চাঁদাবাজির মামলা ৪ দিনের রিমান্ডে দর্জি মনির

আগের সংবাদ

বন্যার পদধ্বনি : পদক্ষেপ এখনই নিতে হবে

পরের সংবাদ

পারমিতার জগৎ

প্রকাশিত: আগস্ট ৬, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: আগস্ট ৬, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

তুমি তো জানো, আমি ‘সৃজন পাঠক ক্লাব’ নামে একটা সংগঠন করি। রিটায়ারমেন্টের পর এখন ওটা নিয়েই ব্যস্ত আছি। আমার সংগঠনের লোকজন নিয়ে আমি একবার ময়মনসিংহে আসতে চাই। সকালে যাবো, সারাদিন কবিতাপাঠ, আড্ডা দিয়ে সন্ধ্যায় ফিরে আসবো ঢাকা। যারা আসবেন, তাদের মধ্যে বেশ ক’জন বিশিষ্ট কবি-সাহিত্যিক আছেন। তুমি শুনে খুশি হবে, ওরা সবাই তোমাকে জানে, তোমাকে সবাই সমীহও করে। সাহিত্যাঙ্গনে তোমার এতটা প্রভাব দেখে ভালোই লাগলো।” এনায়েত আলীকে আমি চিনতাম, জানতাম তাকে থামিয়ে না দিলে তিনি সহজে থামবার পাত্র নন। তিনি একসময় আমাদের কৈশোরে-প্রথম যৌবনে ময়মনসিংহে ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন, পরবর্তীতে জয়েন্ট সেক্রেটারি হয়ে অবসরে গেছেন। প্রয়োজনে পিঠ চাপড়ে, মাথা বুলিয়ে কার্যোদ্ধার আর প্রয়োজন ফুরালে ভুলে যাবার আমলাস্বভাব এনায়েত সাহেবের ছিলো পুরোদস্তুর, আমি জানতাম। তাই তাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, “আমাকে কী করতে হবে সেইটে বলুন স্যার? আপনি দলবল নিয়ে পিকনিক করতে আসবেন, এখানে আমার আপনাদের জন্য আয়োজন করতে হবে; কী কী দায়িত্ব আমায় পালন করতে হবে সেটা বলুন স্যার? আপনি তো নিশ্চিত জানেন, এখানে আপনার বেশ ক’জন সৈনিক আছে।” আমার ত্যাড়া স্বভাবের কথা বুঝতে পেরেই এনায়েত আলী বিশ্বাস সুর পাল্টে দিলেন, “আরে কবি সবুজ, তুমি বিষয়টিকে পিকনিক হিসেবে নিচ্ছো কেনো? স্থানীয় কবিদের সাথে জাতীয় পর্যায়ের কবি-সাহিত্যিকদের দেখা হবে, পরিচয় হবে, মত-বিনিময়ের সুযোগ ঘটবে, মন্দ কী। আর তুমি দেখলাম সবার কাছে পরিচিত, তাই ভাবলাম হোক না একটা মিলনমেলা। হোক না গ্রাম-নগর একাকার!” এনায়েত সাহেবের কথায় আমার মেজাজ খারাপ হচ্ছিলো বটে, কিন্তু তাঁর সাথে আমার যে সম্পর্ক, তাতে তাঁর সাথে আমি অসৌজন্য করতে পারতাম না। নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, “স্যার মফস্বল আর নগরের কনসেপ্ট বদলে যাচ্ছে। সামনে আরও বদলাবে। আপনি আসছেন বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে, বড় মুখ করে আপনি সবাইকে বলেছেন, আপনার সম্মান রক্ষা করা আমার দায়িত্ব। আমাকে কী কী করতে হবে বলুন, আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি; কিন্তু স্যার আয়োজনের খরচাপাতি কে যোগাবে? আমি আপনাকে ‘মাগনা কামলা’ খেটে দিতে পারবো, কিন্তু গাঁটের পয়সা তো দিতে পারবো না!” উনি বললেন, “তুমি টেনশান নিও না, আমি সব ব্যবস্থা করছি। পরে তোমাকে বিস্তারিত জানাচ্ছি।” সেদিনের মতো কথা শেষ হলো। এরপর আরও কয়েকদফা আলোচনার পর সব সিদ্ধান্ত পাকা হলো। গঠিত হলো ‘সৃজন পাঠক ক্লাব ময়মনসিংহ জেলা কমিটি’, আমাকে সম্পাদক বানাতে চাইলেন, আমি বললাম, “দুঃখিত স্যার, আমি সম্পাদক হতে পারবো না। আমাকে বরং এবারের আয়োজনের আহবায়ক করে দিন, অনুষ্ঠান শেষে আমার কোন দায়িত্ব থাকবে না। আমি যা করবো, আপনার সম্মানে করবো।” আমার আসলে ধারনা ছিলো, এসব কমিটি শুধু শুধুই করা, অনুষ্ঠান শেষ হলে আর খোঁজ পাওয়া যাবে না। অগত্যা তাই হলো। নির্দৃষ্ট তারিখে আয়োজন হলো সাহিত্য সমাবেশ। ব্রহ্মপুত্রতীরে খোলা জায়গায় ঘন গাছের ছায়ায় আয়োজন, সবার পছন্দ হলো, সব ব্যবস্থা হলো সুচারুভাবে। সকালে আলোচনা, দুপুরে মধ্যাহ্নভোজ, সাড়ে তিনটা থেকে স্বরচিত কবিতা ও গল্পপাঠ। শহরে কিছু আমন্ত্রণপত্র বিতরণ হলো। সকাল থেকে শুরু হলো অনুষ্ঠান, স্থানীয় তরুণ কবিরা অনেকেই যুক্ত হলেন। দুপুরের পর শুরু হলো স্বরচিত গল্প-কবিতা পাঠের আসর। একজনকে সভাপতির আসনে বসিয়ে আর একজনকে সঞ্চালকের দায়িত্ব দিয়ে আমি পিছনের চেয়ারে বসে বিশ্রাম সেরে নিচ্ছি। অনুষ্ঠান চলছে, হঠাৎ দূরে তাকিয়ে দেখলাম একজন নারী আমাদের আয়োজনের দিকে এগিয়ে আসছেন। তার মাথার উপর শিরিষের ডাল আন্দোলিত হলো, ব্যাকুল বাতাসে রুমঝুম শব্দে বেজে উঠলো শিরিষের বীজাধার। আমি বিমুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছি। একসময় তিনি কাছে চলে এলেন, আমি মঞ্চের দিকে মনোযোগী হলাম। একটু পরেই কেউ একজন আমার পাশের ফাঁকা চেয়ারটাতে বসলেন, বাতাস যখন সৌরভে মাতাল হলো তখন আমি বুঝতে পারলাম, কোনো লাস্যময়ী বসেছেন আমার পাশে। পাশ থেকে আমার কাঁধে হাত রেখে তিনি বললেন, “কী হলো, আমাকে কী চেনা যায় না?” আমি ফিরে তাকালাম, ক্রমশ পৃথিবীর সমস্ত বিস্ময় আমার চোখে ভীড় করলো, “পারমিতা! তুমি! তুমি এখানে কী ভাবে?” পারমিতা তার ভুবন ভোলানো হাসি হেসে বললো, “বিনা দাওয়াতে নয়, আমি তোমার দাওয়াত পেয়েই এসেছি। এই যে কার্ড।” কার্ড দেখালো। আমি আমার সমস্ত কথা হারিয়ে ফেললাম মুহূর্তে। মঞ্চ থেকে উচ্চারিত কবিতা যেনো পারমিতার সম্মানে মৌনব্রত পালনে আত্মমগ্ন হলো; মাথার উপর বকুলের ডালে বসা পাখির ঠোঁট থেকে একটা পাকা বকুল পড়ে গেলো পারমিতার পায়ের কাছে। এভাবেই বত্রিশ বছর পর নতুন করে আবিষ্কার করলাম হারানো পারমিতাকে।

আমার জীবন, আমার পৃথিবী অনুচ্চারিত থাক পারমিতার জগতে। উচ্চারিত হোক পারমিতার সুখ-দুঃখ আনন্দ-বেদনার কথা; আলোকিত হোক পারমিতার জীবনসংগ্রামের আঙিনা। ‘সবুজ কবিনামা’ নামে ভিন্ন আখ্যানে নিজেকে উন্মোচিত করার পরিকল্পনা রেখে এখানে পারমিতার না-বলা কথাগুলো বলবো আশা করি। পারমিতা এখন আচারে-ব্যবহারে অনেক সহজ, অনেক প্রাণৈশ্বর্য ওর মধ্যে। এতোবছর পর ও আমাকে এতোটাই সহজভাবে গ্রহণ করলো, এতোটাই আন্তরিকতায় স্পর্শ করলো, যে আমি অবাক হলেও কোন অভিমান দেখাতে পারলাম না; আসলে অভিমান করার কিছু ছিলোই না আমার। পারমিতা মাসুমকে বিয়ে করে নেয়াতে, এক অর্থে আমি বরং খুশিই হয়েছিলাম। আমার বিশ্বাস আমার সাথে গাঁটছড়া বাঁধলে জীবনে বরং ও অখুশিই থাকতো; যে প্রাচুর্য আর সাচ্ছন্দ্য মাসুম ওকে দিতে পেরেছিলো, তা দেবার কোন সম্ভাবনাই ছিলো না আমার মধ্যে, আর ঐশ্বর্যের স্বচ্ছলতা না থাকলে পারমিতা সুখী হতেই পারতো না; আমার বুকে এ ধারনা বদ্ধমূল ছিলো। পারমিতা অদ্ভুত স্বভাবের মেয়ে। ও কেবল সুখী হতেই জানে; কোন কষ্ট-বেদনা ধারণ করবার আগ্রহই ছিলো না ওর মধ্যে। ছোট-খাটো দুঃখ-ব্যথাগুলো স্বল্পসময়ের বিষাদ আর দু’ফোঁটা অশ্রæতেই ধুয়ে নেবার অদ্ভুত এক শক্তি ছিলো ওর। বত্রিশ বছর পর আমাদের পুনর্মিলন আর পরবর্তী সময়ের ঘনিষ্ঠতার ফাঁকে ওর সম্পর্কে আমার ধারনাগুলো সর্বাংশে সত্য প্রমাণ করে নিতে পেরেছিলাম কি?
সেদিন অনুষ্ঠান শেষে এনায়েত আলী বিশ্বাস এবং তাঁর সফরসঙ্গীদের সম্মানে পারমিতা আর মাসুম স্থানীয় একটা চীনে রেস্তোরাঁয় ডিনারসহ আড্ডায় আমন্ত্রণ জানিয়েছিলো, আমাকেও যেতে বলেছিলো পারমিতা, কিন্তু মাসুম নিজে এসে বলেনি বলে আমি যাইনি। এনায়েত সাহেবও বলেছিলেন, “সবুজ, তোমার কিন্তু আমাদের সাথে যাওয়াই উচিত?” আমি হেসে বললাম, “এ কথা অবশ্যই সত্যি, আমার যাওয়াই উচিত স্যার; কিন্তু আপনি নিশ্চয়ই মানবেন, অনুষ্ঠান শেষ হবার পরও এখানে আমার কিছু আবশ্যিক কাজ থেকেই যাবে, যা আমার শেষ করেই যাওয়া উচিত; তাছাড়া আপনাদের হাতেও তো খুব একটা সময় নেই, যে আমার জন্য দু’ঘণ্টা অপেক্ষা করতে পারবেন, তাই নয় কি স্যার?” হয় আমার যুক্তি তিনি মেনে নিলেন, না হয় আমি না যাওয়াতে তিনি স্বস্তিইবোধ করলেন; প্রকাশ্যে বললেন, “কবি হলেও সবুজ তো জাত সংগঠক, তাই ও এভাবে ভাবতে পারলো।” তাঁর সহযাত্রীদের যারা আমার উপস্থিতি বিশেষভাবে প্রত্যাশা করছিলেন, তিনি তাঁদের এভাবে বুঝিয়েই বিদায় নিয়েছিলেন সেদিন আমার কাছ থেকে। বিদায়ের আগে পারমিতা আমার সেলফোন নাম্বার নিতে ভুল করলো না; এবং সেদিন রাতেই কল করে আমার কাছে দুঃখ আর অভিমান প্রকাশ করলো।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়