মানুষের কল্যাণ করার জন্যই আল্লাহ বাঁচিয়ে রেখেছেন : সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনা

আগের সংবাদ

প্রশাসনের উচ্চপর্যায়ে বিভাজন! মাঠ প্রশাসনকে কেন্দ্রের বিশেষ নির্দেশনা : জানালেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব

পরের সংবাদ

শব

প্রকাশিত: আগস্ট ২৩, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: আগস্ট ২৩, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

লেখক আমজাত হোসেন খাঁর নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে গিয়েছি। তিনি একজন জনপ্রিয় সাসপেন্স এন্ড থিলার রাইটার। মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান শেষে অতিথিরা চলে গেলেন। আমরা চারজন থেকে গেলাম। চারজনই লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত। লেখক আমজাত হোসেন খাঁ, লেখক সন্দীপ সাহা, কবি কবির পাটোয়ারি আর আমি।
ফ্ল্যাট বাড়ির ছাদে জম্পেশ আড্ডা বসেছে। আড্ডা বেশ জমে উঠেছে। অমাবস্যার রাত। আবহাওয়াটাও দারুণ। শুকনো খাবারের পাশাপাশি চিকেনের কিছু আইটেমও আছে। আর আছে বিশেষ ধরনের তরল। যে তরল মস্তিষ্কে উন্মাদনা সৃষ্টি করে। ডিটেকটিভ ধরনের লেখায় নাকি এটা এক ধরনের টনিক হিসেবে কাজ করে।
সাহিত্য নিয়ে কথা হচ্ছে। হঠাৎ লেখক সন্দীপ সাহা বললেন, আমজাত ভাই, আপনার লেখায় ভৌতিক বিষয়টা কিন্তু মিসিং।
আমজাত হোসেন খাঁ বলল, কী বলছেন? আমার অনেকগুলো উপন্যাসে ভূতের ঘটনা আছে।
কবি কবির পাটোয়ারি বললেন, তা আছে কিন্তু শেষে দেখা যায় আপনি একটা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দাঁড় করে ফেলেছেন। রহস্যকে আর রহস্য রাখেননি।
আমজাত হোসেন খাঁ বলল, আসলে পাঠকদের মধ্যে কুসংস্কার ছড়াতে আমার কিঞ্চিৎ অনীহা কাজ করে। আর আমি নিজেও এসব বিশ্বাস করি না। যদিও একবার অবশ্য ভূতের মুখোমুখি হয়েছি।
আমি বললাম, আপনি ভূত দেখেছেন?
আমজাত হোসেন খাঁ বলল, ঠিক দেখেছি কিনা জানি না। তবে সে এক রহস্যময় ঘটনা। যে রহস্যের এখনো কোনো কূলকিনারা করতে পারিনি।
আমি বললাম, এত বড় একজন ডিটেকটিভ রাইটার যে কিনা অনেক কঠিন ও জটিল রহস্যের জট খুলেছে, সে নিজে একটা রহস্যের কাছে হার মেনে গেছে। তাহলে তো শুনতেই হয় ঘটনাটা। বলুন তো ভাই।
বাকিরাও বেশ আগ্রহ দেখাল। আমজাত হোসেন খাঁ অবশ্য প্রথমে না করলেও আমাদের চাপাচাপিতে শেষমেশ রাজি হলেন।
আমজাত হোসেন খাঁ তার গøাসে কিছুটা হুইস্কি ঢালতে ঢালতে বলল, আগে বলে রাখি, ছাত্র বয়স থেকেই আমি ড্রাইভিং জানি। পড়াশোনার খরচ জোগাতে রেন্ট-এ-কার চালাতাম।
একবার বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা আন্দোলন হলো। হঠাৎ ক্যাম্পাস বন্ধ ঘোষণা করাতে আমি বাড়ি রওনা হলাম। মাওয়া ঘাটে বসে আছি। রাত ২টা। কোনো গাড়ি নেই। অনেক অপেক্ষার পর একটা অ্যাম্বুলেন্স এলো। অ্যাম্বুলেন্সের ভেতরে লাশ ছিল।
অ্যাম্বুলেন্সের চালক বলল, কোথায় যাবেন?
আমি বললাম, অনেক দূরে, বরগুনার পাথরঘাটা।
অ্যাম্বুলেন্সের চালক বলল, আমি লাশ নিয়ে যাচ্ছি বরিশালের উজিরপুরে। আমার সঙ্গে উজিরপুর পর্যন্ত যেতে পারেন। যেতে যেতে ভোর হয়ে যাবে, ওখান থেকে গাড়ি বদলে নেবেন।
আমি বললাম, না ভাই, লাশের গাড়িতে যাবো না।
ড্রাইভার সাহেব হাসির ভঙ্গিতে বলল, লাশকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। মৃত মানুষ বিপজ্জনক নয়, মানুষ জীবিত অবস্থায় বিপজ্জনক। উঠে পড়েন, এত রাতে কোনো গাড়ি পাবেন বলে মনে হয় না। সারা রাত এই নির্জনে বসে থাকতে হবে। একা একা আরও বেশি ভয় পাবেন। তাছাড়া এই অঞ্চলে ডাকাতের বেশ উপদ্রব। মালামাল দিয়ে দেয়ার পরও অনেক সময় জানে মেরে ফেলে।
– আপনাকে ভাড়া কত দিতে হবে?
– ভাড়া দিতে হবে না।
আমি আর কিছু জিজ্ঞেস করলাম না। চট করে গাড়িতে উঠে পড়লাম। বিনা পয়সার যেতে পারব, এটাই বেশি। অকারণে ডিটেকটিভ সাজার দরকার নেই। ড্রাইভার যাতে ঘুমিয়ে না পড়ে তাই হয়তো কথা বলার সঙ্গী চাচ্ছে। আমি বসেছি ড্রাইভারের পাশে।
ড্রাইভার বলল, আমার নাম রুস্তম। ভাইজানের নাম?
আমি বললাম, আমি আমজাত। আপনার বাড়ি কি এই দিকে?
– না। সিরাজগঞ্জ।
ড্রাইভার পকেটে থেকে একটা কাগজ বের করে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, দেখেন তো, লাশ যাবে যে ঠিকানায়, এটা চেনেন কিনা।
আমি দেখলাম, সেখানে লেখা উজিরপুর থানার শিকারপুরের একটা জায়গার ঠিকানা।
– হ্যাঁ, চিনি।
অ্যাম্বুলেন্স ধীরগতিতে চলছে। লাশের গাড়ি নাকি একটু ভার চলে।
আমার হঠাৎ মনে হলো লাশ নিয়ে এই ড্রাইভার একা কেন যাচ্ছে? মৃত ব্যক্তির আত্মীয়স্বজন কেউ কেন সাথে নেই?
আমি বললাম, আচ্ছা, লাশের সাথে কেউ নেই কেন?
রুস্তম বলল, লাশের সাথে কে থাকবে?
আমাদের দেশে কেউ মারা গেলে তার দাফন হওয়ার আগ পর্যন্ত স্বজনরা মৃত ব্যক্তিকে ঘিরে থাকে। আপনি একা লাশ নিয়ে যাচ্ছেন কেন?
রুস্তম বলল, মৃত ব্যক্তির আত্মীয়-স্বজন সবাই গ্রামেই থাকেন। হাসপাতালে মৃত্যু। হাসপাতাল থেকে মৃতের আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ করে আমাকে দিয়ে লাশ পাঠানো হচ্ছে।
– ও আচ্ছা।
অনেকটা নীরবেই চলছে গাড়ি। রুস্তম হঠাৎ বুকে ব্যথা অনুভব করে। গাড়ি থামিয়ে কিছুক্ষণ ঝিমাতে থাকে। আমি পানি খাওয়ালাম। রুস্তমকে দেখে মনে হলো সে আর গাড়ি চালাতে পারবে না।
আমি বললাম, আপনি বসে থাকেন, আমি ড্রাইভ করছি।
রুস্তম বলল, তাহলে তো খুব সুবিধা হয়। আমি পেছনে কিছু সময় শুয়ে থাকি।
– পেছনে শুয়ে থাকবেন মানি? লাশের পাশে?
– হ্যাঁ।
– ভয় লাগবে না?
– এই গাড়িতে অনেক লাশ বহন করেছি। এখন এসব ভয় হয় না।
আমি গাড়ি নিয়ে রওয়ানা করলাম। খুব দ্রুত চালাতে লাগলাম।
ফজর আজান হয়ে গেছে। চারদিকে আলো আসতে শুরু করেছে। আমি আর কোথাও থামালাম না। রুস্তমকেও ডাকলাম না। একেবারে ঠিকানা মতো লাশ নিয়ে চলে গেলাম।
মৃতের আত্মীয়-স্বজনরা ছুটে এলো। আমি রুস্তমকে ডাকতে গিয়ে অবাক। রুস্তম নেই। সেখানে শুধু কফিনে ডেডবডি রাখা।
রুস্তমকে খুঁজবো নাকি কাউকে ব্যাপারটা বলবো বুঝতে পারছি না। কিছু বুঝে ওঠার আগেই সবাই গাড়ি থেকে কফিন নামাল। কফিন খোলা হলো। ডেডবডির দিকে তাকাতেই আমার চোখ ছানাবড়া। ডেডবডি আর কারো না, এ তো রুস্তম!
আমজাত হোসেন খাঁ চুপ হয়ে গেল।
আমি বললাম, তারপর।
তারপর আর কী। নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করলাম। অল্প ভয়ের ব্যাপার ঘটলে মানুষ আতঙ্কিত হয়। অধিক ভয়ে মানুষ শক্ত হয়ে যায়। আমি সেখান থেকে চলে গেলাম আমার গ্রামের বাড়িতে। কয়েকদিন পর ঢাকায় ফিরলাম। কিছুদিন মনের মধ্যে ব্যাপারটা বয়ে বেড়ালাম। তারপর ভুলেও গেলাম। বেশ কয়েক বছর পর যখন লেখালেখি শুরু করি তখন আবার ঘটনাটা মাথার মধ্যে ঢুকে পড়ে। অনেক ভেবেছি, কোনো সমাধান করতে পারিনি।
লেখক সন্দীপ সাহা বলল, হয়তো গাড়িতে লাশ ছিল না। রুস্তম যখন বিশ্রামের জন্য গিয়েছে তখনই তার মৃত্যু হয়েছে।
আমজাত হোসেন খাঁ বলল, আমি গাড়িতে উঠার সময় লাশ দেখেছি। আর রুস্তমের মৃত্যু হলে আমার সাথে এত পথ কথা বলেছে কে? কফিন কোথায় থেকে এলো?
কবি কবির পাটোয়ারি বলল, এমনও তো হতে পারে, রুস্তমের মৃত্যু আগেই হয়েছে, সে-ই ছিল কফিনে। রুস্তমের সাথে কথোপকথন ছিল আপনার দৃষ্টিভ্রম।
আমজাত হোসেন খাঁ বলল, তাতেও সুরাহা হয় না। সেক্ষেত্রেও একই প্রশ্ন থেকে যায়। রুস্তমের মৃত্যু আগে হলে এত পথ গাড়ি চালিয়েছে কে? অ্যাম্বুলেন্স এবং ডেডবডি রাস্তার পাশে কেন ছিল? কে নিয়ে এলো? তাছাড়া আমিই বা রাস্তার পাশে পড়ে থাকা অ্যাম্বুলেন্স কেন নিয়ে যাবো? তর্কের খাতিলে সব কিছু যদি মেনে নেই তবুও সমস্যা থেকে যায়। সব থেকে বড় সমস্যা।
আমি বললাম, কী?
আমজাত হোসেন খাঁ বলল, রুস্তমের বাড়ির ঠিকানা আমি কীভাবে পেলাম? যে আমাকে ঠিকানা দিল, সে কে?
সবাই চুপ করে রইল। মনে মনে এই ভেবে আনন্দিত হলাম যে, এত রহস্যের জট যে খোলেন, তিনিই একটা রহস্যের জটে আটকে গেছেন। জগৎ রহস্যময়।
:: মগবাজার, ঢাকা

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়