৩১ আগস্ট পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি বাড়ল

আগের সংবাদ

ট্র্যাকে জ্যামাইকান সুন্দরীদের রাজত্ব

পরের সংবাদ

ফকির আলমগীর : হাজার কবিতার অন্তঃমিল

প্রকাশিত: জুলাই ৩১, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুলাই ৩১, ২০২১ , ১২:০৮ পূর্বাহ্ণ

করোনা মহামারির ১৬ মাসে আমরা হারিয়েছি অসংখ্য গুণীজন। পঞ্চাশ ও ষাটের যে প্রজন্মের হাত ধরে বাংলাদেশের সমাজের বুনিয়াদ রচিত হয়েছিল খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে তাদের একটা বড়ো অংশকেই হারাতে হয়েছে আমাদের। বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় মহামারি একদিন কেটে যাবে। কিন্তু জাতীয় জীবনের এই শূন্যতা পূরণ কী হবে? করোনায় আক্রান্ত হয়ে গত ২৩ জুলাই চলে গেলেন শিল্পী ফকির আলমগীর। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছরটাতেই আমরা হারালাম আমাদের গণসংগীত ধারার শেষ প্রতিনিধিকে। শুধু গণসংগীত নয়, পপ ও দেশজগানের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন জনপ্রিয়তম। কালো সুঠাম শরীরে দুহাত উপরে তুলে ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দুলিয়ে দরাজ কিন্তু হাস্কি ভয়েসের গায়কীতে ফকির আলমগীর স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের গানে স্বতন্ত্র এক স্টাইল। ফকির আলমগীরের জন্ম ১৯৫০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গার কালামৃধা গ্রামে। শিল্পী নিজেই বহুবার বলেছেন, আউল-বাউলদের সঙ্গ আর বয়ে চলা কুমার নদী খুব শৈশবে তার শিল্পীসত্তা জাগরণে ভূমিকা পালন করেছে। বলা চলে ফকির আলমগীরের সমন্বয়ী ও সংবেদনশীল শিল্পীসত্তার ভিত্তিটা সেখান থেকেই গড়ে ওঠা। সবুজ-শ্যামল-কোমল গ্রাম ছেড়ে যখন নগরে এসেছেন সময়টা তখন বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের তুঙ্গস্পর্শীকাল। সময়ের সেই পরশমনি তাকে মানুষের মুক্তি ও সংগ্রামশীলতার প্রতি আজীবন অঙ্গীকারাবদ্ধ করে দিয়েছে। ১৯৬৬ সালে ঢাকায় এসে জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হন। যুক্ত হন ছাত্র ইউনিয়নের প্রগতিশীল রাজনীতিতে। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পুরাধাপুরুষ কামাল লোহানীর হাত ধরে ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠীতে যোগ দেন। নেমে পড়েন বাঙালির অসহযোগ আন্দোলনে। মাটি ও মেঠো মানুষের সামষ্টিক দুঃখ-ব্যথা এবং মানুষের সংগ্রামশীলতা এই দুয়ের মেলবন্ধন মেলে ফকির আন্দোলনের গানে। তার অর্ধ শতাব্দীর সংগীত জীবন বহুত্ববাদ আর সমন্বয়ের। মার্কস থেকে মাইজভান্ডারি কিংবা লেনিন থেকে লালন সবকিছুকে আত্মসাৎ করতে চেয়েছেন নিজের ভাবনা ও গানে। ষাটের দশকের অসহযোগ আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলাদেশের সব ঐতিহাসিক আন্দোলনে তিনি তার গান দিয়ে মানুষকে উজ্জীবিত করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা থেকে সঞ্চিত যন্ত্রণা ও পরবর্তীকালে তারুণ্যের স্বপ্নভঙ্গের বেদনা বাংলা গানের ধারায় নতুন এক যুগ সৃষ্টি করে। দেশজ বাউল, মারফতি, কীর্তন, মাইজভান্ডারি গানের সঙ্গে পাশ্চাত্য সংগীতের (ইস্টার্ন ফোক উয়িথ ওয়েস্টার্ন বিট) মেলবন্ধনে নতুন ধারার পপসংগীত জন্ম হয়। আজম খান, ফিরোজ সাঁই, পিলু মমতাজ, ফেরদৌস ওয়াহিদ ও ফকির আলমগীর এই পাঁচজন বাংলা আদি পপ গানের পঞ্চপাণ্ডব। সময়ের প্রয়োজনে চটুল এই পপ গানের উন্মাদনার মধ্যে গেলেও সেখানে নিজেকে আটকে রাখেননি ফকির আলমগীর। সামষ্টিক মানুষের দুঃখ, যন্ত্রণা, আশাভঙ্গের বেদনা নিয়ে একের পর এক গান গেয়ে গেছেন। ১৯৮২ সালে বিটিভির আনন্দমেলায় তার গাওয়া ‘ও সখিনা গেসস কিনা ভুইল্লা আমারে, আমি অহন রিসকা চালাই ঢাহা শহরে’ গানটি কালজয়ী এক সৃষ্টি। সখিনা এবং গ্রাম থেকে উচ্ছেদ হওয়া তার ‘রিসকাচালক’ প্রেমিকের না পাওয়ার যন্ত্রণা সামষ্টিক মানুষের না-পাওয়ার যন্ত্রণাকেই প্রতিনিধিত্ব করেছে। সখিনা ফকির আলমগীরের কাছে প্রতীকী সত্তা। বীরাঙ্গনা, মধ্যপ্রাচ্যে পাচার হওয়া নারী, কারখানার শ্রমজীবী, ফুটপাতের ইটভাঙা শ্রমজীবী নারী, কিংবা প্রথম প্রেমের প্রতীক। সখিনাকে নিয়ে তিনি আরো কয়েকটি গান গেয়েছেন। সেগুলোও সমানতালে রেখাপাত করেছে মানুষের মনে। ফকির আলমগীরের গাওয়া মায়ের একধার দুধের দাম, মন আমার দেহঘড়ি, আহারে কাল্লু মাতব্বর, সান্তাহার জংশনে দেখা, বনমালী তুমি গানগুলো আশি ও নব্বই দশকে দারুণ জনপ্রিয়তা পায়। গণমানুষের সংগ্রামের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে ১৯৭৬ সালে গড়ে তোলেন ‘ঋষিজ শিল্পী সংস্থা’। বাংলাদেশের নানা আন্দোলন-সংগ্রামে ও শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে তার ভূমিকা অনস্বীকার্য। আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের নেতা নেলসন ম্যান্ডেলাকে নিয়ে গেয়েছিলেন ‘কালো কালো মানুষের দেশে’। এই গানটার একটা লাইন হচ্ছে ‘নেলসন ম্যান্ডেলা তুমি অমর কবিতার অন্তঃমিল’। ফকির আলমগীরের জীবন ও গানকে একটু ঘুরিয়ে আমরা হাজার কবিতার অন্তঃমিল দিয়ে চিহ্নিত করতে পারি। একজীবনে তিনি সমন্বয় ঘটিয়েছেন বহুকিছুর।
:: মনোজ দে, কবি ও সাংবাদিক

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়