অক্সিজেন ঘাটতি নিয়ে রওশন এরশাদ আইসিইউতে

আগের সংবাদ

এবার লক্ষ্য কূটনৈতিক জয় : তালেবানের ওপর বাড়ছে আন্তর্জাতিক চাপ >> চ্যালেঞ্জের মুখে ভারত

পরের সংবাদ

সিরাজউদ্দৌলা

প্রকাশিত: আগস্ট ১৮, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: আগস্ট ১৮, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

মুজিব বাইয়া যাওরে
নির্যাতিত দেশের মাঝে
জনগণের নাওরে
মুজিব বাইয়া যাওরে।
ঊর্মি গাইছে নিবিষ্ট মনে। মেয়ের কণ্ঠটা চমৎকার। মেয়ের গান শুনে কাছে এসে বসল মিতা। মায়ের মতোই হয়েছে ঊর্মি। চঞ্চল, একরোখা। ক’দিন ধরেই ঊর্মি অস্থির। তাদের স্কুলের অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু আসবেন। কীভাবে তাকে বরণ করা হবে তার প্রস্তুতি চলছে স্কুলে। এইটুকু মেয়েকে দিয়ে বঙ্গবন্ধুর গলায় ফুলের মালা দেয়া হবে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ঊর্মি গাইবে এই গান। এইটুকু মেয়ের কণ্ঠে এই গান এই সুর। নিশ্চিত সবাই তন্ময় হয়ে শুনবেন। বঙ্গবন্ধুও নিশ্চয়ই খুশি হবেন। ভাবে মিতা।
ভাবতে ভাবতে মিতা চলে যায় আরো ন’বছর আগের দিনগুলোতে। মিতা তখন ছবিঘরের সদস্য। পাকিস্তান কালচারাল একাডেমি ছেড়ে হাসনা আপা, টিপু ভাই, ফজল-এ-খোদা ভাই ও কামাল ভাইদের নেতৃত্বে গড়ে উঠে ছবিঘর। ছবিঘরের পরিচালনায় দুর্বার চলছে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড। এর মধ্যে হয়ে গেল একটি মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে। অনুষ্ঠানটি সব দর্শক-শ্রোতার ব্যাপক প্রশংসা কুড়ায়। পত্র-পত্রিকায় এ নিয়ে ছবি ও প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এতে কামাল ভাইয়ের নামও ছাপা হয়। তা দেখে কামাল ভাইয়ের বাবা অর্থাৎ মুজিব ভাই ছবিঘরের সদস্যদের দেখতে চান। তখন সবার মুখে মুখে মুজিব ভাই, আমাদের মুজিব ভাই। কামাল ভাইয়ের কাছে দেখা করার কথা শুনে সকলের মধ্যেই অস্থিরতা শুরু হয়। মিতার তো আর তর সইছে না। কখন দেখা হবে মুজিব ভাইয়ের সঙ্গে! এর দু’তিন দিনের মধ্যেই মুজিব ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়েছিল তার।
ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের সেই বাসাতে, বসার ঘরে হৈ চৈ করে ঢুকতেই মুজিব ভাই উঠে দাঁড়িয়ে তাদের জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, আয় আয় তোরা সব এসে গেছিস? তখন তিনি তাজউদ্দীন সাহেবের সঙ্গে কথা বলছিলেন। তিনি তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তুমি যাও, আমি এখন ছবিঘরের বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলব। কামাল, তোর মাকে বল, নাস্তা দিতে। আগে খাওয়া দাওয়া, তারপরে কথা। মুজিব ভাইয়ের উষ্ণ অভিনন্দনে সবাই অভিভূত।
ফজল ভাই বললেন- আমরা আপনাকে দেখতে এসেছি।
– আরে দেখবি দেখবি, যখন তোদের জন্য কিছু করতে পারব। এখনো কিছুই করতে পারিনি। কেবল ছয় দফা দিছি। দেখি কী হয়। মুজিব ভাইয়ের ঝটপট জবাব।
সেদিন কত কথা হয় মুজিব ভাইয়ের সঙ্গে। তিনি সকলকে পেয়ে খুবই খুশি। মানুষকে এভাবে আপন করে নিতে পারে কেউ, কাছে থেকে না দেখলে বোঝার কোনো উপায়ই নেই। সবাই যেন তার কতদিনের চেনা।
সেদিন একথা সেকথার পর মুজিব ভাই বললেন, তোরা নাচ করলি গান করলি, কিন্তু নাটক করলি না কেন? একটা অন্তত নাটক করা উচিত ছিল তোদের। নাটক করলে কথা বলার সাহস হয়।
কথা প্রসঙ্গেই মুজিব ভাই জানালেন, যখন ক্লাস সিক্সে পড়েন, সেসময় একবার ইন্সপেক্টরের তাদের স্কুল ভিজিটের কথা হয়। এ উপলক্ষে স্কুলে একটি অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত নেন শিক্ষকরা। ওই অনুষ্ঠানে সিরাজউদ্দৌলা নাটকটি মঞ্চস্থ হবে। কিন্তু সিরাজউদ্দৌলা কে হবে? শিক্ষকরা কয়েকজনের পরীক্ষা নিয়ে তাকে দিয়েই সিরাজউদ্দৌলা চরিত্রে অভিনয় করানোর সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ইন্সপেক্টর আসেননি। তাই নাটকটি মঞ্চস্থ হয়নি আর তিনিও সিরাজউদ্দৌলা হতে পারেননি। শেষ লাইনটা বলার সময় তার কণ্ঠে যেন আক্ষেপ ঝরে পড়ে।
একথা শুনেই মিতা বলে ওঠে, মুজিব ভাই, তবুও আপনিই আমাদের সিরাজউদ্দৌলা। কথা শুনে মুজিব ভাই যেন কিছুটা থতমত খেলেন। পরক্ষণেই হো হো করে হাসতে হাসতে বললেন, তোরা দোয়া কর, সিরাজউদ্দৌলা নয়, আমি যেন তোদের মুজিব ভাই হয়েই থাকতে পারি। আমি সবার মুজিব ভাই-ই থাকতে চাই, বাংলার দুখী মানুষের সুখ-দুঃখের সঙ্গী হতে চাই।
সেই মুজিব ভাই এখন দেশের প্রেসিডেন্ট। সেদিনের সেই ঘটনার পর কতদিন চলে গেছে। মুজিব ভাইয়ের সঙ্গে আর দেখা নেই। মিতারও ঘর সংসার হলো। মুজিব ভাইও ব্যস্ত হয়ে গেলেন রাজনীতিতে। দেশ স্বাধীন হলো। মিতাও ব্যস্ত থাকল নিজেকে নিয়ে। এই ক’দিন মুজিব ভাইয়ের কথা খুব মনে পড়ছে মিতার। মুজিব ভাই, সকলের মুজিব ভাই, বাংলার সিরাজউদ্দৌলা।
মিতার আজ খুব করে মনে পড়ছে মুজিব ভাইয়ের কথা। খুব শিগগিরই মুজিব ভাই ঊর্মিদের স্কুলে আসবেন। মিতা সিদ্ধান্ত নেয়, স্কুলের অনুষ্ঠানে সে নিজেও থাকবে। ঠিক সোজা গিয়ে দাঁড়াবে মুজিব ভাইয়ের সামনে, তার সিরাজউদ্দৌলার সামনে। নিশ্চয়ই মুজিব ভাই তাকে দেখেই চিনতে পারবেন। মিতা জেনেছে, মুজিব ভাইয়ের স্মরণশক্তি অনেক প্রখর।
আচ্ছা, মুজিব ভাইয়ের সামনে যাওয়া যাবে তো? এখন তো মুজিব ভাই দেশের প্রেসিডেন্ট। প্রটোকলের লোকজন তাকে কাছে যেতে দেবে তো? মিতা ভাবছে, নিশ্চয়ই দেবে। মিতা জেনেছে যে, মুজিব ভাই প্রটোকল মানেন না। সবার সঙ্গে কথা বলেন তিনি।
এসব ভাবতে ভাবতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ে মিতা। হঠাৎ গুলির শব্দে না কি লোকজনের চেঁচামেচিতে তন্দ্রা ছুটে যায় তার। আর তখনি মনে হয়- মিতাকে বলছেন নবাব, তুমি চলে যাও মিতা। ক্লাইভের সৈন্যরা এগিয়ে আসছে। বিপদ এখন চারদিকে। হুগলি, কাটোয়ার দুর্গ, অগ্রদীপ ও পলাশীতে আমাদের সৈন্যরা ইংরেজ সৈন্যদের পথরোধ করেনি। সেনাপতিরা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত…।
মিতা দেখছে হাজার হাজার সৈন্য ঘোড়ায় চড়ে তলোয়ার হাতে এগিয়ে আসছে। এখানে ওখানে গোলার আঘাতে ছিন্নভিন্ন হচ্ছে চারদিক। মীরজাফর, ইয়ার লতিফ ও রায় দুর্লভ ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে। ইংরেজ সৈন্যদের প্রতিরোধ না করেই দাঁড়িয়ে আছে তাদের অধীন সৈন্যরা। ইংরেজ সৈন্যরা আক্রমণ করছেন নবাবের দুর্গে, রাজধানীতে। একটি গোলা অগ্নিপিণ্ডের মতো ধেয়ে আসছে মিতার দিকে।
মিতা ওঠো- মামুনের এমন চিৎকারে ঘুম ভাঙে মিতার। বুকটা ধড়ফড় করছে তার।
– মিতা ওঠো, বিপদ,
দুঃসংবাদ…। বলে যায় মামুন।
– কী দুঃসংবাদ, বলো। স্বপ্নের রেশ কাটিয়ে প্রশ্ন করে মিতা।
– বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে, রেডিওতে বলে যাচ্ছে এক মেজর।
– কী বলো তুমি? চিৎকার করে ওঠে মিতা। তারপর চুপ হয়ে যায় সে। কোনো কথা নেই। শুধু তার দু’চোখ বেয়ে নামে শ্রাবণের ধারা। মনে মনে নিজেকে দোষারোপ করে মিতা। কেন মুজিব ভাইয়ের নাম দিলাম সিরাজউদ্দৌলা! মিতা নিজেকে খুনি ভাবে, ভাবে অপরাধী।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়