সবুজ বাংলাদেশকে সবুজতর করার আহ্বান আইজিপির

আগের সংবাদ

হুমকির মুখে রোহিঙ্গা জাতিসত্তা : বিশ্বব্যাংক ও জাতিসংঘের প্রস্তাব নিয়ে কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের অভিমত

পরের সংবাদ

শহীদ কাদরী রূপ, রং ও গন্ধ দিয়েছেন বাংলা কাব্যসাহিত্যকে

প্রকাশিত: আগস্ট ১৩, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: আগস্ট ১৩, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

‘কবি তখন স্বপ্ন দেখান জাতি যখন দুঃস্বপ্নে’। অর্থাৎ জাতির ক্রান্তিকালে কবিগণ জাতিকে পথ বাতলিয়ে দিবেন। দেখাবেন সমস্যা সঙ্কুল অবস্থা হতে উত্তরণের উপায়। আর যদি কোনো কবির কাব্য বা চিন্তাধারা সেরকমটি না হয় তবে কবি পুরোধাটি সম্ভবত তার জন্য অপাঙক্তেয়। আদিযুগ থেকে আজ অবধি কত যে লিখিয়ে এসেছেন তার ইয়ত্তা নেই। তবে স্বকর্মের প্রতি যারা আন্তরিক ও স্বার্থান্বেষী ছিলেন না, তারাই প্রোজ্জ্বল। তারা অমর। এমনই একজন প্রোজ্জ্বল ও অমর কবি শহীদ কাদরী।
তিনি কলকাতার পার্ক সার্কাসে ১৯৪২ সালের ১৪ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন। কবিতার মানসপুত্র খ্যাত কবি দশ বছর বয়সের এক কিশোর অবস্থায় চলে আসেন ঢাকায়। নাটকের মাধ্যমে লেখালেখির জগতে প্রবেশ করলেও তিনি মাত্র ১১ বছরের কৈশোরের খাতায় লিখেছিলেন ‘পরিক্রমা’ নামক কবিতা। ১৯৫৩ সালে ‘স্পন্দন’ পত্রিকায় প্রকাশ হয়েছিল। এই শুরু তার কবিতার রাজপথে পদচারণার। ২০১৬ সাল পর্যন্ত তিনি সেই কবিতার রানীর সাথে ঘরকন্না করেছেন। তবে থেকে থেকে। মাঝে দীর্ঘদিন বিরতিও ছিল। বোহেমিয়ান কবি জীবন তার। কখন কোথায় ছুটে চলেছেন। পৃথিবীর অনেক দেশ করেছেন ভ্রমণ। দ্বিতীয়া পতœী নীরা কাদরীর কাছে যুক্তরাষ্ট্রে সর্বশেষ হয়েছিলেন থিতু। দেশের প্রতি অভিমান করে অভিবাসী হয়ে থাকলেও শেষজীবনে বারংবার দেশের মাটিতে আসতে চেয়েছিলেন। কিন্তু নিম্নার্ধ সচল ছিল না তার। অবশেষে তিনি মাতৃকায় ফিরেছিলেন ২০১৬তে। আগস্টের ৩১ তারিখ। তবে তখন আর খেদ দেখানোর মতো সক্ষমতা ছিল না কবির। যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসাধীন অবস্থায় দেশে ফেরার তিনদিন পূর্বে না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছিলেন।
বাংলা কবিতার খুবই বিরলপ্রজ এই কবি জীবদ্দশায় মাত্র চারটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেছিলেন। তিনি বিশ্বাসী ছিলেন কাজের মানে। কাজের ঢাউস পরিমাপে তার ছিল নেতিবাচক মনোভঙ্গি। সৃজনকর্মকে ঋদ্ধ করতে হয় বুনন আর নিটোলতায়। তার সেই চারটি গ্রন্থে কবিতা রয়েছে ১৫০টির মতো। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, শার্ল বোদলেয়ার, যাকে বলা হয় প্রফেট অব মডার্নিজম এবং জাঁ আর্তুর রাবোঁর মতো বিশ্বসাহিত্যের দুই পথিকৃৎ কবি যারা খুব কম লিখেছেন কিন্তু আজো বেঁচে আছেন। কীভাবে? কাজের নিপুণতায়। কাজের কারুকার্যে।
‘উত্তরাধিকার’ (১৯৬৭), ‘তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা’ (১৯৭৪), ‘কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই’ (১৯৭৮), ‘আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও’ (২০০৯) এই চারটি কাব্যগ্রন্থ বাংলা কাব্যসাহিত্যে এক নতুন সংযোজন। তিনি তার কাব্যে শব্দের জুঁতসই ব্যবহার করেছেন। শিল্পীর তুলির মতোই আঁচড় কেটেছিলেন কাব্যের শব্দে শব্দে। বিশ্বসাহিত্য সম্পর্কিত জানাশোনা তার ঢের। তিরিশের দশকের কাব্যধারা ও মাইকেলীয় ধাঁচ ধারণ তার ভিতর। তবে সেগুলোর সাথে আরো স্বাদ যুক্ত হয়েছে বিশ্বসাহিত্যের অভিজ্ঞতা।
তিনি প্রয়াত হওয়ার এক বছরের মাথায় তার অগ্রন্থিত ২৩টি কবিতা যা বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল এবং তার দ্বারা অনূদিত বিশ্বসাহিত্যের বিখ্যাত কবিদের ১৩টি কবিতার সমন্বয়ে নীরা কাদরীর তত্ত্বাবধানে ২০১৭ সালে ‘প্রথমা’ প্রকাশনী থেকে পঞ্চম কাব্যগ্রন্থ বের হয়। সেই কাব্যগ্রন্থটির নাম ‘গোধূলির গান’।
খুব কম লিখে বেশি জনপ্রিয়তা অর্জনকারী কবির সংখ্যা খুবই কম। আর সেই কবিদের একজন শহীদ কাদরী। নিজেকে উত্তরোত্তর বুনন করেছেন কাব্য জমিনে। তার শ্লাঘার জায়গাটি হচ্ছে কোনো পুনরাবৃত্তি নেই তার হাতেগোনা এই কয়েকটি কবিতায়। নির্মেদ ও বাহুল্যবর্জিত কাব্য।
তরুণ সমাজের কাছে অসম্ভব জনপ্রিয় তিনি। বিশ্বের নামকরা দার্শনিক, নৃতত্ত্ব, মনস্তত্ত্ব, বিজ্ঞান ও ইতিহাসচর্চার গভীরতা তাকে উদ্বেলিত করেছিল। সেগুলোর অনুষঙ্গ কবিতার পরতে পরতে প্রথিত করেছিলেন তিনি। তার কবিতা আমাদের নিয়ে যায় সম্পূর্ণ এক আলাদা জগতে, ঝলমলে বিশ্ব নাগরিকতাবোধ ও গভীর স্বাদেশিকতার মিশেলে শব্দ, উপমা, উৎপ্রেক্ষার অভিনবত্বে আমরা বিস্মিত হই। তিনি গদ্য কবিতা লিখেছেন।
তার কবিতাগুচ্ছের মধ্যে মানুষের মনকে নাড়িয়ে দেয়ার মতো বেশকিছু কবিতা আছে। আছে আবৃত্তি করার মতো উদ্বেল কবিতা। তন্মধ্যে অন্যতম কবিতাটি হচ্ছে ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা’র নাম কবিতা ‘তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা’।
একজন প্রেমিক তার প্রেমিকাকে ভালোবাসে নিজের থেকে বেশি। প্রেমিকার মনকে উৎফুল্ল করতে তার কী না প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা! কবি এখানে তার মাতৃভূমিকে প্রেমিকারূপে দাঁড় করিয়েছেন। আর সেই প্রিয়তমা দেশকে মানবিক ও কল্যাণকর করে তোলার কবির কী পদক্ষেপ দেখুন!

‘ভয় নেই
আমি এমন ব্যবস্থা করবো যাতে সেনাবাহিনী
গোলাপের গুচ্ছ কাঁধে নিয়ে
মার্চপাস্ট ক’রে চ’লে যাবে
এবং স্যালুট করবে
কেবল তোমাকে প্রিয়তমা।
ভয় নেই আমি এমন ব্যবস্থা করবো
বন-বাদাড় ডিঙিয়ে
কাঁটাতার, ব্যারিকেড পার হ’য়ে, অনেক
রণাঙ্গনের স্মৃতি নিয়ে
আর্মার্ড- কারগুলো এসে দাঁড়াবে
ভায়োলিন বোঝাই ক’রে
কেবল তোমার দোরগোড়ায় প্রিয়তমা।’
(‘তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা’)

দেশকে তিনি অভয় দিচ্ছেন। বলছেন, সেনাবাহিনীর স্যালুটগুলো কোনো জোচ্চোর শাসকের তরে নয়। এ স্যালুট একমাত্র, কেবলমাত্র, শুধুমাত্র তোমারই, প্রিয় দেশ। প্রিয় শ্যামলিমা। সবকিছুই তোমার পায়ে সঁপিবে তারা, প্রিয়তমা।
প্রেমিক তার প্রেমিকার জন্য সওদা করে আনে গঞ্জ বা শহর থেকে। যেমনটি ‘কবর’ কবিতায় দাদু তার কিশোরী স্ত্রীর জন্য শাপলার হাটে তরমুজ বিক্রি করে সদাই কিনতেন। তেমনটি প্রেমিক তার প্রেমিকার জন্য আধুনিক যুগে লজেন্স, আইসক্রিম, চকবার, ফুচকা, টফি বা ক্যান্ডি বয়ে আনে শপিং মল থেকে। কিন্তু শহীদ কাদরীর যে কাক্সিক্ষত দেশ সেখানে সুখের সমীরণ বইবে। চারদিক সব অনুকূলে থাকবে। প্রেমিকার চাওয়াতেই আকাশ হতে ঝরে পড়বে সদাই। কী চমৎকার এক দৃশ্যপটের অবতারণা এখানে।

‘ভয় নেই, আমি এমন ব্যবস্থা করবো
চকোলেট, টফি আর লজেন্সগুলো
প্যারাট্রুপারদের মতো ঝ’রে পড়বে
কেবল তোমার উঠোনে প্রিয়তমা।’
(‘তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা’)

পরের ছত্রগুলোতে আবারো অভয় দিয়ে বলছেন, নৌকমান্ডের কমান্ডার হবেন একজন কবি। কবি তো হবে না নিষ্ঠুর কিংবা পাষাণ। মানুষ, মানবিকতা, মমত্ববোধ যিনি ধারণ করবেন নিজের ভিতরে তিনি পারবেন না মানুষ মারতে। তিনি পারবেন না তার কমান্ডোকে হামলা চালাতে বলতে। আর দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বা সমরমন্ত্রীর নির্বাচনী ভোটে কোনো কলুষিত রাজনীতিককে তিনি নির্বাচিত হতে দিতে চান না। তার পরিবর্তে একজন দেশপ্রেমিকরূপী কবিকে কল্পনা করেন মন্ত্রী হিসেবে। আর বিরোধী দলের প্রধানও যদি হন একজন গায়ক তবে সেতো মানুষের মননকে জাগায় গানের সুরে। তার পক্ষে সম্ভবপর নয় হরতাল বা নৈরাজ্য করে মানুষের কষ্ট বাড়িয়ে দেয়া। তাই সীমান্তগুলো পাহারা দিবে আমাদের প্রাকৃতিক বন্ধু শিল্পিত অবয়বের মৎস্যকুল।
কবি বরাবরের মতো তার প্রেমিকাকে অভয় দিয়ে বলছেন, দেশের অর্থনৈতিক মন্দা তিনি হতে দেবেন না। তার স্থলে শিল্পোন্নত কবিতার সংখ্যা বেড়ে যাবে। আর যদি তা বেড়ে যায় মানুষ কবিতায় বুঁদ হবে। ভুলে যাবে হিংষা-দ্বেষ। শত্রæ হবে মিত্র। হন্তারক আর হাতে করে বয়ে বেড়াবে না কৃপাণ। কবিতার বই হাতে আওড়াতে থাকবে পরিবর্তনের আহ্বানের শিল্পিত পঙ্ক্তিমালা। এটি কবির কাক্সিক্ষত দেশের চিত্রের নমুনা। কবির ভাষায়-

‘ভয় নেই
আমি এমন ব্যবস্থা করবো মুদ্রাস্ফীতি কমে গিয়ে বেড়ে যাবে
শিল্পোত্তীর্ণ কবিতার সংখ্যা প্রতিদিন
আমি এমন ব্যবস্থা করবো গণরোষের বদলে
গণচুম্বনের ভয়ে
হন্তারকের হাত থেকে প’ড়ে যাবে ছুরি, প্রিয়তমা।’
(‘তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা’)

প্রত্যেক পর্বের শুরুতে ‘ভয় নেই’ বলে প্রারম্ভ। আর কেন ভয় নেই সেটার ব্যাখ্যা বা সমাধান টেনেছেন কবি সেই পর্বের মাঝেই। তার এই কবিতায় নাগরিকবোধ, সচেতনতাবোধ, রাজনৈতিকবোধ, সমকালীনবোধ এবং অবশেষে দেশপ্রেম সবই মহৎ শিল্পোত্তীর্ণ কবিতার পরিচয় প্রকাশ করেছে। এই ধরনের কবিতার মাধ্যমে নতুন রূপ, রং ও গন্ধ দিয়েছেন তিনি বাংলা কাব্যসাহিত্যকে।
আগামীকাল ১৪ আগস্ট কবির জন্মদিন। শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়