চাঁদাবাজির মামলা ৪ দিনের রিমান্ডে দর্জি মনির

আগের সংবাদ

বন্যার পদধ্বনি : পদক্ষেপ এখনই নিতে হবে

পরের সংবাদ

সংগীতে রবীন্দ্রনাথ

প্রকাশিত: আগস্ট ৬, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: আগস্ট ৬, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সৃষ্টিক্ষম প্রজ্ঞার এক উজ্জ্বল স্বাক্ষর তার সংগীত ভুবন। রবীন্দ্রসংগীতের শরীরে ও সত্তায় উৎকীর্ণ হয়ে আছে রৈবিকচিত্তের দার্শনিক প্রত্যয়, তার জগৎ ও মানবভাবনা, তার আধ্যাত্মিক পরমানন্দে উত্তরণের ইতিহাস। রবীন্দ্রনাথের জীবনবিশ্বাস ও জগৎভাবনা তার সংগীতে যে গভীর ব্যঞ্জনায় শিল্পিত হয়ে আছে, রবীন্দ্র-সৃষ্টি সত্তার অন্য কোনো রূপকল্পে আমরা তা লক্ষ্য করি না। সংগীতের মাঝেই রবীন্দ্রনাথ নিজেকে সবচেয়ে বেশি আন্তরিকভাবে এবং আত্ম-সমাহিত উচ্চারণে উপস্থাপন করেছেন। প্রেম প্রকৃতি মানব ঈশ্বর- এই চারটি প্রত্যয়ই রবীন্দ্রসংগীতে অখণ্ড অনুভূতিতে আত্মপ্রকাশ করেছে। এই বিষয় চতুষ্টয় নিয়েই গড়ে উঠেছে রবীন্দ্রসংগীতের বিশাল ভাবসম্পদ। ফলে এই বিষয়গুলোর মধ্যে কখনো বিরোধ ঘটেনি, তারা হয়ে উঠেছে পরস্পর পরিপূরক। এই সূত্রেই বিবেচ্য রবীন্দ্রনাথের সংগীতে নারীর অবস্থান-বিষয়ক বর্তমান আলোচনার অন্বিষ্ট বিষয়।
রবীন্দ্রসংগীতের মহাভাবলোকে যে নারীর আমরা সন্ধান পাই, সে কোনো ব্যক্তি-মানুষ নয়; রবীন্দ্রনাথের নারী মূলত শাশ্বত নারীর প্রতীকী রূপ। রবীন্দ্রসংগীতে নারী কখনো হয়ে ওঠে তার কাব্যল²ী, কখনো জীবনদেবতা, কখনো-বা লীলাসঙ্গিনী, স্বপ্ন-সহচরী। রবীন্দ্রনাথের সংগীত ভুবনের নারী মর্ত্যরে কোনো মানবী নয়, বরং সে-নারী রবীন্দ্রনাথের দার্শনিক জীবনতত্ত্ব ও লীলারহস্যের অনন্ত সঙ্গিনী, কবিমানসী। রবীন্দ্রসংগীতের নারী ‘বিশ্বের কবিতা’- ‘গৃহের বণিতা’ নয়। রবীন্দ্রনাথের উচ্চারণেই আছে এই শাশ্বত নারীর প্রতি তার আত্ম-নিবেদনের আহ্বান:
আমারে যে ডাক দেবে এ জীবনে তারে বারবার
ফিরেছি ডাকিয়া,
সে নারী বিচিত্র বেশে মৃদু হেসে খুলিয়াছে দ্বার
থাকিয়া থাকিয়া।
এই অশরীরী নারী, এই লীলাসঙ্গিনী রবীন্দ্রনাথকে চালিত করে নিয়ে চলেছে যুগযুগান্ত পেরিয়ে সীমাহীন সুদূরে। সংগীতের মাঝে রবীন্দ্রনাথ যে-নারীকে খুঁজেছেন সে তো কোনো মর্ত্যরে মানবী নয়, রক্ত-মাংসের মানুষ নয়- এ নারী একটা ভাব ও উপলব্ধির শিল্পরূপ মাত্র। বস্তুত রবীন্দ্রসংগীতের নারী রবীন্দ্রনাথের দার্শনিক ধ্যানলোকে উত্তরণের অন্তহীন আশ্রয় মাত্র।
রবীন্দ্রসংগীতে নারী ও দেবী প্রায়ই মিলেমিশে হয়ে গেছে একাকার। বৈষ্ণব কবিদের মতো রবীন্দ্রনাথও তার গানে ‘দেবতারে প্রিয় করেছেন, প্রিয়রে দেবতা’। ফলে রবীন্দ্রনাথের পূজা ও প্রেমপর্বের গানে সর্বত্র একটা নিবিড় আন্তঃসম্পর্কের টান অনুভূত হয়। রবীন্দ্রনাথের কবিচৈতন্যে মানব ও দেবতা যেমন অঙ্গাঙ্গীভাবে সম্পৃক্ত, তেমনি তার সঙ্গীতেও দেবতা ও নারী প্রায়ই একই চৈতন্যভূমিতে মিলিত হয়েছে। প্রেমের সাধনবেগ ও প্রসাধনকলা, উপলব্ধি ও অসীমের সন্ধান বারবার সমবেত হয় রবীন্দ্রনাথের গানে- ব্যক্তির সীমানা ছাড়িয়ে নারী হয়ে ওঠে রূপক। নিচের গানে আমরা খুঁজে পাব এ সত্যের স্বীকৃতি :
আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ সুরের বাঁধনে-
তুমি জান না, আমি তোমারে পেয়েছি অজানা সাধনে \
সে সাধনায় মিশিয়া যায় বকুলগন্ধ,
সে সাধনায় মিলিয়া যায় কবির ছন্দ-
তুমি জান না, ঢেকে রেখেছি তোমার নাম
রঙিন ছায়ার আচ্ছাদনে \
তোমার অরূপ মূর্তিখানি
ফাল্গুনের আলোতে বসাই আনি।
বাঁশরি বাজাই ললিত বসন্তে, সুদূর দিগন্তে
সোনার আভায় কাঁপে তব উত্তরী
গানের তানের সে-উন্মাদনে \
সীমা থেকে অসীমের, রূপ থেকে অরূপের সাধনায় রবীন্দ্রনাথের কাছে মর্ত্যরে দেহধারী নারীই হয়ে ওঠে স্বর্গের দেবী-পরিচিত প্রাত্যহিক নারীর শরীরেই ফুটে ওঠে শাশ্বত নারীর ব্যঞ্জনা। ফলে দেখি, নারী যে প্রেমিকা হয়ে এসেছে তার ভবনে, সে-ই অন্তিমে মন্দিরের দেবী হয়ে দেখা দেয় তার চিত্ত-ভুবনে। প্রেম-পর্বের গানে নারী আর দেবী হয়ে উঠেছে পরস্পর পরিপূরক।
বস্তুত এখানেই রবীন্দ্রসংগীতে নারীর কেন্দ্রীয় অবস্থান। যেমন :
কেন যামিনী না যেতে জাগালে না, বেলা হল মরি লাজে।
শরমে জড়িত চরণে কেমনে চলিব পথের মাঝে \
আলোক পরশে মরমে মরিয়া হেরো গো শেফালি পড়িছে ঝরিয়া,
কোনোমতে আছে পরান ধরিয়া কামিনী শিথিল সাজে \
নিবিয়া বাঁচিল নিশার প্রদীপ ঊষার বাতাস লাগি,
রজনীর শশী গগনের কোণে লুকায় শরণ মাগি \
-সন্দেহ নেই, এ গান একই সঙ্গে প্রেমের গান, পূজার গান। এভাবেই রবীন্দ্রসংগীতে প্রেমের নারী পূজার দেবী তথা শাশ্বত নারীতে রূপান্তরিত হয়ে যান।
ঘরের নারীকে, প্রেমের নারীকে শাশ্বত নারীতে রূপান্তর রবীন্দ্রসংগীতের এক পৌনঃপুনিক অনুষঙ্গ। এভাবে অভিজাত কোনো নারী নয়, তুচ্ছ সাধারণ নারীর মাঝেও তিনি ছড়িয়ে দেন শাশ্বত অরূপের ব্যঞ্জনা। তাই ক্ষণিক প্রেমের মাধুরী ছড়ানো পথের ধারে কৃষ্ণকলি মেয়ে রবীন্দ্রনাথের কাছে চিরায়ত প্রেমের অরূপ নারীতে রূপান্তরিত হয়ে যায় : ‘কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি, কালো তারে বলে গাঁয়ের লোক!/মেঘলা দিনে দেখেছিলাম মাঠে কালো মেয়ের কালো হরিণ-চোখ।/ঘোমটা মাথায় ছিল না তার মোটে, মুক্তবেণী পিঠের ‘পরে লোটে।/কালো? তা সে যতই কালো হোক, দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।’
রবীন্দ্রসংগীতে নারী সব সময়ই স্মৃতি-জাগানিয়া, প্রীতি-জাগানিয়া, স্থিতি-জাগানিয়াও বটে। কেবল সপ্রাণ নারী নয়, ফ্রেমে-বাঁধা নারীর চিত্রপটও তাই তাঁকে শোনায় মর্মের আহ্বান। নয়নের সম্মুখে না থেকেও সে-নারী দেখা দেয় বিশাল বিপুল অস্তিত্বসত্তায় : ‘তুমি কি কেবলই ছবি, শুধু পটে লিখা।/ওই-যে সুদূর নীহারিকা/যারা করে আছে ভিড় আকাশের নীড়,/ ওই যারা দিবারাত্রি/আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী গ্রহ তারা রবি,/তুমি কি তাদের মতো সত্য নও।/কবির অন্তরে তুমি কবি-/নও ছবি, নও ছবি, নও শুধু ছবি \’
নারীর জন্য রবীন্দ্রনাথের যে আকুল আকাক্সক্ষা, পরমার্থে তা তার ঈশ্বর-অনুভূতিরই দ্যোতক। এ কারণেই রবীন্দ্রনাথের গানে নারী আর ঈশ্বরের মাঝে পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যায় না। যে-নারীর বিচ্ছেদে রবীন্দ্রনাথের অন্তরাত্মা কাতর, তিনি কোনো অনির্দেশ্য রমণীসত্তা নন, যেন কবির জীবনদেবতা তিনি, যেন মানসপ্রিয়া, যেন ব্রহ্মসংগীতের জীবননাথ।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়