। লতা-গীতা-সন্ধ্যা ত্রয়ীকে নিয়ে শচীনকর্তার কত স্বপ্ন। তাকে খানিক কষ্ট দিয়ে দু’বছরেই বাংলায় ফিরে এসেছিলেন গীতশ্রী। শুধুই ইতিহাস নয়, রূপকথা গড়তে। এই রাজ্য তখন বিশ্বযুদ্ধ, দেশভাগের ক্ষত বুকে ধুঁকছে। সাদা-কালো ছবিগুলো কল্পরাজ্য গড়ে তোলে এই যন্ত্রণায় মায়ার পালক বুলিয়ে দিল। শুরু হলো বাংলা ছবির স্বর্ণযুগ। মহানায়ক হিসেবে উত্তম কুমারের ভাবমূর্তি গড়তে সহায় হলো উদাত্ত হেমন্ত কণ্ঠ। আর সুচিত্রার আবেদন অলৌকিক পর্যায়ে পৌঁছে দিল সন্ধ্যার কারুকার্যশোভিত কণ্ঠ ও জায়গা চিনে তার অলঙ্কার ভরে দেয়ার ক্ষমতা। আরতি মুখোপাধ্যায়ের আবির্ভাবের আগে গীতশ্রী প্রায় একাই নায়িকার স্বর। সুপ্রিয়া, সাবিত্রী, অঞ্জনা, সন্ধ্যা, তনুজা, অপর্ণা, রাখি, দেবশ্রীকেও কণ্ঠ দিয়েছেন। তবু, সন্ধ্যাকণ্ঠ যেন কীভাবে মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের ব্যক্তিত্ব ও সৌন্দর্যের সঙ্গে মিলেমিশে গিয়েছে। ‘এই পথ যদি না’-র ‘লাল্লালালাল্লালা’ অংশটুকু তো বহু লোকে সুচিত্রার গাওয়া বলেই জানে। কোনো অনুভবে এমন একাত্ম দু’জন? সুচিত্রার কণ্ঠে সন্ধ্যার প্রথম গান ‘অগ্নিপরীক্ষা’য়। তার পর ছয় দশকের হৃদয়ের সম্পর্ক। গত ডিসেম্বরে আনন্দবাজারকে জীবনের শেষ সাঙ্গীতিক সাক্ষাৎকারে গীতশ্রী বলেছিলেন, “সুচিত্রা, আমার গান চোখের ভাষা, মুখের অভিব্যক্তি দিয়ে এমন ফুটিয়ে তুলত- অপূর্ব সমন্বয়! ‘কমললতা’র ‘নয়ন মোহন শ্যাম’ গানটি রেকর্ডিংয়ের আগে সুচিত্রা বলে গেল কী এক্সপ্রেশন দেবে। বাড়িতে বারবার গানটা শুনত। নিবিড়ভাবে অনুভব করে লিপ দিত। ওর ডায়লগের পর যখন আমার গানটা আসত, মনে হতো দুটি কণ্ঠস্বর মিশে গিয়েছে। গলার মিল, এক্সপ্রেশনের মিল- কমপ্লিট আইডেন্টিফিকেশন। অভিনয় আর গান একাকার। সেটাই মানুষের মনে রেখাপাত করে গিয়েছে।”
আসলে, লঘু গানে তার এই আকাশছোঁয়ার নেপথ্যে রয়েছে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে অসীম শক্তি। তার গুরুমশায় বাবা বড়ে গোলাম আলি খান বলেছিলেন ‘বেটা তিন ভাগ শুননা, এক ভাগ গানা’। আজীবন অক্ষরে অক্ষরে মেনেছেন। ধ্রæপদী গান আর লঘুসঙ্গীত একসঙ্গে গাননি, যখন যেটায় থেকেছেন, একশো ভাগ উজাড় করেছেন। হারমোনিয়ামে বসে স্বর্গ নামিয়েছেন পৃথিবীতে, সভায় পিছিয়ে এসেছেন অন্য শিল্পীরা। এর পর আর গাওয়া যায় না। তিনি সরল হেসে বলেছেন, ‘মায়াবতী মেঘে এল তন্দ্রা’? ও তো রাধাকান্ত নন্দীর তবলার কারিগরি! মাম্পসে কম বয়সেই সন্ধ্যার এক কান নষ্ট। তবুও সঙ্গীতেন্দ্রিয়ের ক্ষয় নেই! জীবন্ত কিংবদন্তি হয়েছেন, তবুও প্রচারের আলো বা গø্যামারের ছটা তাকে সঙ্গীতসাধনা থেকে এতটুকু টলাতে পারেনি।
জগৎ থেকে স্বেচ্ছা নির্বাসন, আধ্যাত্মিকতার প্রতি অমোঘ টান, সাধারণের ধরাছোঁয়ার বাইরে আলাদা পৃথিবী তৈরি করে থাকা- এই সব বৈশিষ্ট্যে মিসেস সেনকেই কেন মনে পড়ে? আপাতদৃষ্টিতে সন্ধ্যা-সুচিত্রাকে ভিন্ন মেরুর মনে হলেও যেন অন্তর্ব্যক্তিত্বের কোনো বিন্দুতে তাদের মুখোমুখি দেখা হয়ে যায়। অন্তরের জগতেরই তো প্রতিফলন শিল্পে- একজনের অভিনয়ে, অন্যজনের গানে। সেই সংযোগের ফল হয় মহাজাগতিক। গানের ইন্দ্রধনু ওঠে সন্ধ্যার স্বরে, তার আবেশ ছড়িয়ে যায় সুচিত্রার মুক্তোঝরা হাসিতে। অন্য ব্রহ্মাণ্ডের ঝিকিমিকি তারা হয়ে দেখা দেন সুচিত্রা, সেই আকাশেই ঘুমঘুম চাঁদ হয়ে সুরের রেণুতে মাধবী রাত এঁকে যান সন্ধ্যা। সন্ধ্যার সরল জীবনের অন্তরালে যে কতখানি অনুভবের ঘূর্ণি, তার প্রমাণ মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ‘আমি এত যে তোমায় ভালোবেসেছি’। গীতিকার শ্যামল গুপ্তের এই গানের অনুপ্রেরণা স্ত্রী সন্ধ্যাই! তার কণ্ঠে রোম্যান্সের বিস্ফোরণ তো হবেই!
সন্ধ্যা-সুচিত্রার মধ্যে বাস্তবে শ্রদ্ধা-মমতার সম্পর্কের রং ছিটকে পড়েছে সাদা কালো সেই গানের দিনে, তাই তো ‘মমতা’-র মিনিট তিনেকের ঠুমরিতেও এমন অবিচ্ছেদ্য হয়ে অনন্তকাল বেঁচে সুচিত্রা-সন্ধ্যা। গীতশ্রী আত্মজীবনীতে জানিয়েছেন, স্টুডিওতে তাকে শুটিং দেখতে ডাকতেন সুচিত্রা বা শুনতে আসতেন তার রেকর্ডিং। ল²ীপূজোয় তার বাড়ি এসেছেন সুচিত্রা, আবার মুনমুনের বিয়ের দিন সকালে তাদের বাড়িতে গিয়েছেন সন্ধ্যা- কত আদর-ভালোবাসা দুই সখীতে! সন্ধ্যা মেয়ের বিয়ের নেমন্তন্ন করতে গিয়েছেন, সুচিত্রা তখন অন্তরালবাসিনী। তবু বান্ধবীকে গাড়িতে তুলে দিতে বাইরে রাস্তায় চলে এসেছেন! সন্ধ্যার স্মৃতিতে আছে, মুনমুন চিরকুট লিখেছেন, ‘যবে থেকে মাকে সুচিত্রা সেন বলে জেনেছি, সন্ধ্যামাসি তবে থেকে তোমাকেও চিনি।’ কী সহজ-সরল স্নেহটান দু’জনের, দুই পরিবারে। বোধহয় এই নির্মল সারল্যের সম্পদেই এত কঠিন কাজ অবলীলায় করে গেলেন মহানায়িকা ও মহাগায়িকা।
মুনমুন সেনের প্রথম বাংলা ছবি ‘রাজবধূ’তেও সন্ধ্যার ছোঁয়া লেগে ‘আজ রং খেলাতো’-য়। মুনমুন বললেন, ‘কিছু দিন আগেও এক অনুষ্ঠানে তার অটোগ্রাফ চাইলাম।’ তিনি অবাক! বিহ্বল মুনমুনের কথায়, ‘মাসখানেক মতো আগে তাকে ফোন করলাম। মনটা খুব খারাপ ছিল। তাকে বললাম, ‘মায়ের গানগুলো শুনছিলাম, আপনার কথা খুব মনে পড়ছিল।’ মায়ের মতো উনিও তো খুব চুপচাপ থাকতেন, যেন পৃথিবীটা থেকেই আলাদা। উনিই আমাকে বললেন, ‘তুমি গান শোনাও না একটু?’ বললাম, ‘আমি তো গান গাই না!’ তখন কোনো সিনেমার গান নয়, উনি চার-ছ’লাইন রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে শোনালেন। কী আশ্চর্য! নব্বই বছরের মানুষটা একটুও আটকালেন না কোত্থাও, গলাটা এতটুকুও ভাঙল না! খাঁটি সঙ্গীতের স্পর্শ। বাড়িতে তো গান করতেন নিশ্চয়ই, কিন্তু বাইরের লোকের মধ্যে কি আমিই তার গান শেষ শুনলাম?’ সমাপ্তি-সঙ্গীতটি কি তবে মহানায়িকা-কন্যার জন্যই রাখা ছিল! এ কি শুধুই ভালোবাসা না কি সেই সুচিত্রা-সন্ধ্যার দৈব মেলবন্ধনেরই শেষ সিলমোহর? যার ফলে পৃথিবীটা স্বপ্নেরই দেশ হয়?
:: আনন্দবাজারের সৌজন্যে

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়