জাপান পাঠাল আড়াই লাখ : দেশে চীনা টিকা তৈরির আনুষঙ্গিক কাজ শুরু

আগের সংবাদ

নিউইয়র্কে বিএসইসির বিনিয়োগ সম্মেলনে বক্তারা : করোনাতেও এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতি

পরের সংবাদ

চোরাবালি

প্রকাশিত: জুলাই ২৬, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুলাই ২৬, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

হঠাৎ রুপার সঙ্গে নিউমার্কেটে দেখা। রুপা অনিতার ছোট খালা। কলেজে পড়ে। অসম্ভব রূপবতী।
কোনো সৌজন্যতা না দেখিয়েই সে কথা শুরু করে- দুদিন ধরে আসছেন না যে! নেকস্ট উইকে অনিতার একজ্যাম সেটা জানেন?
– জানি
– তাহলে!
– একটা বিশেষ কারণে… কথা শেষ করতে পারে না রঞ্জু। গলার কাছে এসে কথা যেন আটকে যায় তার। নিশ্বাস যেন ফুরিয়ে যায়।
– বিশেষ কারণটা জানতে পারি কি? কৈয়িফত চাওয়ার মতো করে প্রশ্ন করে মেয়েটা।
– আমার রুমমেট চয়ন খুবই অসুস্থ। হাসপাতালে ছিলাম।
– তাই!
– জি।
– বলেননি তো!
রঞ্জু বলেছে। ফোন করে অনিতার মাকে জানিয়েছে দুদিন সে আসতে পারবে না। হাসপাতালে থাকবে। তার বন্ধু খুবই অসুস্থ। রুপা নিশ্চয় জানে না। সে সামনের ব্যস্ত রাস্তার দিকে তাকিয়ে বলে- তাহলে তো আপনিও অসুস্থ হয়ে যাবেন। বাংলাদেশের হাসপাতালের যা অবস্থা।
মেয়েটার কথার ধরন বোঝা যায় না। কটাক্ষ করছে না সিম্প্যাথি দেখাচ্ছে? রুপা অবশ্য জানে রঞ্জু কোনো মারাত্মক কারণ ছাড়া টিউশনি মিস করে না। ঝড়-বৃষ্টি, এমনকি হরতালের মধ্যেও চলে আসে সে।
রঞ্জুকে নিশ্চুপ থাকা দেখে রুপা বলে- কাল তাহলে আসছেন তো!
রঞ্জু এ কথার কোনো উত্তর দেয় না। আগামীকাল সে এমনিতেই যেত। তারপর রুপা আর কোনো কথা না বলে আচমকা সামনের কসমেটিকসের দোকানে ঢুকে পড়ে।

পরের দিন।
কলিংবেল টিপতেই দরজা খুলে দেয় রুপা। বেশিরভাগ দিনই অনিতার মা অথবা বুয়া দরজা খোলে। আজ রুপা।
বাসায় ঢুকে বেশ অনেকক্ষণ ড্রয়িংরুমে বসে থাকে রঞ্জু। যাবার সময় রুপা ফ্যানের সুইচ অন করে গেছে। লো ভলিউমের ফ্যানে সজনে পাতার মতো ঝিরঝিরে বাতাস হচ্ছে।
কিন্তু অনিতা পড়তে আসে না। একটু পর ফলের ট্রে হাতে আসে রুপা।
সরষে ফুলের মতো সিল্কের একটা শাড়ি পরেছে ও। ঐ শাড়িতে শরীরের প্রতিটি বাঁকই দেখা যাচ্ছে। সঙ্গে ম্যাচ করে পরেছে আকাশি কালারের ব্লাউজ। মেদহীন অনাবৃত তলপেট। পদ্মনাভীতে চাঁদের সৌন্দর্য। নগ্ন পা দুটি তেলা আপেলের মতো চকচকে। মসৃণ।
একটু আগেই বোধহয় গোসল করেছে ও। শরীর থেকে তাজা লেবুর গন্ধ আসছে। শ্যাম্পু করা নরম চুলগুলো বুকের ওপর টেনে দেয় রুপা।
কোনো কথা খুঁজে না পেয়ে অসহায় চোখে ঘরের জানালার দিকে তাকিয়ে রঞ্জু জানতে চায়- অনিতা কি বাসায় নেই?
সামনের সোফায় বসতে বসতে রুপা বলে- না, অনিতা বাসায় নেই। ও আপু-দুলাভাইয়ের সঙ্গে এয়ারপোর্ট গিয়েছে। তারপর রঞ্জুর চোখের দিকে তাকিয়ে বলে- বাসায় আমি আর বুয়া। রুপা আবারো থামে। একটা বড় শ্বাস নেয়। তারপর বলে- বুয়া কিচেনে মাংস সিদ্ধ করছে।
ঘরের জানালায় দুলে ওঠে জলপাই রঙের পর্দা। ওর মধ্যে আরো একটা রং। কিন্তু রংটা রঞ্জু চেনে না। রঞ্জু অনেক রংই চেনে না। ছোটবেলায় ঈদের আগের দিন বিকালে মা যখন শাড়ির আঁচল খুলে দুই টাকার জাফরান রং আনতে বলতো তখন বাজার থেকে আসবার সময় মোড়ক খুলে রংটা দেখতো রঞ্জু। শিউলি ফুলের বোঁটার মতো সেই রং। মনের মধ্যে কী যে আনন্দ খেলে যেত তখন! কাল বাড়িতে পোলাও রাধা হবে। বাবা আসবে সিরাজগঞ্জ থেকে। রঞ্জুর জন্য একটা শার্ট নিয়ে আসবে। রঞ্জু হানিফ চাচার ফোনে বাবাকে বলেছিল ওর জন্য এক সেট স্কুল ড্রেস যেন নিয়ে আসে। সময়ে-অসময়ে টিচাররা শুধু বকা দেয়। কিন্তু রঞ্জু জানে না বাবা ওর জন্য স্কুল ড্রেস আনবে কিনা! তবে রঞ্জু নিশ্চিত স্কুল ড্রেস না আনলেও একটা শার্ট নিশ্চয় নিয়ে আসবে বাবা। তারপর ঈদের দিন সেই শার্ট পরে ঈদগা থেকে ফিরে সবাই মিলে মজা করে পোলাও আর সাদা পোল্ট্রির গোস্ত খাবে। ছোট বোন রিনু তখনো ওর মার পেটে।
হঠাৎ রুপার কথায় জানালার পর্দা থেকে চোখ সরায় রঞ্জু। চিন্তা এলোমেলো হয়ে যায়। রুপা বলে- অনিতার এক কাকু মালয়েশিয়া থেকে আসছে। নাম রাশেদ। দুলাভাইয়ের কেমন যেন ভাই হয়।
তারপর রুপা দেয়ালে ঝুলানো সুলতানের আঁকা ‘চরদখল’ ছবির দিকে তাকিয়ে থাকে অনেকক্ষণ। চোখ নামিয়ে বলে- দু-একদিন থাকবে এখানে। তারপর গ্রামে যাবে।
– আপনি তো কালকেও এটা জানতেন!
– জানতাম।
– তাহলে আসতে বললেন যে!
– আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।
– আমার সঙ্গে! ভুরুজোড়া কুঁকড়ে যায় রঞ্জুর।
– হ্যাঁ, আপনার সঙ্গে।
শ্যাম্পু করা মসলিন চুলগুলো ফিনফিনে বাতাসে উড়তে থাকে এলোমেলো চোখে, মুখে, বুকে। ওর নগ্ন পায়ের পাতা থেকে চোখ সরিয়ে রঞ্জু বলে- কী কথা?
কোনো ভনিতা না করেই রুপা বলে- আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই।
– বিয়ে! অনেকটা বিষম খাওয়ার মতো অবস্থা হয় রঞ্জুর।
– হ্যাঁ, বিয়ে। কেননা আমি আপনাকে ভালোবাসি। আবারো থেমে যায় রুপা কয়েক মুহূর্তের জন্য, যেন ভেতরে সাহস পুরে নেয় বেলুনের মতো। তারপর বলে- আমার ধারণা আপনিও আমাকে ভালোবাসেন। শুধু ভালোবাসেন বললে ভুল হবে। গভীরভাবে ভালোবাসেন।
যেন কেউ আঠা দিয়ে রঞ্জুর দুই ঠোঁট এক করে দিয়েছে। নড়াবার শক্তি নেই। মেয়েটা বুঝলো কী করে যে রঞ্জু তাকে ভালোবাসে। মনের কথা সত্যিই তাহলে মেয়েরা বোঝে! রুপা বলে- যে লোকটা আজ বাসায় আসছে তাকে আমি চিনি। এর আগেও দুবার এসেছে। ওর সঙ্গে আবার আমাকে…
আর বলতে পারে না রুপা। চোখের মধ্যে জল ছলছল করে। আচমকা রঞ্জুর দুহাত চেপে ধরে বলে- আপনি আমাকে বাঁচান প্লিজ। ওরা আমাকে জোর করে বিয়ে দিয়ে দেবে।
দুফোঁটা জল দুচোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে গালে। কাঁদতে কাঁদতেই রুপা বলে- আপনি যদি বিয়ে না করেন তাহলে আমি সত্যি সত্যি আত্মহত্যা করব। বিষও জোগাড় করে রেখেছি, দেখবেন? ইঁদুর মারা বিষ। র‌্যাট কিলার। মোড়ের দোকান থেকে কিনেছি।

রঞ্জু মনে মনে ভাবে, সুন্দরী মেয়েদের অনেক যন্ত্রণা! রাশেদ লোকটা ইস্ট্যাবলিসড। মালেশিয়াতে থাকে। গাড়ি-বাড়ি আছে নিশ্চয়! এ রকম একটা ছেলেকে ছেড়ে রুপা রঞ্জুকে বিয়ে করতে চায়। চাল-চুলোহীন রঞ্জু। লোকের বাড়ি বাড়ি টিউশনি করে যার দিন চলে। ভবিষ্যৎ যার অনিশ্চত। বুদ্ধিমতি মেয়েরা এ রকম অনিশ্চত ভবিষ্যতে সহজে পা রাখে না। কিন্তু এ আবার কী মেয়ে!
রঞ্জুর এক বন্ধু মেথিন একটা মেয়েকে ভালোবাসতো। অনেকদিন। প্রায় চার বছর। এলাকার প্রায় সবাই জেনে গিয়েছিল ওদের প্রেমের কথা। কিন্তু তারপরও ওই মেয়েটা এ রকম বিদেশে থাকা একটা ছেলের সঙ্গে হঠাৎ বিয়ে করে ফেলে। কিন্তু এই রুপা! আসলেই একেক মেয়ে একেক রকম। সব মেয়েই বিত্ত ভালোবাসে না।
রুপা আচমকা যেমন কাঁদতে শুরু করেছিল আচমকাই আবার থেমে যায়। তারপর কিছু সময় ঘরের মধ্যে শ্মশানের নীরবতা নেমে আসে। রঞ্জু অসহায় চোখে ঘরের সিলিংয়ের দিকে তাকায়। সবুজ ফ্যানের দিকে তাকায়। শোকেসের রঙিন ফুলের দিকে তাকায়। ভেতরে ভেতরে অস্থির হতে থাকে।
রঞ্জু ধরেই নিয়েছিল বিয়ে ছাড়া কোনো নারীর হাত সে ধরতে পারবে না। যদি ধরতেই হয় অল্প টাকায়… আজ স্বর্গের এক অপ্সরী তাকে ভালোবাসার আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। কী করবে সে এখন?
রঞ্জুর চোখের পানে চোখ রেখে রুপা বলে- বাগানে একদিন আমাকে না দেখলে আপনার কষ্ট হয়, আমি জানি। সেদিন আমাকে না দেখে অনিতাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন তোমার ছোট খালামণি কোথায়। কি করেননি?
– করেছি। কিন্তু…
– না, কোনো কিন্তু নয়। আপনি আমাকে বিয়ে করবেন। আমি শুধু আপনার। শুধু আপনার।
কথাগুলো বলতে বলতেই গা ঘেঁষে আসে রুপা। মায়াভরা দুটি চোখে নীল সমুদ্রের আকর্ষণ। শরীরজুড়ে মোহনীয় মাদকতা। একেবারে মুখোমুখি।
– আপনি আমাকে বাঁচান প্লিজ। মন্ত্র পড়ার মতো করে কথাগুলো বলে সে।
রঞ্জু দুহাত দিয়ে চোখের পানি মুছে দেয়। মুখের ওপর থেকে চুল সরিয়ে দেয় আলতো করে। তারপর আজীবন যা করেনি তাই করে বসে। চুমু খায় রুপাকে। ঠোঁটে, চোখের পাতায়, কপালে। তারপর অদ্ভুত এক ভালোলাগার শিহরণে কাঁপতে থাকে সে।
কেমন যেন অস্থির হয়ে পড়ে রুপা। রঞ্জু পরাজিত হয়ে যায়। তার মনে হয় তেইশ বছরের এই বিবশ অনাবাদি জমিতে রুপা যেন গা জুড়ানো এক পশলা শীতল বৃষ্টি।
ঠিক ঐ মুহূর্তে ঘরে ঢোকে রুপার বোন এবং দুলাভাই। পেছনে রাশেদ, অনিতা। অবস্থা দেখে কিছুই বুঝতে পারে না প্রথমে। তারপরই দুলাভাই বুঝে যায় ঘটনাটা।
রঞ্জু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। মাথার মধ্যে হঠাৎ বিদ্যুতের আলোর মতো ঝিলিক দিয়ে ওঠে। রুপা কি তাহলে দরজা লাগাতে ভুলে গিয়েছিল!
শালিক যেমন গোসলের পর গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে রুপাও সে রকম গা ঝাড়া দেয়। রঞ্জু উঠে বসতেই ঠাস করে একটা চড় গালে এসে পড়ে। সকালের সেভ করা মসৃণ গাল মুহূর্তেই লাল হয়ে যায়। আর সঙ্গে সঙ্গেই কান দুটোর মধ্যে তেমন ভোঁ ভোঁ আওয়াজ শুরু হয়ে যায়।
তারপর লোকটা অনেক কিছু গালি দেয়। কিছুই শুনতে পায় না রঞ্জু। ওর কানের ভোঁ ভোঁ ক্রমেই বাড়তে থাকে।
রঞ্জুর জামার কলার ধরে লোকটা এক ঝটকায় ঘর থেকে বের করে দেয়। ঠিক সেই সময় রাশেদ আর অনিতা সোফায় বসে মোবাইলে গেম খেলতে শুরু করে। যেন এখানে তেমন কিছুই ঘটেনি।
রাস্তায় নামবার পর গাড়ির আওয়াজের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কানের ভোঁ ভোঁ একটু কমে আসে।
ফুটপাথ দিয়ে হাঁটতে থাকে রঞ্জু। টিউশনিটা মিস হয়ে গেলো। অনিতার মা একটা হ্যান্ডসাম স্যালারি দিতো মাসে। সঙ্গে ফল-মিষ্টির ভারী নাস্তা। এর জন্য তাহলে কে দায়ী!
রঞ্জুর চিন্তা থমকে দাঁড়ায় পথের পাশের টং দোকানে এসে।
পাঁচ টাকা দামের একটা সিগারেট কিনে ধরায়। আস্তে আস্তে ধোঁয়া ছাড়ে। কাল সকালেই আবার নতুন একটা টিউশনির খোঁজে বেরুতে হবে। তা না হলে মাস চলবে না। বাড়িতে ছোট বোনের বই কেনা হবে না।
:: চুয়াডাঙ্গা

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়