সবুজ বাংলাদেশকে সবুজতর করার আহ্বান আইজিপির

আগের সংবাদ

হুমকির মুখে রোহিঙ্গা জাতিসত্তা : বিশ্বব্যাংক ও জাতিসংঘের প্রস্তাব নিয়ে কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের অভিমত

পরের সংবাদ

রাত আঁধারে

প্রকাশিত: আগস্ট ১৩, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: আগস্ট ১৩, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

চরসিন্দুর বাজার থেকে বের হয়ে রউফ খান যখন বাড়ির উদ্দেশে যাত্রা করেন তখনো বেশখানিকটা তেজ ধরে রেখেছে শীতকালের সূর্যটা। হেঁটে ফিরছিলেন তিনি। দুপুরবেলা বাড়ি থেকে আসার সময় সঙ্গে ছিল জয়নাল। বাজারে এসে টুকিটাকি এটা-সেটা কেনাকাটার পর জয়নালের হাতে পঞ্চাশটা টাকাও দিয়েছিলেন তিনি। জয়নালের দাবি ছিল আরেকটু বেশি। কিন্তু সেটি না পাওয়ার ক্ষোভেই কিনা এক পর্যায়ে হাওয়া হয়ে যায় জয়নাল। অনেক খোঁজাখুঁজির পরও তাকে না পেয়ে একাই বাড়ির উদ্দেশে যাত্রা রউফ খানের। চরসিন্দুর থেকে মাইলখানেক পেরিয়ে মরাডাঙার বিলের কাছে আসতেই ঝুপ করে সন্ধ্যা নেমে যায়। মিঠে আলোর সূর্যটা বিদায় নিলে চারপাশটা দখল করে নেয় তীব্র কুয়াশা। এক হাত দূরেও কিছু দেখা যায় না। অথচ আকাশে পূর্ণ চাঁদের জোছনা। এমন জোছনায় রুপার পাতের মতো চকচক করার কথা রাস্তাটা। কিন্তু আজ সবকিছুই ধূসর, ঝাপসা। মরাডাঙার ঈদগাহের ঠিক আগে আগে ঝাঁকড়া বটগাছটা হাতের ডানে রেখে একটু সামনে এগিয়ে গেলে ছোট্ট একটা পুল, নিচ দিয়ে বয়ে চলেছে মরাডাঙা খাল, সেই পথ ধরে এগিয়ে যেতে হবে আরো মাইল আড়াই অথবা তার কিছুটা বেশি তারপরেই রউফ খানের বাড়ি। অথচ আজ এই কুয়াশা মোড়া সন্ধ্যায় কিছুই ঠাহর হয় না ঠিকমতো। কোথায় বটগাছ- যার নিচে সব সময় বাঁধা থাকতো মুচিদের বেশকিছু শুয়োর। তাদের হুমহাম শব্দ শোনা যেতো সব সময়। কোথায় মরাডাঙার পুল, কোথায় ঈদগাহ- কিছুই নজরে আসছে না। পথ হারিয়েছেন রউফ খান। পথ খুঁজে হয়রান হচ্ছেন রউফ খান।
হয়রান রউফ খান এক সময় বসে পড়েন পথের ধারে। বসে পড়লে পরে শরীরে ঠেকে শক্ত কোনো একটা বস্তু। এই রাত আঁধারে রউফ খান বুঝতে পারেন না- একটা গাছের শেকড়ের ওপর বসেছেন তিনি। ক্লান্ত বিধ্বস্ত রউফ খানের তন্দ্রামতো আসে। মনে পড়ে একাত্তরের কথা। একাত্তরের এক শীত রাতে এই মরাডাঙায়, খালের জলে বসে ছিলেন সারারাত। সেই রাতেও ছিল জবর কুয়াশা। তবে বরফ ঠাণ্ডা খালের জলে থেকেও কোনো শীত অনুভূতি ছিল না। তন্দ্রা আসার প্রশ্নই ওঠেনি সেদিন। শুধু অতন্দ্র অপেক্ষার রাত ছিল সেটি। বাজপাখির তীব্রতায় শিকারের আশায় বসে থাকার রাত ছিল সেটি। শেষ রাতের দিকে আসে লাইন ধরে একে একে তিনটি কনভয়- প্রতিটিতে আটজন করে মোট ২৪ জন জওয়ান। আর তিন গাড়ির তিন ড্রাইভার। মোট ২৭ জনের বহর। রউফ খানদের দলের কমান্ডার ছিল ২২-২৩ বছরের সাত্তার। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া বাচ্চা ছেলেটির কি তুখোড় তেজ! সংকেত আগেই ঠিক করা ছিল। পাকিস্তানিদের গাড়ি নাগালের মধ্যে আসলে প্রথমে ফায়ার ওপেন করবে ফজলু। যে কিনা পুরো দলটা থেকে ২৫ গজ দক্ষিণে বটগাছটার নিচের ঢালু জমিতে বসে ছিল অ্যামবুশ নিয়ে। ফজলুর ফায়ারে আতঙ্কিত পাকিস্তানি সৈন্যরা নজর দেবে সেদিকে। আর এই ফাঁকে গর্জে উঠবে রউফ খানদের অস্ত্র। কাজ হয়েছিল একেবারে পরিকল্পনা মতো। ভোরের আলো ফোটার পর রউফ খানরা গুনে গুনে দেখেছিলেন সাতটি লাশ পড়েছিল। তিনটি গাড়ির একেবারে পেছনেরটা ব্যাক গিয়ার দিয়ে কোনোমতে পালিয়ে বেঁচেছিল। এই অপারেশনের পর রউফ খানরা সরে গিয়েছিলেন মরাডাঙা থেকে অনেক দূরে। তবে খবর শুনেছিলেন- অপারেশনের দুদিন পর পাকিস্তানি সৈন্যরা এসেছিল এই এলাকায় রব লটবহর নিয়ে। আশপাশের বাড়িঘরে আগুন দিয়েছিল। আর মুক্তি কোথায়! কোথায় মুক্তি বলে চিৎকার-চেঁচামেচি করে লুট করে নিয়েছিল মুচিদের বেশকটি ছাগল এবং হাঁস-মুরগি। সেদিন পাকিস্তানিদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল বাতেন রাজাকার। তার তখনকার ক্লাস সেভেনপড়ুয়া ছেলে এখন মুক্তিযোদ্ধা। রাজনীতির খাতায় নামও লিখিয়েছে। এসব নিয়ে অবশ্য রউফ খান কখনো ভাবেননি। এখনো ভাবছেন না। শুধু মনে পড়ছে তারা তখন নতুন ক্যাম্প করেছেন মেথিকান্দা বাজার থেকে আড়াই মাইল উত্তরের এক জঙ্গলে। এক রাতে সেই ক্যাম্পে হাজির মরাডাঙার মুচি সুহাস ডোম। উদভ্রান্তের মতো চেহারা। সারাক্ষণ চোলাই মদ খায় বলে সুহাসের চোখ এমনিতেই লাল হয়ে থাকে। সেদিন যেন আরো লাল। হারিকেনের আলোয় রউফ খান দেখতে পান আগুন ঝরছে যেন তার চোখ থেকে। তবে দুয়েক মিনিট পরেই সেই আগুন লাল চোখ থেকে নামে জলের ধারা। শীতলক্ষ্যার সব জল যেন গড়িয়ে পড়ছে সুহাসের চোখ থেকে।
-দাদা গো আমার সবশেষ! সবশেষ। বউডারে তুইল্যা লইয়া গ্যাসে। ১২ বছরের মাইডারেও ছাড়ে নাই।
বুক ভেঙে আসে রউফ খানের। বাজারে যাওয়ার পথে কতদিন সুহাসকে বসে থাকতে দেখেছেন বটগাছের নিচে। সব সময়ই বাড়ি যেতে অনুরোধ করতো সুহাস। কিন্তু কখনো যাননি রউফ খান। মুচির বাড়িতে গেলে সমাজে মান-সম্মান থাকবে না- এমন একটা মিথ্যে অনুভূতি সবসময় জেগে থাকতো মনের মধ্যে। অথচ আজ এই ক্যাম্পে কোথায় সেই জাতপাত! কোথায় সেই ছোঁয়া বাঁচিয়ে চলার তাগিদ? একাত্তরের বিশাল এক মোহনায় এসে সব মিশে গেছে একস্রোতে। হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ-খ্রিস্টান, ডোম-চণ্ডাল, চোর-সাধু, ভালো-মন্দ- সব মানুষ আজ এক কাতারে। আরেক কাতারে দাঁড়িয়ে আছে বাতেন রাজাকারের মতো কিছু অমানুষ। সেদিনের সেই রাতে সাত্তার কমান্ডার সুহাসকে ভর্তি করে নিয়েছিলেন রউফ খানদের মুক্তিযোদ্ধা দলে। অল্প কিছুদিনেই দুর্র্ধর্ষ গেরিলা হয়ে উঠেছিল সুহাস ডোম। তবে কমান্ডার সাত্তার দেখে যেতে পারেননি অমিত সাহসী যোদ্ধা সুহাসকে। নীলক্ষার অপারেশনে গুলি লেগেছিল সাত্তার মণ্ডলের কোমরের নিচে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাত্তারকে উদ্ধার করেছিল সুহাস ডোম। রউফ খানরা তখন ব্যস্ত শত্রæপক্ষকে ঠেকিয়ে রাখতে। কোথাকার কোন সাত্তার মণ্ডল- রউফ খানের প্রায় ছেলের বয়সি। মেলাঘর ক্যাম্প থেকে ট্রেনিং শেষে দেশে ফেরার পথে রউফ খানদের দলনেতা হিসেবে নির্বাচন করে দেয়া হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া সাত্তারকে। এরপর সুখে-দুঃখে, বৃষ্টি-রোদে, শীতে-গরমে এক সঙ্গে কেটেছে সাতটি মাস। কিন্তু সাত্তার মণ্ডলের বিস্তারিত জানার সুযোগ হয়নি কখনোই। দলের মধ্যে রউফ খান ছিলেন সবচেয়ে বয়সি ব্যক্তি। তিনিই আগলে রাখতেন সবাইকে। এমনিতে বিশ্রামের সময়, অবসরের সময় রউফ খানকে অনেকটা লজ্জা পেতো, মনে হয় কিছুটা সমীহ করতো সাত্তার মণ্ডল। কিন্তু অপারেশনে গেলে কেমন যেন বদলে যেতো ছেলেটা। কী যেন এক স্বর্গীয় তেজ দেখা যেতো তার চোখে-মুখে। সাত্তার মণ্ডলকে সমাহিত করা হয়েছিল মেথিকান্দার এক কাঁঠাল বাগানের বুনো ফুলের ঝোপের পাশে। ফুল বড় ভালোবাসতো ছেলেটা! ইস্পাত কঠিন রউফ খান- এই কয় মাস বাড়ি ছেড়ে থাকছেন। ছেলে, মেয়ে, বউ, বাবা, মা কারো জন্য এক ফোঁটা চোখের জল ফেলেননি কোনোদিন। বাড়ির জন্য মন উচাটন হয়নি একবারও। সেই রউফ খান সাত্তারকে সমাহিত করে এসে হাউমাউ করে কেঁদেছিলেন। সে রাতে সবাই ঘুমিয়ে গেলে চুপি চুপি সাত্তারের ব্যাগটা খুলেছিলেন রউফ খান। যদি বাবা-মায়ের ঠিকানাটা মেলে। ছেলের শেষ চিহ্নটুকু পৌঁছে দেবেন তাদের কাছে। কয়েকটা কাপড়-চোপড়, টুকিটাকি কিছু জিনিস, শরৎচন্দ্রের একটা বই আর ছিল দুটি চিঠি। একটি মাকে লেখা। আরেকটি এলাচি নামে এক মেয়েকে। কিন্তু কোনো ঠিকানা লেখা ছিল না। তাই পৌঁছানো হয়নি সেগুলো আর। এখনো সেগুলো আছে রউফ খানের পশ্চিম ঘরের দক্ষিণ-পশ্চিম কোনার কাঠের সিন্দুকটাতে। মাঝে মাঝে নেড়েচেড়ে দেখেন। সাত্তার মণ্ডলের ব্যাগটা খুললে চোখের সামনে যেন খুলে যায় পুরো একাত্তর। সেই মেলাঘর ক্যাম্প। সেই মরাডাঙার শীতের রাত। মেথিকান্দার জঙ্গল। সব যেন এক এক করে হাজির হতে থাকে চোখের সামনে। কী ভয়াবহ দিন! কী আন্দন্দে ভরা দিন! কী দুঃখে ভরা দিন! কী আশাজাগানিয়া দিন! কী বেদনা ভরা দিন! সাত্তার মণ্ডল শহীদ হলো অক্টেবরের ২৭ তারিখ। এর কিছুদিন পর গোখলায় একটা অপারেশনে গিয়ে শহীদ হয় সুহাস। এবার সুহাসের মুখাগ্নি করবে কে? দায়িত্বটা পালন করেন রউফ খানই। ১৬ ডিসেম্বর আসে সেই কাক্সিক্ষত বিজয়। এরপর যার যার বাড়ি ফেরার পালা। কমান্ডার সাত্তার মণ্ডল ছাড়া দলের বাকি সবাই তো ছিলেন আশপাশের গ্রামেরই। সবাই সহি-সালামতে ফিরেন। শুধু কোন অচিন গাঁওয়ের অচিন বাবা-মায়ের সন্তান সাত্তার মণ্ডল শুয়ে থাকে মেথিকান্দার এক কাঁঠাল বাগানের ছায়াঘেরা স্থানে। আর সুহাসের দেহাবশেষ তো ভাসিয়ে দেয়া হয়েছে পুরনো ব্রহ্মপুত্রের জলে। সেই জল বইতে বইতে গিয়ে মিশেছে বঙ্গোপসাগরে। সাগর-নদীর জলে ভাসতে ভাসতে সুহাস মিশে গেছে বাংলার বাতাসে বাতাসে। যেমন মিশে গেছে আরো অনেক অনেক নাম জানা, না জানা শহীদেরা।
তবে পাকিস্তানি ক্যাম্প থেকে জীবন নিয়ে ফিরতে পেরেছিল সুহাস ডোমের স্ত্রী আরতি বালা। ফিরেনি শুধু তার মেয়ে পারুল। সুহাস যেমন মিশে গেছে জলে-বাতাসে। ভুলে গেছে সবাই তার নাম। তেমনই আরতিও যেন বেঁচে থেকেও কারো স্মরণে নেই। সে এখন ভিক্ষা করে বাজার থেকে বাজারে!
সেই যে সন্ধ্যা রাতে পথ হারিয়েছিলেন রউফ খান। এখনো পথ খুঁজে পাননি। বসে আছেন গাছের গোড়ায়। শীত শীত লাগছে তার। রাত কতো হয়েছে এখন? বোঝার চেষ্টা করেন রউফ খান। এখানে আসার পর থেকে এখন পর্যন্ত কতোবার শেয়াল ডেকেছে! তাহলে হয়তো বুঝতে পারতেন রাতের কয় প্রহর পার হলো! কিন্তু কিছুই খেয়াল হয় না তার। কী করবেন রউফ খান? নিজের পরিচিত জায়গায় বেঘোরে মরে থাকতে হবে তাকে?
হঠাৎ বাইসাইকেলের টুং টাং শব্দ কানে আসে রউফ খানের। আর ক্ষীণ একটা আলো। শব্দ এবং আলো দুটোই ধীরে ধীরে কাছে এগিয়ে আসে রউফ খানের। সাড়া দেয়ার চেষ্টা করেন তিনি- কিন্তু আওয়াজ বের হয় না মুখ থেকে। একটা সময় আলোটা খুব কাছে আসলে দেখা যায় মহসিনকে। রউফ খানের নাতি। এগিয়ে নিতে এসেছে তাকে। রউফ খান কোনো কথা বলেন না। নাতির আনা কম্বলটা গায়ে জড়িয়ে বসে থকেন। মহসিন কিছুটা সময় নেয়। দাদা কি পারবেন সাইকেলের পেছনে বসে বাড়ি যেতে? আশপাশে কোনো রিকশাও চোখে পড়ে না। অথচ রাত তখন মাত্র সাড়ে ১২টা।
পুনশ্চঃ পথ হারিয়ে রউফ খানের বসে থাকার ঘটনাটা ঘটেছিল মুক্তিযুদ্ধের ২০ বছর পর। আর গল্পটা আমি শুনি রউফ খানের নাতি মহসিনের কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধের ৪৫ বছর পর। ততোদিনে বাতেন রাজাকারের ছেলে এলাকার জনপ্রতিনিধি হয়েছে। এবং মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় তার নামটাও লেখা আছে। তবে রউফ খান কিংবা সুহাস ডোমের নাম সেই তালিকায় আছে কিনা আমি জিজ্ঞেস করিনি। মহসিনও এ ব্যাপারে কিছুই বলেনি!

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়