সবুজ বাংলাদেশকে সবুজতর করার আহ্বান আইজিপির

আগের সংবাদ

হুমকির মুখে রোহিঙ্গা জাতিসত্তা : বিশ্বব্যাংক ও জাতিসংঘের প্রস্তাব নিয়ে কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের অভিমত

পরের সংবাদ

লেখাকেই আরাধ্য করেছেন রিজিয়া রহমান

প্রকাশিত: আগস্ট ১৩, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: আগস্ট ১৩, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

রিজিয়া রহমান একজন ব্যতিক্রমী কথাসাহিত্যিক। সাহিত্য আসর, বক্তৃতামঞ্চ, টেলিভিশন, বিদেশযাত্রায় তাকে তেমনভাবে দেখা যায়নি। আমন্ত্রণ পেলে সবিনয়ে ফিরিয়ে দিতেন। বিশ্বাস করতেন লেখকের কাজ লেখা। আপনমনে লিখে গেছেন একের পর এক অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ভিন্নধর্মী লেখা। তার প্রতিটি লেখাই আলাদা। নির্মাণ ভঙ্গি এবং বিষয়বৈচিত্র্য স্বতন্ত্র।
তিনি ছিলেন আত্মমর্যাদাশীল। এ দেশে আত্মপ্রত্যয়ী আর আত্মমর্যাদাশীল লেখকের বড় অভাব। লেখকরা আজ ধরনা দেয়া আর গোত্রভুক্ত হবার প্রতিযোগিতায় মেতেছে। পদবি, পুরস্কার, চেয়ার, প্রশংসা পাবার উন্মাদনায় মত্ত। এই অস্থির আর অরাজক সময়ে আপা লিখেছেন লেখাকে ভালোবেসে। শান্ত স্থির অবিচল থেকে, সব প্রলোভনকে ডিঙিয়ে, এই লেখক তার অপরিসীম প্রজ্ঞা, মেধা আর ক্ষুরধার লেখনী দিয়ে সৃষ্টি করেছেন অজেয় সব লেখা। লেখার আগে প্রচুর পড়েছেন। তৈরি করেছেন বীজতলা। অঙ্কুরোদগম হবার আগেই ফুল ফোটাবার, ফল ফলানোর চেষ্টা করেননি।
রিজিয়া রহমানের জন্ম ভারতের কলকাতার ভবানীপুরে ১৯৩৯ সালের ২৮ ডিসেম্বর। পারিবারিক নাম জোনাকী। পিতা আবুল খায়ের মোহাম্মদ সিদ্দিক একজন চিকিৎসক। মা মরিয়ম বেগম গৃহিণী। দাদা মুন্সী আব্দুল খালেকের লেখাপড়ার অভ্যাস ছিল। সেলফ ভর্তি ছিল ইংরেজি ও ফারসি বই। বাবা সংগীত অনুরাগী ছিলেন। এসরাজ ও বাঁশি বাজাতেন, উচ্চাঙ্গ সংগীত শুনতেন। মা সায়গল জগন্ময় মিত্র ও কানন বালার গান শুনতেন। দেশ বিভাগের পর বাংলাদেশে চলে আসেন। প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় ফরিদপুরে। সে সময় শখের বশে কবিতা লিখতেন। ১৯৫০ সালে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় তার লেখা গল্প ‘টারজান’ সত্যযুগ পত্রিকার ছোটদের পাতায় ছাপা হয়। ১৯৬০ সালে দৈনিক ইত্তেফাকের সাহিত্য পাতায় তার লেখা গল্প ও সংবাদে কবিতা ছাপা হয়। প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘অগ্নিস্বাক্ষরা’ প্রকাশিত ১৯৬৭ সালে। প্রথম উপন্যাস ‘ঘর ভাঙা ঘর’ প্রকাশিত হয় ১৯৬৭ সালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এমএ করেন। কয়েক বছর চাকরি করার পর ছেড়ে দিয়ে নিরলস সাহিত্যচর্চায় নিবেদিত ছিলেন আমৃত্যু। সাহিত্যে অবদানের জন্য পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদকসহ অনেক পুরস্কার। তবে আজো তিনি স্বাধীনতা পদক পাননি। যেটা অনেক আগেই তার প্রাপ্য ছিল।
রিজিয়া রহমান অসাধারণ মানবিক, শক্তিমত্ত আর শেকড়সন্ধানী লেখক। আমার আজকের এই লেখা যেমন তার লেখা নিয়ে তেমনি ব্যক্তি স্মৃতি নিয়েও।
‘রক্তের অক্ষর’ পতিতাপল্লীর মেয়েদের নিয়ে লেখা একটি মানবিক উপন্যাস। ‘ঘর ভাঙা ঘর’ বস্তিবাসীর জীবন নিয়ে লেখা। ‘শিলায় শিলায় আগুন’ ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বেলুচিস্তানের স্বাধীনতাকামী মানুষের বিদ্রোহ আর কারাতের যুদ্ধের পটভূমিকায় লেখা। এ কাহিনীর মধ্য দিয়ে তিনি পৃথিবীব্যাপী স্বাধীনতাকামী মানুষের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। ‘একাল চিরকাল’ সাঁওতালদের জীবন নিয়ে লেখা। বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি যখন খনন করা হচ্ছিল তখন একজন নারী রিজিয়া রহমানকে প্রশ্ন করেছিল, ‘তোমাদের এই খনি থেকে কি ভাত উঠবে?’ এক থালা ভাতই যাদের আরাধ্য আর সেই এক থালা ভাত যারা পায় না সেই অন্ত্যজ নারী-পুরুষ রয়েছেন রিজিয়া আপার লেখার বিরাট অংশজুড়ে। ‘সূর্য সবুজ রক্ত’ চা বাগানের শ্রমিকদের জীবনের আনন্দ দুঃখ সংগ্রাম বঞ্চনার গল্প। ‘অলিখিত উপাখ্যান’ বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জের ইংরেজ জমিদার মোরেলদের কাহিনী। মোরেলগঞ্জে তাদের আধিপত্য বিস্তার, জমিদার হয়ে ওঠা আর শেষাবধি এ দেশ ছেড়ে পালানোর কাহিনী। ইতিহাসাশ্রয়ী এই উপন্যাসে জনগণের ওপর ইংরেজদের অকথ্য বর্বরতা, নারীলুণ্ঠন, বিলাসিতা আর বাঙালির প্রতিবাদের যে চিত্র ফুটে উঠেছে তা অনন্য। ‘আলবুর্জের বাজে’র কাহিনী দশম শতকের শেষার্ধ থেকে একাদশ শতকের মধ্য পর্যন্ত বিস্তৃত। কাহিনীর পটভূমি সুদূর মরুর দেশ দামেস্ক মাজেন্দ্রান সিরিয়া। উত্তর ইরানের আলবুর্জ পর্বতমালায় শিয়া সম্প্রদায়ের একটা দল গুপ্তহত্যা, আত্মঘাতী, চরমপন্থি একটা দল গড়ে তুলেছিল। তাদের বলা হতো হাশাশিন বা হাশিশ। তারা গঠন করেছিল সুইসাইড স্কোয়াড। জেহাদি আর শহীদ হবার নামে তারা অপরিণত বুদ্ধি, সুঠামদেহী বারো থেকে বিশ বছরের ছেলেদের তুলে আনত বিভিন্ন জায়গা থেকে। প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের এমনভাবে তৈরি করত যে তারা শহীদ হয়ে বেহেশত পাবার জন্য উন্মাদ হয়ে উঠত। এই হাশিশরা মাজেন্দ্রান থেকে তুলে আনে কারা তুগানকে। তুগানকে তারা বশ মানাতে পারে না। অনেক ঘটনার পর একদিন দুর্গ থেকে বেরিয়ে আসে এই দুর্র্ধর্ষ তুর্কি যুবক। লক্ষণীয়, পৃথিবীব্যাপী ধর্মের নামে সন্ত্রাস আজো চলছে। আজো শহীদ হবার টোপ ফেলে অসংখ্য যুবককে এক শ্রেণির ধর্মব্যবসায়ী ব্যবহার করছে। তাই রিজিয়া রহমানের এই উপন্যাস আজো সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। ‘আবে রওয়াঁ’ মসলিনের বিস্তারের গল্প। একই সাথে এ গল্প ঢাকা শহরের বিস্তারের, পৃথিবীব্যাপী বণিকদের মসলিন, শঙ্খ, সোরার খোঁজে ঢাকামুখী হবার গল্প। আবে রওয়াঁ মসলিনের এক নাম। মসলিনের কারিগরদের দুঃখী, অভাবী কষ্টকর জীবনের চিত্র এঁকেছেন রিজিয়া রহমান। তুলে এনেছেন নবাবদের ভোগ বিলাসিতা, স্বেচ্ছাচারিতা, মানুষকে অবদমিত রাখা ও নৃশংসতার চিত্র। ‘পবিত্র নারীরা’ উপন্যাসে পাহাড়ি আদিম এক জনপদে নারীর শাসন একই সাথে নারীর অপমানও দেখানো হয়েছে।
উপন্যাস ছাড়াও গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, রম্যরচনা ও শিশুসাহিত্যে তার অবাধ বিচরণ। উত্তর পুরুষ, তৃণভূমির বাইসন, তোমাদের জন্য ভালোবাসা, উৎসে ফেরা, কাছেই সাগর, বাঘবন্দি তার অসামান্য লেখা। লিখেছেন ‘অভিবাসী আমি’ ও ‘নদী নিরবধি’ নামে দুটি আত্মজীবনী।
তার লেখার সাথে আমার পরিচয় রক্তের অক্ষরের মাধ্যমেই। তারপর উন্মুখ হয়ে থাকতাম তার নতুন লেখার জন্য, নতুন বইয়ের জন্য। বই পেলে ক্ষুধার্ত মানুষ যেমন করে হুমড়ি খেয়ে খাবারের উপরে পড়ে আমি সেভাবেই পড়তাম। পড়তাম আর ভাবতাম, ‘আহা যদি কোনোদিন এই লেখকের সাথে আমার আলাপ হতো, আমি ধন্য হয়ে যেতাম।’ আলাপ হলো, তার ভালোবাসা পেলাম। তার লেখার বিষয়বৈচিত্র্য, অন্তর্দৃষ্টি, জীবন অন্বেষণ, ইতিহাসমনস্কতা, নৃতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ, অতীত অনুসন্ধান, বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সম্মিলন, মুক্তিযুদ্ধ আমাকে মুগ্ধ করল। তার প্রজ্ঞা মেধা জ্ঞানের কাছে আমি বরাবর নতজানু হয়ে রইলাম। পড়তাম আর ভাবতাম, এমন লেখাই তো দরকার যা মানুষের জীবনধারা বদলে দিতে পারে।
রিজিয়া রহমানের ‘রক্তের অক্ষর’ পতিতাপল্লীর মেয়েদের নিয়ে লেখা। তাদের আনন্দ, দুঃখ-বেদনা, হতাশা, অনিশ্চয়তা, অন্তর্দ্ব›দ্ব, অস্তিত্বের সংকট, মুক্তির আর্তনাদ, প্রতিবাদ, দ্রোহ, আত্মবলিদান খোদিত হলো রক্তের অক্ষরের পাতায় পাতায়। রাতের অন্ধকারে যারা মুখ ঢেকে ওখানে যায় আর দিনে সফেদ পাঞ্জাবি পরে দোয়া দরুদ আউড়ায় তাদের স্বরূপ উন্মোচন করলেন রিজিয়া রহমান। এই মেয়েদের কষ্ট যাতনা ভালোবাসা সহমর্মিতার চিত্র যেমন পেলাম তেমনই পেলাম ক্রেতা ও মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য, অত্যাচার। ইয়াসমিনের প্রতিবাদ, মেয়েদের পরস্পরের পাশে দাঁড়ানো আমাদের উদ্বেলিত করল। ইয়াসমিনের মুষ্টিবদ্ধ হাত আমাদের হাত মুষ্টিবদ্ধ করল। একজন নারী লেখকের হাত ধরে পতিতাদের গল্প প্রকাশ্যে এলো। সময় ১৯৭৮ সাল, রিজিয়া রহমানের বয়স ৩৪ বছর। তার কলমের মায়াবী ছোঁয়ায় ইয়াসমিন কুসুম আর পল্লীর অসহায় মেয়েগুলোকে আমাদের বোন, আমাদের ঘরের মেয়ে মনে হলো। ঘৃণার বদলে মায়ায় ভরে উঠল বুক।
রিজিয়া রহমানের বহুল পঠিত উপন্যাস বং থেকে বাংলা। বিশালাকার এই উপন্যাসে তিনি বাংলা ভূখণ্ডের জন্ম, জাতিগঠন, বাংলা ভাষা সৃষ্টি, ভাষার বিবর্তন থেকে শুরু করে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় পর্যন্ত কাহিনীর বিস্তার ঘটিয়েছেন। উপন্যাসের প্রধান দুটি চরিত্রের নাম চমৎকার। আড়াই হাজার বছর আগের বং গোত্রের নাম থেকে বং আর এলা। এই নিয়ে বাংলা। তবে এর মূল কথা অন্য। বাংলার সাধারণ মানুষ চিরকালই ছিল অবহেলিত, উপেক্ষিত ও উৎপীড়িত। জাতি হিসেবে সামাজিক, অর্থনৈতিক, গণতান্ত্রিক মর্যাদা তারা কোনোদিনই পায়নি। আসলে গরিব মানুষের বঞ্চনার ইতিহাস বদলায় না। সমাজ কাঠামোর জাঁতাকলে পড়ে এগিয়ে যায় একইভাবে। ‘বং থেকে বাংলা’ উপন্যাস ইতিহাসের পাশাপাশি সেই কথাটিই প্রকাশ করেছে। প্রকাশ করেছে একটি জাতির ঘুরে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতার মর্যাদায় এসে দঁাঁড়ানোর গল্প। তাই একটি জাতির জাগরণের ইতিহাস ‘বং থেকে বাংলা’।
নদীমাতৃক বাংলাদেশের সূচনা আনুমানিক তিন লাখ বছর আগে। তৃতীয় হিমবাহর সময়ে অর্থাৎ শেষ প্লাইস্টোসিন যুগ থেকে বর্তমান নদী মেখলা পলল সমৃদ্ধ ভূমি বাংলাদেশের উৎপত্তি। বাংলাদশের নৃতাত্ত্বিক গঠন অনুসারে অস্ট্রো-এশিয়াটিকের একটি শাখা ছিল স্থলের অধিবাসী। আরেকটি শাখা নৌকায় বসবাস করত। এরা বেদে বা বাইদ্যা নামে পরিচিত। মৌর্য, তুর্কি, মোগল, ব্রিটিশ, পাকিস্তানি সবাই এ দেশকে লুণ্ঠন করেছে। বিভিন্ন জাতির শাসনে একটু একটু করে বদলে গেছে এই অঞ্চলের মানুষ, তাদের ভাষা, তাদের সংস্কৃতি।

দশটি অধ্যায়ের দশটি গল্পের ‘বং থেকে বাংলা’ উপন্যাসের দিকে নজর দিতে পারি আমরা। গল্প এক. আনুমানিক তিন হাজার বছর আগের কথা। প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর এক ভূমি যাযাবর আর্যদের নজরে পড়ল। আর্যরা অশ্বারোহী। তাই আত্মরক্ষার তাগিদে একদল সমুদ্রচারী হলো। সমুদ্র দেবতাকে সন্তষ্ট করার অভিপ্রায়ে দেবতার আহারের জন্য সমুদ্রচারীদের মধ্য থেকে তারা যুবক বং আর যুবতি এলাকে সমুদ্রে ফেলে দিল। কিন্তু দেবতা বং আর এলাকে আহার করলেন না। বরং দিলেন সুজলা-সুফলা ভূমি। ঘুরতে ঘুরতে একদিন বং-এলার একদিন পরিচয় হলো একদল বাইদ্যার সঙ্গে। যাদের মধ্যে আছে কৈয়ারত আর পাইককী। পাইককী মনে মনে ভালোবেসে ফেলল বংকে। ওদিকে এলাও বংকে চায়। গল্প দুই. গল্প দেড় হাজার বছর আগের কথা। বঙ্গ আলালের প্রধান বাইদ্যা ভুলু, তার তৃতীয় পক্ষের বউ বুইনী, ভুলুর ছেলে কালু নৌকায় জীবনযাপন করত। একদিন তারা এলো এই বঙ্গআলে। নদীর পাড়ের আলঘেরা জমিতে তারা ধান আর কার্পাস চাষ করল। উত্তরদেশীয় কেরাতভূমি থেকে নমসিন নামে এক বিদেশি আসলো বাণিজ্য করতে। বুনো মহিষের শিং-এ গেঁথে প্রাণ হারালো ভুলু। এবার কালু বঙ্গআলের প্রধান হতে চাইলো। সবাই মেনে নিলেও বাধা দিলো বুইনী। গল্প তিন. এ গল্প বৈদিক সভ্যতার। আর্যযোদ্ধা মহাবীর ভীম তার অশ্বারোহী সেনাবাহিনী নিয়ে হানা দিল সমতটের (বাংলা) প্রান্তে।
গল্প চার. গল্পের সময়কাল ১৬৫০ বছর আগের। মৌর্যবংশের স¤্রাট অশোক কলিঙ্গের সময়কাল থেকে গুপ্তবংশের স¤্রাট সমুদ্রগুপ্তের শাসনকাল পর্যন্ত এ গল্প বিস্তৃত। তখন সমতটে বৌদ্ধধর্ম বিশেষ প্রাধান্য পেয়েছিল। গল্প পাঁচ. গল্পের সময়কাল সপ্তম থেকে অষ্টম শতাব্দী। তখন আরব বণিকেরা চট্টগ্রামে ব্যবসা করতে আসতেন। গৌড়াধিপতি শশাঙ্ক স্বাধীন নৃপতি থেকে ‘মহারাজাধিরাজ’ উপাধি পেয়েছিলেন তখন। গল্প ছয়. সময়কাল সেনরাজাদের রাজত্বকাল। এ দেশে তখন শুধু আরব বণিকই নয়, দলে দলে পীর আউলিয়া আসছিলেন। বঙ্গালরা সেনদের ব্রাহ্মণ্য প্রতাপের অপব্যবহারে ও অন্যায়ে অতিষ্ঠ হয়ে তাদের নিশ্চিহ্ন করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। গল্প সাত. সময়কাল ত্রয়োদশ শতাব্দী। তুর্কিরা এ দেশে রাজত্ব বিস্তার করে। ইলিয়াসশাহী বংশের নাসিরুদ্দিনের পুত্র রুকনউদ্দিন বারবাক শাহ আবিসিনিয়া থেকে বিরাট এক হাবসী ক্রীতদাস বাহিনী নিয়ে আসেন আভিজাত্যের নিদর্শনস্বরূপ। এটা ছিল বাংলার জন্য কলঙ্কিত সময়। সৈয়দ আলাউদ্দিন হুসেন শাহ হাবসী রাজত্বের অবসান ঘটিয়ে বাংলার শাসনকর্তা নিযুক্ত হন। গল্প আট. সময়কাল মোগল সা¤্রাজ্যের শুরু থেকে শেষ। পাঠান যুগের অবসান ঘটিয়ে মোগলরা দিল্লিতে আধিপত্য বিস্তার করে। তখন বহুসংখ্যক পাঠান এ দেশে এসে আশ্রয় নেয়। এক পর্যায়ে বিদ্রোহ করে। মোগল সা¤্রাজ্যের সমাপ্তি ঘটে। বঙ্গাল দেশের নাম তখন বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। এমন সময় আসে ইংরেজ বণিকরা। গল্প নয়. সময়কাল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দুইশ বছর শাসন। এই গল্পে ইংরেজ আর জমিদারদের অন্যায় অত্যাচারের চিত্র আর একই সাথে নীলচাষিদের বিদ্রোহের কথা বর্ণিত হয়েছে। ফুটে উঠেছে সাধারণ জনগণদের সশস্ত্র বিদ্রোহের কথা। গল্প দশ. সময়কাল দেশ বিভাগের পর থেকে স্বাধীনতা অর্জন পর্যন্ত। সাবের সাহেব, তার একমাত্র পুত্র আনোয়ার, পুত্রবধূ জমিলা, নাতি মিন্টু, সহকর্মী ইসলাম সাহেব এদের নিয়ে গল্পটি বুনেছেন লেখক। জিন্নাহ সাহেব, রাষ্ট্রভাষা উর্দু করার ঘোষণা, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ মর্মে জনতার দাবি আন্দোলন সবই আছে গল্পের পরতে পরতে। পাকিস্তান সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে। ছাত্র-জনতা সেই ১৪৪ ধারা ভেঙে আন্দোলনে নামল। ছাত্র-জনতার ওপর অঝোর গুলিবর্ষণ হলো। এগিয়ে গেল আন্দোলন। গণআন্দোলন স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপ নিল। এলো ১৯৭১-এর ২৫ মার্চের কালরাত্রি। তারপর এলো স্বাধীনতা, কাক্সিক্ষত স্বাধীন দেশ।
দশটি গল্পে সাড়ে তিন হাজার বছর আগের প্লাইস্টোসিন যুগ থেকে নিটোল হাতে বিনুনি গেঁথে সে বিনুনি শেষ করলেন এ জাতির মহান অর্জন একাত্তরের স্বাধীনতায় এসে।
দুই বাংলার দুজন খ্যাতিমান লেখকের সান্নিধ্য পাবার সুযোগ হয়েছিল আমার। রিজিয়া রহমান ও মহাশ্বেতা দেবী। ‘হাজার চুরাশির মা’, ‘অরণ্যের অধিকার’, ‘চট্টী মুণ্ডা ও তার তীর’ মহাশ্বেতাদিকে অমর করে রাখবে। মহাশ্বেতা দেবী আদিবাসীদের নিয়ে কাজ করতেন। আদিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য মামলা করে তিনি ভারডিকটও পেয়েছিলেন। রিজিয়া রহমানের লেখার বড় অংশজুড়ে আছে আদিম আর অন্ত্যজ মানুষ। তিনি ইতিহাসাশ্রয়ী। তিনি একবার আমাকে বলেছিলেন, ‘আমার প্রিয় বিষয় ইতিহাস আর নৃতত্ত্ব। ইতিহাস বা নৃতত্ত্ব পড়তে চেয়েছিলাম। কীভাবে যে অর্থনীতি পড়ে ফেললাম সেটা ভাবলে নিজেই অবাক হই।’ আমি অর্থনীতির ছাত্রী। অর্থনীতি নিয়ে তার সাথে আলোচনা হয়েছে একাধিকবার। দেখেছি, তার অর্থনীতি জ্ঞান যে কোনো ভালো অর্থনীতিবিদের মতোই। বিবিধধর্মী লেখাপড়ার কারণে তার রচনায় সন্নিবেশ ঘটেছে ইতিহাস নৃতত্ত্ব অর্থনীতি রাজনীতি সংস্কৃতি লোকজ উপাদানসহ ভিন্নধর্মী উপাদানের। অনেকে মহাশ্বেতা দেবীর সাথে রিজিয়া রহমানের তুলনা করেন, করছেন। রিজিয়া আপা কারো সাথে তুলনীয় নন। তিনি একক, অনন্য, নিজ গুণে বিশিষ্ট। মহাশ্বেতা দেবীও নিজগুণে অসামান্য।

জীবনে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে আপাকে। কষ্টও পেয়েছেন অনেক। অকালে স্বামীকে হারিয়েছেন। চোখের অসুখে ভুগেছেন দীর্ঘদিন। বুড়িগঙ্গায় এক মর্মান্তিক ট্রলার ডুবিতে একসাথে হারিয়েছেন পরিবারের ১১ জনকে। সেই মর্মান্তিক কষ্ট নিয়ে জীবন কাটিয়েছেন। কিন্তু অদম্য তিনি, থেমে যাননি। আর সেই ১১ জনের মধ্যে একজন তার এক নাতনির কবরেই সমাধিস্থ করা হয়েছে তাকে।
রিজিয়া আপার সাথে আমার পরিচয় লেখক সাংবাদিক বেবী মওদুদের মাধ্যমে। তারপর বেবী আপা, লেখক সাংবাদিক দিল মনোয়ারা মনু, কবি রুবি রহমান, আপার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী শর্মিলী আহমেদসহ (লিলি) কাটিয়েছি অনেক আনন্দময় সময়। আপার শেষ জন্মদিনে গিয়েছিলাম। আপা ফোন করে বলেছিলেন, ‘তপু (আপার ছেলে) তোমাকে দাওয়াত দিয়েছে। বলেছে আফরোজা খালাকে অবশ্যই বলবে।’ সে দিন খুব হৈ চৈ আনন্দ আর খাওয়া-দাওয়া হয়েছিল। খুব কাছ থেকে দেখেছি তাকে। পেয়েছি তার নিবিড় সান্নিধ্য। আপার জীবনের শেষ পনেরো বছরের খুব অল্প দিন ছিল যেদিন তার সাথে কথা হয়নি। দুদিন ফোন না করলেই ফোন করে বলতেন, ‘অনেকদিন ফোন করোনি। ভালো আছ তো? নির্লোভ সদাচারী ধার্মিক ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এই মানুষটির মন ছিল শিশুর মতোই নরম, কোমল। সহজে অন্যকে আপন করে নিতে পারতেন। তবে ভালোবাসতেন আত্মমর্যাদাশীল মানুষকে। পরিশ্রমী এই লেখক ফাঁকিবাজি, আত্মপ্রবঞ্চনা আর শর্টকাট রাস্তায় চলা মানুষকে মোটেও পছন্দ করতেন না। খেতে আর খাওয়াতে ভালোবাসতেন। আমি ছিতরুটি খেতে ভালোবাসি বলে আমার জন্য ছিতরুটির ব্যবস্থা রাখতেন। অকপটে মন খুলে বলতেন অনেক কথা। বাংলাদেশের লেখকদের ওপরে ওঠার প্রতিযোগিতা নিয়ে তার মনে অসন্তোষ ছিল। বলতেন, ‘কখনো প্রলোভনের পেছনে দৌড়াবে না। নিমগ্ন হয়ে লিখবে আর পড়বে। মনে রাখবে লেখাই তোমার কাজ।’ তাকে যে প্রাপ্য সম্মান দেয়া হলো না তা নিয়ে একবারের জন্যও আফসোস বা আক্ষেপ করতে দেখিনি। বরং একুশে পদক পাবার পর বিব্রত হতে দেখেছি।
২০১৯ সালের ১৬ আগস্ট তিনি প্রয়াত হয়েছেন। তার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
চিরশান্তিতে থাকুন আপা! অনেক ভালোবাসা, অনেক আলিঙ্গন!

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়