বিমানের পাইলটদের কর্মবিরতির হুমকি

আগের সংবাদ

ইভ্যালি হাওয়া, বিপাকে গ্রাহক

পরের সংবাদ

শুভ জন্মদিন : প্রেমিক কবি ফারুক মাহমুদ

প্রকাশিত: জুলাই ১৬, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুলাই ১৭, ২০২১ , ৮:২৬ অপরাহ্ণ

সত্তরের প্রথমপাদের কবিদের অন্যতম ফারুক মাহমুদ। বৃহত্তর ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জ জেলার ভৈরবে ফারুক মাহমুদের জন্ম ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের ১৭ জুলাই। তার প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের মধ্যে ‘পাথরের ফুল’, ‘অপূর্ণ তুমি আনন্দ বিষাদে’, ‘অনন্ত বেলা থেকে আছি’, ‘এত কাছে এত দূরে’, ‘সৌন্দর্য হে ভয়ানক’, ‘বাহ্যের বিষণ্ন দিন’, ‘অন্ধকারে মুগ্ধ’, ‘হৃদয়ে প্রেমের দিন’, ‘সামান্য আগুন যথেষ্ট জীবন’, ‘ভ্রæণ পদ্য’, ‘রৌদ্র এবং জলের পিপাসা’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এছাড়া প্রকাশিত হয়েছে তার ‘নির্বাচিত একশ পদ্য’ এবং কিশোর পদ্যের বই ‘ও স্মৃতিমেঘ ও স্মৃতিরৌদ্র’ ইত্যাদি। ফারুক মাহমুদ তার কবিতার প্রকরণে বাঁক নিয়েছেন বারবার; কিন্তু বিষয়-অনুষঙ্গ প্রশ্নে সামান্য বৈচিত্র্যের সমাবেশ ঘটালেও প্রেমের কবিতায় প্রত্যাবর্তন করেছেন ঘুরে-ফিরে। ফারুক মাহমুদের কবিতার সবচেয়ে বড় সম্পদ আবেগ, তার কবিতার প্রতিপক্ষও তেমনি আবেগ পরিহারে অনীহা।
ফারুক মাহমুদ শব্দ নিয়ে খেলতে পছন্দ করেন- ছন্দ নিয়ে খেলতে পছন্দ করেন; পাশাপাশি প্রেমের কবিতার আবহে যেমন জটিল অনুষঙ্গের সমাবেশ ঘটাতে চেষ্টা করেন, তেমনি জটিল অনুষঙ্গের কবিতায়ও প্রেমের ফুল ফোটাতে সচেষ্ট থাকেন। শব্দ-ছন্দ-বিষয়-অনুষঙ্গ নিয়ে তার এই খেলায় কখনো কখনো তার কবিতায় সামান্য আড়াল তৈরি হয়ে যায় বটে কিন্তু তা কিছুতেই দুর্বধ্যতার বিবরে হারিয়ে যায় না। আমরা তার ‘একটি রাতের গল্প’ কবিতাটি উদাহরণ হিসেবে পড়তে পারি।
তার কবিতায় প্রেমের আবহে ভিন্ন প্রসঙ্গ যেমন সন্নিবেশিত হয়, তেমনি তার বিপরীত চিত্রটিও আছে। স্বতঃস্ফূর্ত কবিতার সাথে সচেতন কাব্য-নির্মিতির যে সৌন্দর্য, তার সন্ধান পাওয়া যায় ফারুক মাহমুদের কবিতায়; একই বিষয় নিয়ে সিরিজ কবিতা এবং দীর্ঘ কবিতা লেখার প্রবণতাও লক্ষ করা যায় তার মধ্যে। রচনার সংক্ষিপ্ততার প্রয়োজনে এখানে তার দীর্ঘ কবিতা উদ্ধৃত করার সুযোগ নেই; তথাপি তার দীর্ঘ কবিতার কিছু অংশ নিচে উপস্থাপন করছি। উল্লেখ থাকে এক অর্থে তার দীর্ঘ কবিতাগুলো দীর্ঘ নয় মোটেই, দীর্ঘ কবিতা বেশকিছু ক্ষুদে কবিতার যোগফল মাত্র। এখানে তার ‘ভ্রæণপদ্য’ শিরোনামের কবিতা থেকে বিক্ষিপ্তভাবে দুটি পদ্য উপস্থাপন করছি। আমার বিশ্বাস এ পদ্য দুটি পাঠ করে কবির প্রেম ও কামবিষয়ক আগ্রহ এবং বুৎপত্তি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে-
১.
সকল অনন্ত নিয়ে রচিত সে প্রেমের ভুবন
বিষাক্ত বিদ্যার চেয়ে বেশি সত্য এই ভালোবাসা
কত যে হেঁটেছি পথ, ছায়াচিহ্ন- মরুময়তায়
প্রান্ত নেই, ক্লান্তি নেই, (নতুনত্বে) শুধু ফিরে আসা
৫.
শরীর হয়নি বটে, দেখা হল চুমুর সাহস
‘মরা গাছ’- যুক্তি নেই, কেন নেব মিথ্যে অপবাদ
নোনা ঠোঁট। পলিগন্ধ। থেকে থেকে জোয়ারের জল
আমার কপাল ছুঁয়ে ফুটে ছিল ঘনগূঢ় চাঁদ
(৭০ ভ্রæণপদ্য)
দীর্ঘ কবিতায় এমনকি ফারুক মাহমুদ কাব্যে গল্প লেখার প্রয়াসও চালান। তার ‘রৌদ্র এবং জলের পিপাসা’ কাব্যের ফ্ল্যাপে লেখা হয়েছে- ‘কবিতায় নাটক বা উপন্যাস লেখার ঐতিহ্য রয়েছে বাংলা সাহিত্যে। নিকট অতীত এবং হাল আমলেও এ ধরনের রচনা চোখে পড়ে। তবে কবিতা দিয়ে গল্পের চারিত্র্য নির্মাণের কথা খুব একটা শোনা যায় না। আগাগোড়াই কবিতা, কিন্তু কবিতার প্রাধান্য না থেকে হয়ে উঠেছে গল্প। বিষয়, প্রকাশভঙ্গি, নানা ছন্দের উপস্থিতিতে কবিতার মেজাজ যেমন অক্ষুণ্ন আছে, ঘটনার বিন্যাস, চরিত্রের ঘাতপ্রতিঘাতে গল্পের আবহও রয়েছে অটুট। ফারুক মাহমুদ এ ধরনের রচনাকে বলেছেন ‘কাব্যগল্প’। এই গ্রন্থে সন্নিবেশিত হয়েছে তিনটি কাব্যগল্প।’ ফারুক মাহমুদের কবিতা নিয়ে এই নিরীক্ষা শেষ পর্যন্ত সর্বমহলে গ্রহণীয় হয়ে উঠবে কিনা তার জন্য নিশ্চয়ই আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। তবে তার ‘রৌদ্র এবং জলের পিপাসা’ পাঠকের পিপাসা মিটাতে সক্ষম কিনা তা একজন পাঠকের অবস্থান থেকে বুঝতে চাই। ফারুক মাহমুদের রৌদ্র এবং জলের পিপাসা পড়তে পড়তে বারবার আমাদের লোকসাহিত্যের পথকবিতার কথা মনে পড়েছে। তার ‘রৌদ্র এবং জলের পিপাসা’য় প্রতি পঙ্ক্তির শুরুতে পথকবিতার পুনরুক্তির ব্যবহার পরিহার করা হয়েছে; অন্যথায় আমরা তার কবিতায় পথকবিতার স্বাদ পেতে পারতাম। ফারুক মাহমুদের ‘কাব্যগল্প’ গল্পপ্রবণ বাঙালি কতটা সহজভাবে গ্রহণ করবে সেইটে দেখবার বিষয়। গল্প বয়ানের যত কলা তা কাব্যগল্প ধারণ করতে পারে কিনা সেইটেও বুঝবার আছে। অবশ্য একজন কবিতাকর্মী হিসেবে বন্ধুর সাফল্য নিশ্চয়ই আমরা প্রত্যাশা করতে পারি; প্রার্থনা মঞ্জুর না হলেও ফারুক মাহমুদের যে নিরীক্ষা তা আলোচিত হবে দীর্ঘদিন। কবিতাকে উন্নততর মাত্রায় নিয়ে যাবার সামর্থ ফারুক মাহমুদের আছে, তা আমরা জানি। অনেক কবিতায় ফারুক তার সামর্থ্যরে পরিচয় দিয়েছেন। তার সামর্থ্যরে স্বরূপ সন্ধানে আমরা নিচের কবিতাটি পড়বো-
দোতলা ঘর পাশের বাড়ি/ শব্দ নিয়ে কাড়াকাড়ি/ শব্দ ওড়ে আকাশ চূড়ো/ শব্দ রঙিন ঘুড়ি/ শব্দ ফোটে বাসনকোসন/ ভাঙল কাচের চুড়ি।

মেয়ের কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথ/ জানলায় দেয় উঁকি/ বাবার কণ্ঠে চৈত্রদুপুর-/ ‘কই গেলিরে খুকি!’/ খুকি গেছে চিলেকোঠায়/ মেঘভাঙা রোদ ছাদে/ ঝাপসা পথে কার দু’টি চোখ/ মুখ লুকিয়ে কাঁদে!/ দোতলা ঘর পাশের বাড়ি/ শব্দ দিল আকাশ পাড়ি। (বাবা ও মেয়ের গল্প)
ফারুক মাহমুদ তার কবিতায় নানান অনুষঙ্গের সমাবেশ ঘটাতে সচেষ্ট থাকেন এবং নিজের মেধা ও মনীষা মিশিয়ে পাঠককে অন্য এক ভাবালুতার রাজ্যে পৌঁছে দেন। পাশাপাশি তিনি এমন কবিতাও গ্রন্থনা করেন যা তার সারল্যকে উসকে দেয়।

কবিতার প্রাকরণিক বিভিন্ন প্রসঙ্গ নাম ধরে বর্ণনা করা না হলেও ইতোপূর্বে উদ্ধৃত পঙ্ক্তিমালায় ফারুক মাহমুদের কবিতায় ছন্দ-বুননশৈলী-উপমা-উৎপ্রেক্ষা ইত্যাদি প্রতিভাত হয়েছে আশা করি। ফারুক মাহমুদের কবিতায় শব্দ নিয়ে খেলা করার প্রবণতার কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, যার নমুনা হিসেবে আমরা তার ক’টি কবিতার নামের দিকে দৃষ্টি দিতে পারি- ‘মনোমেঘছায়াকাদাজলে’ অথবা অন্যত্র তার ‘মূর্খকর্মগীতি’, ‘কলহক্রন্দনক্রোধ’, ‘আনন্দঘনবেদনাময়’ এমন অসংখ্য শব্দবন্ধ তৈরির প্রবণতা লক্ষ করা যায়; কিন্তু এমন সব শব্দবন্ধও তার কবিতার গীতলতায় চ্ছেদ ঘটাতে পারে না।
চমৎকার কুশলতায় ফারুক মাহমুদ আমাদের জীবন, গ্রামীণজীবনের বনেদি আবহ, পাশাপাশি বাঙালির জীবনসংগ্রামের সাথে মিশে থাকা মুক্তিযুদ্ধের গভীর ক্ষতের কথা স্মরণ করেন। অসংখ্য অনুষঙ্গের কবিতা লিখেছেন ফারুক মাহমুদ, কিন্তু ঘুরে ফিরে বারবার কড়া নেড়েছেন প্রেয়সীর দুয়ারে, নানা কায়দায় বাখান করেছেন নিজদয়িতার- নিজেকে সমর্পণ করে-
তোমার অবজ্ঞা নিয়ে যতটুকু থাকা যায়-
আছি, থেকে যেতে চাই কষ্টবিন্দু মানুষের ভিড়ে
(টান)
যখন তিনি উচ্চারণ করেন, ‘কবিতার পাপ ছাড়া অন্য কোনো পুণ্য জমা নেই’। তখন বুঝতে পারি কবিতার সাথে গৃহস্থালি তার- কবিতায়ই সহবাস, কবিতায় সন্তরণ তার কবিতায় নিয়ত ভ্রমণ। ৭০তম জন্মদিনে বন্ধু ফারুক মাহমুদকে অনাবিল শুভেচ্ছা।
ফরিদ আহমদ দুলাল : কবি ও প্রাবন্ধিক; সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়