নির্বাচনী আইন প্রণয়নসহ ৫ দফা প্রস্তাব এনপিপির

আগের সংবাদ

বদলে গেছে ‘প্রাচ্যের ড্যান্ডি’

পরের সংবাদ

দীপ্তপ্রাণ লেখক অজয় দাশগুপ্ত

প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৪, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ১৪, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

অজয় দাশগুপ্ত বাংলাদেশের ছড়াসাহিত্যে অনন্য একটি নাম। গত শতকের সত্তর দশকের অকুণ্ঠ মেধার অধিকারী ছড়াসাহিত্যিকদের অন্যতম তিনি। তার ছড়ায় স্বপ্নের কথা আছে, আছে স্বপ্নভঙ্গের হাহাকারও। ছড়ার শৈল্পিক উৎকর্ষ ও বক্তব্যের স্পষ্টতার জন্য তিনি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছেন। শব্দের বিন্যস্ততায়, জীবনবোধের গভীরতায়, ছন্দ ও বক্তব্যের শৈল্পিক নিপুণতায় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে তার ছড়া। ছোট-বড় সবার জন্য নানামুখী ছড়া লিখে তিনি পাঠক সমাজে খ্যাতি লাভ করেছেন। বলা যেতে পারে অজয় দাশগুপ্ত দেশের পাঠকপ্রিয় এক দক্ষ ছড়াশিল্পী।

স্বাধীনতা পতাকায়, স্বাধীনতা রক্তে
কারা আনে স্বাধীনতা, কারা বসে তখতে!
২.
সংস্কৃতি মানে যদি লাকী খান নাচা
দেশ তবে দেশ নয় বানরের খাঁচা!
৩.
যারা করে চাষ, হৃদয়ের ঘাস
ফোটানো গোলাপ গালিচায়
সে বাগান জুড়ে কোথা থেকে উড়ে
উটকো লোকেরা তালি চায়!

এরকম অনেক জনপ্রিয় ছড়ার নির্মাতা অজয় দাশগুপ্ত। আমাদের ছড়া-অঙ্গন তোলপাড় করা লেখক তিনি। বর্তমানে প্রিন্ট মিডিয়া ও অনলাইন মিডিয়ায় অত্যন্ত সচল ও সক্রিয় লেখক। সমকালীন বিষয়ে কলাম লিখে তিনি পেয়েছেন ব্যাপক পরিচিতি ও খ্যাতি। দীর্ঘদিন প্রবাস জীবন যাপন করলেও নিরন্তর লেখালেখির জন্য দেশে তার অনুপস্থিতি অনুমান করা যায় না। বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা নিয়ে তার মূল্যায়ন মূলধারার পাঠককে মোহিত করে। সমসাময়িক বিষয়ে তার যৌক্তিক ও মননধর্মী বিশ্লেষণের কারণে তিনি সক্ষম হয়েছেন তার নিজস্ব পাঠক ভুবন তৈরি করতে।
অতি স¤প্রতি ঘটে যাওয়া ঘটনার তাৎক্ষণিক শিল্পসম্মত প্রকাশ রীতিমতো অভাবনীয় বিষয়। দেশের যে কোনো সংকট সমস্যায় তিনি উচ্চকণ্ঠ, অন্যায় অনাচার অনিয়মের বিরুদ্ধে সোচ্চার। প্রায় প্রতিদিনই তিনি লিখেন। প্রতিটি লেখায় ফুটে ওঠে তার সমকালীন ভাবনা।
অজয় দাশগুপ্তের ছড়ায় সমসাময়িকতার প্রভাব খুব বেশি স্পষ্ট। ড. মহুয়া ভট্টাচার্য গোস্বামী তার ‘বাংলা শিশু-কিশোর সাহিত্যের ইতিহাস ও বিবর্তন’ গ্রন্থে লিখেছেন: ‘সমাজ তথা পরিপার্শ্বিকতার ওপর নির্ভর করেই গড়ে ওঠে সাহিত্যের মূল ভিত্তি। বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে এসে ভারতের পরাধীনতা মুক্তির পর সমাজজীবনের সেই জটিলতা-অস্থিরতার ছবি আরো ভয়ংকর রূপ লাভ করল। এই পটভূমিতে ছোটদের জন্য আর নিছক ছেলে ভোলানো বা ঘুম পাড়ানি ছড়ার শান্ত সরল পরিবেশ-পরিস্থিতি উপযুক্ত বলে মনে হলো না। বরং ছোটদের রাষ্ট্র তথা সমাজব্যবস্থার বাস্তব পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতন করে তোলার উদ্দেশ্যে এক শ্রেণির ঘুমতাড়ানি ছড়া এই পর্বে সৃষ্টি হলো। যার মধ্য দিয়ে ছড়াকারেরা সমাজ বিবর্তনের নানা ছবি তথা স্বদেশ ভাবনা, রাজনৈতিক চিন্তা-ভাবনা, সামাজিক-নৈতিক, শুভ-অশুভবোধ, প্রকৃতি পরিবেশ সম্পর্কে সচেতনতা, জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা তথ্য, নতুন নতুন আবিষ্কারের কথা, খেলাধুলা, ভ্রমবৃত্তান্ত প্রভৃতি বিচিত্র বিষয়ের উপস্থাপন করেছেন। পাশাপাশি শৈশব-কৈশোরের আনন্দ-কোলাহল, আবেগ-অনুভূতি প্রভৃতি সূ² মানসিক দিকগুলোও ছড়ায় বিশেষভাবে প্রতিফলিত হয়েছে’।
আসলে এই অনুভূতি বড়দের চোখে দেখা ছোটদের স্বপ্ন কল্পনার প্রতিচ্ছবি। আধুনিক সময়ে রচিত ছড়া গ্রামীণ লোকজীবন থেকে সৃষ্ট কোনো লোকসাহিত্য নয়; বরং তা আজ আধুনিক যুগ-ভাবনায় পুষ্ট আধুনিক কবি ছড়াকারের হাতের সৃষ্টি। তাই আধুনিক ছড়াশিল্পী অজয় দাশগুপ্তের ছড়া যুগ ও জীবনের ক্রম পরিবর্তনের ধারায় নতুন নতুন বৈচিত্র্যে ও বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল।
১৯৭১ সাল বাঙালির জন্য এক জ্যোতির্ময়ী বছর। ওই বছরে বাঙালি অর্জন করেছে তার শ্রেষ্ঠ সম্পদ ‘স্বাধীনতা’। দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম, অনেক ত্যাগ তিতিক্ষা ও আত্মাহুতির ইতিহাসের কথা লিপিবদ্ধ করেছেন অজয় দাশগুপ্ত তার ‘ছড়ায় গড়ায় ইতিহাস’ গ্রন্থে। মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, ভাষা আন্দোলন তার বুক থেকে উৎসারিত শুধু এক একটি অধ্যায় নয়, তার পথ চলার ক্ষেত্রে নিরন্তর প্রেরণার উৎস হিসেবেও কাজ করেছে। সেই মুক্তিযুদ্ধের কথা, স্বাধীনতার কথা, মুক্তিযুদ্ধের মহানায়কের কথা ও স্বাধীন বাংলাদেশের কথা চমৎকারভাবে চিত্রায়িত হয়েছে তার অনেকগুলো ছড়া-কবিতায়। ছড়ায় দেশবন্দনা আমরা লক্ষ করি এভাবে:
তোমার জন্ম না হলে মা
আমার জন্ম বৃথা
তুমি আমার ধাত্রী মাতা
শেষ বয়সের চিতা।

তুমি আমার ছেলেবেলা
দুরন্ত যৌবন
তুমি আমার মা ও মাটি
জীবন ও মরণ।

তুমি যদি না হতে মা
কোথায় শুরু, শেষ?
জয়িতা হে জননী হে
আমার বাংলাদেশ।

যুগের পরিবর্তন ও সামগ্রিক বিবর্তনের ধারায় নতুন নতুন বিষয় যেমন ছড়াসাহিত্যে সংযোজিত হয়েছে, তেমনি অনেক প্রচলিত বিষয় আশায়ও যুক্ত হয়ে বিস্তৃত হয়েছে এর আঙিনা। গভীর ও তথ্যসমৃদ্ধ রচনাও সরল সাবলীল হিসেবে ধরা দিয়েছে ছড়াশিল্পীর নিপুণ হাতে। ছড়া ক্রমশ হয়ে উঠেছে সরস ও প্রাঞ্জল। গভীর ও গম্ভীর বিষয়কে পাঠকের কাছে গ্রহণীয় ও আকর্ষণীয় করার ক্ষেত্রে লেখকরা তাদের পরিবেশনায় নতুন নতুন কলাকৌশল গ্রহণ করেছেন। অজয় দাশগুপ্ত তেমনই একজন লেখক, যিনি বৈচিত্র্য ও অভিনবত্বের দিকগুলো ফুটিয়ে তুলতে পারেন অবলীলায়। অতিসম্প্রতি তিনি লিখেছেন ‘মানবজীবন’ শীর্ষক একটি অসাধারণ ছড়া।

দাঁড়িয়ে থাকাই মানব জীবন
মানুষরা সব দাঁড়িয়ে থাকে
দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ যতো
মিলিত হয় বাঁকে বাঁকে।

কেউ দাঁড়িয়ে অপেক্ষাতে
কেউ দাঁড়িয়ে কৌতূহলে
কারো মুখে হাসির ছটা
কেউ দাঁড়িয়ে চোখের জলে।

কেউ দাঁড়িয়ে বিষণ্নতায়
কেউ দাঁড়িয়ে ঝলমলে রোদ
দাঁড়িয়ে থেকে তৃপ্ত কেউ
দাঁড়িয়ে থাকাই তার প্রতিশোধ।

কেউ দাঁড়িয়ে পিতার জন্য
কেউ দাঁড়িয়ে খুঁজছে মাকে
আসবে না কেউ জেনেও মানুষ
তবুও ঠিক দাঁড়িয়ে থাকে।

দাঁড়িয়ে পাওয়া ঘর সংসার
দাঁড়িয়ে পাওয়া দয়িতাকে
ছেলে মেয়ে সব চলে যায়
তবুও সে দাঁড়িয়ে ডাকে।

কেউ দাঁড়িয়ে ভালোবাসায়
কেউ দাঁড়াতেই ভালোবাসে
কেউ দাঁড়ালে আঁধার নামে
দাঁড়ালে কেউ আলো আসে।

পুরো বয়স কাটিয়ে দিয়েও
দাঁড়িয়ে থাকে অশান্ত মন
জন্ম থেকে দাঁড়িয়ে থাকা
দাঁড়িয়ে থাকাই মানবজীবন।

আজকের আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থ সবর্স্ব মানব সমাজের ছবি সুন্দরভাবে তিনি অংকন করেছেন তিনি। সংসার, শ্রেণিগত বিভেদ, দূরত্ব ও সংস্কারের দ্ব›দ্ব নানাভাবে তিনি তুলে ধরেছেন লেখায়।

অজয় দাশগুপ্তের জন্ম চট্টগ্রামে। পড়াশোনা করেছেন মিউনিসিপ্যাল মডেল হাই স্কুল, চট্টগ্রাম কলেজ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমান পেশা: বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রফেশনাল পরীক্ষক। তার প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে রয়েছে :
তোমার আমার ঠিকানা (ছড়া), কৃষ্ণ সংস্কৃতির উথান পর্বে (প্রবন্ধ), তৃতীয় বাংলার চোখে (কলাম), ছড়ায় গড়ায় ইতিহাস (ছড়া), দূরের দুরবিনে স্বদেশ (কলাম), শুধু ছড়া পঞ্চাশ (ছড়া), কলামগুচ্ছ (কলাম সংকলন), কালো অক্ষরে তোমার রক্তাভ মুখ (কবিতা)। লেখালেখির জন্য তিনি কবিতায় জাতীয় পুরস্কার ১৯৮৪ সাল (বাংলাদেশ পরিষদ), মুক্তিযোদ্ধা সংসদ পুরস্কার, সিডনি মুক্তমঞ্চ পুরস্কারসহ কয়েকটি পুরস্কার ও সম্মননা লাভ করেন।
অজয় দাশগুপ্ত আমার প্রিয় ছড়াসাহিত্যিক। প্রায় ৪০ বছর ধরে আমি আছি তার সঙ্গে। ‘রাজাকারের বিরুদ্ধে ছড়া’, ‘দাবাইয়া রাখতে পারবা না’, ‘আমরা তোদের বিরুদ্ধে’ প্রভৃতি সংকলন সম্পাদনার সময় আমি পেয়েছি তার আনুকূল্য। ১৯৮৯ সালে প্রথম জাতীয় ছড়া উৎসবের যখন উদ্যোগ গ্রহণ করি, তখন অন্যদের চেয়ে তিনিই আমাকে বেশি উৎসাহিত করেন। এখনো আমাদের মধ্যে সেই সম্পর্ক বিদ্যমান, চুল পরিমাণ এদিক সেদিক হয়নি। আমাদের প্রিয় ছড়াসাহিত্যিক অজয় দাশগুপ্ত তেমনি সপ্রাণ থাকুন- সেই প্রত্যাশা আমার।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়