সবুজ বাংলাদেশকে সবুজতর করার আহ্বান আইজিপির

আগের সংবাদ

হুমকির মুখে রোহিঙ্গা জাতিসত্তা : বিশ্বব্যাংক ও জাতিসংঘের প্রস্তাব নিয়ে কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের অভিমত

পরের সংবাদ

পারমিতার জগৎ

প্রকাশিত: আগস্ট ১৩, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: আগস্ট ১৩, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

আমি কিছুটা রহস্য করেই বললাম, “তুমি কি মনে করো আমি তোমার ওখানে গেলে এনায়েত আলী খুশি হতেন?” পারমিতা উত্তর করলো, “তাঁর খুশি-অখুশিতে আমার কী যায় আসে! উনি রিকোয়েস্ট করেছিলেন, যেনো তাঁর সফরসঙ্গীদের আমরা আপ্যায়ন করি, তাই তাঁর সম্মান রক্ষা করেছি। তুমি আসলে যদি উনি অখুশি হোতেন, হোতেন! তাছাড়া মাসুমও তোমার কথা জিজ্ঞাস করছিলো বারবার।” আমি আর তর্ক বাড়াতে চাইনি। প্রসঙ্গ এড়িয়ে যেতে তাই বললাম, “আরে বাদ দাও তো ওসব কথা; আসলেই আমার বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিলো, আসতে পারতাম না কিছুতেই।” বিতর্কের ইতি টেনেছিলো পারমিতাই, বলেছিলো, “আচ্ছা বাদ দাও। যা হবার হয়ে গেছে। আগামীকাল সন্ধ্যায় তুমি কিন্তু আমার বাসায় আসবে, কথা আছে অনেক।” পরদিন সন্ধ্যায় যাবার প্রতিশ্রæতি দিয়ে সেদিনের মতো ওকে নিরস্ত্র করতে পারলাম।
পরদিন সন্ধ্যায় পারমিতার বাসায় পৌঁছলাম। পারমিতা আর মাসুম এখন পৃথক বাসায় থাকে, মাসুমদের মূল বাসার কাছেই; এ জায়গাটা মাসুম কিনেছিলো ঢাকায় থাকতেই। ঢাকা থেকে ফেরার পর এখানে একটা একচালা হাফ বিল্ডিং বানিয়ে ওরা উঠেছে। ঢাকাতেও একটা এপার্টমেন্ট কিনেছে; ছেলে-মেয়ে ওখানেই থাকে। ছেলে রাজীব একটা অনলাইন হাউসে চাকরি করে, আর মেয়ে রুনা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে অনার্স পড়ে। আমি যখন পৌঁছলাম মাসুমও বাসায় ছিলো। আমরা একসঙ্গে চা-বিস্কুট খেলাম। মাসুম উঠে বললো, “আমার জরুরি একটা কাজে বাইরে যেতে হবে। তোরা গল্প কর। রাতে খেয়ে যাস সবুজ। আমি চলে আসবো।” মাসুম বেরিয়ে যায়। পারমিতা মাসুমের প্রশংসা দিয়ে নিজের কথা শুরু করে, “মাসুম খুবই ভালো, কাজ ছাড়া কিছুই বোঝে না। সারাদিন কাজ আর কাজ। ব্যবসা নিয়ে ও এতটাই ব্যস্ত থাকে, মাঝে মাঝে আমি হাঁপিয়ে উঠি। সংসার, মাতৃত্ব এসব বিষয়ে আমি খুব যোগ্য নই; তারপরও তো জীবন কাটিয়ে দিলাম আনন্দে। নিজের মধ্যে একটা শক্তিকেই আমি বড় বলে মানি, সেটা হলো, কোনো কষ্টকে গায়ে না মাখা। নইলে তোমাকে ছেড়ে মাসুমকে আমি বিয়ে করতে পারতাম না!” এতক্ষণ আমি মনোযোগ দিয়ে শুনছিলাম পারমিতার কথা, এবার আমি হাসলাম- কথা বললাম, “আমাকে ছেড়ে মানে? আমাকে ধরলে কবে তুমি?” পারমিতা দূরের সোফায় বসে ছিলো, “ইয়ার্কি করো না?” উঠে চায়ের কাপগুলো রেখে আসলো বেসিনে। ফিরে এসে আর দূরের সোফায় বসলো না, আমার পাশে গা ঘেঁষে বসলো। আমার হাতে একটা চকলেট দিয়ে বললো, “তুমি হয়তো আমাকে ভালোবাসার অবকাশ পাওনি, কিন্তু আমি তোমাকে ভালোবাসতাম, তাও তুমি বুঝতে পারোনি? তুমি না কবি, তুমি না দৃশ্যের অধিক দেখতে পাও?” পারমিতার কথায় আমি মৃদু হাসলাম, বললাম, “দৃশ্যের অধিক দেখতে পাই বলেই তো নিজেকে নিরাপদ দূরত্বে রেখেছি। মনে পড়ে আমি তোমার হাত দেখেছিলাম? তোমার হাত দেখেই তো বুঝেছিলাম আমার সাথে তোমার বন্ধুতা হতেই পারে, জুটি নয়। তোমার জীবন তাই আমার কাছে ছিলো সুদূরের দ্বীপ।” ও এবার কাছে থেকে আরও ঘনিষ্ঠ হলো, “এখনও তুমি হাত দেখতে পারো?” আমি হাসলাম, “হাত দেখতে কে না পারে! যে একবার পারে সে সারাজীবনই পারে। চোখে দ্যুতি থাকলে যে কেউ হাত দেখতে পারে। তুমিও পারো।” আমার কথায় ও লজ্জার হাসি হাসলো, “তাতো পারেই! কিন্তু তোমার মতো হাত দেখে অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ বলতে পারে না কেউ; কেমন তোমার প্রতিটি কথা সত্যি হলো আমার জীবনে। আজ আর একবার আমার হাতটা দেখো না প্লিজ!” ও তার ডান হাতটা বাড়িয়ে দিলো, মুহূর্তে নিজের ভুল সংশোধন করে ডান হাত সরিয়ে বাঁ হাত বাড়ালো। অগত্যা আমি ওর হাতটা নিয়ে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করলাম। হাতটা ছেড়ে দিতেই পারমিতা আমার কাঁধে হাত রেখে বললো, “কী দেখলে? বিচ্ছেদের বত্রিশ বছরের কথা বলো শুনি? প্লিজ!” আমি আবার হাসলাম। কাঁধ থেকে পারমিতার হাতটা নামিয়ে নিজের হাতে নিয়ে বললাম, “মনে হয় আমার ধারনা ভুল হয়েছে; অথবা তোমার আড়াল উন্মোচিত হয়েছে। আমি শুনেছিলাম মাসুম অনেক টাকার মালিক হয়েছে; তুমি ওর সাথে আনন্দেই আছো।” পারমিতা হাসলো আমার কথায়, “খুব একটা ভুল শোনোনি তুমি, মাসুম টাকা ভালোই আয় করতো, কিন্তু ঝামেলায় যুক্ত হয়ে গেলো। ঝামেলামুক্ত হতে খরচও হয়েছিলো মোটা অংকের টাকা। শেষপর্যন্ত আড়াই বছর পর ও মুক্তি পেয়েছিলো ঝামেলা থেকে। ঢাকা থেকে আমরা ফিরে এলাম, অবশ্য আমি ভালোই ছিলাম।” আমি নিজেও দীর্ঘদিন মহল্লার বাইরে আছি; তবু কখনো কারো মুখে মাসুমের জীবনের দুর্যোগ সম্পর্কে শুনেছিলাম, কিন্তু আমলে আনিনি। হঠাৎ করেই বললাম, “কিন্তু তোমার হাত দেখে কেনো আমার মনে হলো, মাসুমের জীবনের বিপর্যয় ছাড়াও তোমার নিজস্ব কোন বিপর্যয় তোমাকে পুড়ছে। জীবনে তুমি যেনো বড় কিছু হারিয়ে ফেলেছো?” পারমিতা মৃদু হেসে বললো, “স্বামীর জীবনের বিপর্যয় স্ত্রীকে যন্ত্রণায় দগ্ধ করবে, সেটাই কি সঙ্গত নয়?” এবার ওর হাতটা ছেড়ে দিয়ে বললাম, “নিশ্চয়ই! সে যন্ত্রণা তো থাকবেই। কিন্তু তোমার চোখ বলছে ভিন্ন এক যন্ত্রণার খবর। যে যন্ত্রণা অপ্রকাশ্য, তুমি নিজেও যাকে পাশ কেটে যেতে চাও, যাকে তুমি গায়ে মাখো না, অথচ সে তোমার সাথে ছায়া হয়ে হাঁটছে, একদিন যা তোমার জীবনে দাবানল হয়ে জ্বলে উঠবে।”
সেদিন রাতেই পারমিতার ফোন এলো।
: তুমি কি আমায় সারাজীবন যন্ত্রণায় রাখতে চাও?
: এ কথার অর্থ কী? আমি আবার তোমায় কোন যন্ত্রণায় বিদ্ধ করলাম?
: কী-সব বলে গেলে আমার নিজস্ব যন্ত্রণার কথা! আমি তো কিছুই খুঁজে পাচ্ছি না?
: তাহলে ধরে নাও আমি ভুল-ভাল কিছু বলে দিয়েছি। আমার কথাগুলো তুড়ি দিয়ে উড়িয়ে দাও। আমি তো কোনো ত্রিকালদর্শী মহাপুরুষ নই। যেমনটি আমার মনে হয়েছে তেমনটি বলেছি। আমার কথা তো অলঙ্ঘ বেদবাক্য নয়!
: কিন্তু আমার মন মানছে না। তোমার কথা ভুল হতে পারেই না। নিশ্চয়ই তুমি আরও কিছু বলতে পারতে, কিন্তু এড়িয়ে গেছো।
: না-না তেমন কিছু নয়। যা আমার মনে হয়েছে, তাই বলে দিয়েছি; ভুল তো হতেই পারে।
: না আমি নিজেকে সান্তনা দিতে পারছি না। আরও কিছু বলার থাকলে বলে দাও।
: সত্যি বলছি, আমার আর কিছু বলার নেই।
: কালকে কি তুমি একবার আসবে প্লিজ? আজ তো খেয়ে গেলে না, কালকে রাতে আমাদের সাথে খাবে?
: না পারমিতা, দুঃখিত! কালকে তো আমি আসতে পারবো না। কালকে আমি একটু ঢাকা যাবো, জরুরি কাজ আছে।
: তাহলে পরশু আসো।
: পরশু আমি ফিরবো বটে, কিন্তু ফিরতে রাত হতে পারে; সুতরাং পরশুদিনের কথা না দেয়াই ভালো।
: তাহলে তার পরদিন আসো? সেদিন অবশ্য মাসুম ঢাকা যেতে পারে বলছিলো। তবু অসুবিধা নেই তুমি চলে আসো।
দু’দিন পর সন্ধ্যায় আমি পারমিতার সাথে দেখা করতে গেলাম। গিয়ে শুনলাম মাসুম ঢাকা গেছে, রাতেই ফিরবে। ঘরে ঢুকেই বসতে বসতে বললাম, “ঘন ঘন তোমার বাসায় এসে তোমায় সমস্যায় ফেলছি না তো?” পারমিতা প্রজাপতির মতো উড়তে উড়তে বললো, “কাকে নিয়ে সমস্যা? কে করবে সমস্যা? আমি কি কাউকে কেয়ার করি না-কি? আমার স্বামী জানে তুমি আসবে। আমি ওকে বলেছি তোমার কথা। ও বলেছে, তাড়াতাড়ি ফিরে তোমার সাথে ডিনার খাবে।” আমি হাসলাম, “খাওয়া নিয়ে কেনো এতো ব্যস্ত হও? আমি তো সহজে কোথাও খেতে চাই না। আর আজ আমি খেতে পারবো না। আমার কাজ আছে, আমাকে যেতে হবে। অন্য একদিন খাওয়া যাবে।” আমার কথা শেষ হতেই পারমিতার সেলফোন বেজে উঠলো, ও উঠে গিয়ে সেটটা নিয়ে এলো বেডরুম থেকে, আমার পাশে বসেই কথা বললো, “হ্যাঁ বলো?…..সমস্যা কী?….. আরে সবুজ ভাই তো এসেছে।….হ্যাঁ হ্যাঁ আমি তো বললাম তুমি ফিরে এসে ডিনার করবে।……..অবশ্য উনিও আজ খেতে চাইছেন না। আজ না-কি তার জরুরি কাজ আছে, চলে যেতে হবে।….সমস্যা নেই ফ্রিজে তুলে রাখবো।…ওকে, বাই।” সেটটা সেন্টার টেবিলে রেখে বললো, “নাও মাসুম আজ আসতে পারছে না, কালকে বিকেলে আসবে। কাজ শেষ করতে পারেনি।” আমি একটু চিন্তিত হলাম, “রাতে তুমি তাহলে একা থাকতে পারবে?” পারমিতা হাসলো, “সমস্যা কী? আমার একা থেকে অভ্যাস আছে, ভয় করে না। আর তুমি যদি মনে করো ভয়ের কিছু আছে, তাহলে তুমিও থাকতে পারো আমার সাথে। সারারাত আড্ডা দিয়ে কাটাতে পারবো। তোমার সাহস আছে থাকবার?” আমি একটু অবাক হলাম, তবু নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বললাম, “না-না আমার অতোটা সাহস নেই তোমাকে রাত জেগে পাহারা দেবার। আজ তোমার এখানে থাকবো, কালকেই বাজারে তোমার নামে ঢিঢি পড়ে যাবে।” এবার শব্দ করে হেসে উঠলো পারমিতা, “ওসব নিয়ে ভাববার বা ভয় পাবার কিছু নেই আমার! কলংকের অনেক ঘাট পেরিয়ে আমি আজ এখানে পৌঁছেছি। আর তোমায় নিয়ে কলংক তো আমার বিয়ের আগেই হয়ে গেছে! এখন বুড়ো বয়সে কী আর কলংক হবে?” আমি কিছুটা রস করেই বললাম, “হুম, বয়স তো তোমার হয়েছেই, কিন্তু আজও তোমার আকর্ষণ একেবারে ফুরিয়ে যায়নি। আমার চোখে তো আজও তুমি লাস্যময়ী আছো।” আবার হাসলো পারমিতা, “তা ঠিক আছে, তোমার চোখে আমি লাস্যময়ী আছি; যেমন আমার মনে হয় তোমার সামান্য স্পর্শে আমি সহসা জেগে উঠতেও পারি।” মনে হলো আমি যেনো কিছুটা সর্মিন্দা হলাম। কতটা অকপট এখন পারমিতা, কিছুটা অবাকও হলাম, হয়তো বিবাহিত নারীরা যৌন বিষয়ে কিছুটা অকপটই হয়। আমার ভাবনায় লাগাম টেনে ধরলো সে, “আচ্ছা রগড় করা বন্ধ করি। আগে বল, সেদিন তুমি কী বলেছিলে আমার নিজস্ব কষ্টের কথা? কী দেখেছিলে তুমি আমার চোখে?” আমি একমুহূর্ত চোখ বন্ধ করে থাকলাম, অতঃপর চোখ মেলে বললাম, “বলবো। তার আগে তুমি বলো এনায়েত আলী বিশ্বাসের সাথে কীসের ঘনিষ্ঠতা তোমার?” পারমিতা যেনো আমার প্রশ্নে ধাক্কা খেলো। ওর মুখে হঠাৎ যেনো মেঘের ছায়া পড়লো; চোখের ভাষা যেনো বদলে গেলো, এবার বুকের গভীর থেকে কথা বলে উঠলো পারমিতা; “তোমার মনে কি তাকে নিয়ে কোন সন্দেহ? তার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। দুঃসময়ে যখন সবাই আমাকে ছলনা দিয়ে ঘোরাচ্ছেন, এনায়েত আংকেল সেদিন আমার বুকে সাহস যুগিয়েছিলেন; আশার আলো জাগিয়েছিলেন, আমায় সঠিক পথের দিশা দিয়েছিলেন; অবশ্য এ কথা আমি অস্বীকার করবো না, কখনো কখনো সুযোগ পেলে তিনিও পুরুষ হয়ে উঠতে চেয়েছেন, ডাকের যে সম্পর্ক, তার সুতো ছিঁড়ে ফেলতে উদ্যত হয়েছেন; তারপরও নিজেকে চূড়ান্ত বিপর্যয় থেকে রক্ষা করতে পেরেছিলাম। কখনো কখনো শরীরের স্পর্শকাতর অংশে ছুঁয়ে দিতে চেয়েছেন। অপমানে-ঘৃণায় আমার গা ঘিন ঘিন করেছে, তবু নিজেকে সামলে নিয়েছি। আমার জীবনে তখন চরম সংকট, তাই ছোটখাটো অপমানকে গায়ে মাখিনি আমি। অকূল পাথারে নিজের জন্য আশ্রয় পেতে পুনর্বার তারই শরণাপন্ন হয়েছি। জীবনের সেই দুঃসময়ে আমি উপলব্ধি করেছিলাম, আমাদের সমাজের পুরুষেরা যেনো সবাই তৃষ্ণার্ত মরুভূমি, জল পেলেই শুষে নিতে চায় পলকে। অনেকের মধ্যে এনায়েত আংকেলকে পেয়েছিলাম কিছুটা আন্তরিক। অন্যরা যখন আমার উপকারের চেয়ে নিজের লালসাকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন, এনায়েত বিশ্বাস তখন আমায় সাহায্য করতে কিছু বাস্তব পদক্ষেপ নিয়েছেন, কখনো সঠিক পথের দিশা দেখিয়েছেন নিঃস্বার্থভাবে। তারপরও কখনো শিল্পিতভাবে আমার শরীরের উত্তাপ নিতে চেয়েছেন নিজের শরীর দিয়ে; কিন্তু তার সেই কুশলী যৌনাচারকে আমি সরব প্রতিবাদ করতে পারিনি। প্রতিটি নারী যেমন বুঝতে পারে পুরুষ কখন লালসার আগুনে পোড়ে, তেমনি আমিও বুঝেছি; কিন্তু সৌজন্যের শিষ্টাচার ছিঁড়ে তিনি যেমন আমাকে অসম্মান করেননি; আমিও তেমনি তাকে বুঝতে দিইনি আমার ঘৃণার স্বরূপ।” কথা থামিয়ে পারমিতা মাথা নিচু করে চুপ করে যেনো নতুন দম নিচ্ছে। আমি ওর কাঁধে হাত রাখলাম। পারমিতা যন্ত্রচালিতের মতো নিজেকে আমার কাঁধে সমর্পণ করলো নিঃশব্দে। আমি একটু সময় দিলাম। তারপর নিজের আঁজলায় ওর মুখটা তুলে মৃদুকণ্ঠে প্রশ্ন করলাম, “আসলে কী ঘটেছিলো তখন তোমার জীবনে?” পারমিতা তাৎক্ষণিক কোনো উত্তর করলো না, কেবল অপলক আমার চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো। ওর চোখ যেনো আমার চোখে আস্থা খুঁজে নিতে চাইছিলো। ওর চোখ দু’টি যেনো বলছিলো, “তুমি কি বিশ্বাসী? তোমাকে বিশ্বাস করে আমি কি আমার বুকের সমস্ত বেদনা উন্মোচন করতে পারি?”
পারমিতার চোখের ভাষায় আমি দেখলাম গভীর আর্তি। আমি ওর চোখের ভাষা পড়েই নিজের মনবীক্ষায় সে ভাষার মনস্তত্ত্ব আবিষ্কারের লক্ষ্যে বিশ্বাসের আলোয় বললাম, “দেখ পারমিতা, তোমার জীবনে যা-কিছু স্বচ্ছলতা সেখানে অনুপ্রবেশ করতে চাই না, তোমার জীবনের সুখানুভবেও কোন অশুভ ছায়া ফেলতে চাই না; তবে তুমি চাইলে তোমার কষ্টের আঙিনায় সহযোগিতার আলো ফেলতে চেষ্টা করতেই পারি। প্রশ্ন হচ্ছে, কেনো? যদি তুমি আগ্রহী হও তবে বলতে পারি, আমার কৈশোরে অথবা যৌবনের সূচনায় আমি তোমার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলাম; তোমাকে ভালো লেগেছিলো; হয়তো ভালোও বেসেছিলাম; কিন্তু যখন তোমাকে প্রেম নিবেদনের সময় এলো, তখন আমার বোধোদয় হয়েছিলো, আমি বুঝেছিলাম, তোমার মনস্তত্ত্ব আমার সাথে পথ চলার জন্য প্রস্তুত নয়; তারপরও যদি আমি আগ্রহী হতাম, তুমি হয়তো যৌবনের চপলতায় রোমান্টিক হয়ে উঠতে, আর আবেগের বশে ঝুকে পড়তে আমার দিকে। যে আবেগে তুমি ঝোকের মাথায় সেদিন মাসুমকে বিয়ে করেছিলে, একই আবেগে হয়তো সেদিন তুমি আমাকেই বিয়ে করে নিতে; কিন্তু যে মূল্যবোধ-ঘাটতিজনিত কারণে মাসুম তোমার জীবনে স্বচ্ছলতা আর সাচ্ছন্দ্য এনে দিতে পেরেছিলো; একই মূল্যবোধে বৈপরিত্যের কারণে আমি তোমার জীবনে একজন ব্যর্থ পুরুষ হতাম; আর ঐ একটিমাত্র কারণে আমি তোমার জীবন থেকে পালিয়ে থাকতে চেয়েছিলাম। তুমি যেদিন আমার কাছে তোমার বান্ধবী, ঐ যে দুর্গাপুরের মেয়ে, পারভিনকে পাঠিয়ে ছিলে; ওকে আমি এ কথাগুলোই বলেছিলাম।” পারমিতা অপলক চোখে তাকিয়ে ছিলো আমার দিকে। আমাকে থামতে দেখেই প্রশ্ন করলো, “তাহলে কি তুমি আমার অনুপস্থিতিতে পারভিনের প্রেমে পড়েছিলে?” আমি মুচকি হাসলাম, “পারভিন কি তোমায় তাই বলেছিলো?”
: না, পারভিন বলেছিলো, তুমি আমাকেই ভালোবাসো, আর আমার কাছেই ফিরবে।
: হ্যাঁ, আমি তোমাকেই ভালোবাসতাম, কিন্তু তোমার মঙ্গল বিবেচনায় তোমার কাছ থেকে দূরেই সরে থাকতাম। আমার সৌভাগ্য, তুমি হুট করে মাসুমকে বিয়ে করে নিলে; আমাকে আর অপ্রস্তুত হবার সম্মুখিন হতে হলো না। আমি তোমার সুখের দিনে সারথি হতে পারিনি; কিন্তু তোমার দুঃখের দিনে কিছুতেই দূরে সরে থাকতাম না, আজও আমি তোমার পাশে থাকার স্পর্ধা রাখি। এবার তুমি বলো, তোমার একান্ত বেদনার কথা?

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়