ডেঙ্গু পরিস্থিতি : ১৯ দিনে হাসপাতালে ভর্তি ৯৯৪ ডেঙ্গু রোগী

আগের সংবাদ

চালের দাম বাড়ার নেপথ্যে : ধান-চালের উৎপাদন ও বিপণনে তথ্যে গরমিল, দেশে ধান-চালের কোনো সংকট নেই

পরের সংবাদ

বীরত্বের গল্প শুনি : আরো ৬ কিশোর মুক্তিযোদ্ধার

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২২, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ডিসেম্বর ২২, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের মাধ্যমে স্বাধীন হয়েছিল বাংলাদেশ। ‘মুক্তিযুদ্ধ’ আর ‘বিজয়’ শব্দ দুটো আমরা যত সহজে উচ্চারণ করি, কাজটা কিন্তু এত সহজ ছিল না। বাংলাদেশের লাখো মুক্তিযোদ্ধা নয় মাস মরণপণ লড়াই করে সে বিজয় অর্জন করেছিলেন। সেই যুদ্ধে বাংলার তরুণ-যুবকদের সঙ্গে অনেক শিশু-কিশোরও অংশ নিয়েছে। তাদের মধ্যে অনেকেই বীরের মতো যুদ্ধ করে প্রাণ দিয়েছে। আবার অনেকে যুদ্ধ শেষে ফিরে এসেছে স্বাধীন দেশে। গত বছরের ডিসেম্বরে ইষ্টিকুটুমে চারজনের বীরত্বগাথা জেনেছো তোমরা। আজ জেনে নাও আরো ছয় কিশোর মুক্তিযোদ্ধার বীরত্বের কাহিনী।
মুক্তিযুদ্ধ শুরুর দিকে একদিন সিলেটের দক্ষিণ সুরমার পালপুর গ্রামে হিন্দুদের বাড়িঘরে আক্রমণ চালায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। বাড়ির লোকজন যে যেদিকে পারে পালিয়ে যায়। এ খবর কুচাই ইছরাব আলী উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র নীলমণির কানে গেলে সে স্কুল থেকে বাড়ি না ফিরে চলে যায় ভারতে। সেখানে প্রশিক্ষণ নিয়ে ফিরে আসার পর চার নম্বর সেক্টরের আমলসিদ সাব-সেক্টরে যোগ দিয়ে কয়েকটি গেরিলা যুদ্ধে অংশ নেয় সে। মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর সদস্যদের সিলেটের দিকে অগ্রসর হওয়ার জন্য কানাইঘাট মুক্ত করা ছিল জরুরি। কানাইঘাটে পাকিস্তানিরা তখন শক্ত অবস্থান তৈরি করে ছিল। পরিকল্পনা অনুযায়ী মুক্তিবাহিনীর কয়েকটি দল দরবস্ত-কানাইঘাট এবং চরঘাট-কানাইঘাট সড়কের ওপর পজিশন নেয়ার জন্য অগ্রসর হন। পথে নীলমণিদের দলটি পাকিস্তানি সেনাদের আকস্মিক আক্রমণের মুখে পড়ে। সেখানে ভয়াবহ যুদ্ধ শুরু হয়। নীলমণিসহ কয়েকজনের সাহসিকতার পরও মুক্তিযোদ্ধারা সামনে এগোতে ব্যর্থ হন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গুলিতে আহত ও নিহত হন কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা। একপর্যায়ে বাঙ্কারে থাকা নীলমণি মাথা তুলে পাকিস্তানি সেনাদের দিকে গ্রেনেড নিক্ষেপের চেষ্টা করে। এমন সময় গুলি এসে লাগে তার মাথায়। মারা যায় বীর কিশোর নীলমণি। মুক্তিযুদ্ধে অসীম সাহসিকতার জন্য স্বাধীনতার পরে তাকে বীরবিক্রম খেতাব প্রদান করা হয়।
কুমিল্লা জিলা স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র আবু জাহিদ বাড়ি থেকে পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে নাম লেখাল। কম বয়সের কারণে অনেক মুক্তিযোদ্ধাই তাকে দলে নিতে চাননি। কিন্তু তার অদম্য ইচ্ছার কাছে হার মানলেন কমান্ডার শেখ ফজলুল হক মণি। প্রশিক্ষণের সুযোগ করে দিলেন আবুকে। একাত্তরের ১২ সেপ্টেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবার চারগাছ বাজারের এক অপারেশনে যায় আবু। নয়জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল রওনা হলো নৌকায় করে। মাঝপথে পাকিস্তানি বাহিনী গুলি চালায় মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর। সঙ্গে সঙ্গে মারা যান দুই মুক্তিযোদ্ধা। দলের সবচেয়ে ছোট মুক্তিযোদ্ধা আবু গুলিবিদ্ধ হয়ে নদীতে ঝাঁপ দেয়। পরে নদী থেকে উদ্ধার করা হয় তাকে। কিন্তু ততক্ষণে মারা গেছে আবু।
গোলাম দস্তগীর টিটো ছিল অসীম সাহসী এক কিশোর মুক্তিযোদ্ধা। বিজয়ের মাত্র দুদিন আগে একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর শহীদ হয় সে। সাভারের আশুলিয়ার জিরাব এলাকায় নাসিরউদ্দীন ইউসুফ বাচ্চুর নেতৃত্বে লড়াই করছিল টিটো। অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধার মতো তারও স্বপ্ন ছিল স্বাধীন বাংলাদেশ দেখার। কিন্তু স্বাধীনতা দেখে যেতে পারেনি টিটো।
যুদ্ধের শুরুর দিকে একদিন পাকিস্তানি বাহিনী গুলি শুরু করল টাঙ্গাইলের গোপালপুরে। প্রাণভয়ে এলাকা ছাড়তে শুরু করল সবাই। এ সময় কিশোর শহিদুল ইসলামও স্বজনদের সঙ্গে পালিয়ে বর্তমান ধনবাড়ী উপজেলার কেরামজানীতে আশ্রয় নিল। সেখানে লালুর সঙ্গে পরিচয় হলো মুক্তিযোদ্ধাদের। কিছুদিন পর একদল মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে ভারতে চলে যায় সে। ভারতে গিয়ে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেয় লালু। তুরা ক্যাম্পে প্রশিক্ষণকালে ব্রিগেডিয়ার সামসিং শহিদুল ইসলামের নামের সঙ্গে লালু নামটি যুক্ত করে দেন। সেই থেকে তার নাম হয়ে যায় শহিদুল ইসলাম লালু। স্টেনগান ও গ্রেনেডের ওপর প্রশিক্ষণ নিয়ে টাঙ্গাইলের গোপালপুরে ফিরে আসে লালু। একদিনের ঘটনা। গোপালপুর থানায় শক্ত ঘাঁটি গেড়ে বসেছে পাকিস্তানি সেনারা। এদিকে মুক্তিযোদ্ধারাও যে কোনো মূল্যে দখল করতে চান এই থানা। থানার ভেতরের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে পাঠানো হলো লালুকে। থানার কাছাকাছি পাহারা দিচ্ছিল লালুর দূরসম্পর্কের ভাই রাজাকার সিরাজ। লালুকে কাছে ডেকে নিয়ে তাকে রাজাকারদের সঙ্গে কাজ করার প্রস্তাব দিল সিরাজ। সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেল লালু। পাকিস্তানি সেনাদের চা-নাশতা দেয়া আর নানান ফুটফরমাশ খাটার ফাঁকে ফাঁকে থানার নিরাপত্তা ব্যবস্থা দেখতে লাগল সে। তিনটি বাঙ্কার খুঁড়ে ভারী অস্ত্র নিয়ে থানা পাহারা দিচ্ছিল পাকিস্তানি সেনারা। একফাঁকে দৌড়ে গিয়ে সে কাদেরিয়া বাহিনীর কাছে সবকিছু খুলে বলল। মুক্তিযোদ্ধারা ঠিক করলেন, বাঙ্কারে গ্রেনেড চার্জ করে পাকিস্তানি সৈন্যদের খতম করে থানা দখল করবেন তারা। গ্রেনেড চার্জ করার দায়িত্বটি নিজের ঘাড়ে তুলে নিল লালু। তিনটি গ্রেনেড নিয়ে সে ফিরে গেল থানায়। থানার ভেতরে এক জায়গায় লুকিয়ে রাখল সেগুলো। সবাই যখন অন্য কাজে ব্যস্ত তখন লালু তিন বাঙ্কারে তিনটি গ্রেনেড চার্জ করল। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই বিকট শব্দে গ্রেনেডগুলো বিস্ফোরিত হলো। এতে বাঙ্কারে থাকা ১২ জন পাকিস্তানি সৈন্যের সবাই মারা গেল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর অসাধারণ বীরত্বের জন্য শহিদুল ইসলাম লালুকে বীরপ্রতীক খেতাব দেয়া হয়।
রাজশাহীর ১৪ বছরের গ্রাম্য কিশোরী পুতুলদের বাড়িতে মাঝে মাঝে অস্ত্রশস্ত্র জমা রাখতেন মুক্তিযোদ্ধারা। সে সময় এক মুক্তিযোদ্ধা মেয়েটিকে শিখিয়েছিলেন কীভাবে গ্রেনেড চার্জ করতে হয়। একদিন সেই বাড়িতে আশ্রয় নেন দশজন মুক্তিযোদ্ধা। পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকাররা হঠাৎ আক্রমণ করে ওই বাড়িতে। মুক্তিযোদ্ধাদের রক্ষা করার জন্য পুতুল ঘরের দোতলা থেকে পরপর দুটি গ্রেনেড চার্জ করে। অল্প সময়ের জন্য পিছু হটে পাকিস্তানিরা। ততক্ষণে মুক্তিযোদ্ধারা প্রস্তুত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন শত্রæসেনাদের ওপর। সেদিন পুতুলের সাহসিকতার জন্য দশ মুক্তিযোদ্ধাসহ বাড়ির সবার প্রাণ বেঁচেছিল।
হালুর বয়স তখন ষোলো কি সতেরো। যুদ্ধ শুরু হলে সে যোগ দেয় কাদেরিয়া বাহিনীতে। বিভিন্ন অপারেশনে হালুর হাতে মারা যেতে থাকে অনেক রাজাকার আর আলবদর। ১৬ ডিসেম্বরের কয়েকদিন আগে একদিন হালু ফিরে আসে তার এলাকায়। বাজারে চায়ের দোকানে বসে জমিয়ে আড্ডা দিয়ে বাড়ির পথ ধরে। রাত গভীর হতে থাকে, কিন্তু হালু আর বাড়ি ফিরে যায় না। একসময় স্কুলের দিক থেকে গোলাগুলির আওয়াজ ভেসে আসে। পরদিন সবাই গিয়ে দেখে, স্কুলের পাশের ধানক্ষেতে অনেকগুলো লাশ, সবই স্থানীয় রাজাকারদের। কিন্তু হালুর লাশ নেই। সেদিনের পর থেকে হালুকে আর পাওয়া যায়নি। সেই রাতে রাজাকারদের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে অল্পের জন্য স্বাধীন বাংলাদেশ দেখে যেতে পারেনি এই কিশোর মুক্তিযোদ্ধা।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ মূলত এমনি লাখো মুক্তিসংগ্রামীর বীরত্বের গল্প। আমরা যদি এই দেশটাকে ভালোবাসি, তবে মুক্তিযোদ্ধাদেরও ভালোবাসতে হবে। তাদের বীরত্বকে সম্মান জানাতে হবে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়